ছায়া বিহীন পর্ব-০৪

0
2094

গল্পঃ #ছায়া_বিহীন (৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

কাঁপা কাঁপা হাতে দরজাটা খুললো কিন্তু কোনো একটা ভয়ে সে তার মুখ লুকিয়ে সেখান থেকে সরে আসলো। ইনাম তাকে পেছন থেকে দেখে তার মা’কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো..
___কে উনি?

তার মা ঊষার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মাথায় গুছিয়ে ওড়না দেওয়া, বুঝতে পারলেন ইনাম চিনতে পারেনি। জোহানা বলতে যাবেন কিন্তু তার আগেই ইনাম আবার বললো,
___ওও বুঝেছি আমি। বলতে হবে না। কিন্তু আগেরটার মতো সেও কয়দিন পরে টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যাবেনা তো?

জোহানা ঊষার দিকে হাত নাড়িয়ে বললেন
___আরে না, ও তো…

তার আগেই খেয়াল করলেন ঊষা চোখ ইশারা করছে যেন না বলে।
ইনামও কিছু শুনতে চাইলোনা। সে গিয়ে তার বাবার কাছে বসলো সারাদিনের কাজের হিসাব দিতে৷ ঊষা রুমে বসে রইলো, মাঝে মাঝে একটু উঁকি দিয়ে শুনলো বাবা ছেলের কাজের কথা।
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে জোহানা খাবার দিতে বললেন। ঊষাও কিচেনে গেলো খাবার দেওয়ার জন্য।

খাবারে বসে ইনাম একটু খেয়েই আনমনে বলে ফেললো,
___আম্মু নতুন মেয়েটার রান্না কেমন পরিচিত লাগছে! তুমি একদিন খেয়েছিলে না ঊষার রান্না সেটা কিছুটা এমন ছিল না?

বলেই ইনাম তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো, আর তোতলাতে তোতলাতে বললো,
___সরি আম্মু আমি বেখেয়ালে বলে ফেলেছি। প্লিজ কিছু মনে করো না।

রসিদ সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে খাচ্ছেনা, চোখে এখনি বর্ষা নেমে যাওয়ার উপক্রম।
ইনাম অল্প খেয়েই উঠে চলে গেলো, সাথে সাথে জোহানাও। এর মধ্যে বেকায়দায় পড়লেন রসিদ সাহেব। উনার খেতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনিও উঠে গেলেন। আড়াল থেকে ঊষা সবকিছুই শুনছিল। সবাই চলে যাওয়ার পরে সে গিয়ে একা একা খেলো।

রসিদ সাহেব রুমে যাওয়ার সাথে সাথে জোহানা বললেন.
___ওরে বলবে কাল সকালে সূর্য উঠার আগে যে এই বাসা থেকে চলে যায়। ওর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে আমি নিজেই দূর্বল হয়ে যাবো।

___ কিন্তু ওরে তো তুমিই কাল আসতে বললে, এখন তুমিই চলে যেতে বলো! আমাকে জড়িও না প্লিজ। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি কিছু বলতে পারিনা, খুব মায়া লাগে!

___ উফফ এই মায়া শেষ করে দিবে সব। ওরে দরজার সামনে বসা দেখে আমি গলে গিয়েছিলাম। রাতের বেলা মেয়েটা কোনো সমস্যা পড়ে কিনা। এটা মানবতা ছিল, সকালে চলে যেতে বললে দোষ হবে না। বলবে তুমি ব্যস!

___ জুহি তুমি মেয়েটার বাবার শাস্তি তাকে কেন দিচ্ছো?

___ তুমি তাদের পক্ষ নিচ্ছো? ভুলে গেছো আমার ভুলের শাস্তি কিন্তু আমার চেয়ে আমার পরিবার বেশি পেয়েছিল! আমার জন্য আমার বাবা মারা গেছে, কিন্তু আমি কার উসকানিতে এই ভুলটা করেছিলাম? বলো কার হাত ছিল পেছনে? এখন তার জন্য তার মেয়ে শাস্তি পাবেনা তো কে পাবে?তার মেয়ে পেলেই তার পাওয়া হবে।

