ছদ্মবেশ পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
385

#ছদ্মবেশ (পর্ব ৪৩)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

– স্যরি মি. নিলয়। আপনি হয়তো একটা কথা জানেন না যে, আমাদের স্যার মানে রাজ চৌধুরি শুধু তাদের সাথেই দেখা করে, যাদের সাথে সে নিজে দেখা করতে চায়। তাই এই ক্ষেত্রে আমি কিছুই করতে পারছি না। তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা ছারা কিছুই করার নেই আমার।
কথাটা বলেই একটু মুচকি হাসলো ইকবাল সানি।
নিলয় চেয়ারে হেলান দিয়ে থাকা অবস্থায় স্থির হয়ে চেয়ে রইলো ইকবাল সানির দিকে। ভালোই বুঝতে পারছে যে কথা বারিয়ে লাভ নেই। এই রাজ চৌধুরি নামক ব্যাক্তিটার কাছে পৌছানো টা যতটা সহজ ভেবেছিলো বিষয়টা এতোটাও সহজ না।
তাই আর সময় নষ্ট না করে উঠে দাড়ায় নিলয়। ইকবাল সানির সাথে হেন্ডসেক করে বিদায় নিয়ে একটু হাসির রেখা টেনে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। পাশে একটা ছেলে। ছেলেটা প্রায় সময়ই নিলয়ের সাথে চলাফেরা করে। নাম তার প্রিন্স পিন্টু। নিলয়ের অবর্তমানে টুকটাক বিষয় গুলো সেই দেখাশোনা করে।
নিলয় যখন খুব জটিল একটা বিপদে পরেছিলো তখন এই পিন্টুর উসিলায় বেচেছিলো সে। তখন থেকেই নিজের সাথে রেখে দেয় এই পিন্টুকে। বলতে গেলে নিলয়ের খুব বিশ্বস্থ এই ছেলে। তবে এসব পথে বিশ্বস্ত মানুষ গুলোই পেছন থেকে ছু’রি বসাতে দ্বিতীয় বার ভাবে না। এসব রাস্তায় প্রতিটা মোড়ে মুড়ে সাইনবোর্ডের শব্দ গুলো হলো, স্মা’গলিং, মা’র্ডার, বিশ্বাসঘাতকতা, নিজের মেধা খাটিয়ে বড় হওয়া। উদ্যেশ্য একটাই, ক্ষমতার লোভ।

গাড়ির সামনে আসলে পিন্টু দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে বসে নিলয়। তারপর পিন্টু অপর পাশে গিয়ে ড্রাইবিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
,
,
ওদিকে আজ বাসায় ফিরলো আরোহিরা। এই দু’এক দিন আরোহির আশে পাশেই ছিলো রাজ। তবে তেমন কোনো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি তার। নির্জন কি তাহলে শুধুই ফ্যামিলি নিয়ে সময় কাটাতে গিয়েছিলো? নাকি ভেতর ভেতর কোনো চাল চালছে? নাকি ফ্যামিলির কাছে নতুন করে ভালো সাজতে এসব করছে? বিষয়টা মাথায় ঢুকছে না রাজের।

আর সেখেনে কচি সেজে আরোহির সাথে যেভাবে কথা হয়েছে আর আরোহিও রাজকে নিয়ে যা যা বলেছে তা মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না রাজের। আরোহি তাকে পছন্দ করে বাট সেটা সে নিজেও বুঝতে পারে না। আর আরোহির বিয়েও অন্য জায়গায় ঠিক করা। আর মেয়েটাও একটু বাচ্চা স্বভাবের। হয়তো এসব মাত্রই আবেগ। তার বয়সের দোষ এটা। আর আরোহির এসব বাচ্চামো দেখতে দেখতে পড়ানো শেষে বাসায় আসার পরও আরোহির বাচ্চামু গুলো চোখের সামনে ভেষে উঠে। বিরক্তির মাঝেও এক চিলতে ভালো লাগা এসে হাতছানি দিয়ে যায় তাকে। হয়তো এটা নতুন করে একটা সাইকোলজিকাল প্রব্লেম দেখা দিয়েছে।
যার জন্য প্রয়োজন আরোহি বেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার আগেই এখান থেকে চলে যাওয়া। বাট তার লক্ষের কিছুটা কাছাকাছিই চলে এসেছে বলে টিউশনিটাও বাদ দিতে পারছে না। যাই হোক আরোহির এসব আবেগ কে একধমই পাত্তা দেওয়া টা ঠিক হবে না। এসব বিষয় ইগনোর করে পড়ানোর বিষয় টা খেয়াল রাখতে হবে।

ওদিকি রাজ আজ পড়াতে আসলে তাকে ওখানের সব কিছু বলার জন্য অস্থির হয়ে আছে আরোহি। মনে হচ্ছে তার সুন্দর মুহুর্ত গুলো রাজের সাথে শেয়ার না করা অব্দি শান্তি হবে না সে।

রাজ পড়াতে আসার পরই বই হাতে নিয়ে বলে,
– কয়েকদিন ছুটি পেয়েছো, এখন চুপচাপ পড়ায় মন দিবে। কোনো ফাকি দেওয়ার চলবে না।
আরোহি তবুও উৎসাহ নিয়ে রাজের দিকে চেয়ে বলে,
– জানেন সেখানে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে।
রাজ বইয়ের দিকে চেয়ে বলে,
– আগেই বলেছি পড়ায় ফাকি দেওয়ার চেষ্টা করবে না।
আরোহি এবার জেদ ধরে বলে,
– আমার কথা না শুনলে আমি পড়বো না।
রাজ একটু রাগি লুক নিয়ে বলে,
– না পড়লে কানের নিচে খাবে একটা।
আরোহি আবার বলে,
– মা’রলে আম্মুকে গিয়ে বলে দিবো।

একটু বিরক্তিবোধ করলো রাজ। এতো বড় ময়েকে মে’রেছে তা আবার গিয়ে আম্মুকে বলে দেওয়া। বিষয়টা অবশ্যই লজ্জা জনক। যদিও আরোহিকে ভয় দেখানোর জন্যই এটা বলেছিলো।
রাজ ভেবে পায় না, আরোহি কি সত্যিই এমন? নাকি শুধু তার সাথেই এমন বাচ্চামু করে? কই অন্য জায়গায় তো আরোহির কথাবার্তা গুলো বড় মেয়েদের মতোই থাকে? তাহলে তার সামনেই বা কেন এমন অজথা বাচ্চামু করে?

