ছায়া সঙ্গিনী পর্ব-০৭

0
361

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-০৭
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

কৌতুহল দমাতে তাড়াতাড়ি গিয়ে রুমের লাইট জ্বালিয়ে, খাটে ফিরে এলাম।এসে দেখলাম নতুন পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট! সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট! দ্রুত চিরকুটের বাজ খুলে পড়তে শুরু করলাম,

— আমার আয়রা,

জানি আমার উপর খুব রেগে আছো তুমি, কি করবো বলো আল্লাহ চায় তো আবার চার মাস পর তোমাকে দেখবো! তাই শেষ বারের মতো একটু ছুঁয়ে দিলাম,রাগ করোনা প্লীজ।

আর টাকা গুলো দেখেও রাগ করো না। এখন বিবাহিত তুমি,তাই বাবার থেকে ভাইয়ার থেকে টাকা চাইতে খুব লজ্জা পাবে।জানো তো বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে টাকা চাওয়াটা লজ্জার ও বটে। তাই এখান থেকে খরচ করো, আরো লাগলে ব‌ইলো প্লিজ।

তোমার রাহাত,,,

চিরকুট টা পড়ে আবার আগের ন্যায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি, তার শেষাংশ কাজের জন্য কি আসলেই রেগে আছি আমি? বুঝতে পারছি না তো! আনমনে ডান পাশে গলায় হাত রাখতেই ব্যাথা অনুভব করলাম। হয়তো স্থানটি লাল রঙা ধারন করেছে,তাই ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।
______
রাতটা কেটে গেল কোনরকম ভাবে। সকাল থেকে সাফা আর মার‌ওয়া কে নিয়ে টাইমপাস করতে শুরু করলাম। দুটো কে নিয়ে ঘরের বাহিরে বের হতেই দেখি, ঘরের সামনে পুকুর থেকে লতা বরসি দিয়ে মাছ ধরছে। আমার ও ইচ্ছে হলো মাছ ধরার তাই লতার থেকে বরশি হাতে নিয়ে পাকা সিরিতে বসে পড়লাম।লতা সাফা আর মার‌ওয়া কে নিয়ে উপরের সিরি গুলোতে বসে আছে। ময়দা মাখানো ছোট্ট দলা বরশি তে লাগিয়ে ” বিসমিল্লাহ ” বলে পানিতে ফেললাম। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন মাছ ধরবো।মার‌ওয়া মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠে তখন আঙুলের ইশারায় চুপ করতে বলি। কারণ শব্দ শুনতে পেলে মাছ ভয়ে দূরে চলে যায়। অনেক সময় পর ছিপ নাড়াচাড়া করতে না দেখে,বরশি উঠিয়ে দেখি ময়দা মাখানো ছোট্ট দলাটা খেয়ে ফেলছে। তাই আবার লাগিয়ে দিলাম,এর কিছুক্ষণ পর পানির নিচ থেকে টান পরায় দ্রুত বরশি তুলে ফেললাম।যা দেখে সাফা আর মার‌ওয়া আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। কারণ এবার একটা মাঝারি সাইজের তেলাপিয়া মাছ আটকা পড়েছে।
এরকম একটার পর একটা তেলাপিয়া মাছ উঠতে থাকে। শেষে আমি বিরক্ত হয়ে উঠে যাই, কারণ তেলাপিয়া মাছ আমি খাই না।তাই এগুলো দেখলেই বিরক্ত লাগে।এই পুকুর’টাতে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করা হয়। অথচ শুধু তেলাপিয়া গুলো ধরা দিচ্ছে।তাই লতার হাতে বরশি ধরিয়ে দিয়ে,সাফা আর মার‌ওয়া কে কে নিয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকে গেলাম। এখানে অনেক ধরনের ফলের গাছ আছে,ভাইয়ারা বাসায় না থাকলে সব আশে পাশের মানুষজন সংগ্রহ করে খায়।ফলের বাগানে গিয়ে দেখলাম একটা ছোট্ট গাছে কমলা ধরে আছে। গাছটা ছোট হলেও ঝাঁপিয়ে ধরেছে কমলা। তবে এগুলোর সাইজ অনেক ছোট, দেখতে মনে হচ্ছে পেকে গেছে।সাফা আর মার‌ওয়া আমার অপেক্ষা না করে নিজেরাই গিয়ে গাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসে। আমার হাতে দিতে, খোসা ছাড়িয়ে দিলাম। সবার প্রথমে সাফা পুরো কমলা মুখে পুরে দেয়।চার সেকেন্ডের মধ্যে সাফার মুখশ্রী দেখার মতো অবস্থা, একদম যাকে বলে বাংলার পাঁচ! সাথে মার‌ওয়া মুখে দিয়ে সাথে সাথে ফেলে দেয়। ওদের এই অবস্থা দেখে আমার সাহস হচ্ছে না খাওয়ার। কিন্তু সাফা জোর করে মুখে ঢুকিয়ে দিল, এগুলোর টেষ্ট কেমন বলার জন্য। খেয়ে আমার ও করুন অবস্থা!এত্ত পরিমানে টক কি বলবো?মার‌ওয়া হাসতে হাসতে বললো,
– আম্মু তক?হা হা হা,,,,
সাথে সাফা ও হাসছে। আমি হাতে থাকা বাকি কমলা গুলো ফেলে দিয়ে, পেয়ারা গাছের দিকে গেলাম। গাছটা বড় বলে পেয়ারা গুলো নাগালে পাচ্ছি না আমি। তাই একটা লাঠি দিয়ে আঘাত করলাম, কিন্তু তাও পড়ছে না। তখন ভাইয়া এলো, ভাইয়াকে বলতেই তিনি খুব সহজেই পেরে দিলেন। সাফা আর মার‌ওয়া একটু খেয়ে খেয়ে চুষে ফেলে দেয়, সাথে দৌড়া দৌড়ি করা শুরু করে। গাছের সাথে লেগে ব্যাথা পাবে সেই দিকে কোন খেয়াল নেই এদের।
একটা বেল গাছে অনেক বেল ধরে আছে,এর কয়েক হাত দূরে তেঁতুল গাছ। তেঁতুল গাছটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক পুরনো আর অনেক লম্বা। গাছে উঠা ব্যতিত তেঁতুলের নাগাল পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। এর কয়েক হাত এগিয়ে অনেক গুলো সুপারি গাছ, সুপারি ও বেশ ভালো ধরে আছে। তাছাড়া আরো অনেক ফলফলাদি রয়েছে এখানে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন, তোমরা খাও এবং পান করো তবে অপচয় করো না। সেই জন্যই ভাইয়া এখানে কোন পাহারাদার রাখেন না, মানুষজন যেন খেয়ে তৃপ্তি পায়।
________
এখানে কিছুদিন থেকে, সবাই মিলে নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি। আমার কলেজের গলি থেকে দশ মিনিটের পথ এগিয়ে একটা চার তলা বিল্ডিং এ দুতলার পুরো অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকি আমরা। বাসায় আসার পর থেকে ভাবির মুখের দিকে তাকানো দায়!তার খুব রাগ, তাকে ছাড়াই বিয়ে সম্পূর্ণ হলো তাই। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে বিয়েটা হয়েছে সেটা মানতে তিনি নাড়াজ‌। কতো বার বুঝিয়ে বললাম,আপু ও বললো তাও সেই মুখ ফুলিয়েই আছে।

