ছায়াবর্ণ পর্ব-৬+৭

0
299

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৬

— এই ছায়া! আমার ক্রাশ তোর সাথে রিকশায় কি করছিল রে? সত্যি করে বল, তুই আবার আমার ক্রাশকে পটিয়ে ফেলিসনি তো?

আমি হতাশ শ্বাস ফেলে রানির দিকে তাকালাম। রানির কাছ থেকে এমনটাই আশা করা যায়। কি দেখে যে একে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বানিয়ে ছিলাম কে জানে? বর্ণ ভাই রোজ আমার সাথে রিকশা শেয়ার করেন। ওনার কোথায় কি কাজ থাকে সেখানে যান। রানি আজ সেটাই দেখে আমাকে ওই কথাটা বললো। আমি এটা বুঝি না রোজ রোজ আমার সাথে যাওয়ার মানেটা কি? আর রোজ রোজই বা আমার থেকে পুরো ভাড়া কেন নেওয়া হয়? লজ্জায় ওনাকে কিছু বলতেও পারি না। বললেই দেখা গেল সবার সামনে লজ্জা দিয়ে বসলেন। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম–

— আচ্ছা? আপনি রোজ রোজ আমার সাথে যান কেন? প্রতিদিনই কি আপনার কাজ থাকে?

তিনি হালকা কেশে বলেছিলেন–

— হ্যাঁ, প্রতিদিন আমার কাজ থাকে। তাই আমি যাই।

— তাহলে আমার সাথেই কেন যেতে হয়? আপনি আলাদা রিকশা নিয়ে যেতে পারেন না?

তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বরাবরের মতই মাথা নিচু করে নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন–

— রিকশা কি তোমার শশুরের?

কন্ঠে তার রাগ। আমি মাথা দুপাশে নাড়িয়ে মিনমিন করে বলেছিলাম–

— না।

— তাহলে আমি যে রিকশায় যাই না কেন তোমার সমস্যা কোথায়? আমার ইচ্ছে। তুমি তো একা একাই যাও, আমার সাথে রিকশা শেয়ার করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

আমি আর কিছু বলিনি। যুক্তিতে তাকে কখনও হারানো সম্ভব নয়।
রানির ঝাঁকুনি তে আমি বাস্তবে ফিরলাম। সে আমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল–

— এই! আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি না? বোবা ভুতে ধরলো নাকি তোকে? চুপ করে আছিস কেন?

আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললাম–

— ক্রাশ কার?

— অবশ্যই আমার।

— তাহলে তুই গিয়েই জিজ্ঞেস কর না। বক বক করে আমার কানের মাথা খাস না। আমি বাসায় যাচ্ছি।

রানিকে ফেলে রেখে এগোতে লাগলাম। তোর ক্রাশ তুই গিয়ে বোঝ। আমি মরছি আমার জ্বালায় আর উনি আসলেন ওনার ক্রাশ নিয়ে। রানি পেছন থেকে দৌড়ে এসে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল–

— আরে ছায়া। তুই রাগ করছিস কেন? আমি তো এমনি এমনি বললাম।

আমি ওর কথার কোনো জবাব দিলাম না। রানি মুখ কালো করে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ এলো।

— হেই কিউটি!

আমি ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালাম। পর মূহুর্তে ভ্রু যুগল শিথিল হয়ে এলো। প্রফুল্ল কন্ঠে বললাম–

— আরে আফীফ ভাইয়া! কেমন আছেন আপনি? কতদিন পর আপনার সাথে দেখা।

আফীফ ভাই এক গাল হেসে এক পা এগিয়ে এসে উত্তর দিলেন–

— আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

মনে মনে বললাম,” আপনার খাটাশ বন্ধু ভাবো থাকতে দিচ্ছে কই? সব সময় পেছনে লেগেই আছে। কদিন পর তো তাকে কাঁঠালের আঠা নামক এওয়ার্ড দেওয়া হবে।” মুখে বললাম–

— আমিও ভালো আছি ভাইয়া। আপনাকে এতো দিন দেখিনি কেন? কোথায় ছিলেন?

