#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৪
বর্ণ ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠলাম। দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বললাম–
— দাঁড়ান প্লিজ।
বর্ণ ভাই দাঁড়িয়ে গেলেন। নিজের আশে পাশে কিছু দেখে বললেন–
— আপনি কি আমাকে বলছেন?
আমি হতাশ শ্বাস ফেলে বললাম–
— হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। আমাকে একা রেখে যাবেন না দয়া করে।
বর্ণ ভাই অবাক হওয়ার ভান করে বললেন–
— আমি কি আপনাকে চিনি? অদ্ভুত মহিলা তো আপনি! একজন পর পুরুষের সাথে যেতে চায়ছেন! মতলব কি আপনার?
আমি বুঝতে পারলাম, তখনকার সেই কথাগুলোর জন্য উনি এমন করছেন। সেই জন্যই নিজের সদ্য বিয়ে করা মানে জোর করে বিয়ে করা বউকে চিনতে পারছেন না। আমি মুখ ছোট করে বললাম–
— আমি জানি তখনকার সেই কথাগুলোর জন্য আপনি এমন করছেন। সত্যিই ওগুলো বলা আমার উচিত হয়নি। তবে আমি কি করতাম? মাথায় রাগ চেপে ছিল আমার। সেদিন ছাদে নীলা আপু আমাকে যা তা বলে অপমান করেছেন। বলেছেন আপনার থেকে দূরে থাকতে। আপনার সাথে নাকি তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এমনকি এটাও বলেছে যে আমি যদি আপনার থেকে দূরে না থাকি তবে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আমার বাবাকেও অপমান করবে। তাই আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম যেন আপনি আর আমাকে পড়াতে না আসেন। আমিও তাহলে আপনার থেকে দূরে দূরে থাকতে পারবো। আর আপনি আজ জেদ করে রাগের বশে যে কাজটা করলেন, এটা কি আদৌ ঠিক?
একটানা কথা বলে আমি থামলাম। নীলা আপুর কথা বলে দিতে বাধ্য হলাম। কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসছে। কান্না গিলে ভেজা কন্ঠে বললাম–
— এরপরও আপনার যদি মনে হয় সব দোষ আমার, সব অন্যায় আমার তাহলে তাই। আমি চলে যাচ্ছি।
বর্ণ ভাইকে রেখে আগে আগে হাঁটতে লাগলাম। চোখ থেকে নিজের অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়ছে। উনি কোনো কিছু না ভেবে না চিন্তা করে আমাকে বিয়ে করে ফেললেন! এখন কি হবে আমার? বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ উনি পেছন থেকে টেনে রিকশায় উঠিয়ে নিলেন। আমি ওনার থেকে ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করতে করতে বললাম–
— ছাড়ুন আমাকে। আপনি তো আমাকে চিনেন না। এভাবে টেনে তুললেন কেন? ছাড়ুন।
উনি দুহাত শক্ত করে চেপে ধরে গালে ঠান্ডা কিছু ছোঁয়ালেন, যে গালে উনি দাবাং থাপ্পড় মেরেছিলেন। আমি মাথা পিছিয়ে দেখলাম আইসক্রিম! কান্না জড়ানো গলায় বললাম–
— থাপ্পড় মেরে এখন দরদ দেখানো হচ্ছে? লাগবে না আপনার দরদ। এতো জোরে কেউ মারে? মুখটা বোধহয় বেঁকে গিয়েছে আমার। নি’ষ্ঠু’র লোক কোথাকার!
