ছায়াবর্ণ পর্ব-১৬+১৭

0
272

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৬

আজ আমাদের যাওয়ার দিন। একটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। এই গাড়িতে করেই আমরা যাবো। নদী পথেও যাওয়া যায়। কিন্তু মা ঠিক করেছেন যাওয়ার সময় স্থল পথে যাবেন আর ফেরার সময় নদী পথে আসবেন। ব্যাগ পত্র নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি আন্টি এবং আমার ওনার জন্য। আমার উনি! ভাবতেই লজ্জা পেলাম। উনি আমাকে কোনো সম্বোধন করতে মানা করেছেন। তবে সম্বোধন না করলেও চলে না। কিছুক্ষণ পরই ওনারা নেমে এলেন। মা গাড়ির মাঝের সিটে বসে বললেন–

— উঠে আয় ছায়া।

আমি উঠতে গেলেই বাঁধা দিলেন উনি। বললেন–

— আন্টি, মা ভেবেছিল আপনার সাথে গল্প করতে করতে যাবে। তাই যদি মা আর আপনি একসাথে বসতেন তাহলে ভালো হতো।

মা হাসি মুখে বললেন–

— ভাবি আপনি আমার পাশে বসুন। ছায়া তুই পেছনে বোস।

আন্টি মায়ের পাশে বসলেন। আমি তাদের পেছনের সিটে বসে পড়লাম। বমি হবার ভয়ে কিছু খাইনি। আমি জার্নিটা এনজয় করতে চাই। অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার সমস্যা। বর্ণ ভাই আমার পাশে এসে বসলেন। নেভি ব্লু শার্ট এবং কালো প্যান্ট পরেছেন। উনি যাই পরুন না কেন আমার কাছে সব সময় সুন্দর লাগে। আমার বে’হায়া চোখ ঘুরে ফিরে শুধু তার দিকেই যাচ্ছে। গাড়ি চলতে শুরু করলো। মা আর আন্টি পুরো দমে গল্প শুরু করেছেন। আমি ভেবে পাই না, এতো গল্প ওনারা কোথা থেকে নিয়ে আসেন? বর্ণ ভাই আমার পিঠের নিচ দিয়ে হাত গলিয়ে আগলে বসে রইলেন। আমি চমকে উঠে ফিসফিস করে বললাম–

— কি করছেন? মা, আন্টি দেখে ফেললে কি ভাববে?

উনি কন্ঠ নিচু করে বললেন–

— কিছু দেখবে না। দেখতে পাচ্ছ না কেমন গল্প করছে? এখন তোমাকে দশ বারোটা চুমু খেয়ে নিলেও কিচ্ছু দেখবে না।

আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললাম–

— ধুর! আপনি একটা যা তা।

উনি কিছু বললেন না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন শুধু। আমাদের যেতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম–

— একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

উনি ইশারায় সম্মতি দিলেন। আমি বললাম–

— মাত্র কটা মাসে আপনি আমাকে কীভাবে এতোটা ভালোবাসলেন যে বিয়ে করে ফেললেন?

উনি গভীর চোখে তাকালেন। আমি আগ্রহী হয়ে চেয়ে আছি ওনার জবাবের আশায়। উনি মোহময় কন্ঠে বললেন–

— আমি এখন যা বলবো সব মিথ্যে। আমি তোমাকে একটা দুটো দিন না দুটো বছর ধরে ভালোবাসিনি। সেদিন রাস্তায় আমাকে তুমি প্রথম দেখলেও আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি। তুমি যে স্কুলে পড়তে সেই স্কুলে আমি তোমায় প্রথম দেখিনি।

আমি অতিষ্ট হয়ে বললাম–

— আপনি ভালো করে বলুন। আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।

উনি নাক টেনে দিয়ে বললেন–

— মাথা মোটা তুমি। বুঝবে কি করে?

