চিরবন্ধু পর্ব-০৩

0
74

#চিরবন্ধু
#পর্ব_৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

সরাসরি রাগের বহিঃপ্রকাশ যেখানে অপ্রীতিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক সেখানে মুখের উপর কিছু না বললেও বুদ্ধিমতী তাসনিয়া সেটা বুঝতে পারলো। ডাক্তার বলেছে তাই সে পানি ঘাঁটতে পারবেনা বললেই সে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারছেনা। রান্নাবান্নার সমস্ত দায়িত্ব গোফরান নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে যাতে তাসনিয়ার পানি না ঘাঁটতে হয় কারণ শীতল পানিতে হাতটা বেশিক্ষণ ডুবানো থাকলে ক্ষত জীবনেও শুকোবে না।
রান্নাবান্না ছাড়াও কাপড়চোপড় ধোঁয়া থেকে শুরু করে ঘরমোছার কাজ সব পড়ে আছে তা দেখতে ভালো লাগছিলো না তাসনিয়ার। তাই সে বাঁহাতের সাহায্যে কাপড়চোপড়গুলি ধুয়ে দিল যদিও ডানহাতটাকেও অল্পস্বল্প কাজে লাগিয়েছে সে। কাপড়গুলি শুকোতে দেয়ার সময় দেখে ফেলেছিলেন গোফরান সিদ্দিকী। তারপর থেকে উনার গুমোট চেহারাটা লক্ষ করছিলো সে। যেন হাজারটা কথা শুনিয়ে দেয়ার জন্য তিনি উশখুশ করে বেড়াচ্ছেন।
তাসনিয়া পালিয়ে বেড়াচ্ছিলো। কথা শুনতে তার ভালো লাগে না। যদি এই জাঁদরেল মিলিটারির খোঁচা মারা কথা হয় তাহলে তো একদমই না। রান্না করছেন ভালো কথা কিন্তু তার কাপড়চোপড় তো ধুয়ে দেবেন না তাহলে অতকথা সে শুনবে কেন? ইচ্ছে করলে রান্নাবান্নাও সে করতে পারবে শুধু শুধু এত যত্নআত্তিরের নাম দিয়ে গমগম করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। জীবনে কতশত আঘাত পেয়ে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। এসব সামান্য পোড়া ক্ষতে কিছুই যায় আসে না তার। কিন্তু এসব কথা বলে উনার সাথে তর্কে জড়াবে কে?