উনি শান্ত স্বরে বললেন–
— রাগিয়ে দিয়েছিলে আমায়। এটা তো আমাকে রাগানোর ফল।
— রেগে গেলেই চড় মেরে মুখ লাল করতে হবে! আপনি আবার কাজীকে বোকা বানিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। আমার মোটেও আঠারো বছর বয়স হয়নি। এক নম্বরের মিথ্যুক আপনি! ছাড়ুন আমায়।
আমি আবারও ছটফটানি শুরু করলাম। উনি আইসক্রিম টা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিকশার হুড তুলে দিলেন। আমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন। জায়গা পেয়ে আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম। চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে ওনার বুকের অংশের শার্ট। রিফাতের করা কাজ থেকে বিয়ে পর্যন্ত ঘটনা! আমি ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত। তিনি আমার মাথায় বিরামহীন ভাবে হাত বুলিয়ে চলেছেন। আমি এক হাতে ওনার শার্ট খামচে ধরে মুখ তুলে বললাম–
— আপনি রাগের বশে কেন বিয়ে করলেন আমায় কেন? আমার বাবা মা আপনার বাবা মা জানতে পারলে কি হবে ভেবেছেন আপনি? আর নীলা আপু! ওনার সাথে তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আপনার।
উনি ঠোঁটে এক আঙুল রেখে বললেন–
— হুশ! কোনো বিয়ে টিয়ে ঠিক নেই। ও তোমাকে মিথ্যে বলেছে। আর কিচ্ছু হবে না।
— তাহলে উনি এমন বললেন কেন? আর আপনি আমাকে যেভাবে চুপিচুপি বিয়ে করেছেন। সেভাবে চুপিচুপি ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। তাই না?
বর্ণ ভাই চোয়াল শক্ত করে বললেন–
— তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। এখন কেউ কিছু জানবে না। সময় হলে আমি বুঝবো কি করতে হবে আর কি করতে হবে না। এখন চুপ করে বসে থাকো।
আমি ওনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলাম। নিজেকে ঠিক আদুরে বিড়াল ছানা মনে হচ্ছে। আর সেই ছানাকে আগলে রেখেছেন তিনি।
—
আজ হঠাৎ করেই বর্ণ ভাই পড়াতে এসেছেন। মা তো তাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠেছেন। মা বর্ণ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন–
— তুমি এতো দিন আসোনি কেন বাবা? ছায়া কি তোমাকে কিছু বলেছে? আমি ফোন দিলেও ধরতে না।
— না আন্টি। আমি আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম। পর পর কয়েকটা ইন্টারভিউ ছিল।
— তুমি যে ভালো ছাত্র তোমার চাকরিটা ঠিকই হয়ে যাবে দেখো। আমি তো সব সময় দোয়া করি তোমার জন্য। ছায়াটা তোমার জন্যই তো ভালো রেজাল্ট করলো। তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
— আরে আন্টি! এভাবে বলবেন না। একজন টিচার হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব।
বর্ণ ভাই রুমে এসে চেয়ার টেনে বসলেন। মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বললেন–
— দরজাটা লক করে দিয়ে এসো তো।
আমি অবাক হয়ে কিছু বলতে নিলেই বললেন–
— কোনো প্রশ্ন নয়।
অগত্যা আমি উঠে দরজা লক করে দিলাম। মা দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। উনি তো আর বুঝবেন না যে আমরা স্বামি স্ত্রী দরজা লক করলেও কিছু যায় আসে না। আজ বিয়ের তিন দিন হলো। তিন দিনে ওনার দেখা পাইনি। সে জন্য একটু মন খারাপ হচ্ছিল। উনি বসা থেকে উঠে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন। আমি হতবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম–
— একি! আপনি শুয়ে পড়লেন কেন?
উনি চোখ বন্ধ করে বললেন–
— খুব ক্লান্ত আমি। মাথাটা খুব ধরেছে। একটু টিপে দাও তো। আবার এটা বোলো না যে কোন অধিকারে আমি মাথা টিপে দিতে বলছি। কোন অধিকার সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।
আমার ওনার ওপর খুব মায়া হলো। ওনার মাথার কাছে বসলাম। বসার সাথে সাথেই উনি কোলে মাথা রাখলেন। শীরদাড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। উনি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন–
— কোনো কথা বলবে না। মাথা টিপে দাও। আমি এক ঘন্টা ঘুমাবো। ঘড়ি দেখে সাড়ে আটটায় ডেকে দেবে। অনেক রাত ঘুমাতে পারিনা। একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই।
আমি তার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললাম–
— কেন ঘুমাতে পারেননি আপনি?