রাজ যদিও কক্সবাজারে পুরোটা সময়ই আরোহির সাথে ছিলো, তবুও একটু বিরক্তি নিয়ে বলে,
– আচ্ছা বলো দেখি কি এমন অদ্ভুত কান্ড।
আরোহি এবার একগাল হেসে বলে,
– ওখানে আমার রুমে যেই লোকটা সার্ভিস দিতো, সে দেখতে একধম আপনার মত ছিলো। আমি তো প্রথমে কনফিউশান এ পড়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম লোকটা আপনার মতো দেখতে। একটু অদ্ভুত টাইপের লোকটা। সারাক্ষন আমার পিছে লেগে থাকতো। আমি যেখানে যেতাম, সেও সেখানে যেতো। আমার মনে হয়, লোকটা আমাকে পছন্দ করে ফেলেছিলো। তাই এভাবে আমার পেছন পেছন ঘুরতো।

আরোহি কথাটা বলা মাত্রই রাজের বিষম উঠে গেলো। কয়েকটা কাশি দিলে আরোহি পানির গ্লাস টা এগিয়ে দেয় তার দিকে। রাজ পানি খেয়ে শান্ত হয়ে আরোহির দিকে তাকায়। কি বলে এই মেয়ে, তাকে পেছনে প্রেম করার জন্য ঘুরতাম আমি?
তবুও বিষয় টা হজম করে নিলো রাজ। আরোহির মুখে পরের কাহিনি টা শুনার জন্য আগ্রহ জন্মালো এবার। তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
– হুম তারপর?
আরোহি আবার বলে,
– লোকটা এতো পিছন পিছন ঘুরলো কিন্তু লোকটাকে ছ্যাকা দিয়ে চলে আসলাম আমি। হিহিহি,,,,,,
রাজ এক গাল হেসে বলে,
– হুম ভালো করেছো।
আরোহি আবার বলে,
– আরেকটা অদ্ভুত বিষয় কি জানেন? তার নাম কচি। হা হা হা,, কচি কারো নাম হয় নাকি?
রাজ এবার সৌজন্য মুলক একটা হাসি দিয়ে বলে,
– সুন্দর নাম। তোমার কচি কাচি শেষ হয়েছে? তাহলে এবার আমরা পড়ায় আসি?
আরোহি এবার রাজের দিকে চেয়ে বলে,
– আপনার হাসি পায় নি? আপনি এমন কেন? গম্ভির হয়ে থাকেন। একটু গাল টেনে হেসে আবার গম্ভির হয়ে যান। আমার মত মন খুলে হাসতে পারেন না? হাসলে মন ফ্রেশ থাকে।
রাজ বলে,
– তোমার মতো এমন করে পাগলের ন্যায় হাসতে অভ্যস্ত নই আমি।
আরোহি রাজের দিকে চেয়ে হাস্যজ্জল মুখে বলে,
– তাহলে কাতুকুতু দিলে হাসবেন?
রাজ এবার চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে মুখটা উপরের দিকে করে দুই হাত মুখে দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– ইয়া আল্লাহ্ কার পাল্লায় পড়লাম আমি। অল্প দিনে পাগল করে ছাড়বে।
,
,
আজ রিমার প্রথম এক্সাম। খুব ভোরে উঠে পড়তে বসেছে সে। গত কাল রাতে রুশান ফোন দিয়ে জানালো, আসতে পারবে না সে। তা নিয়ে ভিষণ মন খারাপ হলো রিমার। কারণ তার একটা প্লেন ছিলো প্রথম দিন রুশানের সাথে পরিক্ষার হলে যাওয়া। রুশানকে তার ইচ্ছের কথা জানালেও রুশান বললো আসতে পারবে না। মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তা ছারা আরো একটা প্লেন ছিলো, রুশানের সাথে কলেজ গেট দিয়ে ঢুকার সময় একটা স্লো-মোশন ভিডিও বানানো। তার বান্ধবিকে বলেও রেখেছে যেন ক্যামরা নিয়ে রেডি থাকে। প্রথম দিন পরিক্ষা শেষে ছবিও তুলতে হবে। ক্যামরাটা রুশানের কাছে রেখেই হলে চলে যাবে তারা।
কিন্তু এতো কিছু প্লেন করে রাখলেও কিছুই হলো না।

এক্সামের সময় রাত জেগে পড়াটা সবচেয়ে বড় বোকামি। উত্তম হলো ৯টা থেকে ১০ টার মাঝে ঘুমিয়ে যাওয়া। আর ভোড় বেলা উঠে পড়া। কারণ ভোর বেলার পড়াটা মনে থাকে সবটা। আর রাত জেগে পড়লে পরিক্ষার হলে যাওয়ার পর সব এলোমেলো লাগে সব। জানা প্রশ্নও খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

তাই ভোর ৪ টায় উঠে নামাজ শেষে পড়তে বসলো রিমা। সাড়ে ৭ টা অব্দি পুরোনো পড়া সব একবার রিভাইস দিয়ে নিলো। এরপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা শেষে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে রিমা। রামিম নাস্তা করে অফিসের জন্য রওনা দিচ্ছে। রিমার মা ডেকে বলে, রিমাকে যেনো কলেজের সামনে নামিয়ে সিট খুজে বসিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে যায়।
কিন্তু রামিমের ইদানিং কাজের চাপ বেশি থাকায় সময় মত পৌছাতে হবে তাকে। সে হয়তো বড়জোড় রিমাকে গেটের সামনে নামিয়ে দিতে পারবে।