আব্বু তার সাফা আর মার‌ওয়া নানু মনিদের পেয়ে খুব খুশি। তাদের সাথে দৌড়ে খেলছে, মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে বসে পরে। সাফা মারওয়া তখনি বায়না শুরু করে তাদের সাথে খেলা করার। শেষে ছোট ভাই আরিয়ান কলেজ থেকে ফিরলে তাকে ধরিয়ে দিয়ে আব্বু চলে যায় রেস্ট নিতে, এই বয়সে এসে দৌড়ে ছাপ সত্যি খুব কঠিন।

হাবিব ভাইয়া আর অনামিকা আপু এক সপ্তাহ পর চলে যায় ইতালি। আমি আবার আগের মত একা হয়ে যাই। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত জীবন শুরু হয়। তিন দিন পর ইনকোর্স এক্সাম,তাই দিন রাত পূর্ণ মনোযোগ দেই পড়াশোনায়। আমার ছোট বেলা থেকেই অভ্যাস এক্সাম ঘনিয়ে এলে, পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া।এর আগে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো সভাব আমার।যাই হোক, এখন তৈরি হচ্ছি কলেজে যাওয়ার জন্য।এডমিট কার্ড নিতে হবে কলেজ থেকে,তাই যেতে হচ্ছে।
নিজেকে পূর্ণ পর্দায় ঢেকে নিলাম, শুধু চোখ গুলো ব্যতিথ। বাহিরে বের হলেই শুধু পর্দা করি আমি। এছাড়া বাসায় করা হয় না, ছোট বেলা থেকে যেটা অভ্যাস আমার। আমাকে পর্দা নিয়ে কেউ কখনো কিছু বলে নাই,যে পর্দা করার নিয়ম এরকম এরকম। শুধু বাহিরে নয় মেয়েদের সর্বদা সব স্থানে পর্দা করা ফরজ। এখন এসে আফসোস করি ইশ আমি যদি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। ইসলাম সম্পর্কে অনেক অনেক জ্ঞান অর্জন করতে পারতাম। এখন যেগুলা জানি খুবই নগণ্য, কতো কিছুই আছে যেগুলো অজানা রয়ে গেছে।যাই হোক আমিও একদিন সম্পূর্ণ পর্দা করবো ইনশা আল্লাহ।

