ছায়াবর্ণ পর্ব-৮+৯

0
286

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৮

আমার চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। যে ব্যক্তি এতক্ষণ নির্লিপ্ত ছিল কোনো দিকে যার খেয়ালই ছিল না, সেই ব্যক্তি আমার সামান্য বিষয় নিয়ে কেমন উতলা হয়ে উঠলো! তিনি আমার মুখের সাথে পানি ধরে ধমকের সুরে বললেন–

— হা করে তাকিয়ে না থেকে খাও।

আমি হকচকিয়ে পানি পান করে নিলাম। আমাদের দেখে আফীফ ভাই আর রানি মুখ টিপে হাসছে, যেন তারা খুব মজা পাচ্ছে। বর্ণ ভাই টেবিলে গ্লাস রেখে বললেন–

— সব সময় তো তিড়িং বিড়িং। খাওয়ার সময় অন্তত একটু শান্ত হয়ে খাও।

আফীফ ভাইয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন–

— আফীফ! এখন আর একটা কথাও হবে না। চুপ চাপ খা।

আফীফ ভাই আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে খাওয়া শুরু করলেন। বর্ণ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন–

— কি হলো খাও?

আমি কেঁপে উঠে মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললাম–

— খেয়েছি তো। আর খাবো না।

বর্ণ ভাই চোখ ছোট ছোট করে বললেন–

— কি খেয়েছ তুমি?

— চিকেন ফ্রাই আর কোল্ড ড্রিংক।

— ব্যস? পেট ভরে গেল?

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। বর্ণ ভাই গমগমে কন্ঠে বললেন–

— আফীফ কোনো দিন কাউকে ট্রিট দেয় না, এমনকি আমাকেও না। শা/লা কিপটে। আজ তোমার জন্য ও ট্রিট দিচ্ছে, আর তুমি এতো গুলো খাবার নষ্ট করবে? সেটা আমি কিছুতেই হতে দিয়ে পারি না।

আফীফ ভাই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন–

— আমি মোটেও কিপটে নই।

— তুই চুপ থাক।

বলেই তিনি নুডুলসের প্লেট হাতে নিয়ে নুডুলস্ আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন–

— খাও।

আজ যেন আমার অবাক হওয়ার দিন। বর্ণ ভাই! যে আমাকে এক প্রকার সহ্য করতে পারেন না। তার কেয়ারিং রুপ দেখে রীতিমতো আমি অবাকের শীর্ষে। মনে মনে ভাবলাম “খিটখিটে মেজাজের হলেও লোকটা বেশ কেয়ারিং। ইশ্! যে বর্ণ ভাইকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী।” তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি চোখ দিয়ে ইশারা করে নুডুলস্ মুখে নিতে বললেন। আমি চুপ চাপ খেয়ে নিলাম। সত্যি বলতে আমার বাবা , মামা, চাচার পর তিনিই একমাত্র পুরুষ যার হাতে আমি খেলাম। শুধু খেলামই না, তৃপ্তিতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

টিভিতে মুভি দেখছিলাম আর চিপস খাচ্ছিলাম। এমন সময় মা আমার সামনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম–

— উফ্ মা! সরো তো। দেখতে পাচ্ছি না তো।

মা রাগান্বিত কন্ঠে বললেন–

— তোর এসব ছাড়া আর কোনো কাজ নেই ছায়া? পড়ালেখা নেই তোর? কদিন পর যে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা সে কথা মাথায় আছে? বই ছুঁয়ে দেখিস একটুও?

আমি বিরস মুখে তাকিয়ে রইলাম। রোজ রোজ এক কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেল। মা আবারও বললেন–

— রেজাল্ট ভালো না করতে পারলে তোকে রিকশা ওয়ালাও বিয়ে করবে না। তখন থাকিস বাপের ঘাড়ের ওপর বসে।

— মা! থামবে তুমি?

