চোখের দেখাই সব নয় পর্ব-০৪

0
171

#গল্প_চোখের_দেখাই_সব_নয়
#চতুর্থ_পর্ব

আমি যখন মারুফের জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছি, তখনই হঠাৎ সেই মহিলার দেওয়া চিঠির কথা মনে পড়ে গেল।

তৎক্ষনাৎ সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর মূহুর্তের মধ্যে আমার হৃদয় কঠিন রুপ ধারণ করলো। আরে! আমি তো মারুফের বাড়ি ছেড়ে যাওয়া নিয়ে ভাবছি। এতোক্ষণ মনের মধ্যে ছিলো মারুফ আমার বিরহের জ্বালা সইতে না পেরে কোথাও চলে গেছে! কিন্তু সে যে অন্য কোন কারনেও গৃহত্যাগী হতে পারে? আশ্চর্যের কথা সেটা আমার মনে

একবারও উদয় হয়নি!

কি বোকা মেয়ে আমি! আমি এতোক্ষণ কিভাবে ভাবছিলাম মারুফ আমার বিরহে অভিমানী হয়ে কোথাও চলে গেছে? কিন্তু এখন আমার কাছে আসল ঘটনা জলের মতো পরিষ্কার মনে হলো।

সে তো আমার বিরহে কোথাও চলে যায়নি। আমি ছাড়াও তো তার জীবনে আরও একজন প্রিয়জন আছে! সে হয়তো সেই চিঠির জবাব খুঁজতে বাড়ি ছাড়া হয়েছে। নিশ্চয়ই সেই চিঠিতে কোন ঠিকানা ছিলো। হয়তো সেই ঠিকানায় গেছে ঐ মহিলার সাথে দেখা করতে?

সত্যি বলতে নিজের অজান্তেই মারুফের প্রতি ভালোবাসা আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো। তাই ওর ব্যাপারে অমন খবর পেয়ে আমার হৃদয়ের সেই ভালোবাসাই জেগে উঠেছিল। আমি ক্ষনিকের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। নিজের এই আচরণের কারণে এখন আমার খুব আফসোস হচ্ছে! নিজের কাছেই নিজেকে লজ্জিত মনে হচ্ছে। তাই তারাতাড়ি চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। নিজেকে বললাম, চরি*ত্রহী*ন মানুষের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই!

যে মনে প্রাণে আমার নয়! তার জন্য আমি কেন কেঁদে বুক ভাসাবো? রাতের খাবার খেতে গিয়ে ছোট দুই ভাই বোন ও বাবা-মায়ের সামনে পড়ে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল। তবুও খেতে যেতে হলো। নয়তো সবাই আমাকে নিয়ে আরও কথাবার্তা বলে যাবে। আমি চাই, আমাকে নিয়ে আড়ালে কোন কথা না উঠুক।

কেউ অবশ্য এখনো কিছু বলছে না আমাকে। কিন্তু আমি জানি, সবার মনের মধ্যে আমাকে নিয়ে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। একে একে সবাই খাবার খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আমি আর মা শুধু খাবার ঘরে রয়ে গেলাম।

এটা সেটা করতে করতে মা হঠাৎ বললেন, জামাইয়ের জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে সায়মা! বলতো অমন করে কাউকে কিছু না বলে, কোথায় যেতে পারে ছেলেটা? মায়ের দিকে না তাকিয়ে সোজাসাপ্টা জবাব দিলাম, তার আমি কি জানি?

সে পুরুষ মানুষ। যেখানে খুশি ইচ্ছে হলেই যেতে পারে! তার কি আমার মতো সীমাবদ্ধতা আছে, স্বামীর বাড়ি নয়তো বাপের বাড়ি। দেখো গিয়ে কোথাও আনন্দ ফূর্তি করতে ব্যস্ত আছে! কথাটা আমার নিজের অজান্তেই মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো। আর সেই কথার রেশ ধরে আমার মা জিজ্ঞেস করে বসলেন, তুই কি বলতে চাস সায়মা? তুই কি আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখতে চাইছিস?