___ আচ্ছা সেদিন রোমান তোমাকে বলেছিল পালাতে, তুমি তো অমত ছিলেনা, তখন তুমি না চাইলে সে জোর করে নিতে পারতো বলো?

জোহানা চুপ করে আছে।
রসিদ সাহেব আবার বললেন..
___যদি সেদিন রোমান আসতো তাহলে কি তোমার বাবা মারা যেতো না? তুমি এটাই বলতে চাও? আরে উনি তো তোমার এভাবে চলে যাওয়ায় চারপাশের মানুষের অপমান নিতে পারেননি। তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য রোমানের না আসাকে দোষ দিতে পারো না, আর রোমানকেও সম্পূর্ণ দোষ দিতে পারোনা। তুমি তো তোমার বাবাকে জানতে,তিনি তোমার উপর উপর কতটা ভরসা করতেন৷ সেদিনের সিদ্ধান্তে ভুল তোমার বেশি। হতে পারে রোমান এখনো জানেনা সেদিনের পর তোমার উপর দিয়ে ঠিক কি কি ঝড় বয়ে গেছে! আর তুমি আজ পর্যন্ত এটাও জানোনা, সে সেদিন কেন আসেনি!

___প্লিজ স্টপ। আপনার কি হয়েছে? আমি আগেও বলতাম সব দোষ রোমানের এখনো বলবো। সে আগে থেকেই জানতো সে আসবেনা। এরপরও সে আমাকে বিশ্বাস দিয়েছিল আসবে, মিথ্যে বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করেছিল, যার জন্য এতোকিছু হয়েছে। নয়তো আজ এতটা বছর আমাকে এতো যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হতোনা। সব দোষ রোমানের।

রসিদ সাহেব বিছানায় শুতে শুতে বিড়বিড় করে বললেন,
___ হ্যাঁ রোমান এমন না করলে সব ঠিক থাকতো, কিন্তু আমি তোমাকে পেতাম না। তোমার বাবা বেঁচে থাকলেও হয়তো, এতোদিনে আমিই মরে যেতাম।

জোহানা কথাটায় একদম চুপ করে গেলো। অনেক্ষণ একমনে কিছু ভাবলো। তারপর পেছনে তাকিয়ে দেখলো রসিদ সাহেব ঘুমিয়ে গেছেন। তার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন আসলেই তো সেদিন সব ঠিক থাকলে আজকে এই মানুষটাকে তিনি পেতেন না। মাঝে মাঝে রসিদ সাহেবের ধৈর্য্য আর শ্রদ্ধাবোধ দেখে জোহানা প্রতিনিয়ত অবাক হয়, নতুন করে চিনে আর তার প্রেমে পড়ে। সেদিন তার অসময়ে উনিও যদি মুখ ফিরাতেন হয়তো জোহানা সেদিন আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ খুঁজে পেতোনা। এই একটা মানুষ ছাড়া হয়তো পৃথিবীর কেউই তার এতকিছু সহ্য করে সবকিছুর অভাব ভুলিয়ে এতবছর কাটিয়ে দিতো না। জোহানার হাজার জটিল কিছুও তার কাছে একদম সহজ সাবলীল! তিনি প্রতিটা ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার ছোঁয়ায় ছেয়ে থাকেন সবসময়!
.
.
এদিকে ঊষা এদিক ওদিক ঘুরছে, তার ঘুম আসছেনা। ইনামের সাথে তার অনেক কথা ছিল। কিন্তু সেটারও সুযোগ নেই। ইনাম দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেছে। তাছাড়া এই রুম থেকে ওইদিকে গেলে ইনামের মা টের পাবে। পাশের রুমে থাকতে বলেছে তাকে। তার এসব ভাবনার মধ্যে তার ফোনে রিং বেজে ওঠলো। পাশাপাশি রুম হওয়ায় জোহানা তার রুম থেকে সব শুনতে পাচ্ছেন।
ঊষা ফোন ধরেই শুনলো তার বাবার কণ্ঠস্বর ভারী।
একটু জোর দিয়েই জিজ্ঞাসা করলো,
___ বাবা তোমার কি হয়েছে?

ওপাশ থেকে কি বলছে জোহানা শুনতে না পেলেও ঊষা কি বলছে শুনতে পাচ্ছে। ঊষা বলছে..
___মানে কি বাবা? আমি এখানে এসেছি সেই খবর ছোট চাচ্চু জানবে কীভাবে? আমি তো রাস্তায় কাউকে দেখিনি। কিংবা ইনামদের বাসায় আমাকে আসতে দেখেছে এমন কাউকে দেখিনি। উনারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে কেন এটা নিয়ে?