রিমার মা রিমার কাছে গিয়ে বলে,
– রুশান কি বলেছে? তোর এক্সাম জেনেও যে আসলো না।
রিমা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
– আমার প্রতি আগের থেকে গুরুত্ব কমে গেছে তার। এখন শুধু ব্যস্ততা দেখিয়ে বেড়ায়।
আরিশা একটু হেসে মেয়েকে বুঝাতে বলে,
– আরে ওসব কোনো বিষয় না। পুরুষ মানুষের অনেক ব্যাস্ততা থাকে। রামিম তোকে হলে নামিয়ে দিয়ে আসবে। সিট খুজে নিতে পারবি? নাকি আমি সাথে আসবো?
রিমা বলে,
– তোমার যেতে হবে না। এই গরমে এত দুর যেবে আবার একা একা ফিরবে তার চেয়ে ভালো আমিই খুজে নিতে পারবো।
আরিশা মেয়ের মাথায় একটা ফু দিয়ে বলে,
– সব কিছু ভালো হোক। আর মাথা ঠান্ডা রেখে পরিক্ষা দিবি।

বলেই যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় তারা। বাড়ি থেকে বের হয়ে অবাক হয় রিমা। দেখে রুশান বাইক নিয়ে দাড়িয়ে আছে সেখানে। আরিশা একটু হেসে মেয়ের দিকে চেয়ে বলে বলে,
– রুশান ঠিকই বলে, তুই অজথাই তাকে ভুল বুঝিস।
রিমা একটু রাগি লুকে তাকিয়ে থাকে রুশানের দিকে। আসবেই যখন গত কাল এতো ঢং করার কি দরকার ছিলো?
রুশান একটু হেসে বাইকে উঠতে বললে রিমা একটু ঝাঝালো ভাবে বলে,
– উঠবো না আমি। ভাইয়ার সাথেই যাবো। কেউ নিয়ে যেতে হবে না আমাকে।
রিমা ভেবেছিলো রুশান ক্ষমা চেয়ে স্যরি বলে তার রাগ ভাঙাবে। কিন্তু রুশান বাইক স্টার্ট দিয়ে বলে,
– লাষ্ট বার বলছি, উঠলে ভালো আর না উঠলো সোজা চলে যাচ্ছি আমি।

এবার রিমা রাগ ঝেড়ে লক্ষি মেয়ের মতো চুপচাপ গিয়ে উঠে বসলো। রুশান ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে বলে,
– সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে নিয়েছো?
রুশানের মুখে হটাৎ তুমি শুনে কিছুটা অবাক হয় রিমা। বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে হজম করে নিয়ে বলে,
– হুম নিয়েছি।
,
,
ঐ দিকে সকাল সকাল ফ্রেশ হয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে একা একা রুমের ভেতর বসলো রাজ। দেখে ইকবাল সানি বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। কল ব্যাক করলে ওপাশ থেকে রিসিভ করে গত কালকের বিষয়টা জানায় তাকে।
যে একটা লোক তার সাথে দেখা করতে চাইছিলো। বাট পরিচয় দেয়নি। আর লোকটা যে চেনা, বিষয়টা এমনও না। শুধু বলেছিলো বিজনেস ডিল।

রাজ গম্ভির ভাবে বলে,
– অপরিচিত কারো সাথে সাক্ষাৎ করার আগে তার সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিৎ ছিলো তোমার। যাই হোক লোকটা কি একেবারেই পরিচিত না?
ইকবাল সানি বলে,
– তেমন ভাবে পরিচিত না। শুধু প্রস্তাব রেখেছে আপনার সাথে দেখা করতে চায়।
রাজ আবার গম্ভির ভাবে বলে,
– বিজনেস সাব্জেক্ট হলে তোমার সাথেই সব করতো। এতোটা গভিরে হাত দিতো না। যাই হোক। ওয়াট্সএ্যাপ এ তার পিক সেন্ড করে দাও লোকটার। সাথে তোমার সাথে দেখা করার মুহুর্তের সব সিসি টিভি ফুটেজ পাঠাও। বাকিটা আমি দেখছি।

To be continue……….

#ছদ্মবেশ (পর্ব ৪৪)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

প্রথম দিন তাই পরিক্ষার হলে অনেক ভিড় জমে আছে। আরো ২ টা কলেজের স্টুডেন্ড পরিক্ষা দিতে এসেছে এখানে। সবার মনে আজ প্রথম পরিক্ষার উত্তেজনা ও ভয় মিশে আছে। প্রস্তুতি যতই থাকুক, প্রথম পরিক্ষায় কম বেশ সবাই নার্ভাস থাকে কিছুটা।

রিমাকে নিয়ে গেট পেড়িয়ে কলেজের সামনে এসে বাইক থামালো রুশান। দেখে একটু আগে হল খুলে দিয়েছে, আর সবাই নিজেদের সিট নাম্বার খুজতে ব্যাস্ত।

একটা বোর্ডে লাগানো আছে কোন হলে কোন রোলের শিক্ষার্থীর সিট পড়েছে। রুশান সেটা দেখে ৯ নাম্বার হলের দিকে চলে গেলো। রিমাও ফাইল টা নিয়ে পেছন পেছন চললো তার।
খুজতে গেলে সামনে থেকে প্রথম বেঞ্চিতেই পড়লো রিমার সিট। মানে একেবারে সামনের টেবিল। ব্যাপার টা এমন হয়ে দাড়ালো যে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়।
রিমা মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করলেও রুশান তার সামনে হাই বেঞ্চটাতে বসে রিমার দিকে চেয়ে বলে,
– ভালোই হয়েছে সামনে সিট পড়ায়। একধম আরামে পরিক্ষা দিতে পারবি। কেউ ডিস্টার্ব করতে পারবে না।
রুশানের কাছে আরাম মনে হলেও রিমার কাছে কি সেটা শুধু সে নিজেই জানে। যাই হোক কি আর করার? ইচ্ছে করছে টেবিলটাকে মাথায় করে নিয়ে পেছনে বসিয়ে দিতে।