— দেখবে আর কি করে? পড়ালেখা শেষ করেছি তিন বছর হলো। এই তিনটা বছর শুয়ে বসেই আছি। এখন আর কিছু না করলেই নয়। তাই চাকরির জন্য ছোটাছুটি করলাম কদিন।

— চাকরি হয়েছে ভাইয়া?

— হ্যাঁ। তোমাদের দোয়ায় ব্যাংকে চাকরি হয়ে গিয়েছে।

আফীফ ভাই একদম আমার নিজের ভাইয়ের মতো। আমাকে খুব স্নেহ করেন। ওনার চাকরির খবর শুনে খুশিতে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বললাম–

— এটা তো খুব খুশির খবর। মিষ্টি খাওয়াবেন না?

আফীফ ভাই পুনরায় হাসলেন। বললেন–

— অবশ্যই খাওয়াবো। কবে খাবে বলো?

— যেদিন আপনার সময় হবে সেদিন।

পর মূহুর্তে বর্ণ ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। উনিও তো পড়ালেখা করে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম–

— ইয়ে মানে ভাইয়া, বর্ণ ভাই চাকরি করবেন না?

আফীফ ভাই রসিকতার সাথে বললেন–

— বর্ণ তোমার ভাই নাকি?

আমি ভাবুক হয়ে বললাম–

— আপনাকে তো ভাইয়া বলি। আবার বর্ণ ভাই আপনার বন্ধু। তো তিনি আমার ভাই-ই হবেন, তাই না?

আফীফ ভাই ঠোঁট টিপে হেসে বললেন–

— হ্যাঁ ঠিক বলেছ।

অতঃপর বিড়বিড় করে বললেন–

— তোমার মুখ থেকে ভাই ডাক শুনে ওর কি হাল হবে কে জানে?

আমি শুনতে না পেয়ে বললাম–

— কিছু বললেন ভাইয়া?

— বলছিলাম যে বর্ণ চাকরি বাকরি করতে চাই না। বাপের ঘাড়ের ওপর বসে খেতে চায়। তবে তুমি একবার বলে দেখতে পারো।

আমি চমকে উঠে বললাম–

— আমি বলবো কেন?

— আরে বলেই দেখো একবার। আর আগামীকাল ট্রিট দেবো। তুমি তোমার পাশের হাওয়া হাওয়ায়ী কে নিয়ে কলেজ শেষে কলেজের সামনে দাঁড়িও। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। এতক্ষণ রানি চুপ করে ছিল। এখন সে মুখ খুললো–

— এই! আপনি কি বললেন?

— আমি আবার কি বললাম?

— আপনি আমাকে হাওয়া হাওয়ায়ী বললেন।

— আসলে তোমাকে দেখলেই মনে হয় তুমি বাতাসে উড়ে যাবে। তাই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল আর কি।

রানি ফুঁসে উঠে বলল–

— আপনি সেই প্রথম দিন থেকেই আমাকে অপমান করে যাচ্ছেন। আমি মোটেও এতোটা রোগা নই।

আফীফ ভাই ফিক করে হেসে দিলেন। যেন রানি খুব মজার জোকস্ বলেছে। হাসি থামিয়ে বললেন–

— বিয়ের পর খুব ভুগতে হবে। আমার কথা মিলিয়ে নিও, শুধু আফসোস করবে যে আমি আর একটু মোটা কেন হলাম না?