বেরোনোর আগে বলে গেলেন, আমি আসার সময় মাছ নিয়ে আসবো। রাতে ঠিক ইয়াব্বড় সাইজের একটা কাতলামাছ নিয়ে ফিরলেন। মাছটা লাফাচ্ছিলো। ইউনিফর্ম ছেড়ে এসে সেটি একাএকা কাটাকুটি করে, পরিষ্কারও করলেন। তারপর গোসল করে এলেন। তাসনিয়াকে ঘুরঘুর করতে দেখে সোজাসাপটা বলে দিলেন,
– আপনার সাহায্য দরকার নেই। তাই ঘুরঘুর করেও লাভ নেই।
তাসনিয়া কাঠকাঠ গলায় বলল,
– আমি পরিমিত ডিস্টেন্স মেইনটেইন করে ঘুরঘুর করছি।
গোফরান ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো একপলক। কিছু বলার রইলো না তার। সেদিন বার্নাল ক্রিম লাগানোর সময় ঠিক একই কথাটা বলেছিলো সে।
– পরিমিত ডিস্টেন্স মেইনটেইন করে বসুন।
কথাটা মনে পড়তেই মাছগুলো ধুয়ে আরেকটা বাটিতে নিতে নিতে গোফরান বিড়বিড়িয়ে বলল,
– মিনিংলেস কথাবার্তা।
– কিছু বললেন?
– না। আপনি বেবিদের কাছে যান।
তাসনিয়া ততক্ষণে বেরিয়ে গিয়েছিলো। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তার।
গোফরান মরিচ হলুদ ধনে গুড়ার কৌটো খুঁজে নিয়ে একটা ছোট্ট বাটিতে নিয়ে মাছের মসলা মাখছিলো। তাসনিয়া রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল। আচমকা হাওয়ার বেগে ছুটে এসে মরিচের কৌটো কেড়ে নিয়ে বলল
– মরিচগুলো খুব ঝাল। বাচ্চারা খেতে পারবে না। একটু কমিয়ে দিন।
গোফরান নিজেই চমকে গেল তাসনিয়ার এমন কাজে। তাসনিয়া নিজেও নিজের কাজে লজ্জিত হলো। এভাবে কেড়ে নেয়াটা ঠিক হয়নি।
– এখানকার মরিচগুলো খুব ঝাল।
তার কথা শুনে গলা কিঞ্চিৎ কাত করে হতাশ চোখে তাকালো গোফরান। ইনি কি সারাক্ষণ তাকে ভুল প্রমাণ করার মাঠে নামতে চায়?
তাসনিয়া তার দিকে তাকিয়ে ধীরেধীরে মরিচের কৌটোটা সরিয়ে ফেললো। বলল,
– হয়ত ওভাবে মিলিটারিরা খায় কিন্তু আমরা সাধারণ জনগণ ওভাবে খেতে অভ্যস্ত নই।
গোফরান বলল,
– মিলিটারিরা খায় মানে?
– হ্যা।
গোফরান মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গজগজ করতে করতে বলল,
– আপনাদের মতো মানুষরা মিলিটারিদের কখনো রেসপেক্ট করতে শেখেনি। সবকটা উগ্রপন্থীর দল।
তাসনিয়া বলল,
– আপনি সেই উগ্রপন্থীকেই ধরে আনলেন।
– আমি এনেছি?
– আনেননি? আমি নিজে নিজে চলে এসেছি বলছেন?
– আমি ধরে আনিনি, আপনিও নিজে নিজে চলে আসেননি। আমাদের আসতে হয়েছে। মরিচের কৌটোটা দিন। মরিচ কম হয়েছে।
তাসনিয়া দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
– অসম্ভব। বুঝতে পারছেন না। মাছটা একদমই খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যাবে। এখানকার মরিচ খুব ঝাল।
গোফরান এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে কৌটো নিয়ে ফেললো। তারপর সরু চোখে চেয়ে বলল,
– মিলিটারিরা কিভাবে খায় তা আপনার উপর এক্সপেরিমেন্ট না করে আমি শান্ত হচ্ছিনা। লেট মি ডু ইট।

সেদিনের রান্নাটা সত্যিই ঝাল হয়েছে। মিনি আর সে হাহু করতে করতে সরে পড়েছিল দ্রুত। ফ্রিজে কেক মিষ্টি রাখা ছিলো। দুজনেই যতটুকু পারলো কেক আর মিষ্টি খেয়ে ঝাল কমানোর চেষ্টা করলো।
গোফরান চুপচাপ খাচ্ছিল আর মাঝেমধ্যে জুবরানকে দেখছিল। তার ঝাল লাগছিলো না দেখে মৃদুমৃদু হাসছিল সে। তাসনিয়া এসে জুবরানকে জিজ্ঞেস বলল,
– খোকন ঝাল লাগছে?
জুবরান দুপাশে মাথা নেড়ে সুপারম্যানকে জিতিয়ে দিল। বিজয়ের হাসির এক টুকরো তখন লেগেছিল কর্নেলের মুখে। হাসিটা ঝুলিয়ে রাখার উদ্দেশ্য তাসনিয়াকে হেনস্তা করা বৈকি অন্য কিছু নয়। মিনি বলল,
– বাবা ইউ পঁচা। ভেরি ভেরি পঁচা।
আমার ঠোঁট পুড়ে গিয়েছে। খুব ঝাল। উফ।
গোফরান তাসনিয়াকে শুনিয়ে বলল,
– জুবরানের মায়ের কাছে বার্নাল ক্রিম আছে।
মিনি কান্নার সুর তুলে বাবার গায়ে নখের আঁচড় কেটে বলল,
– না না জুবরানের মা নয়। আমার মা। বলো মিনির মা।
গোফরান বলল,
– হুমম। মিনির মা।