রুশান কিছুক্ষন ওখানে বসে থেকে বলে,
– আচ্ছা আমি যাচ্ছি, সুন্দরে পরিক্ষা দিবি। একধম টেনশন নিবি না৷
রিমা বলে,
– কোথায় যাবেন? একেবারে বাসায়?
রুশান ছোট করে বলে,
– হুম।
রিমা একটু মুখ কুচকালেও মাস্কের আড়ালে তা বুঝা গেলো না। কুচকানো অবস্থায় বলে,
– আমাকে নিয়ে যাবেন না?
রুশান হেসে বলে,
– নিয়েও যেতে হবে?
রিমা গম্ভির হয়ে চুপ করে থাকলে রুশান মুচকি হেসে বলে,
– যাচ্ছি না, বাইরে আছি আমি। টেনশন নিস না।

রুশান চলে যাওয়ার মুহুর্তে রিমার বান্ধবি প্রীতি এসে রুশানের হাতে ক্যামরাটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
– ভাইয়া এটা রাখেন। স্যার টা দেখলে এ্যবসেন্ট করে দিবে।
রুশান ক্যামরাটা নিয়ে চলে গেলো বাইরে। রিমা প্রীতির দিকে চেয়ে বলে,
– ভিডিও করেছিস?
প্রীতি কিছুটা অপরাধির ন্যায় বলে,
– আমি ক্যামরা অন করতে করতে তোরা ঢুকে পরেছিস। কি করবো বল?
রিমা কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে থেকে বলে,
– মনটা চায় তোরে মাথায় তুলে একটা আ’ছাড় মা’রি। কিন্তু কি করার? তুই তো আমার বান্ধবি। তাই বলে বেচে গেলি।

পরিক্ষার শেষে রিমা ও তার বান্ধবিরা মিলে ব্যস্ত হলো ছবি তোলায়। আর তাদের ফটোগ্রাফার হলো রুশান। ছবি তোলার মতো নানান জায়গা আছে কলেজ জীবনের শেষ স্মৃতি গুলোর প্রতিটা বিশেষ দিন একে একে ফ্রেম বন্ধি করে রাখছে। যেন আজ থেকে ৩০-৪০ বছর পর হুট করে পিক গুলো দেখে মনে হবে যে, এক সময় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কত সুন্দর মুহুর্ত কাটিয়েছি।

এদিকে তাদের এসব রং-ঢং এর মাঝে পড়ে বিরক্তি ধরে গেছে রুশানের। চলে যেতে চাইলে রিমা বলে,
– মাত্রই তো শুরু করলাম। এমন দিন গুলো তো আর ফিরে আসবে না। স্মৃতি হিসেবে রাখলে কি হয়? প্রতি দিন তো আর এভাবে ছবি তুলবো না আমরা।

রিমার কথার জালে ফেঁসে গেলো রুশান। এখন মুখে না, কাজে কিছু একটা করতে হবে। তাই রুশান একটু হেসে রিমার দিকে ক্যামরা টা এগিয়ে দিয়ে বলে,
– ছবি তুলতে তুলতে আমার হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। এখন তুই কিছু তুলে দে আমাদের।
রিমা একটু ভ্রু-কুচকে বলে,
– আমাদের মানে, কাদের?
রুশান কিছুটা হেটে রিমার বান্ধবিদের মাঝখানে গিয়ে দাড়িয়ে বলে,
– আমাদের।
তখন প্রীতি বলে উঠে,
– আমরা দুলাভাইয়ের সাথে ছবি তুলবো না এটা কি হয়? নে রিমা, তুই সুন্দর করে তোল।

রিমার বান্ধবিদের মাঝখানে দাড়িয়ে কিছু ছবি তুললো রুশান। তারপর প্রীতিদের নিয়ে তাদের মাঝখানে বসে বড় বড় ভেটকি দিয়ে ছবি তুলতে লাগলো রুশান। রিমা যেন কিছু বলতেও পারছে না আর সইতেও পারছে না। বিরক্তি নিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছে। একটু পর আর সহ্য করতে না পেরে ক্যামরা রেখে রুশানের হাত ধরে বলে,
– আর ছবি তুলতে হবে না। অনেক তুলে ফেলেছি। এখন বাসায় যাবো আমি।
রুশান পুনরায় মেয়েগুলোর মাঝখানে গিয়ে বসে বলে,
– মাত্রই তো শুরু করলাম। এমন দিন গুলো তো আর ফিরে আসবে না। স্মৃতি হিসেবে রাখলে কি হয়? প্রতি দিন তো আর এভাবে ছবি তুলবো না আমরা।
,
,
দুপুরে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে লেপটপ টা নিয়ে বসে রাজ। দেখে ইকবাল কিছু পিক আর একটা ভিডিও সেন্ড করেছে।
দেখে দাড়ি মোচ সহ পাঞ্জাবি-টুপি পরা এক লোকের পিক। আর ভিডিও তে সেই লোকটার সাথে বসে কথা বলার সময়ের ফুটেজ।
কে এই লোক? বিষয়টা একটু ভাবালো রাজকে। কিন্তু কোনো উত্তর খুজে পেলো না।

লেপটপে কিছু সময় পার করলে ফরিদা আন্টির ডাক কানে আসলে পিক গুলো ও ভিডিও টা সেভ করে লেপটপ অফ করে চলে গেলো রাজ। লোকটার সম্পর্কে পরে জানা যাবে। আপতত খেয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।
ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে নিবিড় আর তুষার বসে আছে। রাজ গিয়ে বসলে তার পেছন পেছন নিলয়ও গিয়ে বসে।
রাজ নিলয়ের এতো কাছাকাছি অথচ ফুটেজ ও পিক দেখে বিন্দু মাত্র চেনার কোনো উপায় নেই। চিনবেই বা কি করে, নিলয়ের অভিনয় গুলো খুবই নিখুদ বলেই তো নির্জন তাকে তার মেইন স্ট্রাইকার হিসেবে ব্যাবহার করছে। আর নিলয়ও এতোটা বোকা নয় যে এতো কিছুর সাথে জড়িয়ে থাকার মাঝে নিজের পরিচয় নিয়ে ওপেন’লি ঘুড়ে বেড়াবে।