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–

— তাহলে ছায়া ওই কথাই থাকলো। দাঁড়াবে কিন্তু।

আফীফ ভাই চলে গেলেন। রানি চাপা ক্রোধে দাঁতে দাঁত চেপে বলল–

— তুই দেখে নিস ছায়া ওই ব্যাটার বউ আমার মতোই রোগা হবে। আর দিন রাত ওনার চুল ছিড়ে টাকলা বানিয়ে ফেলবে।

আমি হাসলাম। কল্পনা করলাম রানির সাথে আফীফ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে আর সে বসে বসে তার মাথার চুল ছিঁড়ছে! নিজের কল্পনার কথা ভেবেই জোরে হেসে ফেললাম। আর রানি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল।

সময়টা সন্ধ্যার পর। এমনিতেও আমি পড়ি না, আজ আর পড়তে ইচ্ছেও করছে না। আম্মুর সাথে গল্প করে মজা নেই। সে আমার কোনো কথাই ভালো করে শোনেন না। ভাবলাম বাড়ি ওয়ালা আন্টি দের বাসায় একবার গেলে কেমন হয়? এখন নিশ্চয়ই কেউ বাড়িতে নেই। এমনকি বর্ণ ভাইও না। আমি মায়ের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম। মা বাবার জামা কাপড় গুছিয়ে রাখছেন। আমি ডাকলাম–

— মা?

মা কাজ করতে করতেই জবাব দিলেন–

— বল।

— আমি একটু বাড়ি ওয়ালা আন্টির কাছে যাই?

— তোর পড়ালেখা নেই ছায়া? এখন শুধু শুধু আন্টিকে জ্বালাতে যাবি কেন?

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–

— আমি মোটেও জ্বালাতে যাই না মা। আন্টি আরও আমাকে যেতে বলেছেন। আমি একটু যাই মা? যাবো আর চলে আসবো।

— আচ্ছা যা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।

আমি আর দাঁড়ালাম না। মাথায় ওড়না টেনে দিয়ে বের হয়ে গেলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালাম। আন্টি দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন–

— আরে ছায়া! এসো এসো।

আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। আন্টি দরজা লক করে দিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলেন। আমিও বসলাম। আন্টি বলা শুরু করলেন–

— কেমন আছো বলো?

আমি হেসে বললাম–

— একদম ফার্স্ট ক্লাস। আপনি কেমন আছেন?

— আমিও ভালো আছি। তুমি এসেছো এখন আরও ভালো লাগছে। বাপ ছেলে থাকে নিজেদের মতো। আমি একদম একা হয়ে থাকি।

আন্টি আমাকে পেলে যে কি খুশি হন তা ওনার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। আন্টি আমার সাথে বিভিন্ন গল্প শুরু করলেন। যেমন: ওনার আর আংকেলের বিয়ের গল্প। আংকেলের বাড়ি থেকে ওনাকে দেখতে গিয়েছিল। তারপর আংকেল এক দেখাতেই কাত হয়ে গিয়েছেন। আন্টি ছাড়া তিনি আর কাউকে বিয়ে করতে চাননি। আন্টি যে এতো সুন্দরী ছিলেন যে আংকেল পুরো ফিদা হয়ে গেছিলেন। আমি বললাম–

— আপনি এখনও অনেক সুন্দর আন্টি। যদি বলেন আপনার জন্য আবার ছেলে দেখি?

আন্টি হেসে আমার কান আলতো ভাবে টেনে ধরে বললেন–

— তুমি দেখি ভারি দুষ্টু ছায়া!

— একটু আধটু দুষ্টুমি না করলে কি আর মজা হয় বলুন তো?

— হ্যাঁ ঠিক বলেছো। তোমার মতো থাকতে কত দুষ্টুমি করেছি। এমনকি বিয়ের পরও করেছি। তোমার আংকেল কে নাকানিচুবানি খাওয়াতে আমার বেশ লাগতো।

আন্টি আর আমি খুব হাসলাম। আন্টি হাসি থামিয়ে বললেন–

— ছায়া তুমি বসো, আমি তোমার জন্য চা করে নিয়ে আসি।

আমি বারণ করা সত্ত্বেও আন্টি শুনলেন না। রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি বসে রইলাম। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেল। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেল। আন্টি রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন–

— ভয় পেও না ছায়া। আমি আসছি।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধকারে আমি ভয় পাই না। তবুও একটু হাতিয়ে দেখি কাছে কিছু পাওয়া যায় কিনা। নাহয় আন্টির কাছে এগিয়ে যাই ধীরে ধীরে।

চলবে..

