ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-০৫

0
122

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#পঞ্চম_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

দরজায় চোখ পড়তেই চমকে উঠে চিত্রা। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্র মহিলা একটু একটু করে এগিয়ে আসতে লাগলো।”চিত্রা মামুনি তুইইই।”

ভদ্র মহিলা চিত্রার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।টিনা কিছুই বুঝতে পারলো না।ভ্যাবলার মত তাকিয়ে রইল।মনে মনে বলল,”চিত্রা ম্যাডামকে দেখে শায়লা ম্যাডাম এতো খুশি হয়ে গেল কেন?ওনারা কি পূর্বপরিচিত?

সাজিদ এসে দেখে তার মা চিত্রাকে জড়িয়ে রেখেছে।ঘটনার মাথা মুন্ডু বুঝতে না পেরে টিনাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো।টিনার থেকে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে বলল,”মা তুমি এখানে?”

“তোর ফোনটা কোথায় রাখিস বল তো?কত বার কল দিয়েছি সবসময়ের হতাশ করলি।”

“মা আমি তো…”

“থাক আর অজুহাত দিতে হবে না।একটা না একটা অজুহাত ঠোঁটের ডগায় রেখে দিয়েছিস তা আমার বুঝতে বাকী নেই।এখন আর কিছু বলবো না। শুধু মনে রাখিস আমি তোর মা।আজ আমি খুব খুশি তাই আজ ছেড়ে দিলাম। অনেক দিন পর আমার চিত্রাকে দেখলাম।তুই এখানে কিভাবে এলি মামুনি?”

সাজিদ বলে “মা আমি তোমায় সব পরে বুঝিয়ে বলবো।তার আগে বলো তুমি চিত্রাকে কিভাবে চেনো?”

“চিত্রাকে শুধু আমি না,তুইও চিনতিস।অনেক বছর আগেকার কথা তাই হয়তো তোর মনে নেই।চিত্রা হচ্ছে আমার ছোটবেলার বান্ধবী চুমকির মেয়ে।ওর মা বেঁচে থাকতে আমি তোকে সাথে নিয়ে ওদের বাসায় যেতাম। এরপর তো আমরা কয়েক বছরের জন্য কানাডায় চলে যাই।ওখানে থাকাকালীন শুনলাম চুমকি আর নেই।কানাডা থেকে ফেরার পরও আমি ওকে দেখার জন্য ওদের বাসায় যেতাম।”

“কিন্তু আমায় তো নাও নি?”

“হুম কারণ তোর বাবা পছন্দ করতো না।তার মধ্যে একটা কারণ হচ্ছে তোর বাবার অর্থের দম্ভ।চিত্রার বাবার অবস্থান তোর বাবার অবস্থান থেকে নিচে।আর দ্বিতীয় কারণ তুই।”

“আমি??”

“হুম। চুমকি যখন বেঁচে ছিলো তখন একদিন আমি তোর বাবাকে লুকিয়ে চুমকির সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম।তুই আমার সাথে আসার জন্য খুব বায়না করছিলি।তাই বাধ্য হয়ে তোকে সাথে নিয়ে আসি।আমি আর চুমকি কথা বলছিলাম।তুই আর চিত্রা খেলা করছিলি। একটু পরে চিত্রার চিৎকার শুনতে পাই।গিয়ে দেখি তুই সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছিস।চিত্রা তোর মাথা কাছে বসে কান্না করছে।মাথা থেকে প্রচুর র****ক্ত বের হচ্ছে।ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল।দেরি না করে তোকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।তোর বাবাকে খবর দিলাম। তোর পড়ে যাওয়ার জন্য তোর বাবা আমায় খুব বকাবকি করলো।চিত্রাকে দায়ী করে চুমকিকে ছোট বড় অনেক কথা বলেছে।সে থেকে লুকিয়ে ওর কাছে যেতাম।তোর বাবা বা তুই কেউই জানতে পারিস নি।”সাজিদ ও এখানে কিভাবে?”

সাজিদ টিনাকে ইশারা দিলো চিত্রাকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। টেবিলের উপরে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে পানি পান করলো।শায়লাকে সোফায় বসিয়ে সব ঘটনা খুলে বলল।সব শুনে শায়লার চক্ষু চড়কগাছ। মনে মনে বলল,”এতো কিছু ঘটে গেছে অথচ মিনহাজ ভাই কিছুই জানালো না।”

শায়লা সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।”আমি চিত্রাকে এখানে রাখবো না।ও আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে থাকবে।তুই বস।আমি ওর সাথে কথা বলে আসছি।”

শায়লা গটগট করে চিত্রার রুমে চলে গেল।”টিনা চিত্রার যা কিছু জিনিসপত্র আছে সব আধ ঘন্টার মধ্যে গুছিয়ে দাও।”

শায়লার এমন আদেশ শুনে চিত্রা মনে মনে ভয় পেলো।”খালামনি আমায় তুমি বের করে দিচ্ছো?”