তুই কিন্তু মারুফের চরিত্রের উপর আঙুল তুলে কথা বলছিস সায়মা! তোদের মধ্যে আসলে কি হয়েছে সত্যি করে বলতো আমায়? তুই কি কোন কারণে মারুফকে সন্দেহ করছিস? অথবা এমন কিছু কি তোর চোখে পড়েছে? মারুফ তো এমন ছেলে নয় সায়মা!

আমি জানি সত্যি কথাটা আমার বাবা-মা এতো সহজে হজম করতে পারবে না। তাই এড়িয়ে গিয়ে বললাম, মা! সে পুরুষ মানুষ কোথায় কখন কি করে আমি কিভাবে বলতে পারি?

তুমিই বল মা! একটা পুরুষ মানুষের সব ব্যাপার কি ঘরের বউ বুঝতে পারে? বা নিশ্চিত করে তার সমন্ধে সবটাই কি বলতে পারে?

মা আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে খুব দুঃখ পেয়েছেন! আমার কথা শুনে কোথাও যেনো হারিয়ে গেছেন এমন ভাবে বললেন, কি জানি? আমি তোর আচরণ ও কথার কোন মানে খুঁজে পাচ্ছি না।

মারুফের এমন করে হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া! তোর হঠাৎ করে বাপের বাড়িতে একা চলে আসা। সবকিছুই যেনো আমার মাথার মধ্যে এলোমেলো ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে! মারুফের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতে তোর মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করে দেখতে পেলাম না। তুই এমন ভাবে স্বাভাবিক আচরণ করছিস যেনো কিছুই ঘটেনি! সবকিছু এতো স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছিস কেমন করে? কিছু একটা যে তোদের মধ্যে ঘটেছে, তাতে আমার আর কোন সন্দেহ নেই।

মা আমার কাছে এসে আমার মুখটা তার দু’হাতে আলতো করে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, সায়মা! আমাকে সব খুলে বলবি না মা? মায়ের এমন আচরণের কারণে আমি ভিষণ বিপদে পড়ে গেলাম! শুধু একটা কথা মুখ ফস্কে বলে ফেলেছি, তাতেই এই প্রতিক্রিয়া! পুরোটা খুলে বললে বাড়ির সবাই আমার প্রতি কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তাই ভেবে পাচ্ছি না। কি বলবো তাও ভেবে পাচ্ছি না। মা আমার গাল দুটোকে গভীর মমতায় স্পর্শ করে বললেন, আমি তোর মা! তোর মনের কথা আমার কাছে খুলে বল সায়মা।

দেখবি তোর কাছে যা কঠিন ও মেনে না নেওয়ার মতো মনে হচ্ছে। তা আমার সাথে বললে, তার একটা সমাধান আমি খুঁজে বের করে দিতে পারবো।

আমি এই পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পেতে রেগে গিয়ে বললাম কিছু হয়নি মা! আমি এখন ঘুমাতে যাবো। আমার শরীর এখনো ক্লান্ত ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ঔষধ বেশ কাজ করে দিলো। আমার রাগ দেখে মা হঠাৎ করে রেগে গিয়ে বললেন, ঠিক আছে। তোর যেমন ইচ্ছে! যা খুশি তাই কর। আমার হয়েছে যতো জ্বালা!

সবার চিন্তা আমাকে একাই কেন করতে হবে? যে যেখানে খুশি গিয়ে ম*রুকগে! তাতে আমার কি? আমি আর কারও চিন্তা করতে পারবোনা। আমি এই ফাঁকে ঘরে চলে গেলাম।

শুতে যাবো ছোট বোন তনিমা জিজ্ঞেস করে আপু তোর আর মারুফ ভাইয়ের মধ্যে কি হয়েছে রে? তনিমার কথা শুনে মে*জাজ আরও গ*রম হয়ে গেল। একটা ধমক দিয়ে বললাম, খুব পেকে গেছিস মনে হচ্ছে? বড়দের কথা গিলিস! এই কথা জিজ্ঞেস করতে এতোক্ষণ জেগে ছিলি, তাই না? তনিমা ধমক খেয়ে চুপসে গেল। চুপচাপ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলো।