ফিজার পরীক্ষা চলছে। তাসনিয়া তাই জানতো। কিন্তু এমন ভরদুপুরে বোঁচকাবুচকি নিয়ে সে এই পাহাড়ে হাজির হবে সে তা কখনো ভাবেনি। তাকে দেখে অবাক হওয়ার ভান ধরলেও মনে মনে সে এটা টের পেয়েছিলো যে রান্নাঘরে তাকে সাহায্য করার জন্য ফিজাকে নিয়ে আসতেন উনি। কিন্তু মেয়েটাকে একা একা চলে আসতে বললেন এতদূরে? ফিজা বলল, ভাইয়া পারছিলো না বলতে, পরীক্ষা না দিয়ে চলে আয়। এতবার ফোন দিচ্ছিলো। তাই পরীক্ষা শেষ হওয়ামাত্র চলে এসেছি। হাত কিভাবে পুড়ল? দেখি।
হাতটা দেখামাত্রই তার কপাল কুঁচকে এল। ইশশ রে এতখানি পুড়লো। তুমি কি একটু সাবধানে থাকতে পারো না? সোনামণিরা কোথায়?
– ওরা ব্যাকইয়ার্ডে খেলছে।
ফিজা তাদের কাছে ছুটে গেল। উফ তাদের ছাড়া বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। পেছন থেকে সে জড়িয়ে ধরলো মিনিকে। মিনি আঁতকে উঠলো । ফিজা তাকে কোলে তুলে গালে চুমু দিতে দিতে বলল,
– আমার মা কেমন আছে?
মিনি হাসতে লাগলো।
– জুবরান সোনা কেমন আছে? কি করছেন আপনি?
জুবরান ফোকলা হাসলো। তার হাতের রুবিক্স কিউবটা দেখালো। ফিজা বলল,
– ভাইয়া এই ছোট বাচ্চাকেও এটা ধরিয়ে দিয়েছে। মাথা নষ্ট করার যন্ত্র।
তাসনিয়া পেছন থেকে বলল,
– এতদূর থেকে এলেন। কি খাবেন ম্যাডাম?
ফিজা মিনিকে কোল থেকে নামিয়ে জুবরানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– তোমরা কি খেয়েছ?
– ওরা খেয়েছে। তুমি কি খাবে বলো?
– গরম গরম এক কাপ চা আর নোনতা বিস্কিট। বিস্কিট আমি এনেছি। ভাইয়ার নাকি মাছ-মাংসে বিরক্তি চলে এসেছে, তাই বড় ভাবি শুঁটকি দিল। আর কয়েকটা নুডলস, পাস্তা আর হালিমের প্যাকেট এনেছি, ফুচকাও এনেছি। আজ কিংবা কাল বিকেলে ফুচকা বানাবো। মিনির ফুচকা খুব পছন্দ। তাই না মিনি?
মিনি দু’হাত উপরে তুলে বলল,
– ইয়েইয়ে ফুচকা খাবো। জুবরান তুমি ফুচকা খাবে? খুব মজা।
জুবরান কিউবে মজে আছে। সুপারম্যান তাকে সলভ করতে বলেছে। না পারলে সে লুজার হয়ে যাবে। মিনি তার দুগাল টেনে দিয়ে বলল,
– জুবরান জুবরান লিচেন টু মি।
জুবরান ভীষণ বিরক্ত হয়ে তার হাত ঠেলে দিয়ে বলল,
– উফফ সরো।
মিনির মুখটা কালো হয়ে এল। তাসনিয়া এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
– এসব কেমন ব্যবহার খোকন? সরি বলো।
জুবরান মিনির কান্নামুখর চেহারাটার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বিরক্ত হয়ে বলল,
– না বলব না। ওর বাবা বলেছে বিরক্ত করলে ওর সাথে আঁড়ি দিতে। তোর সাথে আঁড়ি।
মিনি তাসনিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো।
ফিজা অবাক গলায় বলল,
– ওর বাবা?
বলেই তাসনিয়ার দিকে তাকালো।
তাসনিয়া কোনো জবাব না দিয়ে মিনিকে নিয়ে চলে গেল। ফিজা জুবরানের সামনে বসে বলল,
– এই পঁচা ছেলে মিনির বাবা তোমার বাবা নয়?
জুবরান চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। তারপর দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
– না।
– কেন?
– মা মিনিকে বলেছে মা ডাকতে। মিনির বাবা আমাকে বলেনি বাবা ডাকতে।
– মিনির বাবা তোমাকে ভালোবাসে না?
জুবরান তাকিয়ে রইলো কিন্তু কিছু বললো না।
ফিজা জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি ভালোবাসো না?
জুবরান মৃদু হাসলো। সে হাসিতে কি ছিলো ফিজা নিজেও টের পেল না। মনটা তার খারাপ হয়ে গেল। সে আর বাড়ির সবাই ভাবে ভাইয়া আর ভাবির মধ্যেকার দূরত্ব থাকলেও বাচ্চাগুলোর সাথে তাদের কোনো দূরত্ব নেই। কিন্তু এখানে না এলে তা জানাই হতো না ওর। ভাইয়া কেমন যেন! বাচ্চাটার সাথে কেন এত দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে? সে কতটুকুই বা বুঝে? এমন একটা বাচ্চার সাথে দূরত্ব বজায় রাখা আদৌ সম্ভব?