তিনি উত্তর দিলেন না। ভারি নিঃশ্বাসই বুঝিয়ে দিল যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। উষ্ণ নিঃশ্বাসে শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। শরীর এক প্রকার অবস হয়ে আসছে। আমি সেসবে পাত্তা না দিয়ে আলতো হাতে তার চুল টেনে দিতে লাগলাম। কতটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে লোকটাকে! দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন ঘুমান না তিনি।
—
হঠাৎ মায়ের ডাকে আমি লাফিয়ে উঠলাম। ওনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। উনি এখনও আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন। আমি ওনার দিকে এক পলক তাকালাম। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন, কে বলবে এই লোকের এতো রাগ? মা আবার ডাকলেন–
— এই ছায়া! শুনে যা।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম সাড়ে আটটা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি। কোল থেকে ওনার মাথা খুব সাবধানের সাথে বালিশে নামিয়ে রাখলাম। আস্তে ধীরে উঠে দরজা খুলে বাইরে চলে গেলাম। মা ডাইনিং টেবিলে ট্রেতে নাস্তা সাজিয়ে রেখেছেন। চা, নুডুলস্ আর মিষ্টি। মা আমাকে দেখে বললেন–
— এগুলো বর্ণের জন্য নিয়ে যা। ছেলেটা কত কষ্ট করে তোকে পড়ায়। যা।
আমি হাতে ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলাম। ট্রে টা টেবিলে রেখে দেখলাম উনি উঠে বসে আছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম–
— আপনি কখন উঠলেন?
উনি ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললেন–
— তুমি চলে যাবার পর পরই।
ওনার ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনে হার্টবিট মিস হয়ে গেল। নিজেকে সামলে বললাম–
— চোখে মুখে পানি দিয়ে আসুন। মা আপনার জন্য নাস্তা পাঠিয়েছেন।
উনি বিনা বাক্যে উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মুখে পানি দিয়ে বের হলেন। এগিয়ে এসে আমার ওড়না দিয়ে মুখ মুছলেন। আমি হতভম্ব! চেয়ারে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন–
— আজ তো পড়াতে পারলাম না। পড়াগুলো দিয়ে যাবো এবং অবশ্যই আমার পড়া রেডি চাই।
চা পান করতে করতে পড়া দিয়ে দিলেন। চা ব্যতীত আর কিছুই মুখে তুললেন না। আমি বললাম–
— নীলা আপুকে দেখি না ক’দিন। উনি কি চলে গিয়েছেন?
বর্ণ ভাই শক্ত কন্ঠে বললেন–
— হ্যাঁ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। খুব বাড় বেড়েছিল ও।
— ওনার তো কোনো দোষ নেই। উনি আপনাকে ভালোবাসে বলেই হয়তো..
বর্ণ ভাই তাচ্ছিল্য হেসে বললেন–
— ভালোবাসা! ও যত ছেলেদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল সব ভালোবাসাই ছিল! ভালোবাসার অভাব নেই তার।
বর্ণ ভাই আর কিছু না বলে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন–
— তোমার আঠারো বছর হবে কবে?
— কেন?
বর্ণ ভাই গমগমে কন্ঠে বললেন–
— যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। পাল্টা প্রশ্ন করো কেন?
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–
— নভেম্বরে।
একটু চুপ থেকে আবার বললাম–
— আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন বর্ণ ভাই?
তিনি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন–
— কি বললে? বর্ণ কি?
ওনাকে এই প্রথম হয়তো সম্বোধন করেছি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই হোক, নিজের স্বামীকে ভাই ডাকা আসলেই অদ্ভুত ব্যাপার। আমি আমতা আমতা করে বললাম–
— না মানে, বর্ণ ভাই।
— আমি তোমার ভাই?
— না, কিন্তু সবার সামনে তো ভাই-ই তাই না?
তিনি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললেন–
— আমাকে কিছু বলে ডাকার দরকার নেই। আর আজে বাজে কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।
আমার কথা শোনার অপেক্ষা করলেন না। বের হয়ে গেলেন। আমি হতাশ শ্বাস ফেললাম। কোনো প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দেন না। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করাও বৃথা।
চলবে..