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৭

অন্ধকারে এগোনো চারটি খানি কাজ নয়। আমি তো আর বিড়াল নই যে চোখ জ্বালিয়ে অন্ধকারে হাঁটব। এগোতে নিলেই টেবিলে লেগে পড়ে যেতে নিলাম। তখনই বলিষ্ঠ কোনো হাত চেপে ধরলো আমার বাহু। হেঁচকা টানে একদম তার কাছে নিয়ে গেল। নাকে ঠেকলো মাতাল করা সুগন্ধ। এমন পারফিউম আমি আগেও পেয়েছি। তবে কোথা থেকে পেয়েছি মনে পড়ছে না। কে ধরে আছে আমাকে? হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে নিলেই এক হাত দিয়ে আমার দুহাত বন্দী করে ফেললো। খুব দেখার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। এখন ইচ্ছে করছে বিড়াল হতে। যদি বিড়াল হতে পারতাম তাহলে হয়তো দেখতে পেতাম। একটা হাত আমার ঠোঁটে আলতো স্পর্শ করলো। শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এ কেমন শীতল হাত! কিছুক্ষণ পর আমার আশে পাশে আর কারোর অস্তিত্ব অনুভব করলাম না। বিদ্যুৎ চলে আসলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমি ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। দূর দূরান্তে কেউ নেই। আন্টি চা আর বিস্কুট এনে টেবিলের ওপর রেখে বললেন–

— দাঁড়িয়ে আছো কেন? অন্ধকারে আবার ভয় টয় পাওনি তো?

আমি ধপ করে বসে বললাম–

— না আন্টি। এমনি দেখছিলাম হাতের কাছে কোনো টর্চ বা অন্যকিছু পাই কিনা।

— আচ্ছা ঠিক আছে। খাও এখন।

আমি চায়ের কাপ হাতে নিলাম। তখন ঠিক কি হয়েছিল আমার সাথে? সবটাই কি আমার কল্পনা ছিল? এখানে তো আন্টি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। আর দরজাও লক করা। তাহলে? এমন বাস্তবের মতো কল্পনা কীভাবে সম্ভব? স্পর্শ গুলো একদম জীবন্ত ছিল। আর আমার ঠোঁট! ঠোঁটে হাত দিলাম। এখানেও তো ছুঁয়ে ছিল। কি অদ্ভুত! এমন জীবন্ত কল্পনাও হয়?

কলেজ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি রানি আর আমি। রানি তো কিছুতেই যাবে না। তার এক কথা, “ওই ক্যাবলা কান্তর সাথে আমি যাবো না। আমাকে কি অপমান টাই না করলো। আমি কিছুতেই যাবো না।” আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম যে–

— আরে রানি, আমার কথা শোন। আফীফ ভাই তো তোকে অপমান করেছে তাই না? তুইও আজ ইচ্ছে মতো ওনার টাকা উড়িয়ে শোধ নিবি। আমার বুদ্ধিটা কেমন বল?

রানির আমার কথা মনে ধরলো। অতঃপর সে এক পায়ে রাজি হয়ে গেল। আজ সে আফীফ ভাইকে নাকানিচুবানি খাইয়েই ছাড়বে। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার কিছুক্ষণ পর আফীফ ভাই আসলেন। স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বললেন–

— তোমরা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছ নাকি?

আমি বললাম–

— না ভাইয়া। আমরা কিছুক্ষণ হলো দাঁড়িয়েছি।

— ঠিক আছে। চলো তাহলে যাওয়া যাক?

আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলাম। আফীফ ভাই এগিয়ে গেলেন পিছু পিছু চললাম আমরা। কিছুদূর যেয়ে আফীফ ভাই একটা রিকশার পেছন থেকে দেখিয়ে বললেন–

— তুমি ওটাতে যাও। এই হাওয়া হাওয়ায়ী কে নিয়ে আমি আসছি।

রানি বেঁকে বসে বলল–

— না! আমি আপনার সাথে এক রিকশায় কিছুতেই যাবো না। আমি ছায়ার সাথে যাবো।

রানি এগোতে নিলেই আফীফ ভাই তার হাত চেপে ধরে বললেন–

— ছায়া তুমি যাও। আসলে কি বলো তো? তোমার বান্ধবীর সাথে আমার কিছু কথা আছে। তুমি যাও।

আমি অসহায় হয়ে এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে রানি চেঁচাচ্ছে–

— ছায়া! আমাকে রেখে যাস না। এই! ছাড়ুন আমাকে। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ক্যাবলা কান্ত কোথাকার। ছাড়ুন বলছি।

আফীফ ভাই রানির কোনো কথা কানে না তুলে তাকে টানতে টানতে নিয়ে রিকশায় উঠলেন। রিকশায় উঠতে গিয়েই চকমে উঠলাম। বিস্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গেল। রিকশায় বসে থাকা ব্যক্তি ভাবলেশহীন ভাবে বললেন–

— মুখ বন্ধ করো। মাছি ঢুকবে।

আমি হকচকিয়ে গিয়ে মুখ বন্ধ করে নিলাম। ছলছল চোখে সামনে তাকিয়ে দেখলাম আফীফ ভাইদের রিকশা ইতোমধ্যে অনেকটা চলে গিয়েছে। আফীফ ভাই কাজটা ঠিক করলেন না। আপনার কপালে হাওয়া হাওয়ায়ী জুটবে দেখে নিয়েন। ঝংকার তোলা পুরুষালী কন্ঠ আমায় ভাবনার জগৎ থেকে টেনে বের করলো।

— তুমি কি যাবে? যদি যেতে চাও তাহলে ওঠো, নাহলে আমি চলে যাচ্ছি।

আমি মুখ কালো করে উঠে বসলাম। ওনার সাথে এক রিকশায় বসতে গেলে ওনার গা ঘেঁষে বসতে হয়। রিকশার অর্ধেকের বেশি বর্ণ ভাইয়ের সুঠাম দেহ দখল করে আছে। আমি যত পারছি চেপে বসছি। হঠাৎ কোমরে শীতল স্পর্শে শিউরে উঠলাম। উনি কোমরে এক হাত চেপে টেনে নিলেন। সামনে তাকিয়ে থেকে বললেন–

— আবোল তাবোল কিছু ভেবো না আবার। যেভাবে বসেছিলে একটু ধাক্কা লাগতেই রাস্তায় আছাড় খেতে। আর লোকে ভাবতো আমি তোমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। সো নিজের সেফটির জন্য আমাকে এমনটা করতে হলো।

ওনার কথা তো বুঝলাম। কিন্তু এদিকে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষ এভাবে স্পর্শ করলে ঠিক কেমন লাগতে পারে? হোক সেটা পরিস্থিতির কারণে।

একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে রিকশা থামলো। উনি নিজের হাত সরিয়ে নিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে নেমে পড়লাম। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভাড়া দেবো নাকি দেবো না? বলা তো যায় না, উনি যদি আবার লজ্জা দেন? ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে নিলেই উনি বললেন–

— তোমার কি আমাকে এতোটা গরিব মনে হয় যে আমি একটা রিকশা ভাড়া প্রর্যন্ত দিতে পারবো না?

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম–

— এ কথা আমি কখন বললাম?

— এই যে তুমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছিলে, এটাতে সেই কথাই প্রমানিত হয়।

কি মুশকিল! টাকা দিলে দোষ না দিলেও দোষ। আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি ভাড়া মিটিয়ে এগোতে লাগলেন। আমাকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–

— আপনাকে কি ভেতরে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিতে হবে জনাবা?

ওনার উপহাসের কথা শুনে তীব্র আক্রোশ জন্মালো। গটগটিয়ে হেঁটে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেরতে গিয়ে দেখলাম কোণের একটা টেবিলে রানি এবং আফীফ ভাই বসে আছেন। আমি সেখানে গিয়ে রানির পাশে ধপ করে বসে বললাম–

— আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারলেন আফীফ ভাই?