নিলয় খাবার মুখে দিয়ে বলে,
– রুশান আজ আবার কোথায় গেছে?
ফরিদা আন্টি খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলে,
– বাড়িতে গেলো কি যেন কাজে।
নিলয় খাবার মুখে দিয়ে একটু হাস্যজ্জল ভাবে বলে,
– তার কি প্রায়ই বাড়িতে কোনো কাজ লেগে থাকে? মাঝে মাঝেই দেখি কোথায় উধাও হয়ে যায়।
নিলয়ের দিকে চেয়ে রাজ বলে,
– সবার জীবন তো আর এক না। এক এক জনের জীবন এক এক ভাবে চলে। হয়তো রুশানের ক্ষেত্রেও এমন কিছুই চলে, যেখানে সে উপস্থিত না থাকলেই নয়।
রাজের কথা শুনে নিলয় নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে,
‘ওর কি এমন কাজ লেগে থাকে তা আমার ভালো করেই জানা আছে। বন্ধু বন্ধু দেখে বেচে আছে এতো দিন। আমার এই আবেগ কয়দিন থাকবে তা নিজেরই ঠিক নেই।’

নিলয়ের কথাটা নিজের মাঝে বলায় আশেপাশের কেউ শুনতে পায়নি তার কথা। ফরিদা আন্টি তার প্লেটে আবার খাবার দিতে প্লেট এগিয়ে দিতে বললে একটু মুচকি হেসে বলে,
– আর খাবো না আন্টি। ক্ষুদা নেই আজ।
,
,
– স্যার আমি না একটা আর্ট করছিলাম কয়েকদিন ধরে। গত কালকে শেষ করেছি।
বলেই একটু ভয়ার্ত চেহারায় পিট পিট করে রাজের দিকে তাকায় আরোহি।
রাজ আড় চোখে তার দিকে চেয়ে বলে,
– কিসের আর্ট সেটা?
আরোহি নিজের মাঝে একটু নার্ভাস ফিল করে কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাকিয়ে সময় পার করে বলে,
– আমার না তেষ্টা পেয়েছে। একটু পানি খেয়ে আসি?

রাজ একটু অবাক হলেও অনুমতি দিলো। আরোহি উঠে দাড়িয়ে আর্ট করা কাগজ টা রাজের সামনে রেখেই আর দেড়ি না করে দ্রুত পায়ে চলে গেলো অন্য রুমে।
টেবিলের সামনে এসেই জগ থেকে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলে নিলো।
আর সেই সময় টায় রাজ কাগজটা হাতে নিয়ে সামনে মেলে ধরলে দেখে তারই একটা পিক এঁকেছে আরোহি। যেখানে রাজ মুখের সামনে দুই আঙুলে একটা কলম ধরে রেখে খুব ভাবান্তর হয়ে বসে আছে।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব সময় নিয়ে যত্ন করে আঁকা এই পিক।

রাজ বেশিক্ষন না চেয়ে পিকটা ভাজ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। আর খাতা থেকে একটা সাদা পেজ ছিড়ে নিজের সামনে ধরলো আরোহিকে দেখালোর জন্য।
আরোহি পানি খেয়ে দরজার সামনে এসে একটু উঁকি দিয়ে দেখে রাজের রি-একশান টা কেমন হলো।
রাজকে স্বাভাবিক দেখে গুটি গুটি পায়ে রাজের সামনে এগিয়ে গেলে রাজ সাদা কাগজটা ভাজ করে হাত দিয়ে ছিড়ে তা টুকরো টুকরো করে ফেললো।
নিজের এতো কষ্টে আঁকা আর্ট টা এভাবে ছিড়ে ফেলেছে ভেবে বুকটা কেঁপে উঠলো তার। আর সেই মুহুর্তে রাজের একটা ধমকে চেয়ারে বসে আরোহি। মুখটা গোমড়া করে রেখেছে খুব। খুব কষ্ট হলেও প্রকাশ করতে পারছে না সে।
রাজ রাগি লুক নিয়ে বলে,
– আমার পিক আঁকার আগে আমার পারমিশন নিয়েছো তুমি? আমার পারমিশন ছারা কোন সাহসে আমার পিক এঁকেছো?
রাজের এমন কড়া কথায় তেমন একটা কষ্ট হলো না আরোহি। যতটা কষ্ট হচ্ছে ওটা ছিরে ফেলায়। ভেবেছিলো রাজ দেখে আবার ফেরত দিয়ে দিলে সে এটা নিজের কাছে রেখে দিবে।

আরোহি কাঁপা গলায় খুব করুন ভাবে বলে,
– ওটা ছিরে ফেলেছন কেন আপনি?
রাজ এখনও রাগি ভাবে বলে,
– কারণ আমার অনুমতি ছারা তুমি আমার ছবি এঁকেছো তাই।
আরোহি আর কিছু বললো না। চুপচাপ বসে আছে মাথা নিচু করে।
রাজ এই মুহুর্তটা কে ঘুরানোর জন্য বই হাতে বার বার বিভিন্ন টপিক নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু আরোহি বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে।
রাজ এবার আরোহির দিকে তাকালে দেখে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো আরোহির চোখ দিয়ে। আরোহি হাসছেও না কাঁদছেও না। নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার।
,
,
বাসায় ফিরে আরোহির আঁকা ছবিটা পকেট থেকে বের করে রাজ। সামনে মেলে ধরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মুখে অজান্তেই একটা হাসি ফুটে উঠেছে।
এর মাঝে তুষার পাশে এসে বসলো। হা করে বলে,
– ভাই, ছবিটা কে এঁকেছে? তার আর্টের হাত তো খুবই ভালো।
রাজ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বলে দেয়,
– আরোহি।
বলেই আবার নিজের মাঝে একটা বোকামি বুঝতে পারে সে। যেন সে না চাইতেও বলে দিয়েছে এমনটা।