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৫
বাড়িওয়ালা আন্টি ডেকেছেন। অদ্ভুত হলেও তিনি এখন আমার শাশুড়ি। মাকে বার বার করে বলেছেন আমাকে যেন পাঠিয়ে দেন। এই খবর তিনি বর্ণ ভাইকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। এখন সাড়ে আটটা বাজে, বর্ণ ভাইয়ের পড়ানো শেষ। তার সাথেই এসেছি। প্রবেশ করার সময় বর্ণ ভাই কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন–
— শশুর বাড়িতে তোমাকে স্বাগতম।
আমি হা করে তাকাতেই উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে গেলেন। আমাকে দেখে আন্টি বললেন–
— এসো ছায়া। আজ তোমার আংকেল বাড়িতে নেই বুঝলে? তাই ডাকলাম তোমাকে ডিনারে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। আর তুমি তো আসোই না, আমি কিন্তু রাগ করেছি।
আমি হেসে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বললাম–
— স্যরি সুইট আন্টি। এবার থেকে সময় পেলেই আসবো আর দুজনে খুব গল্প করবো।
আন্টি হেসে ফেললেন। দুজনে সোফায় বসে গল্পে মেতে উঠলাম। আন্টির যত গল্প জমানো আছে সব একে একে বলছেন। এরই মধ্যে বর্ণ ভাই রুম থেকে বের হয়ে এলেন। ফোন হাতে নিয়ে আমার সোজাসুজি সিঙ্গেল সোফাতে বসলেন। আন্টি বললেন–
— কিরে! তুইও আমাদের সাথে গল্প করবি নাকি?
বর্ণ ভাই ফোন চালাতে চালাতে বললেন–
— না, তোমাদের মতো গল্প পাগল নই আমি। রুমে বোর হচ্ছিলাম তাই এসেছি।
আন্টি আমার দিকে ফিরে বললেন–
— একবার কি হয়েছিল শোনো। ছোট বেলায় বর্ণের সামনের দুটো দাঁত একসাথে পড়ে গিয়েছিল। যখন দাঁত বের করে হাসতো তখন কি যে দেখাতো ছায়া! আমরা ছেলের হাসি দেখেই হেসে ফেলতাম। আর ও সবার সামনে যেয়ে দাঁত দেখিয়ে হাসতো। পুরোনো দাঁত পড়ে নতুন দাঁত উঠবে সেই আনন্দে হেসে বেড়াতো। আর যখন কথা বলতো তখন দাঁতের মাঝ দিয়ে কথা ফসকে যেতো। আর এখন দেখো সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে পড়ে থাকে।
আন্টির কথায় আমি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। ওনার ছোট বেলার গল্প শুনে খুব মজা লেগেছে। বর্ণ ভাই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বললেন–
— ক্ষুধা লেগেছে মা।
বলেই উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। আন্টি উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে এগোতে বললেন–
— সেকি! এতো তাড়াতাড়ি?
— হ্যাঁ খেয়ে ঘুমাবো।
আন্টি আমাকেও ডেকে বসতে বললেন। আমি একটা চেয়ার টেনে বসতে গেলেই বর্ণ ভাই হালকা কেশে আমাকে ইশারা করে নিজের সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। আন্টি ব্যস্ত থাকায় সেটা দেখতে পেলেন না। আমি বোকার মতো ওনার সামনে বসলাম। আন্টি খাবার সার্ভ করতে করতে বললেন–
— জানো ছায়া? এ কদিন ইন্টারভিউ এর জন্য দিন রাত এক করে পড়েছে। খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করতো না। দরজা বন্ধ করে পড়তো। পর পর সাত জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছে। এখন একটা চাকরি জুটলেই হয়।
আমি ওনার দিকে তাকালাম। এই জন্যই কি লোকটা ঘুমাতে পারেনি? আন্টি আমাকে সার্ভ করে দিয়ে নিজে বসলেন। খাবার মুখে দিতেই হোঁচট খেলাম। আমার পা কেউ পা দিয়ে চেপে ধরেছে। আমি চোখ রসগোল্লার আকার করে বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি স্বাভাবিক ভাবে খেয়ে চলেছেন। দেখে বোঝার উপায় নেই। আমার গলায় খাবার আটকে আসছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছি না। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি পাত্তা দিলেন না। আমি পানি দিয়ে বহু কষ্টে খাবার গিললাম। বললাম–
— আন্টি আমার খাওয়া শেষ। বেসিন টা কোন দিকে?