আমি মুখ ভেংচি কাটলাম। তিনি বলা শুরু করলেন–

— তোমাদের স্কুলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি কোনো কারণে উপস্থিত ছিলাম। সেদিনই তো আমার সর্বনাশ হয়েছিল। লাল টুকটুকে শাড়ি পরা মেয়েটা আমাকে ভয়ংকর ভাবে মায়ায় জড়িয়ে ফেললো। এ যে সে মায়া নয় কঠিন মায়া। এই মায়ায় এক বার জড়ালে মানুষ বের হতে পারে না। পঁচিশ বছরের আমি একটা নাইনে পড়ুয়া মেয়ের প্রেমে পড়েছি ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর। তবুও আমি পড়েছি। তার পিছু পিছু ঘুরে তার অনেক বন্ধুর থেকে তার সম্পর্কে সব জেনেছি। তখন তো সবে পড়ালেখা শেষ করেছি, সব সময় তার পেছনে থাকতাম। তার আশেপাশে থাকতাম। খুব ভয় হতো জানো তো? যদি আমার শুভ্র গোলাপকে কেউ ছোঁয়ার চেষ্টা করে? যদি আমি ভালোবাসি বলার আগেই কেউ তাকে কেড়ে নেয়? খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তার বাবা বাসা পাল্টাবেন। আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম তাকে নিজের আশেপাশে রেখে চোখে চোখে রাখার।

তিনি একটু থামলেন। লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন–

— আমাদের ফ্লাটটা খালি ছিল। আমি ছলে বলে কৌশলে তার বাবার কানে কথাটা পৌঁছে দিলাম। আর আমার পরিকল্পনা মাফিক তারা আমাদের বাড়িতে উঠলো। তারপর থেকে পুরোপুরি তার ছায়া হয়ে গেলাম। এক মুহূর্তও একা ছাড়তাম না তাকে। মাঝে মধ্যে তো কাজের নাম করেই তার সাথে এক রিকশায় বসে যেতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে কত যে তাকে দেখেছি সে বোকারানি বুঝতেই পারেনি।

আমি সতর্কতার সাথে ওনার কাঁধে মাথা রাখলাম। প্রশান্তির শ্বাস ফেলে বললাম–

— এতো ভালোবাসেন কেন আমায়?

তিনি মশকরা করে বললেন–

— কই আমি তো ভালোবাসি না। একদমই ভালোবাসি না।

আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম–

— এই ক্ষেত্রেই সব সময় আপনাকে মিথ্যে বলতে হবে?

তিনি মৃদু হেসে বললেন–

— এই ব্যাপারে আমি সারাজীবন মিথ্যে বলে যাবো।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। তার কাঁধে মাথা রেখেই পুরোটা রাস্তা চললাম।

আমাদের গ্রামটা ছোট্ট। তবে এর সৌন্দর্যের শেষ নেই। রাস্তার দু ধারে সারি সারি ধানের ক্ষেত। পাঁচ ঘণ্টা জার্নির পর আমরা পৌঁছেছি। প্রায় পুরোটা রাস্তা আমি বর্ণ ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পার করেছি। উনি চুপ চাপ আমাকে ধরে বসে ছিলাম, টু শব্দটি করেননি। মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কিছু খাবো কিনা, আমি খেয়ে এসেছি বলে কাটিয়ে দিলাম।
গ্রামে আমার নানু বাড়ি থেকে তিনটা বাড়ি রেখে আমার দাদু বাড়ি। একদমই পাশাপাশি বলা চলে। আবার আমার নানাভাই ও দাদু ভাইয়ের মধ্যে গলায় গলায় বন্ধুত্ব। তারা সেটাকে আরও গাঢ় করতে আমার বাবা মায়ের বিয়ে দিয়ে ছিলেন। আমার দুই চাচা আর দুই ফুপি আছে। তাদের সব ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমার বাবা সবার ছোট হওয়ায় আমিও সবার ছোট। বাবার গোষ্ঠীতে একমাত্র আমার বিয়েটাই বাকি আছে। কিন্তু কাউকে বলতে পারছি না সেটাও সম্পন্ন হয়েছে। দাদাভাই এর ছোট পুতিন হওয়ায় আর নানাভাই এর একমাত্র নাতনি হওয়ায় আমার আদর বরাবরই একটু বেশি। অন্যদিকে মা মেজ। মামা-মামি, চাচা-চাচি ও কম যত্ন করেন না। আমাকে মাথায় তুলে রাখেন।
গাড়ি থামতেই দুই মামাকে দেখা গেল। তারা আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তারা। গাড়ি থেকে নামতেই মাথা ঘুরে উঠলো, এতক্ষণ না খাওয়ার ফল। বর্ণ ভাই ধরে ফেললেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন–

— ঠিক আছ তুমি?