তারপর কিছুক্ষণ নিরব! হয়তো ওপাশ থেকে কিছু বলছে।

জোহানা অপেক্ষা করতে লাগলো ঊষা কি বলে।

দুই মিনিট পর ঊষা বললো,
___ আজব সেখান থেকে সব ফ্ল্যাটের মানুষকে কে জানালো? আর সবাই এটা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবে কেন? তুমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকো। এতো প্রেসার নিও না বাবা, লোকের কথায় কান দিবেনা।
আর ইনামের সাথে তো আমার বিয়ে হবেই।

জোহানার একদম বুকের ভেতর থেকে অকপটে একটা হাসি বেড়িয়ে আসলো। এবার অন্তত রোমান সাহেব এটা বুঝবেন একটা মেয়েকে নিয়ে বাজে রটনা হয়ে যাওয়ার পরে বাবা-মার কেমন লাগতে পারে! তারপর বিয়ের আগে ইনামের বাসায় থাকার পরেও যখন ইনামের সাথে বিয়ে না হবেনা তখন তো আর বাইরেই বের হতে পারবে না! হাহহ যে যা করে তার শাস্তির রাস্তা সে নিজেই উম্মুক্ত করে দেয়! কে বলেছিল মেয়েকে এভাবে পাঠাতে? আর নিজেই ফাঁদে ফেঁসে যেতে?
এসব মনে মনে ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ তিনি হাসলেন তারপর জোহানাও ঘুমাতে গেলেন।

পরেরদিন সকাল হতে না হতেই জোহানা ঊষাকে ডাকতে লাগলেন, কিন্তু সকালে তারাতাড়ি ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস না থাকায় অনেক্ষণ ডাকাডাকির পরে ঊষা উঠলো। চোখ কচলাতে কচলাতে সে এগিয়ে আসতে লাগলো, ঊষার দিকে তাকিয়ে জোহানা কেমন যেন শীতল হয়ে গেলেন। যেটা বলার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন সেটা পারবেন কিনা দ্বিধায় পড়লেন। তারপরও নিজেকে শক্ত করলেন তিনি।
ঊষা একদম কাছে এসে বললো,
___আম্মু ডেকেছেন?

জোহানা ঊষার চোখ থেকে নিজের চোখ ফিরিয়ে বললেন,
___ইনাম ঘুম থেকে উঠার আগে তুমি বাসায় চলে যাও। আর কখনো এই বাসায় আসবেনা।

ঊষা কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কান্নার স্বরে বললো,
___আপনি যতক্ষণ আপনার ছেলের বউ না করছেন আমি যাবোনা। আমি যে এখানে এসেছি সেটা জানাজানি হয়ে গেছে। এভাবে গেলে আমার বাবা সবার সামনে অপমানিত হবে। সবাই বাজে কথা বলবে। উনি অসুস্থ মানুষ এটা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবে না। প্লিজ এটা করবেন না। আমার বাবার খুব ভরসা আপনার উপর, বাবা আমাকে বিশ্বাস দিয়েছেন আপনি কখনোই আমাকে ফিরাবেন না।

জোহানা এবার ঊষার দিকে ফিরে তাকালো। চোখ উঁচিয়ে বললো,
___ কোন বিশ্বাসের কথা বলছো তুমি? আর আমার উপরে উনার কিসের ভরসা? হাস্যকর তো!

ঊষা কিছু বলতে যাবে তখনি ওপাশ থেকে ইনামের গলার আওয়াজ,
___আম্মু কি হয়েছে? এতো সকালে জোরে জোরে কার সাথে কি বলছো!

জোহানা এগিয়ে গিয়ে বললেন
___ ও কিছু না বাবা, ওই যে মেয়েটার সাথে কথা বলছিলাম। নামাজ পড়তে উঠেছিলে বুঝি? আচ্ছা এখন গিয়ে ঘুমাও!

ইনাম মায়ের কথা শুনে চলে যাবে তখনি ঊষা জোহানাকে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরে বললো,
___আম্মু ছেলের থেকে লুকোনোর কি দরকার! বলেই দেন না আমি এসেছি! এতো ভয় পাচ্ছেন কেন?

ঊষার কথায় জোহানা এবং ইনাম দুজনেই চমকে উঠে..

চলবে….