তুষার একটা হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
– তার মানে তুমিও? বাহ্ ভালো। তোমাদেরই দিন ভাই। মনে হয় তোমার ভাবনার জগতে এসে আমি ফোঁড়ন কাটছি। এখন আসি, ভাবনার জগৎ থেকে বের হলে ডাক দিও।
বলেই উঠে চলে গেলো তুষার। রাজ যেন হা হয়ে তাকিয়ে আছে তুষারের দিকে।

যাই করুক, ছবিটা সুন্দর হয়েছে খুব। অনন্ততঃ মেয়েটার একটা থ্যাংক্স পাওনা ছিলো।
কিন্তু তার বিপরিত চোখের জল ফেলতে হলো মেয়েটাকে। কি করার? আমরা না চাইলেও এভাবে আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর ভালোর জন্য তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিতে হয়। এই সামান্য কষ্টের বিনিময়ে সেই মানুষটা ভালো থাকলে মন্দ কি? আরোহির বিয়ে টিক হয়ে আছে অন্য জায়গায়। আরোহি হয়তো আবেগে পড়ে এসব করছে, তাই বলে কি রাজ নিজেও সেটাকে প্রশ্রয় দিবে? মেয়েটা একধম আলাদা ধরনের। হয়তো ছোট থেকে বাসায় একা একা থাকতে থাকতে সবার মতো এতোটা চঞ্চলতা তাকে গ্রাশ করেনি। অন্য রকম করে তুলেছে তাকে। যেমনই আবেগি তেমনই ভিতু সে। অল্পতেই কাউকে বিশ্বাস করে নেওয়া। লোভ নয়, নিশ্বার্থ ভাবে ভালোবাসা লোভি মেয়েটা। নয়তো রাজ খুব দরিদ্র জেনেও রাজের প্রতি এতো আবেগ কাজ করতো না। মেয়েটা এমন কেন?

To be continue………

#ছদ্মবেশ (পর্ব ৪৫)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

দুধ ভর্তি একটা গ্লাস নিয়ে রিমার রুমে প্রবেশ করে রুশান। রুশানকে দেখেও তার দিকে তাকাচ্ছে না সে। বইয়ের দিকে চেয়ে আছে এক মনে।
রুশান একটু মুচকি হেসে গ্লাসটা রিমার সামনে রাখে। রিমার ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, আজকে মনে হয় ভালোই জেলাস হয়েছে। রিমার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে বলে,
– এটা খেয়ে মাথাটা ঠান্ডা কর। মাথা গরম থাকলে কি পড়ায় মন বসবে বল।
রিমা কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছে। রুশান আবার বলে,
– এক মিনিটও লাগবে না৷ এক টানে শেষ করে আবার পড়তে বস। দুধ খেলে মাথা কুল থাকে।

রিমা এবার রুশানের দিকে চেয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বলে,
– মাথা গরম করে দিয়ে এখন আসছে মাথা ঠান্ডা করার জন্য দুধ খাওয়াতে।
রুশান একটু অবাক হওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলে,
– আমি আবার কি করলাম?
রিমা এক গাল হেসে বলে,
– না আপনি কিছুই করেন নি। আপনি একেবারে দুধে ধোয়া তুলশী পাতা। তখন মেয়ে গুলোর সাথে এতো ঘষাঘষি করে ছবি তুলছিলেন কেন? খুব ভালো লাগছিলো তাই না?
রুশান স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– ভালো তো লাগবেই। আর ওরা তো তোরই বান্ধবি ছিলো। তাহলে প্রব্লেম কোথায়? কলেজে সব কিছুই তো বান্ধবিরা মিলেমিশে করিস। জামাইটাকেও না হয় সবাই মিলেমিশে ভাগাভাগি করে নিবি।
রিমা এবার রাগে ফেটে যাওয়ার অবস্থা। রাগি গলায় বলে,
– তাহলে যান ঐ মেয়েগুলোর মাথা টান্ডা করুন গিয়ে। আমার কাছে কি?
রুশান এবার উঠে দারিয়ে বলে,
– ভালো কথা মনে করিয়ে দিলি। প্রীতি না কি নাম, তার বাড়িতো ঐ যে কাছেই। আমি বরং তাকেই দুধের গ্লাস টা দিয়ে আসি। তুই যেহেতু খাবিনা, কি আর করার।

রুশানের অঙ্গিভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বেটা সত্যিই এখন ঐ প্রীতির কাছে চলে যাবে। রিমা রুশানের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বলে,
– আমার জিনিস অন্যকে কেন দিবেন। আর কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলেও একদম দুজনের মাথা ফা’টিয়ে দিবো।

বলেই এক টানে দুধের গ্লাস টা খালি করলো রিমা। রুশান একটু মুচকি হাসে। এই মেয়েকে কিভাবে লাইনে রাখতে হয়, সেটা তার ভালোই জানা আছে।
,
,
বিকেলে ছাদে বসে ছিলো নিবিড় ও তুষার। বিকেলের ফুরফুরে বাতাসের সাথে গিটারের শব্দে গান ধরতে নিবিড়ের ভালোই লাগছে আজ। পাশে তুষার বসে বসে ফোনে সময় পার করছে।
তুষার ফোন টিপতে টিপতে বলে,
– এখানে বসে থেকে কি করবি? চল বাইরে গিয়ে হাটাহাটি করি। এই সময় টা ফিরোজ চাচার দোকানে বসে চায়ের সাথে আড্ডা টা খারাপ হবে না। মনও ফ্রেশ হয়ে আসবে, চল।
নিবিড় গিটারের টোন থামিয়ে বলে,
– তুই যা, আমি এখন একটা পিনিকে আছি। গানের পিনিক।
তুষার ফোনটা পকেটে নিয়ে বলে,
– আরে ভাই চল না। ভালো লাগছে না এভাবে ছাদে বসে থাকতে।