আমি মৃদু হেসে বললাম–

— হু ঠিক আছি।

তার বিশ্বাস হলো বলে মনে হলো না। এতো লোকের মাঝে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। মামারা এগিয়ে এসে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। বর্ণ ভাইকে আলিঙ্গনও করলেন। ছোট মামা একটা ব্যাগ এক হাতে নিয়ে আমার এক হাত ধরে বললেন–

— আম্মু চলো যাওয়া যাক?

আমি হেসে মাথা দোলালাম। এখান থেকে কিছু টা দূর হেঁটে যেতে হবে। এতো বড় গাড়ি নানু বাড়ি প্রর্যন্ত যাবে না। আমি আর ছোট মামা আগে আগে হাঁটছি। আর বাকিরা পেছনে। দু মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছালাম। ছোট মামা বাড়িতে ঢুকেই হাঁক ছাড়লেন–

— কোথায় সবাই? আপারা চলে এসেছে।

সবাই একে একে বের হয়ে এলো। মামিরা মায়েদের সাথে একটু কথা বলেই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বড় মামি বললেন–

— তুই আজও কিছু খেয়ে আসিসনি তাই না ছায়া? আয় কিছু খেয়ে নিবি আয়।

মা’ও তাল মেলালেন–

— হ্যাঁ ভাবি। এতো করে বললাম কিছু খেয়ে নিতে কিন্তু খেলোই না। বলে যে আমার বমি হয়ে যাবে। রাস্তায়ও কিছু খেলো না।

আমি শুকনো ঢোক গিলে বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি চোখ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি জোর পূর্বক হাসলাম। ছোট মামা ওনাকে টেনে নিয়ে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মা আর আন্টিও চলে গেলেন। তবে মামিরা আমায় ছাড়লেন না। হাত মুখ ধুইয়ে খেতে বসালেন। সবার আগে আমার খাওয়া হয়ে গেল। সবে মাত্র বারোটা বাজে। আমি খেয়ে দেয়ে সামিয়া আপুর রুমে চলে গেলাম। আপু ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি পেছন থেকে গিয়ে ‘ভো’ করে চেঁচিয়ে উঠলাম। আপু ভয়ে লাফিয়ে উঠলো। আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। আপু আমার দিকে তাকিয়ে বুকে থুথু দিয়ে বললেন–

— ছায়া তুই! আমি কতটা ভয় পেয়েছি জানিস?

আমি বিছানায় ধপ করে শুয়ে বললাম–

— ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলে কেন শুনি? জিজুর সাথে কথা হচ্ছে নাকি?

আপু লাজুক হেসে মাথা উপরনিচ দোলায়। আমি রসিয়ে বললাম–

— বাবাহ! জিজুকে খুব মনে ধরেছে দেখছি। তা এটা কি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ নাকি লাভ ম্যারেজ? হু?

আপু আমার বাহুতে মৃদু থাপ্পড় মেরে বললেন–

— মজা করা হচ্ছে আমার সাথে? এটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ’ই।

আমি হতাশ ভঙ্গি করে বললাম–

— আহা গো! অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ তাই এতো পিরিত! লাভ ম্যারেজ হলে না জানি কি হতো?

আমি মেকি ধমকে উঠে বললেন–

— ছায়া! মজা বন্ধ কর।

— কেন? লজ্জা পাচ্ছ বুঝি? আচ্ছা বাদ দাও। জিজুর ছবি তো দেখাও না কি?

আপু ফোন ঘেঁটে ছবি বের করলেন। আমি দেখলাম বেশ ভালো দেখতে। আপুর সাথেও জব্বর মানাবে। তবুও আমি মজা করে বললাম–

— এ কোন বুড়ো গো আপু? এই বুড়োকে তুমি পছন্দ করেছ? তোমার সাথে একদম মানাবে না।

আপু রেগে চিৎকার করে উঠলেন–

— ছায়া! দাঁড়া তুই!

আমি ফিক করে হেসে ফেলে, উঠে ভো দৌড় দিলাম। এখানে থাকলে আমার আর নিস্তার নেই।

চলবে..

