চোখের দেখাই সব নয় পর্ব-০৩

0
213

#গল্প_চোখের_দেখাই_সব_নয়
#তৃতীয়_পর্ব

সেই মহিলা রাত গভীরে পালিয়ে যাওয়াতে আমি ভীষণ অবাক হলাম! তাঁর এমন হঠাৎ চলে যাওয়ার কি কারণ থাকতে পারে? আমি অনেক চেষ্টা করেও সেটা বুঝতে পারলাম না। সে থাকলেই কি আর চলে গেলেই বা কি? আমি তো আমার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি!

তাঁর চলে যাওয়া আর না যাওয়াতে আমার সিদ্ধান্ত তো আর পাল্টে যাবে না!

তিনি চলে গিয়ে কি আমাকে কিছু বোঝাতে চেয়েছেন? আমাকে তিনি কি বোঝাতে চাইলেন? মারুফ কে মুক্তি দিয়ে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন! তার তো কোন অধিকার ছিলোনা মারুফের উপর। যে তিনি সেই অধিকার ছেড়ে দিয়ে গেলে আমি খুশি হবো। তিনি সবার অজান্তে পালিয়ে গিয়ে আমার অধিকার আরও পোক্ত করে দিয়ে গেলেন! ব্যাপারটা আমার কাছে যেমন হাস্যকর মনে হলো।

তেমনি ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন রহস্যময় বলেও মনে হচ্ছে।

যাইহোক, ভাবলাম তাতে আমার আর কি? আমি তো যা দেখার বাকি ছিলো, তা দেখে নিয়েছি। যা বোঝার ছিলো বোঝে নিয়েছি। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিলো, তা নিয়ে নিয়েছি!

এখন আর অতশত ভেবে আমার কোন কাজ নেই। আমি চলেছি আপন গন্তব্যে। মেয়েদের শেষ ঠিকানা যাকে বলে বাবার বাড়ি। পৃথিবীতে সাধারণত মেয়েদের আদি ও শেষ ঠিকানা হচ্ছে বাপের বাড়ি! যে যাই বলুক না কেন? এটাই চরম বাস্তব সত্য! পৃথিবীর কোথাও কোন জায়গা না হলেও বাপের ভিটায় তার অধিকার অটুট থাকে।

গলির রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমার মনের কোথাও যেনো সেই মহিলার জন্য একটা অনুশোচনা কাজ করতে শুরু করেছে। হয়তো তিনি এভাবে পালিয়ে গিয়ে যে ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। এমনটা তার জন্যই হচ্ছে? তাঁকে অনেক নির্মম ভাবে কটুকথা শুনিয়েছি আমি! এখন মনে হচ্ছে এতো কথা আমার বলা উচিত হয়নি! তিনিও হয়তো কোন না কোন ভাবে পরিস্থিতির শিকার হয়ে এই লাইনে এসেছেন?

তাঁর কি দোষ? তাঁর ব্যবসাই তো এটা! তিনি সবার অজান্তে পালিয়ে গিয়ে কি আমাকে এটাই বোঝাতে চাইলেন, যে তিনিও একজন নারীর সংসার বাঁচাতে এইটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না? কিন্তু তাতেই কি লাভ!

আমি যে মানুষটাকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধবো বলে স্বপ্ন দেখেছি। সেই মানুষটার দেহমন দুটোই তো নষ্ট হয়ে গেছে! সেই নষ্ট মানুষ নিয়ে আমি সুখের সংসার কেমন করে বাঁধবো? সেই মহিলা হয়তো আমার কথা শুনে চলে গেছে কিন্তু এমন আরও কত নারী এই সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সবাইকে কি আমি কথা শুনাতে পারবো? পারবো না!

মারুফ হয়তো তাদের মধ্যে থেকে আবারও একজনকে বেছে নেবে? কারও স্বভাব কি সহজে পাল্টে? আপাতদৃষ্টিতে দেখলে পাল্টে না। যদিও পাল্টে তবে সেটাও কদাচিৎ। মূল কথা হচ্ছে মানুষের স্বভাব সহজে পাল্টে না! মারুফ সারাজীবন হয়তো এমনই নারী লোভী হয়ে থাকবে? সেটা প্রকাশ্যে অথবা অতি গোপনে!

এইসব ভাবতে ভাবতে যখন প্রায় গলির মোড়ে এসে পৌঁছেছি। ঠিক এমন সময় দূর থেকে মারুফের ডাক শুনতে পেয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, সে খালি পায়ে দ্রুত আমার কাছে ছুটে আসছে। ঠিক এমন সময় ঐ বাড়ির আরেকটা মহিলা তাঁর চলার পথ রোধ করে সামনে এসে দাঁড়ালো। আমিও এই সুযোগে একটা বাড়ির দেওয়ালের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখলাম।

মহিলাটি মারুফের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। মারুফ চিঠিটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ততক্ষণে আমি দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছি। সে কোথাও আমাকে দেখতে না পেয়ে চিঠিটা পকেটে ঢুকিয়ে আবার দৌড়ে এদিকে আসতে লাগলো।

চিঠিটা দিতে দেখে নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো আমার শরীরটা। কি ভ*য়ংকর মহিলা তিনি! আমাকে বোঝাতে চাইলেন তিনি চলে গেছেন। অথচ মারুফের জন্য ঠিকানাটা ঠিক লিখে রেখে গেছে। নয়তো ঐ চিঠি কিসের জন্য রেখে গেছেন? বিদায়ের বিরহ গাঁথা!