রাতে গোফরান বাড়ি ফিরে গোসল সেড়ে বারান্দায় বসতেই মিনি তার কাছে অভিযোগের খাতা খুলে বসলো। জুবরান কি কি বলেছে তাকে সবটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বাবাকে বুঝিয়ে দিল সে। জুবরান কিউব হাতে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুটা দূরে। গোফরান তাকে ডেকে বলল,
– সলভ করেছ?
জুবরান গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এল। কিউবটা বাড়িয়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ফিজা চায়ের ট্রে এনে সামনে রাখলো। চোখের ইশারায় তাকে বসতে বললো গোফরান। ফিজা চেয়ারে গিয়ে বসলো। তাসনিয়াকে ডেকে বলল,
– ছোট ভাবি চা খেতে এসো।
তাসনিয়ার জবাব এল,
– আসছি।
কিউবটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার পর গোফরান দেখলো প্রায় সলভ করে ফেলেছে জুবরান।
ফিজা বলল,
– ও সারাক্ষণ ওটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার পর কিউবটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– মার্ভেলেস।
তা শুনে জুবরান চোখ তুলে তাকালো তার চোখ বরাবর। কম্পিত হাত বাড়িয়ে কিউবটা নিতে নিতে চোখেচোখে কি কথা হলো দুজনার ? জুবরান হেসে উঠে কিউবটা নিয়ে একদৌড় দিল।

মিনি নাক টানতে টানতে বললো, বাবা জুবরান খুব খুব দুষ্টু। গোফরান তার মুখের দিকে চেয়ে বলল,
– আপনাকেও কিউব সলভ করতে হবে। নইলে রতন আর বদি কাকার মতো কান ধরে ওঠবস।
মিনি তৎক্ষনাৎ কোল থেকে নেমে পড়লো। রেগেমেগে বলল,
– তুমিও দুষ্টু। শুধু মা ভালো। খুব ভালো। তুমি পঁচা বাবা। নটি বয়। ব্যাড বয়।
বলেই দৌড়ে চলে গেল। গোফরান তার প্রস্থানপথ হতে চোখ সরিয়ে ফিজাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কবে পৌঁছেছিস?
– দুটো নাগাদ।
– তুমি খাও। আমি ছোট ভাবি কোথায় দেখি। চা ঠান্ডা হতে চললো।
ফিজা চলে গেল।

তাসনিয়া ঘরটা গোছগাছ করছিলো। আজ সারাদিন তেমন রোদের দেখা পায়নি বলে কাপড়চোপড় কিছু শুকোয়নি। মিনিরগুলো শুকোলেও জুবরান শার্ট-প্যান্টগুলো একদম শুকোয়নি। সেগুলো ঝুড়িতে রেখে শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করে ওয়ারড্রবে রাখার সময় জুবরান কোথা থেকে ছুটে এসে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। তাসনিয়া অবাক হলো। তাকে কোলে তুলে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই শক্ত করে তাকে জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে রাখলো জুবরান। তাসনিয়া টের পেল তার ছোট্ট শরীরটা অল্পস্বল্প কাঁপছে। বুকের ভেতরটাও কাঁপছে।
– কি হয়েছে? তোমার সুপারম্যান কিছু বলেছে?
জুবরান কিছু বললো না। তাসনিয়া ফের জানতে চাইলো,
– কাঁদছো তুমি?
জুবরান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তাসনিয়ার কাঁধটা প্রায় ভিজে উঠলো তার চোখের জলে।