— কেন রে? থামবো কেন? আমার শেষ কথা শুনে রাখ, তোর জন্য একটা স্যার ঠিক করেছি। রোজ রাতে এসে তোকে পড়াবে। ভদ্র মেয়ের মতো পড়বি। যদি একটুও বাঁদরামি করেছিস তো আমার ঝাড়ু আর তোর পিঠ। মনে থাকে যেন।

মা আমাকে শাসিয়ে চলে গেলেন। আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। আশ্চর্য! কি এমন স্যার যে রাতে পড়াবে! এখন তো এক্সট্রা খাটুনি হবে। কোচিংয়েও যাও আবার রাতে প্রাইভেট টিউটরের কাছেও পড়ো। জীবনটা আসলেই বেদনার।

রাতে রুমে শুয়ে শুয়ে মেসেঞ্জারে চ্যাট করছিলাম। কয়টা বা বাজে? সাড়ে সাত কিংবা আট? এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। তারপর ড্রয়িং রুম থেকে মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে এলো। কারো সাথে খুব গদগদ হয়ে কথা বলছেন। আমি বাদে বাকি সবার সাথে উনি খুব ভালো ব্যবহার করেন। বাবাকেও আমার দলে ধরা চলে। বাইরে থেকে মায়ের আওয়াজ এলো–

— ছায়া! এই ছায়া!

আমি অলস ভঙ্গিতে ফোনটা পড়ার টেবিলের ওপর রেখে বাইরে গেলাম। সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিকে দেখে ভয়ংকর ভাবে ভড়কে গেলাম। নিজের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ রসগোল্লার আকার ধারণ করলো। একটা গেঞ্জি আর প্লাজু পরে আছি। গলার দুপাশে ওড়না ঝোলানো। এতক্ষণ শুয়ে ছিলাম, চুল গুলো নিশ্চয়ই পাখির বাসার মতো দেখাচ্ছে? মা আমাকে দেখিয়ে বললেন–

— বাবা বর্ণ এই হলো আমার মেয়ে ছায়া।

উনি আমার দিকে তাকানোর সাথে সাথে আমি দৌড়ে রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলাম। হায় আল্লাহ্! ওনার সামনে আমি এভাবে! ছিঃ ছিঃ উনি কি ভাবলেন! এই প্রথম উনি আমাদের বাসায় এলেন আর আমি! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। বাইরে থেকে মায়ের কন্ঠ ভেসে আসছে–

— এই মেয়েটাও না! তুমি কিছু মনে কোরো না বাবা। আসলে খুব চঞ্চল ও।

বর্ণ ভাইয়ের কন্ঠ পেলাম না। আমি দ্রুত চেঞ্জ করে বাইরে গেলাম। এবার পরিপাটি হয়েই বেরিয়েছি। মা বললেন–

— তুই এভাবে চলে গেলি কেন ছায়া? কি মনে করলো ছেলেটা? যা ওকে তোর ঘরে নিয়ে যা।

মাথাতেই ঢুকছে না, ওনাকে আমার রুমে কেন নিয়ে যাবো? মা আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–

— কি হলো? যা। বর্ণ আজ থেকে তোকে পড়াবে। ওর সব কথা শুনে চলবি।

এবার যেন চারশো কুড়ি ভোল্টের ঝটকা খেলাম। বর্ণ ভাই আমাকে পড়াবেন! বর্ণ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। আমার অপেক্ষা না করেই আমার রুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। আমিও তার পিছু পিছু গেলাম। ভাগ্যিস নতুন স্যার আসবে বলে মা বিকেলে ঘরটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে কি লজ্জাটাই না পেতে হতো। বর্ণ ভাই টেবিলে চেয়ার টেনে বসে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–

— বসো।

তার ঝংকার তোলা পুরুষালী কন্ঠে বুক কেঁপে উঠলো। মাথা নিচু করে বসে পড়লাম। এই লোকটার সামনে যেতেই আমার কাঁপা কাঁপি শুরু হয়। আর রোজ এই লোকটা আমাকে পড়াতে আসবে! ভাবা যায় এসব? তিনি বললেন–

— পরিচয় দিয়ে শুরু করবো। আমি আমার পরিচয় বলবো তারপর তুমি তোমারটা বলবে। ঠিক আছে?

আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলাম। তিনি বিরক্ত হলেন। বললেন–

— মাথা দোলানো, বাঁকানো এসব আমার সামনে করবে না। মুখে জবাব দেবে। বুঝেছ?