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৭

আমার নানু বাড়ি টা এক তলা বিশিষ্ট বেশ পুরনো একটা বাড়ি। এক তলা হলেও এর আয়তন বেশ বড়। বেশ কায়দা করে নানাভাই তৈরি করিয়েছেন এটি। মোট আটটা রুম, ড্রয়িং রুম ডাইনিং রুম আলাদা। পাঁচটি রুমে অ্যাটেস্ট ওয়াশ রুম আছে, বাকি তিনটির জন্য রয়েছে কমোন ওয়াশ রুম। বর্ণ ভাইকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম, উনি মানিয়ে নিতে পারবেন কি পারবেন না? কিন্তু ওনাকে অ্যাটেস্ট ওয়াশ রুম ওয়ালা রুম দেওয়া হয়েছে দেখেই আমি একটু স্বস্তি পেলাম। এখন দুপুরে খাওয়ার সময়। রান্না ঘরের সামনেই খাওয়া দাওয়া করার জন্য বড় জায়গা। নানাভাই ইচ্ছে করেই ডাইনিং টেবিল কেনেননি। তার ভাষ্য মতে নিচে বসে খাওয়ার আলাদা মজা। পাটি বিছিয়ে নানাভাই মাঝে বসেছেন। আর তার দুপাশ দিয়ে বসেছে বাকি সদস্যরা। বড় মামা, ছোট মামা, বড় মামার ছেলে সামি- তার বয়স দশ, ছোট মামার একমাত্র মেয়ে রিনি- তার বয়স ছয়, সামিয়া আপু আর বর্ণ ভাই। আপাতত পুরুষরা আর বাচ্চারা বসেছে। মহিলারা পরে খাবে। আমার যেহেতু খাওয়া শেষ সেহেতু আমি বসে বসে দেখছি।‌ বিশেষ করে বর্ণ ভাইয়ের দিকে নজর রাখছি। উনি দুই মামার মাঝে বসেছেন। মামাদের সাথে বেশ ভাব হয়েছে ওনার। বার বার মোচড়া মুচড়ি করছেন, ওনার বসতে অসুবিধা হচ্ছে। ইশ্! আগে কোনো দিন হয়তো নিচে বসে খাননি। বড় মামা তার কাঁধ চাপড়ে বললেন–

— লুঙ্গি পরতে হবে বুঝেছ? নাহলে এভাবে প্যান্ট পরে বসে খেতে যে খুব অসুবিধা হবে তোমার।

তিনি নড়েচড়ে বসে বললেন–

— ঠিক আছে সমস্যা নেই।

খাওয়া দাওয়া শুরু হলো। মামিরা রান্না ঘর থেকে খাবার বের করছেন আর সার্ভ করছেন। এই সুবিধার্থে রান্না ঘরের সামনেই খেতে বসা হয়। বর্ণ ভাই চুপ চাপ খেয়ে যাচ্ছেন, তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি হচ্ছে না? এরই মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার হলো নানাভাই বেশ কয়েকবার বর্ণ ভাইয়ের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। এর কারণ আমি বুঝলাম না। সবার আগে ভাগে খেয়ে উঠলেন বর্ণ ভাই। মামিরা ধরে বেঁধেও তাকে আর খাওয়াতে পারলেন না। আমি সবার চোখের আড়ালে বর্ণ ভাইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে গেলাম। বর্ণ ভাই চোখের ওপর হাত আড়াআড়ি ভাজ রেখে শুয়ে আছেন। আমি নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে বসলাম। আলতো করে তার চুলে হাত রাখলাম। তিনি চোখ মেলে তাকালেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম–

— এভাবে নিচে বসে খেতে আপনার কষ্ট হয়েছে , না?

— তেমন কিছু না। জার্নি করে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। একটু ঘুম প্রয়োজন আমার। নিজে তো আরামে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলে। কি ব্যথা হয়েছে জানো? নাড়াতেও পারছি না।

আমার মায়া হলো। মিনমিন করে বললাম–

— আপনি আমাকে ডেকে দিলেই পারতেন।

ওনার স্পষ্ট উত্তর–

— ইচ্ছে করছিল না।

— ঘাড়ে কি খুব ব্যথা করছে? ওষুধ নিয়ে আসি?