এর মাঝে সিড়ির রুমের কাছে একটা মেয়ের গলার আওয়াজ পায়। দুজন এক সাথে সেদিকে তাকিয়ে দেখে নীলা। নিবিড়ের দিকে চেয়ে একটু মুচকি হেসে এগিয়ে এলো তাদের সামনে।

তুষার পুনরায় ফোন হাতে নিয়ে আবার আরাম করে বসে পড়লো। নিবিড় ইশারায় বুঝাচ্ছে চলে যেতে। কিন্তু তুষারের কোনো পাত্তা নেই।
বাধ্য হয়ে নিবিড় এবার হাসি মুখে তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
– তোর না কি কাজ আছে বললি? যা কাজটা সেরে আয়। আমরা আছি এখানে।
তুষার ফোনের দিকে চেয়ে বলে,
– কখন বললাম? আমার তো এমন কোনো কাজই নেই।
নিবিড় কিছুটা ভেবে বলে,
– আরো তুই না বললি বাইরে গিয়ে একটু হাটাহাটি করে আসবি।
তুষার আবার বলে,
– কখন বললাম?
নিবিড় এবার বিরক্ত হয়ে বলে,
– আরে ভাই মাত্রই তো বললি, তোর এখানে ভালো লাগছে না। নিচে গিয়ে বাইরের দিকে একটু হাটাহাটি করে আসবি।
তুষার আবারও অস্বীকার করে বলে,
– এখানে ভালো লাগবে না কেন? কত সুন্দর বাতাস। নিশ্বাস নিলেই প্রান টা জুড়িয়ে যায়। আর আমাকে এতো যেতে বলছিস কেন? তোদের এতো প্রয়োজন হলে তোরা যা। আমি এখান থেকে কোথাও যাচ্ছি না।

নিবিড় এবার নিজের মাঝে কিছু একটা ভেবে নীলার দিকে চেয়ে বলে,
– জানো নীলা সেদিন তুষারের সাথে কি হয়েছে। একটা মেয়ে,,,,,
এতটুকু বলতেই নিবিড়কে থামিয়ে দিয়ে তুষার বলে,
– একটা মেয়ে বিপদে পড়েছিলো, তাই আমি হেল্প করেছি এই আর কি। আচ্ছা দোস্ত তোরা কথা বল আমি আসছি। দুজন মিলে একটু প্রাইভেসি চাস এটা বললেই তো হয়। আমি কি তোরের ডিস্টার্ব করতে পারি বল? আচ্ছা আমি গেলাম।

তুষার চলে গেলে নিনিড় নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে, তোমার মতো কতো সয়তান চড়াই খাই। আর তুমি আসলো আমার লগে বিটলামি করতে।
তারপর নীলার দিকে চেয়ে বলে,
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– তো হুট করে এখানে কি মনে করে?
– বাবা তো সন্ধার পর ফিরে। একা একা বাসায় মন বসছিলো না। তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু আড্ডা দিয়ে যাই।
নিবিড় একটু হেসে বলে,
– বাসায় মন টিকবে কিভাবে? পাশের বাসায় কোনো হ্যান্ডসাম পাখি থাকলে কি মেয়ে পাখিটার বাসায় থাকতে ভালো লাগলে? ছুটে ঐ হ্যান্ডসাম পাকিটার কাছে চলে আসবে এটাই তো স্বাভাবিক।
নীলা ভ্রু-কুচকে বলে,
– আমি কি বলছি যে তোমার টানে বাসা ছেড়ে উড়াল দিয়ে এসেছি?
নিবিড় একটু ভাব নিয়ে বলে,
– আমি কি একবারও তোমার নাম বলেছি?

নীলা আর কিছু বলতে পারলো না। টপিক চেন্জ করতে নিবিড়ের গিটার টা ধরে বলে,
– তুমি খুব ভালো গিটার বাজাও। আমি এতোক্ষন ওখানে দাড়িয়ে শুনছিলাম।
নিবিড় মুচকি হেসে গুন গুন করে বলে,
– তোকে একার দেখার লুকিয়ে কি মজা, সে তো আমি ছারা কেও জানেনা।
নীলা গাল ফুলিয়ে বলে,
– মোটেও আমি তোমাকে লুকিয়ে দেখি না।
নিবিড় আবার বলে,
– আমি কি একবারও তোমার নাম বলছি? মানে চোরের মনে সব সময় পুলিশ পুলিশ।

নিবিড়ের দিকে চেয়ে নীলা আবার বলে,
– তুমি নাকি গানের কনসার্ট করো।
নিবিড় বলে,
– হুম করি তো। তবে বড় কোনো কনসার্ট না। কারণ আমি তো কোনো বড় মাপের শিল্পী না। এমনি আশেপাশের ছোটখাট গুলো করি ইনভাইট দিলে। ভালো কথা, তুমি জানলে কিভাবে?
নীলা মুচকি হেসে বলে,
– তুষার ভাইয়া বলছে। তো এখন আমাকে একটা গান শুনান না।
নিবিড় ভ্রু-কুচকে বলে,
– এখনই শোনাতে হবে?
– হুম।
– ওকে মহারানীর ইচ্ছে বলে কথা।