আমি আবারও ঘাড় কাত করতে যেয়েও থেমে গিয়ে বললাম–

— জি।

বর্ণ ভাই মুখ খুলবেন এমন সময় আমার ফোন টুং করে উঠলো। পর পর বেশ কয়েকবার শব্দ হলো। ফোনটা টেবিলের ওপরই ছিল। ভুল বশত আমি নেট অন করে রেখেছিলাম। বর্ণ ভাই ফোন হাতে তুলে নিলেন। ভ্রু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন–

— জানু কে?

আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম–

— রানি।

— “ছায়ার বাচ্চা তোর আফীফ ভাই আমাকে জ্বালিয়ে মেরে ফেললো। আমি কিন্তু ওই ব্যাটার গলা টিপে পটল ডাঙায় পাঠাবো বলে দিলাম।”

“বর্ণ ভাইয়ের সাথে কি তোর কিছু চলছে নাকি রে ছায়া? সেদিন কি সুন্দর তোকে গালে তুলে খাওয়ালো। আহা! আমার ক্রাশটা কত্ত ভালো দেখেছিস?”

রানির পাঠানো মেসেজ বর্ণ ভাই পড়ে আমাকে শোনালেন। আরও একবার লজ্জায় পড়ে গেলাম। বর্ণ ভাই ফোন অফ করে রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন–

— এসব হয় দুই বান্ধবীর মাঝে?

আমি নিজের সাফাই গাইতে বললাম–

— বিশ্বাস করুন। আমি এসবের কিছুতেই নেই। রানি নিজে নিজে এসব করে। এক নম্বরের লুচু মহিলা।

শেষের কথাটা ধীর কন্ঠে বললাম। বর্ণ ভাই সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললেন–

— পড়ার সময় ফোন অফ রাখবে। মনে থাকবে?

আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলাম। তিনি রেগে গিয়ে বললেন–

— আবার সেই ঘাড় বাঁকানো! কি বলেছি তোমায়?

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম–

— স স্যরি। আর হবে না।

— ঠিক আছে। এখন পরিচয় শুরু করা যাক। আমি আওসাফ বর্ণ। আমার বাবার নাম সৈয়দ আব্দুল্লাহ। মায়ের নাম মিসেস বিথী বেগম। আমার কোনো ভাই বোন নেই। আমি তিন বছর আগে আমার পড়ালেখার পাঠ চুকিয়েছি। আপাতত চাকরি করছি না, ইচ্ছে হলে করবো পরে।
এবার তুমি বলো।

পড়াতে এসে কেউ এতো কিছু বলে তা আগে জানা ছিল না। আমি বলা শুরু করলাম–

— আমি তাহসীনা ছায়া। বাবার নাম মোস্তফা রহমান। মায়ের নাম মিসেস তামান্না বেগম। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমি একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী।

— ঠিক আছে। এবার আমি তোমাকে একটা রুটিন তৈরি করে দেবো। সেই অনুযায়ী রোজ পড়তে হবে।

উনি রুটিন তৈরি করে দিলেন। উনি যা পড়ালেন ভদ্র মেয়ের মতো পড়লাম। এমন একটা ভান করলাম যেন আমার থেকে ভদ্র মেয়ে আর দুটি নেই। সত্যি বলতে ওনার সামনে আমি একদমই ভেজা বেড়াল। মা আমাকে কাত করেই ছাড়লো। পড়ানো শেষে আমি মিনমিন করে বললাম–

— আপনি কি রোজ পড়াতে আসবেন?

— কেন? রোজ এলে কি তোমার সমস্যা হয়ে যাবে?

— না না। তা হবে কেন? আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।

— আমার সময় হলে আমি রোজই আসবো। আর যে পড়াগুলো দিয়ে যাচ্ছি, সেগুলো যেন আগামীকাল রেডি থাকে।

হুমকির সুরে বলে উনি চলে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। আমার আনন্দের দিন শেষ। সবই কপাল!

চলবে..