_____________

বেতের চেয়ারে বসে খবরের পাতাটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলো তাসনিয়া। খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাসটা সে বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। ছোটবেলায় তার পছন্দের বিষয় ছিল বিনোদন। তখন সেই বিনোদনের পাতাটা সে উল্টেপাল্টে অনেকবার পড়তো। এখন পছন্দের বদল ঘটেছে। রাজনৈতিক বিষয়ও পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু আজকাল খবরের পাতা হাতে নিতে ইচ্ছে করেনা বড়সড় শিরোনামগুলো পড়ার ভয়ে। কি ভয়ংকর হয়ে উঠছে দেশটা। চারপাশে শুধু দূর্ঘটনা, আগুন, পোড়া লাশ, ভূল চিকিৎসা, মরদেহ, অপহরণ, খুনোখুনি, নিখোঁজ বার্তা, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, আর্তনাদ। পৃথিবী যেন ধ্বংস লীলার যাঁতাকলে। তারপরের একটা খবরের পাতায় উল্টোতেই দেখলো মীরবাজারে গোপন কুঠুরি হতে উদ্ধার দুটো লাশ। খুনী পলাতক।
তাসনিয়া মনোযোগ দিয়ে লেখাগুলো পড়ছিলো হঠাৎই দেখতে পেল একটা বাইক ঠেলেঠেলে আসছে একটা যুবক। মাথায় এখনো হেলমেট পড়া। পিঠে ট্রাভেল ব্যাগ। বুকের একপাশে কালো ঝকঝকে একটা গিটার। তাসনিয়াকে দেখামাত্রই বাইকটা সেখানে থামালো। তাসনিয়া নীচে চলে এল। দরজা খুলতেই দেখলো, ছেলেটা হেলমেট খুলে দাঁড়িয়েছে। সালাম দিতেই তাসনিয়া সালাম নিয়ে বলল,
– কোথায় যেন দেখেছি!
– ফোনে।
– হ্যা হ্যা। আরিব?
ছেলেটা আবারও হাসলো। তাসনিয়া হেসে বলল,
– আমাদের জামাই। ফিজা তো বলেনি তুমি আসবে।
– ফিজা জানেনা। গোফরান ভাইয়া এমনভাব ফোন দিচ্ছে আসার জন্য। আমি বিয়ে, আকিকা কোনোটাই আসতে পারিনি । এবার না এলে আমার মুন্ডুপাত করতো। তাই চলে এসেছি।
বলেই নীচে ব্যাগ গিটার রেখে দিয়ে বলল,
– ফিজা কোথায়?
তাসনিয়া ফিজাকে আবারও ডাকলো। ফিজা এসে বলল,
– কে এল ছোট ভাবী?
– চিনিনা। বলছে ফিজাকে চায়।
আরিব মজা করার জন্য হেলমেটটা পড়ে নিয়েছিলো। ফিজা দেখামাত্রই কপাল কুঁচকালো। চোখগুলো দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– তুই?
আরিব হেলমেট খুলে হেসে বলল,
– সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম?
ফিজা ছুটে গিয়ে ঝাপটে ধরলো তাকে। তাকে শূন্যে তুলে কয়েকপাক ঘুরিয়ে নিল আরিব। ফিজা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
– আই মিসড ইউ।
– ঠু।
ফিজা তার গালের দুপাশে হাত রেখে হাসলো। আবারও জড়িয়ে ধরে গালে আরক্ত চুমু খেয়ে বলল,
– আমি খুব খুব খুশি হয়েছি।
তারপর তাসনিয়ার কথা মনে পড়ায় বলে উঠলো, এই রে ছোট ভাবি।
তাসনিয়া হেসে ততক্ষণে চলে গিয়েছে।
– দেখেনি তো? আমার মাথায় ছিল না রে।
আরিব হো হো করে হেসে উঠে দু’পাশে মাথা নাড়লো।
– দেখেনি।
ফিজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আরিব ততক্ষণে তাকে কাছে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে গালে ঠেঁসে চুমু খেয়ে বলল,
– গোফরান ভাইকে একটা থ্যাংকস দিয়ে দিবি।
ফিজা গালে হাত চেপে ধরে বলল,
– ভাইয়া তোকে আসতে বলেছে? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
আরিব তার নাক টেনে ধরে বলল,
– আমিও স্বপ্ন দেখে চলে এসেছি।
ফিজা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– আমি সত্যিই তোকে অনেক মিস করেছি। অনেকক।
আরিব তার মুখের উপর ফুঁ দিতেই ফিজার কপালের চুলগুলো উড়ে গেল। হেসে উঠলো ফিজা। বলল,
– আমার বরটা কেমন শুকিয়ে গেছে ইশশ।