হঠাৎ প্রশ্নে আফীফ ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন–

— কি করেছি আমি?

— আপনি ওই অসভ্য লোকটার সাথে এক রিকশায় আমাকে পাঠিয়ে দিলেন? কাজটা আপনি একদম ঠিক করেননি।

— বর্ণ তোমাকে কিছু করেছে নাকি?

আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম–

— ওই লোক পারে শুধু আমাকে হেনস্থা করতে। ইচ্ছে তো করে..

— কি ইচ্ছে করে জনাবার?

অতি আবেগে ভেসে গিয়ে যেসব বলছিলাম এই একটা কন্ঠে তা আমার বন্ধ হয়ে গেল। বর্ণ ভাই আফীফ ভাইয়ের পাশে আমার মুখোমুখি বসলেন। আবারও বললেন–

— কি হলো বলো? তোমার দেখি অনেক ইচ্ছে। আমরাও একটু শুনি।

আমি মাথা নিচু করে নিলাম। উনি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, যে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাবার ক্ষমতা আমার নেই। আফীফ ভাই বললেন–

— আরে বর্ণ ছাড় তো। ছায়া কি খাবে বলো? তোমাদের তো আবার বাড়িতেও ফিরতে হবে তাই না?

আমি রানিকে খোঁচা দিলাম। সে বলল–

— আচ্ছা শুনুন।

আফীফ ভাই বাঁধা দিয়ে বললেন–

— তোমার কাছে শুনতে চেয়েছি? ছায়া তুমি বলো।

রানি আঙুল উঁচিয়ে বলল–

— দেখুন! একে তো রিকশায় করে জোর করে এনেছেন আবার বক বক করে আমার মাথা খেয়েছেন। আবার আমার..

রানি থেমে গেল। আফীফ ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললেন–

— হ্যাঁ আবার তোমার? তারপর?

রানি ইতস্তত করতে লাগলো। আফীফ ভাই আবারও বললেন–

— কি হলো বলো?

— আপনি আমাকে আঙুলে কামড়ে দিয়েছেন। বিলাই কোথাকার!

আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। এদিকে বর্ণ ভাই নিজের ফোনে ব্যস্ত, এখানে যে কিছু হচ্ছে সে খেয়াল তার নেই। আফীফ ভাই রানির উঁচু করা আঙুল ধরে কুটুস করে কামড়ে দিলেন। রানি আর্তনাদ করে উঠলো–

— আহ্! আপনি আবার কামড়ে দিলেন? আসলে আপনি শুধু বিলাই না, আপনি হলেন একটা জংলি বিলাই।

— তুমি যত বার এভাবে আঙুল উঁচু করবে তত বার আমি কামড়ে দেবো।

রানি চুপ হয়ে গেল। আফীফ ভাই নিজের পছন্দ মতো অর্ডার দিলেন। আফীফ ভাই আর আমি গল্প জুড়ে দিলাম। রানি মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। আর বর্ণ ভাই? তিনি ফোন নিয়েই ব্যস্ত। কোন গার্লফ্রেন্ড এর সাথে চ্যাট করছেন কে জানে? খাবার চলে এলো। চিকেন ফ্রাই, নুডুলস্, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পেস্ট্রি কেক আর কোল্ড ড্রিংকস্। আফীফ ভাই আর আমার কথা থামলো না। আমাদের সাথে থাকা আরও দুজন চরম বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাতে আমাদের যাচ্ছে আসছে না। আফীফ ভাইয়ের দুই একটা কথাই আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি। হঠাৎ কোল্ড ড্রিংক পান করতে গিয়ে বড় সড় রকমের বিষম খেলাম। নাকে মুখে উঠে যা তা অবস্থা। বর্ণ ভাই লাফিয়ে উঠে চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলেন। মাথায় লাগাতার হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। বিস্ময়ে আমার বিষম এমনি এমনিই ভালো হয়ে গেল।

চলবে..