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৯

আজ আমি একদম পরিপাটি হয়েই বসে আছি। বলা যায় না হুট করেই তিনি কখন চলে আসেন। কিন্তু মূল কথা হলো আমি পড়া করতে ভুলে গিয়েছি। আমার একদম মনেই ছিল না। প্রথম দিন তো, উনি হয়তো মাফ করে দেবেন। এখন বাজে আটটা। একই বাড়ি হওয়ার সুবাদে তিনি যখন তখন পড়াতে আসতেই পারেন। ওনার সময়েরও একটা ব্যাপার আছে। বাবা আসেন দশটায়। বাবা আসার আগেই তিনি বেরিয়ে যান। মা ডাকলেন, আমি আস্তে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। তিনি এসেছেন। মা অসন্তোষ কন্ঠে বললেন–

— তোর কি কান্ড জ্ঞান কখনও হবে না রে ছায়া? বর্ণ না তোর স্যার? এসেই হা করে দাঁড়িয়ে আছিস, সালাম দেবে কে শুনি?

আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। সত্যিই তো, কাজটা ঠিক হয়নি। আমি বিনম্র হয়ে সালাম দিলাম–

— আসসালামু আলাইকুম।

তিনি জবাব দিয়ে আমার অপেক্ষা না করেই রুমে চলে গেলেন। এমন ভাবে হেঁটে গেলেন যে, দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে এ লোক মহা ব্যস্ত মানুষ। মা ধমকের সুরে বললেন–

— দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ছেলেটার অনেক কাজ থাকে, তোর মতো শুয়ে বসে দিন পার করে না। সময় বের করে যে তোকে পড়াতে আসে সেটাই তোর চোদ্দ গোষ্ঠীর ভাগ্য ভালো। যা, আমি ছেলেটার জন্য কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।

আমি হতাশ শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম। মায়ের সাথে পেরে ওঠা কখনও সম্ভব নয়। বর্ণ ভাই নিজে নিজেই বই বের করে ওল্টাচ্ছেন। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। বসার সাথে সাথেই তিনি বললেন–

— অ্যাডাম স্মিথ এর অর্থনীতির সংজ্ঞা বলো।

এই রে! এবার কি হবে? আমি তো বই খুলেই দেখিনি। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ ভেবে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম–

— পারি না।

উনি অদ্ভুত চোখে তাকালেন। যেন বিশ্বের সেরা গর্দভ দেখছেন উনি। থমথমে কন্ঠে বললেন–

— কত মাস হচ্ছে কলেজে যাচ্ছ?

— তিন মাস।

— আর অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার কত মাস বাকি আছে?

— তিন মাস।

— তিন মাসে কি করেছ? অ্যাডাম স্মিথ এর সংজ্ঞা টা পর্যন্ত বলতে পারছ না। আমি পড়া দিয়ে গিয়েছিলাম তাও পড়োনি। পরীক্ষায় কি লিখবে তুমি? আমার মাথা নাকি তোমার মু’ন্ডু?

মাথা নিচু করে বসে আছি। সত্যিই আমার চোখে সর্ষে ফুল দেখার মতো অবস্থা। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–

— আজ কিছু বললাম না। আমি যা পড়াবো এবং পড়া দিয়ে যাবো সবটা রোজ রেডি চাই আমার। পড়ালেখার ফাঁকি আমি একদম পছন্দ করবো না।‌ পরবর্তীতে শাস্তি পেতে হবে মনে রেখো।

উনি সুন্দর করে রুটিন অনুযায়ী পড়িয়ে দিলেন। এমন ভাবে পড়ালেন যে আমার মাথায় তা গেঁথে গেল। সত্যিই উনি একজন চমৎকার শিক্ষক।

আজ শুক্রবার। আমার শান্তির দিন। বর্ণ ভাইয়ের পড়ালেখার অত্যা’চারে প্রাণ ওষ্ঠাগত। পড়া একটু আটকে গেলে তিনি তা দশবার পড়িয়ে পাঁচ বার লেখান। আমি তো পারি না দেওয়ালে মাথা ঠু’কে কাঁদতে। আজ তো আর পড়াতে আসবেন না, সেই ভেবেই আমি শান্তিতে বসে টিভি দেখছি। এখন বাজে সাতটা। বাবা বাইরে গিয়েছেন। মা ঘর গোছাচ্ছেন। তিনি শান্ত হয়ে বসতে পারেন না। কোনো না কোনো কাজ তাকে করতেই হবে। আমি বুঝি না, এতো কাজ তিনি কীভাবে করেন? হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি সেদিকে এক পলক তাকিয়ে আবার টিভিতে মনোযোগ দিলাম। টান টান অ্যাকশান সিন চলছে। মা বিরক্তিতে দরজা খুলতে খুলতে বললেন–