মিনি আর জুবরান এল তখন। মিনি বলল,
– হাই আঙ্কেল।
আরিব তাকাতেই মিনি দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো। আরিব হেসে বলল,
– আরেহ আমার ছোট শ্বাশুড়ি যে। আসুন আসুন।
মিনি ছুটে এল। আরিব তাকে কোলে তুলে আদর করে বলল,
– চকলেট এনেছি।
– দাও। দুটো এনেছ? জুবরানকেও দিতে হবে।
আরিব জুবরানের দিকে তাকালো। দুজনেই হাসলো। আরিব বলল,
– হ্যালো।
জুবরান দৌড়ে এল। গিটারটা ছুঁয়ে বলল,
– আমার বাবারও এমন একটা ছিল।
তার এখনো মনে আছে বাবা যখন গিটার বাজাতো মা তখন খুব হাসতো। মাকে ওরকম হাসতে দেখেনা কতদিন।

আসার সময় আরিব অনেককিছু এনেছে। ফিজা সব গুছিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে।
সন্ধ্যায় তাদের ফুচকাপার্টির আয়োজন করা হলো। অনেকগুলো ফুচকা তেলে ভেজে নিয়েছে তাসনিয়া। ফিজা পুর আর টক বানিয়েছে। তাসনিয়া জানতে চাইলো, আরিব তো এসব খাবে না তাহলে?
ফিজা বলল, ও খায় না কিন্তু আমি জোর করে খাইয়ে দিলে খাবে। আমি কলেজে থাকতেও এরকম করতাম।
– খুব ভালোবাসা দুজনের!
ফিজা লাজুক হাসলো। বলল,
– ও আমার বর কম বন্ধু বেশি। ওর মতো আমাকে কেউ বোঝেনা, আমার মতো ওকে কেউ বোঝেনা।
তাসনিয়ার মনে হলো তাই হওয়া উচিত। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে বন্ধুত্বটা না থাকলে সম্পর্কে একঘেয়েমি চলে আসে। শুধু দায়িত্ব আর কর্তব্যের মধ্যে নিহিত থাকা সম্পর্কগুলোতে কোনো আনন্দ নেই, তৃপ্তি নেই, শান্তি নেই, সন্তুষ্টি নেই।
এই যে বরকে পেয়ে ফিজার সন্ধ্যাবেলাটা প্রায় জমে উঠলো। তাদের দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিতে মেতে উঠলো নির্জন বাড়িটি। আনন্দের ঝড় উঠলো গিটারের সুরের মূর্ছনায়, বাচ্চাদের হাসিখুশিতে, কপোত-কপোতীর ঢিমেতালে নাচেগানে! এই প্রতিটা মুহূর্ত সুন্দর! মনে রাখার মতো। মনে গেঁথে থাকার মতো। যেমন তার আছে।
অথচ সেসব এখন ঘুণেপোকাদের দলে। একটু একটু স্মৃতির পাতা থেকে খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। জীবন যেমন হাসতে শেখায় তেমন কাঁদতেও শেখায়। গড়তে শেখালে ভাঙতেও শেখায়। স্মৃতি মনে রাখতে শেখায় আবার মুছে ফেলতেও শেখায়। ভাঙা-গড়ার কি অদ্ভুত একটা নিয়ম!
খুনসুটি থামিয়ে জুবরান অপলকভাবে তাকিয়ে দেখলো, তার মা আর বাবার সেই দৃশ্যটি। যেখানে ফুপীর জায়গায় মা ছিলো, আঙ্কেলের জায়গায় তার বাবা। কিছুদিন পর কি ফুপী আর আঙ্কেলও আলাদা হয়ে যাবে মা বাবার মতো?