আন্টি অবাক হয়ে বললেন–
— ওমা! তুমি তো কিছুই খেলে না ছায়া।
— আমার পেট ভরে গিয়েছে আন্টি আর পারবো না।
আন্টি আমাকে বেসিন দেখিয়ে দিলেন। বর্ণ ভাই পা ছেড়ে দিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে হাত ধুতে গেলাম। আমার হাত ধোয়ার পর পরই বর্ণ ভাই হাত ধুতে এলেন। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম–
— আপনি ওভাবে আমার পা ধরেছিলেন কেন?
তিনি হাত ধোয়া শেষে তোয়ালে থাকা সত্ত্বেও আমার ওড়নায় হাত মুছলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন–
— আমি? কখন? তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?
চুপসে গেলাম। আমার কাছে তো কোনোও প্রমাণ নেই। তিনি এক হাত কোমরের পাশ গলিয়ে হেঁচকা টান মারলেন। আমি হুমড়ি খেয়ে ওনার বুকের ওপর পড়লাম। দুহাত ওনার বুকে ঠেকিয়ে বড় বড় চোখে তাকাতেই উনি টুপ করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনি বললেন–
— আমি তোমাকে চুমু খেয়েছি? কোনো প্রমাণ আছে?
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। থরথরিয়ে কাঁপতে লাগলাম। তিনি কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন–
— আমি সম্পূর্ণ বৈধ ভাবে তোমাকে ছুঁয়েছি। আমি কিন্তু তোমাকে অপবিত্র করিনি। আমার এই শুভ্র গোলাপকে আমি কখনও অপবিত্র করতে পারি না। কখনও না।
মনের মধ্যে ভালো লাগা খেলে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। উনি আবারও বললেন–
— একটা মিথ্যে কথা বলবো?
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। তিনি ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন–
— আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
আমি চমকে তাকালাম। কম্পিত কন্ঠে বললাম–
— ক কি বললেন?
— আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
উনি মিথ্যে বলছেন। তার মানে উনি আমাকে! আমি লজ্জায় নুইয়ে পড়লাম। ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উল্টো ঘুরে ছুটলাম। পিছু থেকে ভেসে এলো ওনার মৃদু হাসির শব্দ। গোমড়া মুখো লোকটার হাসি দেখতে পেলাম না, আমি তো মুখ লুকাতে ব্যস্ত।
—
মামাতো বোন সামিয়া আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার বড় মামার মেয়ে তিনি। এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছেন। বিয়ের কথা শুনতেই আমি বাকবাকুম হয়ে উঠলাম। বিয়ে মানেই মজা! আর সামিয়া আপুর বিয়ে তো আরও মজা হবে। আপু আমার বোন কম বন্ধু বেশি। বাবা মা এখন আলোচনা করছেন কবে যাবেন কি যাবেন না। আমি বাবার এক হাত জড়িয়ে ধরে তার পাশে বসে আছি। মা বললেন–
— আমার বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আমি কিন্তু আগে ভাগে যাবো বলে দিলাম। আমাদের বংশের প্রথম বিয়ে!
বাবা ভ্রু কুঁচকে বললেন–
— তোমাদের বংশের প্রথম বিয়ে! তাহলে আমরা পর’কি’য়া করছি নাকি?