একটু আগেও যার জন্য অনুশোচনা হচ্ছিল। এখন সেই তাঁর প্রতিই আমার মনের কোণে জমা ঘৃ*ণা আর বি*দ্বেষের পরিমাণটা দ্বিগুণ আকার ধারণ করলো। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো ছি! ক*লঙ্কিনী পথভ্রষ্ট নারী! সত্যি মানুষের স্বভাব কি আর পাল্টে?

আমার সামনে দিয়েই মারুফ দৌড়ে চলে গেল মোড়ের দিকে। কতক্ষণ পরে চোখে মুখে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে এলো সে! গলির মুখে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে কি যেনো একটু ভাবলো। তারপর সে দিকভ্রান্তের মতো এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো।

হঠাৎই একটু থেমে পড়ে সে! আমি তাই দেখে চমকে উঠলাম। কারণ আমার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরেই দাঁড়িয়ে আছে মারুফ! আমি দেওয়ালের এপাশে আর মারুফ ওপাশে। ভাবলাম কিছু টের পেয়ে গেলো না-কি? কিন্তু যা ভেবেছি তা নয়। সে পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দু’হাতে চোখের সামনে মেলে ধরে পড়তে পড়তে আবার বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

ভাবি আজ আমরা দুজনেই এতো কাছে থেকেও কতদূরে চলে গেছি একে অপরের থেকে! মাত্র একটা রাতের ব্যবধানে আমাদের দুজনের সুখের সংসারটা কি ভয়ংকর ভাবেই না এলোমেলো হয়ে গেছে! যা আর কোনদিনই ঠিক হবার নয়।

মারুফ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই আমি বেরিয়ে এসে দ্রুত গলির মোড়ে পৌঁছে গেলাম। একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে একটা টেক্সি ভাড়া করে ফেললাম। টেক্সি ড্রাইভার কে বললাম, মহাখালী বাস টার্মিনালে নিয়ে যেতে। মহাখালী বাস টার্মিনালে এসে টেক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একটা বাসে উঠে বসলাম। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আমার বাপের বাড়ি। সেখানেই আপাতত আমি আমার গন্তব্যস্থল স্থির করেছি। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়?

বাস, অটোরিকশার পরে কিছুটা কাঁচা পথ পায়ে হেঁটে দুপুরের একটু আগে বাপের বাড়ি এসে পৌছলাম। আমার এমন বেশভূষায় এমন ভাবে হঠাৎ করে একা বাপের বাড়ি চলে আসাতে সবাই যেনো মনে মনে কেমন চমকে উঠেছে! মুখে কেউ কিছু না বললেও, তাদের কুঁচকানো কপাল ও চোখের অবাক দৃষ্টিতে আমি সবই আন্দাজ করতে পারলাম। ওরাও মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, আমিও নিজে থেকে সত্যি ঘটনা আগেই প্রকাশ করতে গেলাম না। মা শুধু জিজ্ঞেস করলেন, কি রে সায়মা! জামাই বাবাজী এলোনা? তুই একা এতোটা পথ কি করে?

আমি বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললাম, মা! আমি এসেছি তাতে তোমারা খুশি হওনি বলে মনে হচ্ছে? তাই যদি হয়, তবে আমি আবার চলে যাচ্ছি! মা আমার মুখে এমন কথা শুনে বললেন, রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলিনি। এর আগে কখনো একা বাপের বাড়ি আসিস নি তো! আজ হঠাৎ করেই কোন খবর না দিয়ে এমন করে একা চলে আসাতে আমার মনটা কেন জানি চমকে উঠেছে? তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!

জামাইয়ের সাথে ঝ*গড়া ঝা*মেলা করে আসিস নি তো? আমি বললাম মা! আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে মাথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। খিদের যন্ত্রণায় খুব খারাপ লাগছে আমার। আর তুমি আছো তোমার মনের কৌতুহল নিয়ে। তোমার কি এখনই সবকিছু জানতে হবে? মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে তোর যখন ইচ্ছে কথা বলিস।

পৃথিবীতে যার উপর যতো বেশি মায়া ও অধিকারের সম্পর্ক, তার সাথেই ততটা রাগ দেখানো যায়। মা আমার এই অকারণ রাগের মূল্য দিতে গিয়ে বললেন, আয় আগে খেতে আয়। আমার রান্না প্রায় শেষ। তুই হাত মুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে আয়! আমার রান্না ততক্ষণে শেষ হয়ে যাবে।