— মুখের সামনে দরজা, উনি একটু উঠে খুলতে পারলেন না। আমাকেই আসতে হলো।

দরজা খুলতেই শোনা গেল–

— আরে ভাবি আপনি! আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।

বাড়ি ওয়ালা আন্টি কে দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রতার সাথে সালাম দিলাম। তিনি জবাব দিয়ে হাসি মুখে বললেন–

— ভাবি, আমি একটু শপিং এ যাবো। ছায়াকে যদি আমার সাথে একটু যেতে দিতেন।

— অবশ্যই যাবে। কিন্তু আপনি এ সময়ে যাচ্ছেন যে!

— আসলে কি বলুন তো ভাবি? আপনার ভাইয়ের একদম সময় নেই। আর বর্ণ টাও বাড়িতে ছিল না। মাত্র এলো, আর আমার যাওয়াও খুব দরকার। তাই আর কি।

— আচ্ছা ঠিক আছে।

মা আমাকে ডেকে বললেন–

— ছায়া! আন্টির সাথে একটু যা তো। যা রেডি হয়ে আয়।

আমি রেডি হতে গেলাম। শপিং মানেই আমার কাছে একটা আনন্দের বিষয়, সেটা আমার হোক বা অন্যের। মানা করার প্রশ্নই আসে না। আমি বোরখা পরে হিজাব বেঁধে নিলাম। আন্টিও রেডি হয়েই এসেছেন। মাকে বিদায় জানিয়ে আমরা নেমে আসলাম।
নিচে বর্ণ ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। আন্টিকে বললেন–

— দাঁড়াও আমি সিএনজি ডেকে নিয়ে আসি।

তিনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সিএনজি নিয়ে এলেন। সিএনজির পেছনে তিন ছিটের বসার জায়গা এবং সামনে চালকের দু পাশে দুজন। বর্ণ ভাই চালকের পাশে বসলেন। চালকের অপর পাশে ইতোমধ্যে একজন যাত্রি বসে আছেন। আমি আর আন্টি ভেতরে উঠে বসলাম। এখান থেকে শপিং মল বেশ কিছুটা দূরে। যেহেতু আমার পাশে একজন বসার জায়গা আছে, সেহেতু লোক দেখে চালক সিএনজি থামালেন। আমি চেপে বসলাম। অজ্ঞাত পুরুষের পাশে বসা আসলেই অস্বস্তিকর। লোকটি উঠে বসার আগেই বর্ণ ভাই বলে উঠলেন–

— দাঁড়ান!

লোকটা থেমে গেল। বর্ণ ভাই নেমে বললেন–

— যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি সামনে বসবেন? এই দুজন আমার লোক, তাই তিনজন একসাথে বসলে সুবিধা হতো আর কি।

লোকটা দ্বিমত করলেন না। সামনে উঠে বসলেন। বর্ণ ভাই আমার পাশে এসে বসলেন। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কেন জানি না এই মানুষটার সাথে থাকলে নিজেকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে হয়। রাস্তার দুই এক জায়গায় খারাপ আছে। প্রচন্ড এক ঝাঁকুনিতে আমি উল্টে পড়ে যেতে নিলাম। তৎক্ষণাৎ বর্ণ ভাই আগলে নিলেন। পিঠের পেছন দিয়ে হাত গলিয়ে বাহু চেপে ধরে এক হাতের মধ্যে বেঁধে নিলেন। আন্টি পাশে থাকায় দ্বিগুন অস্বস্তিতে পড়ে মোচড়া মুচড়ি শুরু করলাম। উনি কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা কন্ঠে বললেন–

— চুপ চাপ বসে থাকো। রাস্তা সামনে আরও খারাপ আছে। ধাক্কা ধুক্কি খেয়ে ব্যথা ট্যথা পেলে তো আন্টি আমাকে বলবেন যে তার ভালো মেয়ে নিয়ে আসলাম আর আহত বানিয়ে নিয়ে গেলাম। তা না হলে আমার তো খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই যে তোমাকে ধরে বসে থাকবো।