আমি ঠোঁট চেপে হেসে ফেললাম। জোরে হাসলেই এখন বিপদ। মা মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন–
— আমি বলতে চাইছি আমাদের তিন ভাই বোনের ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিয়ে। সব কিছু কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
— হ্যাঁ তা তো বলতেই হবে। আমি আবার একটু বুঝি কম।
আমি ভাবলাম আপুর আগে আমি বিয়ে করে ফেলেছি। বিয়ে করে ফেলেছি বলাটা ভুল, আমাকে জোর করে বিয়ে করা হয়েছে। এটা জানতে পারলে মায়ের রিয়্যাকশান কি হবে সেটা দেখারই অপেক্ষা। মা বললেন–
— আমি পাঁচ দিন আগেই যাবো কিন্তু ছায়ার বাবা।
— আচ্ছা বেশ যেও। আমার ছুটি হবে না। আমি নাহয় দুই দিন আগে যাবো।
মা সম্মতি দিলেন। কিছু ভেবে বললেন–
— বাড়িওয়ালা ভাবিদের দাওয়াত দিলে কেমন হয়? ভাবির সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে।
— তোমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে তুমি জানো।
মা ক্ষেপে গিয়ে বললেন–
— কি বলতে চাইছেন আপনি? আমার ভাইয়ের মেয়ে আপনার কিছু হয় না?
— আরে বাবা! আমি সেটা বলিনি। ঠিক আছে, তুমি ওনাদের দাওয়াত দাও। খুব ভালো হবে।
মা গদগদ হয়ে আমাকে নিয়ে চললেন তাদের দাওয়াত দিতে।
মায়ের দাওয়াতের কথা শুনে আন্টি বললেন–
— অবশ্যই যাবো ভাবি। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না জানেন তো? এবার বিয়ের ছুতোয় বাইরে থেকে একটু ঘুরেও আসা যাবে।
মা খুশি হয়ে বললেন–
— খুবই ভালো হবে ভাবি। আমাদের গ্রাম আপনার খুব ভালো লাগবে। বাবা বর্ণ! তুমি যাবে তো?
বর্ণ ভাই পাশেই বসে ফোন চাপছিলেন। মুখ খুলে কিছু বলার আগেই আন্টি ব্যাগড়া দিয়ে বললেন–
— আরে ও যাবে না মানে! এখন তো শুয়ে বসেই আছে। কদিন ঘুরে এলে ও’রও ভালো লাগবে। আর এতোটা পথ, আমাদের সাথে ও গেলে ভালো হবে। আপনার ভাই নাহয় ছায়ার বাবার সাথেই যাবে। আমরা আগে চলে যাবো। বিয়ে কবে?
— এই তো দশদিন পর। আমরা পাঁচ দিন আগেই যাবো।
— বেশ হবে। আপনাদের গ্রামটাও ঘুরে দেখতে পারবো।
দুজনে মিলে গল্প জুড়ে দিলেন। এক ফাঁকে বর্ণ ভাই ইশারা করে ওনার পিছু পিছু যেতে বললেন। আমি মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠে গেলাম। ওনার পিছু পিছু ছাদে চলে এলাম। থালার মতো চাঁদ উঠেছে। উনি আমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললেন–
— তোমার মা দেখি জামাই সহ বেয়াই বেয়াইনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম–
— কচু! উনি তো আর জানেন না যে ওনার মেয়েকে আপনি জোর পূর্বক বিয়ে করে নিয়েছেন।
বর্ণ ভাই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। চাঁদের আলোয় তা দেখে এক প্রকার থমকে গেলাম। এতো সুন্দর তার হাসি! উনি বললেন–
— কিন্তু আমি যে যেতে পারবো না।
মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে বললাম–
— যাওয়া লাগবে না। আমি কে যে আপনি যাবেন? ছাড়ুন আমাকে।
উনি হাতের বাঁধন আরও মজবুত করলেন। নাকে নাক ঘষে বললেন–
— আচ্ছা আমি যাবো। কিন্তু তোমাকে খুব জ্বালাবো। যদি রাজি থাকো তাহলে বলো।
অস্ফুট স্বরে বললাম–
— এক মুহুর্ত আপনাকে না দেখে থাকার চেয়ে আপনি আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিন, সব মেনে নেবো।
উনি আবারও হাসলেন, সেই মনোমুগ্ধকর হাসি। আমার বলতে ইচ্ছে হলো, “আপনি সব সময় হাসবেন। তবে শুধু আমার সামনে। আপনার হাসিতে আমি মুগ্ধ হবো। আর কেউ না। কেউ না।”
চলবে..