বলেই নিবিড় গিটার হাতে তুলে নীলার চোখের দিকে চেয়ে একটা গান ধরে,

‘আমি তোর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাই তোকে,
আমি তোর মনটা ছুয়ে স্বপ্ন নিয়ে আঁকবো যে তোকে।,
,
,
সন্ধার পর রাজকে নির্জনদের বাড়িতে ঢুকতে দেখে অবাক হলো নীলয়। একটা কাজে এদিকটায় এসেছিলো সে।
রাজ টিউশনি করায় এটা জানতো নিলয়। বাট কার মেয়েকে পড়ায় বিষয়টা নিয়ে এতো মাথা ঘামায় নি সে।
নির্জনের তো একটাই মেয়ে। আর কোনো সন্তান নেই। তাহলে কি ঐ মেয়েকেই পড়ায়? রাজকে নিয়ে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো সে।

প্রথম দিন রুশান রাজকে ঐ বাসায় নিয়ে আসা। এর পর রাজ এই বাসায় আরোহিকে পড়াতে ঢুকে যাওয়া। আবার সবাই রাজকে ক্ষেত ভাবলেও মাঝে মাঝে রুশান ও রাজের মাঝে কথা বার্তা গুলো একটু অদ্ভুত ধরনের হয়। বিষয়টা মাথায় ঢুকছে না তার। রাজ এই বাসার কারো থেকে কিছু শুনে তা রুশানের সাথে কোনো ভাবে শেয়ার করলে তো সব কিছু একটা জগা খিচুড়ির মতো হয়ে যাবে। এতো বছর ধরে এই অন্ধকার রাজ্যে জড়িয়ে থাকা। নিজে সহ নতুন করে সব সাজিয়ে তোলা। সব কিছু কি এত সহজেই শেষ হয়ে যাবে? এতোই সহজ দুনিয়া। তবে ইদানিং আশে পাশে কি ঘটছে তা নিজেই বুঝতে পারছে না সে।
বাসায় গিয়ে রাজকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে বুঝা যাবে।
,
,
ঐ দিকে রাতের রাস্তায় নীলাকে নিয়ে হাটতে বের হলো নিবিড়। নীলার বাবা ফোন দিয়ে বললো, আজ আসতে একটু দেড়ি হবে। তাই নিবিড়ের সাথে বাইরে হাটতে চলে আসে সে।

হাটতে হাটতে একটা রিক্সা এসে থামে তাদের সামনে। নিবিড়ের এক্স গার্লফ্রেন্ড নিরার সাথে আজ অনেক দিন পর দেখা। নিরা রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে নিবিড়ের কাছে এসে বলে,
– বাহ্ আরেকটা জোগাড় করে ফেললে?
নিবিড় স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– বাজে বকবে না একদম। আর তোমার এখানে কি?
পাশ থেকে নীলা ফিসফিসিয়ে বলে,
– এই মেয়ে কে?
নিবিড়ও ফিসফি তাকে বলে,
– তোমাকে বলেছিলাম না, আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড আছে। এটাই সেই শাকচুন্নি।
নীলা কিছু না বললেও মনে মনে বিরক্ত হলো খুব। নিবিড় তার বন্ধু হলেও কেন জানি এই মেয়েটাকে এই মুহুর্তে সহ্যই হচ্ছেনা তার।

পাশের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো ওরা তিনজন। নিবিড় আগে নিরার থেকে টাকা নিয়েই চলতো। সেই হিসেবে নিবিড় এখনো সেই একই ক্ষেতের মুলা। নিরা নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে, ‘আজ দেখি পকেট থেকে কত টাকা বের হয়? নতুন গার্লফ্রেন্ডের সামনে মান ইজ্জত টা কিভাবে থাকে সেটাও দেখে নিবো আমি।’

মেনু কার্ড টা হাতে নিয়ে একে একে অনেক গুলো খাবার অর্ডার করলো নিরা। সাথে পার্সেলের জন্য অনেক অর্ডার করেছে। সব গুলোর বিল আজ নিবিড়কে ধরাবে।
পাশ থেকে নীলা হা করে চেয়ে আছে নিরার কান্ডে। এই মেয়ের পেটে কি আজ রাক্ষস ঢুকেছে নাকি?

মনে অনেক চিন্তা আসলেও মুখে কিছু বললো না। খাওয়া দাওয়া শেষে দিগুন খাবার নষ্ট হলো। পার্সেলও অনেক। কম করে হলেও বিল ১০ হাজারের কম হবে না। নীলা শুধু চুপচাপ বিষয় গুলো লক্ষ করে যাচ্ছে। ভালোই বুঝতে পারছে আজ এই মেয়ে সব বিল নিবিড়ের উপর চাপাবে। নয়তো কেওই নিজের টাকা খরচ করে এতো কিছু অপচয় করবে না।

নীলা একটা বুদ্ধি খাটিয়ে নিবিড়ের দিকে চেয়ে রাগি দৃষ্টিতে বলে,
– অনেকক্ষন ধরে সহ্য করছি তোমাদের এসব কান্ড। এক্স গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসা। আবার আমাকেও সাথে নিয়ে আসছো। ভালো তো, আজ থেকে আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না তুমি। থাকো তুমি এই মেয়েকে নিয়ে। আমি গেলাম।
বলেই নীলা হগরহুর করে বের হয়ে গেলো সবার সামনে দিয়ে। হটাৎ নীলার এমন কান্ডে নিবিড়ও তাকে বুঝাতে পেছন পেছন ছুটলো। আবার কোন মসিবতে পরলো। নীলা তাকে ভুল বুঝলো না তো?

রাস্তায় এসে দাড়ালো নীলা। নিনিড় পেছন পেছন ছুটে সামনে আসলো। নিবিড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে টানা কয়েকবার স্যরি বললে নীলা হেসে নিবিড়ের হাতে হাতে তালি দিয়ে বলে,
– সিরিয়াসলি নিও না, এটা যাস্ট অভিনয় ছিলো। ঐ মেয়ে যা শুরু করছে আজ তোমাকে ফকির বানিয়ে ছারতো। তাই কৌশলে তোমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসলাম। এবার ঐ মেয়ে নিজের খাদে নিজে পড়ে মরুক। চলো আমরা কে’টে পড়ি।

To be continue………