ছায়া সঙ্গিনী পর্ব-০৬

0
381

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-০৬
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

ভয়ে বক্ষস্থলে ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গেছে! দুই হাত দিয়ে জাপটে ধরে আছি সামনে থাকা ব্যক্তিকে।যদি পারতাম তো ব্যক্তিটির ভিতরে ঢুকে যেতাম। কিছু সময় অতিবাহিত হ‌ওয়ার পর ভয়টা কমে এলো।ব্যক্তিটি সেই কখন থেকে বলে চলেছে,
– আয়রা আর ইউ ওকে?

কথা গুলো যেন আমার কর্ণপাত হচ্ছিল না। এখন ভয়টা কমে যেতে ধীরে ধীরে হাতের বাঁধন ছেড়ে দিতে নিলে, দুটো হাত মোলায়েম ভাবে আষ্টেপিষ্টে জরিয়ে ধরলো আমায়। আমি হতবাক হয়ে মাথা তুলে তাকালাম,তাকাতেই রাহাত দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
– মানুষ নিজে থেকেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমি কিন্তু প্রথমে কিছু করিনি। তাই এখন আমিও ছাড়বো না, এভাবে থেকেই আমাকে বলতে হবে কি এমন ঘটনা ঘটেছে যার ফলে নিজের শত্রুকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে হলো।

রাহাতের কথা শুনে বুঝতে পারছি, আমাকে লজ্জায় ফেলতেই কথা গুলো বার বার রিপিট করছে। এখন আমি চাইলেও ছাড়া পাবো না সেটা নিশ্চিত।যতক্ষন না সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলছি। তাই দেরি না করে বলতে শুরু করলাম,
– আমি মেহগনি ফুলের সুভাষ নিচ্ছিলাম তখন পাশে খেয়াল করতেই দেখলাম তক্ষক! ছোট ছোট পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তখনি ভয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি।
________

– আপুর শ্বশুর মশাই কে জমিদার বলা চলে, প্রচুর সম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি। এখন মানুষটা নেই তবে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি গুলো এখনো আছে। ভাইয়ার বোনেরা নিজেদের ভাগের গুলো নিয়ে গিয়েছেন,আর ভাইয়ার গুলো কৃষকেরা চাষবাস করে খায়। এর জন্য বছরের শুরুতে মোটা অংকের টাকা দিতে হয় ভাইয়া কে।
ভাইয়ার বাবা’কে মানুষজন এক নামেই চিনে ফেলতো,ইনফেক্ট এখনো যদি বলা হয় “রহমান সরকার” বাড়িটা দেখিয়ে দেওয়ার কথা, তাহলে মানুষজন নির্দ্বিধায় অকপটে দেখিয়ে দেয়।
আপুর শ্বশুরবাড়ি টা চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা। তাছাড়া এই বাগানে বিভিন্ন গাছপালার সাথে সাথে অনেক জীবজন্তু ও বিদ্যমান রয়েছে।আপু অবশ্য আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল,একা একা যেন এই বাগানে না আসি আমি। সকাল বেলা প্রকৃতি অবলোকন করতে চলে এসেছি এখানে, আপুর কথা স্মরণে ছিল না। থাকলে,ভেবেই পা রাখতাম। আমি এখানে আসার পর আপু বলেছিল, পাশের বাসার এক মহিলা বাহিরে মাটির চুলায় রান্না করছে তখন আকস্মিক এক তক্ষক এসে মহিলার এক হাতের কনুই পর্যন্ত গিলে ফেলে!যদিও লাঠি পেটা করে তক্ষকের মুখ থেকে বের করে আনা হয়। তবুও এর ফলে মহিলার হাত চামড়া ছিলে, খুব মর্মান্তিক অবস্থা হয়। তক্ষকের ছোট ছোট দাঁত গুলো বিঁধে যায় হাতের মধ্যে। জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেই কথা শুনেই আমি ভয়ে দৌড়াতে শুরু করি। তাছাড়া পাশে একটা পুকুর আছে, অনেক পুরনো। নাম মনির মার পুকুর, এই নামের পিছনেও নিশ্চ‌ই কোন রহস্য আছে।আপু জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু আপু বললো জানে না সে। পুকুরের পাশে অনেক পুরনো গাছ বাঁকা হয়ে পুকুরে ডুবে আবার কিছু বাঁকা হয়ে পানি থেকে দূরত্বে অবস্থান। সেই পুরনো গাছ গুলোতেই তক্ষকের বাসস্থান। মাঝে মাঝে পানিতেও দেখা যায় এদের। দেখতে অনেকটা কুমিরের মতো বলে আমি এদের ছোট কুমির সম্বোধন করি।
_______
রাহাত তক্ষকের কথা শুনে বললো,
– একা একা এখানে আর এসো না,এরা এমনিতে বিষাক্ত প্রানী না। তবুও কিছু ঘটে যেতে কতক্ষন।চলো বাসায় যাই?