আমাদের সমাজে এমন অনেক মেয়েরা আছে যারা সম্পূর্ণ পর্দা মেনে চলা ফেরা করি না।তাই বলে তো অন্যান্য ইবাদত অমান্য করি না। পর্দা করি না ঠিকই কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করি, রোজা রাখি, কোরআন শরীফ পাঠ করি। আরো অন্যান্য ইবাদত করি।
______
বক্স থেকে জুতা বের করছি তখন ভাবি এসে বাজারের লম্বা লিষ্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– আসার সময় বাজার গুলো করে নিয়ে এসো।

আমি ঠিক আছে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম, হাঁটতে হাঁটতে একপলক লিষ্ট টা দেখে বুঝলাম কম হলেও এখানে দুই হাজার টাকার বাজার হবে!অথচ ভাবি টাকা ও দিল না। হয়তো বিয়ে হয়েছে বলে এখন আর আমাকে বিনা পয়সায় খাওয়াবে না। কথা হলো এখন না হয় রাহাতের দেওয়া কিছু টাকা আছে, কিন্তু এগুলো শেষ হলে কি করবো আমি? আমি কখনোই রাহাতের থেকে টাকা চাইবো না, কখনোই না। কলেজ গেইটে আসতেই ভাবনার সুতো কাটলো। গেইটের দারোয়ান খুব নম্র ভাবে বললেন,
– কি প্রয়োজনে আসছো মামা?

বললাম,
– অনার্স প্রথম বর্ষের এডমিট কার্ড নেব।
– আচ্ছা যাও।

ভিতরে ঢুকে ক্যাম্পাস পেড়িয়ে সামনে যেতেই তুলির সাথে দেখা,আমার বেস্টু তুলি। আমি কাছে যেতেই অন্যদিকে হাঁটা শুরু করে তুলি।যা দেখে আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– দোস্ত রাগ করেছিস কেন?

তুলি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
– কথা বলবি না একদম!বর কে পেয়ে তো আমাকে ভুলেই গিয়েছিস, এখন হানিমুন শেষ করে আসছিস দোস্ত বলতে?

বুঝলাম সে ভিশন খেপে আছে আমার উপর,তাই রাগ ভাঙাতে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম একটা রেস্তোরাঁয়।মেনু কার্ড দিয়ে বললাম কি খাবে বলতে কিন্তু সে মুখ ফুলিয়েই বসে আছে। তাই বিয়েটা কিভাবে হয়েছে সবটা বললাম। সবটা শুনে তুলি হতবাক হয়ে গেছে।ও ভেবেছিল খুব ধুমধাম আয়োজন করে বুঝি আমার বিয়ে হয়েছে। এখন সবটা শুনে আমার গার্জেন দের মতো বুঝাতে শুরু করে দিয়েছে, আমি যেন রাহাত কে মাফ করে দেই। এখন তো বিয়ে হয়েই গেছে,তাই রাগ করে কি হবে? হেনতেন বকবক করেই যাচ্ছে সে।

তারপর কি মনে করে হঠাৎ প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে বললো,
– দোস্ত ইমরান ভাই জানলে কি হবে?

তুলির কথায় আমিও গাবরে গেলাম! আসলেই ঐ ছেলে যদি জানতে পারে আমার বিয়ে হয়েছে তাহলে ক্যালেংকারী হয়ে যাবে! সেই কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমার পিছনে পড়ে আছে। তা-ও আবার কলেজ শিক্ষকের ছেলে বলে খুব পাওয়ার তার।

– এই আয়রা কি করবি এখন? ইমরান ভাই শুনলে তো তোকে আজকেই তুলে নিয়ে যাবে!

– আচ্ছা তুই কিভাবে জানলি আমার বিয়ের খবর?

– ফারহা বলেছে। সে জন্যই তো রেগে ছিলাম,ফারহা জানে অথচ আমি তোর বেষ্টু হয়ে জানি না।

ফারহার কথা শুনে আরো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম আমি। কারণ ফারহা কোন কিছু গুপন রাখতে পারে না,সব বলে দেয়।যার কারণে ওকে বলি মুখ পাতলা মেয়ে।

– ফারহা কি কলেজে এসেছে আজকে?

– এসেছে তো, আজকেই তো ওর থেকে জানতে পারলাম আমি।

– তাহলে দ্রুত কলেজে চল।

দু’জনেই কলেজের দিকে দৌড় দিলাম, এদিকে পেছন থেকে ওয়েটার খাবার অর্ডারের জন্য ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখন বসে বসে খাবার খাওয়ার সময় নেই,ঐ মুখ পাতলা মেয়ে কে কিছু ঘটিয়ে ফেলার আগেই আটকাতে হবে। বানিজ্য অনুষদের দিকে দৌড়ে গিয়ে, খুঁজে পেলাম না ফারহা কে। তারপর কিছুক্ষণ দুজনে মিলে খুঁজার পর তুলি বললো,
– আয়রা ঐ দেখ?

তাকিয়ে দেখলাম আমাদের থেকে কিছুটা দূরত্বে ফারহা ইমরান ভাইয়ার সাথে কথা বলছে! কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ঠিক তেমনি, ফারহা এতোক্ষণে বলে দিয়েছে কিনা আল্লাহ তা’আলা জানেন,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।