অপমানে মুখ থমথমে হলো। আমি কি বলেছি যে আমাকে ধরে রাখুন? একশো বার ধাক্কা খাবো আর কপালে ফুলিয়ে আলু বানাবো। হুহ! সিএনজি এসে শপিং মলের সামনে থামলো। তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে নেমে গেলেন। আমি আর আন্টিও নেমে পড়লাম। বর্ণ ভাই ভাড়া মিটিয়ে এগোতে লাগলেন। আমি আর আন্টি হাঁটলাম তার পিছু পিছু। আন্টি আমায় বললেন–

— আমার সাথে সাথে থাকবে ছায়া। এখানে কিন্তু অনেক ভিড়।

আন্টি একটা শাড়ির দোকানে ঢুকলেন। বর্ণ ভাই এক পাশে বসে ফোন দেখতে লাগলেন। আন্টি একের পর এক শাড়ি দেখে চলেছেন। জামদানি শাড়ি। আমি জিজ্ঞেস করলাম–

— শাড়ি কি নিজের জন্য নিবেন আন্টি?

আন্টি শাড়ি দেখতে দেখতে বললেন–

— না গো। আমাদের বাড়ি থেকে দুইটা বাড়ি রেখে একটা ভাবিদের বাড়ি। আমাদের প্রতিবেশীই বলা চলে। তবে ওনাদের সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক আমাদের। তাদের মেয়ের বিয়ে আগামীকাল। তোমার আংকেল আর বর্ণ ব্যস্ত থাকায় কিছুই কেনা হয়নি। তাই আজ ভাবলাম একটা ভালো শাড়ি নিয়ে নিই। ভালো হবে না বলো?

— খুব ভালো হবে।

— কিন্তু আমি তো পছন্দ করতেই পারছি না। তুমি একটু দেখো তো।

আমি শাড়ি দেখতে লাগলাম। গাঢ় একটা খয়েরী রঙের শাড়ি ভালো লাগলো। আন্টিকে বললাম–

— দেখুন তো আন্টি এটা কেমন?

আন্টি গদগদ হয়ে বললেন–

— এটা তো খুব ভালো হবে ছায়া। মেয়েটা ফর্সা আছে তোমার মতো। ও’কে এটা বেশ মানাবে।

আন্টি এটা প্যাক করে দিতে বললেন। মেলে রাখা শাড়ি দেখতে দেখতে আমার একটা শাড়িতে চোখ আটকে গেল। কালো রঙের একটা জামদানি। অসম্ভব সুন্দর! আমি হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। ইশ্! যদি বাবার সাথে আসতাম তাহলে এটা নিয়েই যেতাম।‌ কিন্তু তা হলো না, এটা পরে আর পাওয়াও যাবে না। মন খারাপ হয়ে গেল। শাড়ি আমার হাতে গোনা কয়েকটা আছে। শাড়ির পাশে খুব কম যাই আমি। শাড়ি সামলানো বিরাট ব্যাপার। তবুও পছন্দ হলেই কিনে রাখি। তবে এটা হলো না। আন্টি বললেন–

— ছায়া চলো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। আন্টি হাঁটতে হাঁটতে বললেন–

— ভাগ্যিস তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম। নাহলে তো আমি শাড়ি পছন্দ করতেই পারতাম না।

আমি কিছু বললাম না। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার ফলে এক যুবকের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার পূর্বেই এক বলিষ্ঠ হাত টেনে সরিয়ে দিল আমায়। বর্ণ ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন–

— কপালে চোখ নেই? আর একটু হলেই ধাক্কা খেতে ওই ছেলের সাথে। দেখে হাঁটো।

আমি মুখ কালো করে হাঁটতে লাগলাম। আন্টি বললেন–

— তোর হাতে ওটা কিসের ব্যাগ? কি কিনেছিস?

— আমার প্রয়োজনীয় একটা জিনিস।

আন্টি আর কিছু বললেন না। এবার সিএনজিতে আন্টির হাত ধরে বসে ছিলাম। যেন উনি ধরতেও না পারেন আর কথা শোনাতেও না পারেন।

চলবে..