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম, তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল। রাহাতের পিছন পিছন আমিও হেঁটে যাই। রাহাত সকালের এক্সারসাইজ করতে করতে এই দিকটায় আসে, ভাগ্যিস এসেছিলো না হয় আমার যে কি হতো আল্লাহ মালুম।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসলাম সবাই।সাফা আর মার‌ওয়া আমাদের সবার থেকে একটু একটু করে খাবার খাচ্ছে।আপু বলে তা-ও খাক, না হয় আমাকে পাগল করে দিবে আলাদা করে খাওয়াতে গেলে।
এদিকে হাবিব অনামিকা কে ও মাঝে মাঝে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।তা দেখে ও না দেখার ভান করছি আমি। মাথা নিচু করে তাড়াতাড়ি খেয়ে যাচ্ছি, এখান থেকে তারাতাড়ি যাওয়ার জন্য। হঠাৎ একটা হাত খাবার নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে আছে!যা দেখে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালাম আমি। তাকাতেই রাহাত ইশারা করলো খাবার টা খাওয়ার জন্য।আপু ভাইয়ার কথা চিন্তা করে, দ্বিরুক্তি না করে মুখে তুলে নিলাম খাবার। তারপর আমি যখন নিজ হাতে খেতে নিলাম তখন আমার হাত টেনে নিয়ে রাহাত নিজের মুখে পুরে নিল খাবার! আকস্মিক ঘটনায় বরকে যাই আমি। এদিকে আপু ভাইয়া মুচকি মুচকি হেসে চলেছে।যা দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকালাম আমি, আমার রাঙানি দেখে রাহাত ইনোসেন্ট ভাব করে যেন সে কিছুই করেনি।

পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক হচ্ছে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক।যেটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।যেই সম্পর্কে নেই কোন পাপ,অনাচার-ব্যভিচার। যেখানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ভালোবাসা দেখলে সৃষ্টিকর্তা খুশি হয়ে যান “আলহামদুলিল্লাহ”।এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে। হাদীসে এসেছে,
সাওয়াব পাওয়ার ঘোষণা। হাদিসে এসেছে-প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ সাদকা হল, একজন মানুষ তার স্ত্রীর মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দেবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)শুধু তা-ই নয়, অন্য হাদিসে ‘স্ত্রী পরিবারের জন্য খরচ করাকেও সাদকার সওয়াব বলা হয়েছে’ যদি সাদকার নিয়তে খরচ করা হয়।স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রদশর্নের কথা শরীয়তে বলা হয়েছে। এর সূত্র হচ্ছে কোরআনে কারিমের একটি আয়াত, যাতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের মাঝে প্রীতি ও করুণা সৃষ্টি করেছেন। ‘এই ভালোবাসা মূলত আল্লাহতায়ালার দান। অন্য হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের অসিয়ত আমার কাছ থেকে গ্রহণ করো।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা এরকম, বিয়ের পর পরই উভয় উভয়ের প্রতি আকস্মিক মায়ায় জড়িয়ে পরে। এটা হয়তো পবিত্র বন্ধনের শক্তি। আজকাল ছেলে মেয়েরা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে নিজেদের ইজ্জত বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করছে না, সমাজে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে।তারা যদি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা বুঝতে পারতো তাহলে কখনোই এরকম অশ্লীল কাজে জড়াতো না। বুঝতে পারলে, মেয়েরা নিজেদের পরপুরুষের কুনজর থেকে আড়াল করে রাখতো। ছেলেরাও তাদের দৃষ্টি নত করে চলতো যদি জানতো স্ত্রীর সাথে প্রত্যেকটা সুন্দর কাজে তাদের রয়েছে সদকা। সর্বোপরি প্রত্যেকটা নারীর ভালোবাসা শুধু মাত্র তার স্বামীর জন্য। কোন পরপুরুষের জন্য নয়।
________
বিকাল চারটা বাজে,
রাহাত এক্ষুনি বের হয়ে যাবে, এখান থেকে গিয়ে তার মায়ের সাথে দেখা করবে। তারপর ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে। দুটো দিনে একটু একটু করে মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম, হয়তো পবিত্র বন্ধনের শক্তি এটা।যাই হোক সে চলে গেলে আমি আমার জীবনে পুনরায় ফিরে যাবো। পড়াশোনার মধ্যে থাকলে অসুবিধা হবে না আমার। নারায়ণগঞ্জ চলে যাওয়ার পর, গ্রামের কলেজ থেকে টান্সফার করে আমাকে তুলারাম সরকারি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয় আব্বু। তারপর কলেজ শেষ করে এখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছি আমি। হয়তো এর মধ্যে ইনকোর্স এক্সামের তারিখ দিয়ে দিয়েছে।
খাটের এক কোনায় বসে কথা গুলো আওড়াচ্ছি তখন শেষ বারের মত বলতে আসে রাহাত। আমি খাট থেকে নেমে দাঁড়ালাম, তখন ধীর পায়ে এগিয়ে এলো রাহাত। আমি নিজের দুই হাত দিয়ে কামিজের দুই পাশে শক্ত করে চেপে ধরে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে রাহাত তার কাজটা করেই নিল! শক্ত করে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে,গলার দিকটায় নিজের অধর দুটি ছুঁয়ে দিল গভীর ভাবে! ঠান্ডা বরফের মতো জমে গেলাম আমি। এখানে বাঁধা প্রদান বা হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা বা অধিকার কোনটাই নেই আমার। আমি এখন তার অধিকার দখলে,সে যদি সম্পূর্ণ ভাবে তার অধিকার ফলায় তাও কোন বাধা দিতে পারবো না আমি। না হয় যে জান্নাতি হুর আমাকে অভিশাপ দিবে!
তার স্পর্শ গভীর থেকে গভীরতর হ‌ওয়ায় চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নিলাম। হঠাৎ সব বাঁধন আলগা করে, দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে চলে গেল সে। একটুও পিছনে ফিরে তাকালো না আর।

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলাম সেই দিকে, হয়তো সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির শেষ প্রান্তে চলে গেছে সে।আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না আমি, দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার রুমে শুয়ে পড়লাম।এই রুমটায় দুদিনের স্মৃতি তার সাথে আমার। গতকাল রাতের ঘটনা, দু’জনেই নিজেদের মতো করে চুপচাপ শুয়ে পরি। মধ্যরাতে ভাড়ি কিছুর ওজনে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। চোখ খুলে ড্রিম লাইটের আলোয় দেখতে পেলাম, রাহাত কোণা কোণি হয়ে ঘুমিয়ে আছে।যার ফলে মাথা রেখেছে আমার পায়ের উপর।বিষ্ময়ে কিংবদন্তি আমি, এই ছেলের ঘুমানোর স্ট্যাইল এরকম কে বলবে?হায় আল্লাহ,এর জন্য তো কেউ শান্তি মতো ঘুমাতে পারবে না নিশ্চিত। তারপর আমার পা সরিয়ে নিয়ে আসি, কিন্তু এতো বড় দেহের অধিকারী ব্যক্তিকে ঠিক করে শুয়ে দেওয়ার শক্তি কোন কালেই হবে না আমার। তাই বাধ্য হয়ে তার মতো করেই কোণা কোণি হয়ে শুয়ে পরি আমি।নামাযের সময় তার আগেই ঘুম থেকে উঠে পরি,যার কারণে সে কিছুই বুঝতে পারেনি।
রাতের কথা গুলো ভাবতে ভাবতে, পাশের বালিশ টা কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরতেই হাতে কিছু লাগলো! অন্ধকার বলে দেখতে পেলাম না কিন্তু এগুলো কাগজের মতো হাতে অনুভব হলো, তবে একটা দুটো নয় অনেক গুলো,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।