আমি বললাম তাই যাও না! ক্ষুধার জ্বা*লায় দুচোখে অন্ধকার দেখছি আমি। মা আমাকে আর কোন কিছু বলতে সাহস পেলেন না। কাল দুপুরের পর থেকে আমার পেটে কোন দানাপানি পড়েনি। শরীর এতোটা দূর্বল লাগছে যে বাথরুমে যেতে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো! কিন্তু দরজাটা ধরে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখলাম।

জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম বাবা-মা পথের মাঝে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। বাবা হয়তো আমার কোন কথাই মায়ের কাছে জানতে চাইছেন? আমি কোনরকমে হাত মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমার মনে নেই। ক্লান্তিতে চোখ দুটি বোজে এসেছিলো।

মা গভীর মমতায় আমার মুখে হাত বুলিয়ে ডাকতে থাকলেন, সায়মা! উঠে পড় মা! আমার রান্না শেষ হয়ে গেছে। কয়েক বার ডাকার পরে ঘুম ভেঙে গেল আমার। আমি চোখ মেলে তাকাতেই মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আয় খাবার বেড়ে দিচ্ছি।

মা আমার প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন, তোর মুখটা এতো শুকনো দেখাচ্ছে যে, দেখে মনে হচ্ছে কয়েকদিন ধরে পেটে দানাপানি পড়েনি। আমি খেতে খেতে বললাম মায়েরা এমনই হয় মা! তারা সন্তানের মুখের দিকে তাকালেই তাদের মনে হয় তার সন্তানের মুখটা শুকনো! হয়তো খাওয়া হয়নি? তুমি তার ব্যতিক্রম হবে কেন?

আমার খাবার খাওয়া প্রায় শেষ এমন সময় মা জিজ্ঞেস করলেন, একটা কথা বলি মা! আমি খাবার মুখে দিতে দিতে মায়ের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, সব সংসারেই ঝ*গড়া ঝা*মেলা হয়। যে সংসারে একেবারে মনমালিন্য নেই। কোন প্রকার ঝ*গড়ার লেশমাত্র নেই! সেটা কেমন সংসার হলো? সাংসারে সামান্য ঝ*গড়া মনমালিন্য স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোলাগার, ভালোবাসার নতুন মাত্রা যোগ করে। এরপর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক আরও শক্ত মজবুত হয়। আরও মধুর হয় মা!

আমি মায়ের কথা শুনে খাবার রেখে জিজ্ঞেস করলাম, মা! তুমি কি বলতে চাও? খোলাখুলি বল আমাকে! মা কিছুটা আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, বলছিলাম কি মা! ঝ*গড়া হলেই এমন করে একা চলে আসতে হবে? তোর এমন করে চলে আসাতে। মারুফের একবারও ফোন করে তোর খবর না নেওয়াতে তোর বাবা সহ আমরা সবাই খুব চিন্তিত।

এটা ঠিক আমরা বুঝতে পেরেছি তোদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে ঝ*গড়া ঝা*মেলা হয়েছে! কিন্তু তাই বলে কি মা, স্বামীর অগোচরে বাড়ি থেকে চলে আসতে হবে?

মায়ের কথা শুনে আমিও হঠাৎ ভেবে মনে মনে চমকে উঠলাম। মারুফ তো সত্যি আমার কোন খবর নিলো না! এটা কেমন করে হতে পারে? আমি সত্যি বুঝতে পারলাম না, কিছু! আমি অবশ্য রাগের মাথায় মোবাইলটা আনতে ভুলে গেছিলাম। কিন্তু এবাড়িতে তো সবার হাতেই ফোন রয়েছে। কারও কাছেই মারুফ আমার কথা একবারও জিজ্ঞেস করে নি! এটা যেনো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

তবে কি সেও আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেছে? হঠাৎ যেনো আমার হৃদয়ের কোণে কোথাও মারুফের জন্য হাহাকার করে উঠে। চোখের জল মুছে খাবার রেখে উঠে চলে আসলাম। মা পিছনে ডাকলেন, খাবার শেষ করে যা সায়মা! খাবার রেখে উঠে যাওয়া ভালো নয় মা!

কিন্তু আমার পেট দুঃশ্চিতার বাষ্পে ভরে গেছে! বিছানায় পড়ে চোখের জল ছেড়ে ভাবছি মারুফ এতো সহজে আমাকে কেমন করে ভুলে গেলো?

মা আমাকে আর কিছু না বলে ঢাকায় আমার ছোট ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়ে বললো, গিয়ে দেখ মারুফের কি খবর। কেন সায়মা একা বাড়িতে চলে এলো?

আমার ছোট ভাই রাতে ফোন করে জানালো মারুফ বাড়িতে নেই! তার ফ্লাটের দরজায় একটা বড়সড় তালা ঝুলছে! কোথায় গেছে কেউ কিছু বলতে পারলোনা!

আমি কথা শুনে কেঁদে ফেললাম! বুঝতে পারলাম না কেন? মারুফ কে কি আমি এখনো ভালোবাসি!

চলবে,,,
লেখক মোঃ কামরুল হাসান