উঠে যেতে নিলেই উনি বাঁধা দিয়ে বললেন–

— লাগবে না। চুল গুলো একটু টেনে দাও তো। ঘুমাবো।

আমি হালকা হাতে চুল টেনে দিতে লাগলাম। সত্যি কথা বলতে ওনার চুলে হাত বোলানো আমার প্রিয় কাজের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। খুব ভালো লাগে ওনার মশৃন চুলে হাত বুলাতে। উনি ঘুমিয়ে গেলে আমি ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
বারান্দায় বসে নানাভাই পান চিবু্চ্ছেন। আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। নানাভাই আমার মাথায় হাত রেখে বললেন–

— লঞ্চে আসোনি কেন? গাড়িতে তো তোমার কষ্ট হয়। এবার কতবার বমি করেছ?

— একবারও না নানাভাই। আমি তো সারাটা রাস্তা ঘুমাতে ঘুমাতে এসেছি। কখন সময় পার হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি।

— তোমাদের সাথে এসেছে ওই ছেলেটা কে তাহসীনা?

— উনি তো আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে। যে আন্টি এসেছে না? ওনার ছেলে। কেন নানাভাই?

নানাভাই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন–

— পান খাবা?

— আমি তো পান খাই না নানাভাই।

নানাভাই হেসে বললেন–

— ছোট বেলায় তুমি বসে থাকতে যে কখন আমি হামান দিস্তায় পান বাটবো? তারপর এসে হা করে বলতে, ‘আমি পান খাবো নানাভাই।’ পান খাওয়ার সাথে সাথেই তোমার ঠোঁট টুকটুকে লাল হয়ে যেত। একদম পাকা গিন্নি দেখাতো।

আমিও হেসে ফেললাম। সত্যিই আমি ছোট বেলায় এমন ছিলাম। এখন আর পানের ধারে কাছে যাই না।

বিকেলে ছোট মামার মেয়ে রিনিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দাদু বাড়ি চলে এলাম। নানু বাড়ি থেকে দাদু বাড়ি আয়তনে একটু ছোট। প্রথমেই বড় চাচির সাথে দেখা হলো। তিনি আমাকে দেখে গদগদ হয়ে বললেন–

— ওমা! ছায়া! কখন এসেছিস তুই?

— এই তো বারোটার দিকে এসেছি চাচিমা। এসে খেয়ে দেয়ে একটু রেস্ট নিয়েই চলে এলাম।

— খুব ভালো করেছিস। আয় বোস।

আমি বসলাম না। রিনির হাত ধরে দাদু বাড়ি প্রতিটা কোণা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রায় ছয় সাত মাস পর এসেছি। কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি, নানু বাড়িও তাই। চাচারা এখন কেউ বাড়িতে নেই, আর দাদাভাই ও নেই। নানি গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। তারও বছর দুয়েক আগে দাদি গত হয়েছেন। এক কথায় বাড়িতে কোনো কর্তী নেই। নানাভাই আর দাদাভাই এর কথাই শেষ কথা। বড় চাচার দুই ছেলে। দুজনই বিবাহিত।‌ আর ছোট চাচার দুই মেয়ে, তারাও বিবাহিত। ঘুরতে ঘুরতে বড় ভাইয়ের রুমে গেলাম। ভাবি ঘর গোছাচ্ছেন। আমি পেছন থেকে ডাকলাম–

— ভাবি!

ভাবি পেছন ফিরে হাসি মুখে বললেন–

— আরে ননদিনী! এসো।

আমি রিনিকে বসিয়ে নিজে বসলাম। ভাবির সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলাম। এরই মধ্যে ভাবি বললেন–

— তারপর বলো ভালোবাসার কাউকে পেলে?

আমি লজ্জা পেলাম। বললাম–

— ধুর ভাবি! তুমিও না!

হুট করেই বর্ণ ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। না জানি ঘুম থেকে উঠে গিয়েছেন কিনা! আমি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম–

— ভাবি, আজ আমি যাই। কাল আবার আসবো।

— কেন? থেকে যাও।

— না ভাবি আমাকে যেতে হবে। খুব দরকার।

আমি রিনির হাত টেনে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলাম। নানু বাড়ি গিয়ে বর্ণ ভাইকে আশে পাশে কোথাও পেলাম না। সামিয়া আপুকে জিজ্ঞেস করলাম–

— বর্ণ ভাইকে দেখেছ আপু?