তারপর দুদিন কেটে গেল। মারুফের এখনো কোন খবর আমার ছোট ভাই দিতে পারলো না। ওর মোবাইল সেই থেকে বন্ধ হয়ে আছে।

বাবা-মা ভাই বোন আমার দিকে এখন কেমন ভাবে যেনো তাকিয়ে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারে না,তারা। তারা জানে বেশি কিছু বললে আমি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিবো। তাই তাদের এতো নিরবতা।

পরদিন আমার দেবর মাসুদ আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। ওদের গ্রামের বাড়ি আর আমাদের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব মাইল ছয়েক হবে। মাসুদ এসেই আমার সাথে একা কথা বলতে চাইলো। আমি তার কথায় বুঝতে পারলাম সে কিছুটা হলেও জানতে পেরেছে।

তাই বিনাবাক্য ব্যয়ে ওকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। মাসুদ ঘরে প্রবেশ করে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করে তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে ভাবী? আমি কাল ঢাকা গিয়ে জানতে পারলাম তুমি রাগ করে একা চলে এসেছো। আর সেদিন সকাল থেকেই ভাইয়া একেবারে গায়েব হয়ে গেছে। তাঁর কোন খবর কোন জায়গা থেকে পাচ্ছিলাম না। এমনকি তার মোবাইল পর্যন্ত বন্ধ দেখাচ্ছে! আমি বললাম, তুমি শান্ত হয়ে বস, মাসুদ! কারণ মাসুদের কন্ঠে থেকে আ*গুন ঝরে পড়তে চাইছে।

মাসুদ বসে পড়ে বলে,

কয়েকদিন ধরে ভাইয়ার কোন খবর না পেয়ে মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাই আমি নিজে গতকাল ঢাকা যেতে বাধ্য হয়েছি।

সেখানে গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার কাছে শুধু এইটুকু জানতে পারলাম। আর ভাইয়ের অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম সেখানেও কেউ কিছু জানে না। তারাও আমাদের মতো ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত। বারবার ফোন করেও তাকে লাইনে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমি আজ সকালে ঢাকা থেকে সরাসরি তোমার কাছে আগে এসেছি। এখন তুমি আমাকে সত্যি ঘটনাটা খুলে বল দেখি। আমার ভাই কোথায়?

মাসুদের কথা বলার ধরন দেখে আমার গা জ্বলে উঠলো। ওর ভাইয়ের এমন ভাবে নিখোঁজ হওয়ার পিছনে আমার হাত থাকতে পারে। সেই দিকে ইশারা করছে সে! আমি রেগে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছো কেন? তোমার ভাই কোথায় গেছে তা আমি কেমন করে বলতে পারি?

অবশ্যই পারো ভাবী! তুমি বাড়ি ছেড়ে একা চলে এলে।তারপর থেকেই ভাইয়া নিখোঁজ! তুমি কি বলতে চাও! এর কিছুই তুমি জানো না। তুমি কিসের জন্য এতো সকালে ঢাকা থেকে পালিয়ে এলে? তার জবাব দাও আামকে?

শুনে রাখো ভাবী! আমার ভাইকে যদি খুঁজে না পাই। তবে তোমাকে আমি ছাড়বো না, বলে দিলাম! আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, তুমি কিন্তু রীতিমতো আমার সাথে অ*ভদ্রতা করছো! তুমি কোন সাহসে তোমার ভাইয়ের নি*খোঁজ হওয়ার জন্য আমাকে দায়ী করছো?

মাসুদ আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, কারণ তোমার ওভাবে ঝ*গড়া করে চলে আসাটা আর ভাইয়ের নিখোঁজ হবার মধ্যে একটা যোগাযোগ নিশ্চিত আছে বলে?