তাসনিয়া দরজার পাশে ইউনিফর্ম পরিহিত ছায়াটি দেখামাত্র চমকে উঠলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
– আপনি? এত তাড়াতাড়ি!
গোফরান তাকে চুপ থাকতে বলে আরিব আর ফিজার দিকে চেয়ে রইলো। দুজনেই নেচে-গেয়ে হো হো করে হাসছিলো। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়ায় মিনি বাবা বলে ডেকে উঠায় ফিজা আর আরিব থেমে গেল। আরিব গিটার ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে, মাথার চুল ঠিকঠাক করে ফিজার পেছনে দাঁড়িয়ে তাসনিয়াকে বলল,
– ছোট ভাবি বাঁচান।
তাসনিয়া হাসলো তার কান্ড দেখে। ফিজা বলল,
– ভাইয়া তুমি কবে এসেছ?
– অনেকক্ষণ। আরিব কবে পৌঁছেছ?
আরিব উশখুশ করতে করতে সামনে এসে দাঁড়ালো।
– এই তো তিনটের দিকে।
– পৌঁছে আমাকে ফোন দিতে বলেছিলাম।
– সরি ভাইয়া। মনে ছিল না।
– এটা ভালো অভ্যাস।
আরিব কান চুলকে বলল,
– আসলে..
ফিজা বলল
– ভাইয়া তুমি ইউনিফর্ম পাল্টাও। ভাবি আরিব আসায় অনেককিছু করেছে। ফুচকা, পায়েস, দই, হালিম, চিংড়ি দিয়ে নুডলস। কোনটা খাবে?
গোফরান কপাল কুঁচকালো। তাসনিয়া বলে উঠলো,
– মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। আমার কিছু করার সাধ্য নেই। ওই সব করেছে।
– গুড। আরিব আমার ঘরে এসো। কথা আছে।
আরিব তার পিছুপিছু যাওয়ার সময় ফিজার মাথায় চড় মেরে গেল। ফিজা বলল,
– দেখেছ ভাবি?
তাসনিয়া বলল,
– মারবে না? কত লজ্জা পেয়েছে বেচারা।

বাড়িতে তাদের ঘরে পাশাপাশি দুটো বিছানা ছিলো। কেন ছিলো তার রহস্য তাসনিয়া জানেনা। তাই একটাতে সে বাচ্চাদের নিয়ে শুলে পাশেরটাতে গোফরান শুতো। এখন এই বাড়িতে আসার পর তার জায়গা হয়েছে মেঝেতে। আগে মিনিকে বুকে নিয়ে ঘুমালে তার চোখে তাড়াতাড়ি ঘুম নেমে আসতো এখন সেটা হওয়ার অবকাশ নেই। মিনি এখন মা পেয়েছে।
দু’দিন আগে জুবরান নিজে থেকে খাট থেকে নেমে এল। বলল,
– আমি এখানে ঘুমাই?
সে সম্মতি দিতেই কি খুশি হলো ছেলেটা। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে তাসনিয়া দেখে সে পা দুটো একেবারে তার সুপারম্যানের গায়ে তুলে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। মেঝের তোশকের উপর দুটো বাচ্চা শিশুর মতো ঘুমন্ত মুখ কি নির্ভেজাল ভালবাসায় মুড়িয়ে ঘুমায় দেখেই তাসনিয়ার শান্তি লাগে। আর মিনির তো বুকে গুঁজে ঘুমানোর অভ্যাস। উম না পেলে তার ঘুমই আসে না।

ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে আবারও। একচোট ঘুম শেষে হঠাৎই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো চোখের সামনে কয়েকটা ছায়ামূর্তি দেখে। গোলাকার একটা কেকের উপর দু-তিনটে মোমবাতি জ্বালিয়ে হ্যাপী বার্থডে টু ইউ” সুরটা একনাগাড়ে বারংবার কানে আসতেই চোখ পড়লো দেয়ালে। ১২ টা। আজ কি জানুয়ারির সাত তারিখ?
ফিজা আরিব মিনি জুবরান সবাইকে দেখতে পেল সে। হাঁ করে সবার দিকে তাকিয়েছিলো। আরিব কেকটা মিনি সাইড টেবিলে রেখে তাসনিয়ার সামনে এনে রাখলো। বলল,
– এবার কেক কাটুন।
তাসনিয়া ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটলো কেমন একটা ঘোরে। এগুলো কি হচ্ছে? তার জন্মদিনের কথা তার নিজেরও খেয়াল নেই। ফিজার কি করে মনে থাকলো? সবাইকে কেক খাওয়ালো সে। জুবরান কেক খেয়ে মায়ের দুগালে আদর করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মা ছেলে দুজনেই আচমকা কেঁদে উঠলো। ফিজা জুবরানকে ছাড়িয়ে নিয়ে মাথায় ঘনঘন হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
– এখন তো খুশির সময় বাবা। এখন মাকে হাসাবে তা না করে তুমি কাঁদাচ্ছ?
জুবরান তার কাঁধে মাথা ফেলে কান্না গিলে ফেললো। কেক কেটে সবাইকে খাইয়ে তাসনিয়া মেঝের দিকে তাকালো। গোফরান
ঘুমোচ্ছে এখনো। এত হৈচৈ হচ্ছে আর উনি ঘুমোচ্ছেন? এ কেমন ঘুম?
তাকে তাকাতে দেখে ফিজা বলল,
– আমরা যাই। কাল সকালে সবটা বলব তোমাকে। এই কেকটা ভাইয়া সকালে খাবে। টা টা। গুডনাইট ভাবি।
আরিবকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে।

দুদিন দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে যাবে তা বলে রাখা ছিলো। তাসনিয়া খাবার ভরে বক্সটা গোফরানের সামনে শব্দ করে রাখলো।
গোফরান বক্সটা নিয়ে বলল,
– মিনির বোধহয় জ্বর এসেছে। আমি এখানকার ডাক্তারকে ফোন করেছি। উনি আসছেন। আপনার হাতটাও দেখিয়ে নেবেন।
– হুম।
সে বেরোতে যাচ্ছিলো। আবার থামলো কি মনে করে। পিছু ফিরতেই তাসনিয়ার চোখাচোখি হলো। বলল,
– কালকের জন্য সরি। আসলে ওসব আমার দ্বারা হয় না। আমি কখনো সুন্দর করে উইশ করতে পারিনা। তবে এটুকু বলব, আপনার আগামী জন্মদিনগুলো মিনি আর জুবরানকে নিয়ে আনন্দের সাথে কাটুক। আর প্রতি জন্মদিনের সকালবেলায় আপনার গালটা এভাবেই ফুলে থাকুক।
তাসনিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি প্রস্থান নিলেন। তাসনিয়া অবাক হলো এই ভেবে, তাকে রাগিয়ে দেয়ার ফাঁকে কি অদ্ভুতভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে নিজের অস্তিত্বটাকেও বাঁচিয়ে রাখার নিবেদন পেশ করে গেলেন উনি।
জিপ গাড়িটার ইঞ্জিন শব্দ করে উঠার পর ফিজার মুখ থেকে সে শুনতে পেল কেকটা আরিবকে দিয়ে উনি নিজেই আনিয়েছেন।
একথা শুনে খুশি নয় বরঞ্চ অপমানিত বোধ করলো সে। একটা কেক, দুটো মোমবাতি, দুটো কথা দিয়ে তাকে খুশি করার চেষ্টা না করলেও সে মিনির দেখভাল করতো।

চলমান….