আপু কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন–

— কে? ওই হ্যান্ডসাম ছেলেটা?

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম–

— তোমার না বিয়ে ঠিক? তো আশে পাশে এতো নজর দাও কেন?

আপু আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললেন–

— চুপ! নাম জানতাম না তাই ওভাবে বলেছি। তাছাড়া সত্যি বলতে আমার বিয়ে ঠিক না থাকলে এই বর্ণ ভাইকে ঠিক পটিয়ে নিতাম।

মনে মনে গালি দিলাম, “লুচু মহিলা! বোনের বরের দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না?” মুখে বললাম–

— তাকে দেখেছ কিনা সেটা বলো।

— হ্যাঁ দেখলাম তো। বাবা আর চাচ্চু মিলে তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেল মাঠের দিকে।

আমি এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ছুটলাম। সামিয়া আপু পেছন থেকে ডাকাডাকি করলেও শুনিনি। মাঠে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল একে অপরের থেকে। মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। বড় মামা আগে, ছোট মামা পিছে আর মাঝখানে বর্ণ ভাই। এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার কারণ হচ্ছে বর্ণ ভাই লুঙ্গি পরেছেন। অসহায় মুখে এক হাতে লুঙ্গি আঁকড়ে ধরে আছেন। আর মামাদের সাথে তাল মেলাচ্ছেন। মামারা তাকে নিজেদের ধানের ক্ষেত দেখাচ্ছেন। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ছোট মামা আমাকে দেখে বললেন–

— আম্মু দেখো তো তোমাদের এই শহরের বাবুকে লুঙ্গি পরে কেমন লাগছে? জোর করে ধরে বেঁধে পরিয়েছি।

আমি বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক হাতে লুঙ্গি ধরে। আমার ভীষণ হাসি পেল। আমি হাসি চেপে রাখতে পারলাম না, হেসে ফেললাম। বর্ণ ভাই চোখ রাঙালেন। বড় মামা বললেন–

— আহা! হাসছিস কেন? ছেলেটাকে কি ভালো টাই না লাগছে।

আমি হাসি থামিয়ে বললাম–

— হ্যাঁ হ্যাঁ খুউউব ভালো লাগছে। যেন শহরের বাবু নয় একদম গ্রামের বাবু।

বর্ণ ভাই চোখ গরম করে তাকিয়ে বোঝালেন, “আমাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে তাই না? একবার হাতে কাছে পেয়ে নিই তারপর দেখাচ্ছি মজা।” আমি শুকনো ঢোক গিললাম। বললাম–

— মামা সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে। বাড়িতে চলুন এখন। ওনাকে পরে আবার নিয়ে আসবেন।

মামারা সম্মতি দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো। তারা আগে আগে হেঁটে চলেছেন আর আমরা পেছনে। বর্ণ ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন–

— খুব মজা লাগছে, না? রাতে ছাদে আসবে। যদি না আসো তাহলে সবার সামনে টেনে নিয়ে যাবো। মনে থাকে যেন।

আমি পুনরায় ঢোক গিললাম। ব্যাটা দেখি ক্ষেপেছে। উনি আমাকে পেছনে ফেলেই মামাদের সাথে এগিয়ে চললেন। আমি আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলাম। না জানি আজ আমার কপালে কি আছে?
বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই সামিয়া আপু টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। বাইরে উঁকি মেরে বর্ণ ভাইকে দেখে বললেন–

— লুঙ্গি পরে বর্ণ ভাইয়াকে সেই লাগছে বল?

আমি বিরক্ত হলাম। আমি আছি আমার জ্বালায় আর উনি এলেন আমার বর নিয়ে টানাটানি করতে। ছাদে যেতে বুক কাঁপছে আবার বর্ণ ভাইকে বিশ্বাস নেই। যে ব্যক্তি জোর করে বিয়ে করতে পারে সে ব্যক্তি সবার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যেতেও পারে। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললাম। আজ কপালে সত্যিই দুঃখ আছে। ধুর কেন যে হাসতে গেলাম?

চলবে..