হঠাৎ আমি কঠিন সত্যিটা বুঝতে পারলাম। ঘটনা সেই আগের সামান্য স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখানে এখন একটা জলজ্যান্ত মানুষ গু*ম হওয়ার প্রশ্ন উঠতে যাচ্ছে। আমার কথা এখন নিজের বাবা-মা বিশ্বাস করবেন কি-না? তাতেও অনেক সন্দেহ আছে। আর এ-তো স্বামীর আপন ছোট ভাই! সে কেমন করে বিশ্বাস করবে?

আমি তাই নিজের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রেখে ঠান্ডা মাথায় নরম কন্ঠে বললাম, মাসুদ তুমি যা জানতে চাইছো। তা আমি তোমাকে বলছি শোন। তারপর একে একে সব কথা মাসুদের কাছে বলে দিলাম। কোন কিছু গোপন করলাম না। কোন কিছু বাদ দিলাম না।

মাসুদ আমার কথা শুনে কতটুকু বিশ্বাস করলো তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু সে কিছুটা শান্ত হয়েছে। মাসুদ চুপচাপ কিছু একটা ভেবে চলেছে। আমি নিরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ তুমিই বল! আমি একটা নারী হয়ে স্বামীর এই অধঃপতন কেমন করে মেনে নিই? কেমন করে ওখানে দু’জনে মিলেমিশে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে পারি?

মাসুদ আমার কথার জবাবে শুধু বললো, ভাবী আমার ভাই বলে বলছি না। ভাইয়া তেমন স্বভাবের কোন মানুষ নয়! তার নিশ্চয়ই কোন বি*পদ হয়েছে। মাসুদ আমার সামনে দু-হাতে নিজের মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে বলে, ভাবী! আমার ভাইয়া খুব ভালো মানুষ! সে নিশ্চয়ই অনেক বড় বি*পদে পড়েছে!

হঠাৎ মা ঘরে প্রবেশ করে বলেন, আমি সব কথা শুনেছি! মারুফ মোটেই এমন ছেলে নয়! মাসুদের কথাই ঠিক। জামাই আমার কোন বি*পদে পড়েছে।

মাসুদ চলে যাবার আগে আরও একবার বলে গেল। ভাবী আমি চাই এতে যাতে তোমার কোন হাত না থাকে। আমার ভাইটি যেনো ভালোয় ভালোয় বাড়িতে ফিরে আসে। আর যদি এমনটা না হয়, তবে ভাবী তুমি এরজন্য দায়ী থাকবে!

কথাটা বলেই মাসুদ ঝড়ের বেগে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা ওর পিছনে ডাকতে ডাকতে গেল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম মা বলছে, বাবাজী! আমার মেয়ের কোন দোষ নেই। এতে ওর কোন হাত থাকতে পারে না।

মাসুদ চলে গেল মায়ের কথা শুনে একটুও দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করলো না। মা এসে সোফার উপর শরীরটা যেনো ছেড়ে দিলেন। বাড়ির সবাই যখন কথাটা একে একে শুনতে পেলো। তাদের মনের মধ্যে একটা গভীর চিন্তা ভর করে বসলো।

বাড়িতে হঠাৎ করে যেনো অন্ধকার নেমে এলো! কয়েক দিন পর্যন্ত কেউ কারও সাথে ঠিক ভাবে খুব একটা কথা বার্তাও বললো না।

আমিও ভীষণ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম। সত্যিই লোকটার কি হলো? এমন করে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল। সত্যি ঘটনাটা এখন আমার কাছেও কেমন রহস্যময় মনে হতে লাগলো। সত্যি বলতে আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তার আসল রুপ কি?

আর এর সাথে মারুফের নিখোঁজ হওয়ার রহস্যটাই বা কি?

আরও কয়েক দিন এমন ভাবে কেটে যাবার পরে মাসুদের ফোন এলো। আমি রিসিভ করতে ভ*য় পাচ্ছি কি না কি শুনতে হয় বলে।

তবুও কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই মারুফের কান্না জড়িত কন্ঠ শুনতে পেলাম।

চলবে,,,

লেখক মোঃ কামরুল হাসান