“তোকে বের করে দেবো এটাই তুই ভাবলি কি করে মা?আমি তোকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো!সেখানেই তুই থাকবি।এই সময়ে পরিবারের সাথে থাকতে হয়।”

“খালামনি আমি তোমার সাথে গেলে আঙ্কেল তো খুব রেগে যাবে।”

“তুই কিচ্ছু ভাবিস না।তোর আঙ্কেল তোকে অনেক বছর দেখে নি।তাই চিনতেও পারবে না।আর যদি কোনোভাবে জেনে যায় তবে সেটা সামলানোর দায়িত্ব আমি নিলাম।”

শায়লা সাজিদ আর চিত্রা মিলে সাজিদদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো‌।চিত্রা মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছে। “আনোয়ার আঙ্কেল যদি কোনো ভাবে বুঝতে পারে তবে খালামনিকে অনেক বকাঝকা করবে। আমার জন্য সবার জীবনে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।আমায় কিছু একটা করতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি এদের সবার জীবন থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যেতে হবে।”

সাজিদদের গাড়ি একটা বড় বাড়ির সামনে এসে থামলো।গাড়ির হর্ণ দিতেই দারোয়ান এসে গেট খুলে দিলো।শায়লা গাড়ি থেকে নামলো।”শেফালী শেফালী”

“জি ম্যামসাব কন?”

“গাড়িতে কিছু জিনিসপত্র আছে এগুলো ভেতরে নিয়ে যাও।ওমা চিত্রা তুই বসে আছিস কেন?নেমে আয়!”

শায়লার ডাক শুনে চিত্রা অতি সন্তর্পণে নেমে এলো। চারপাশটা ভালোভাবে দেখতে লাগলো।বাড়িটা খুব সুন্দর।একদম রাজ প্রাসাদের মতো। শেফালী জিনিসপত্র নিয়ে ভেতরে গেল।শায়লা চিত্রার হাত ধরে ভেতরে ঢুকলো।”ম্যামসাব এগুলান কোনহানে রাখমু?”

“দোতলায় নিয়ে যা।”

শেফালী সিঁড়িতে পা দেবে তক্ষুনি শায়লা বলে ,”শেফালী দোতলা যাস না এই অবস্থায় ওর সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা একদম উচিত হবে না।তুই বরং নিচতলার ওই রুমে রেখে দে।”

“এসব কার শায়লা?”

আনোয়ার হোসেনের গলার আওয়াজ পেয়ে চিত্রা ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। শায়লার পেছনে নিজেকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা চালাতে লাগলো।

“এই মেয়েটি কে শায়লা?”

“ও আমার এক বান্ধবীর মেয়ে।ওর মা বাবা একটা কাজে দেশের বাইরে গেছে তাই এখন আমাদের সাথে থাকবে।”

আনোয়ার সাহেব চিত্রাকে ডাকলেন।চিত্রা যেতে চাইছে না। শায়লা ওর হাত ধরে আশ্বস্ত করলো।”বাহ ভারী মিষ্টি মেয়ে তো!একদম নিশ্চিন্তে থেকো তুমি।কোনো সংকোচ করবে না।এটাও তোমার বাড়ি।”

“যাকে তাকে তুমি আজকাল বাসার ভেতরে নিয়ে এসে কি ঠিক করছো মম?এটা তো একটা বাড়ি কোনো হোটেলে কিংবা মেয়েদের হোস্টেল নয়? আমাদের প্রাইভেসি বলে কিছুই রাখছো না দেখছি।আর বাবা তুমিও মমের হ্যাঁতে হ্যাঁ মিলিয়ে যাচ্ছো। অসাধারণ!”

কথাগুলো শুনে শায়লা নিজের মেয়ে জেরিনের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”তোমার সাহস তো কম নয়? আমার অতিথিকে তুমি যাকে তাকে বলছো? খবরদার জেরিন আজ যা বলার বলেছো। পরবর্তীতে আর যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়। এক্ষুনি এসে চিত্রার কাছে ক্ষমা চাও!”

“সরি মম।আমি প্রাইমারী স্কুলের ছোট্ট খুকিটি নই যে তোমার কথায় একটা রাস্তার মেয়েকে সরি বলবো। তুমি তোমার অতিথিকে মাথায় তুলে রাখো।”

“তাই নাকি জেরিন?তুই শিওর মা যাকে নিয়ে এসেছে সে রাস্তার মেয়ে?একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এভাবে অপমানজনক কথা বলতে মুখে একটুও আটকায় না?বিবেক বুদ্ধি কি সব জলাঞ্জলি দিয়ে ফেলেছিস? অবশ্য তোর দোষ নেই।ছোট বেলা থেকে সব না চাইতে পেয়ে গেছিস তাই মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে ইগোতে লাগে।

সাজিদের কথায় খুব অপমানিত বোধ করলো জেরিন।ধুপধাপ শব্দ করে রুমে চলে গেল।চিত্রা জেরিনের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে।”মন খারাপ করার মতো কিছু হয়নি। রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।মা চিত্রার অনেক যত্নের প্রয়োজন।টাইমলি খাওয়া দাওয়া করতে হবে।”

“তুই ভাবিস না।ওর কোনো অযত্ন হবে না।”

শায়লা চিত্রাকে রুমে নিয়ে গেল।ড্রাইভার এসে সাজিদকে বলল,”স্যার গাড়িতে একটা হারমোনিয়াম রাখা আছে। কি করবো?”

“আমার রুমে নিয়ে এসো।”

সাজিদ হারমোনিয়ামটা নিয়ে নিজের রুমে রেখে দেয়।”সময় হোক তোমার শখের জিনিস তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেবো।আমার হাতে তো বেশি সময়…..”

“স্যার ম্যাডাম আপনারে খাইতে ডাকতাছে।”

সাজিদ খাওয়ার টেবিলে এসে দেখে সবাই আছে শুধু চিত্রা ছাড়া।”মা চিত্রা খাবে না?”

“ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এলাম‌‌।”

সাজিদ চুপচাপ খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল।পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথাটা ভারী লাগছিল সাগরের।”চিত্রা কড়া করে এক কাপ চা দাও!”

বেশকিছুক্ষন হয়ে গেছে কিন্তু চিত্রার কোনো সাড়া পেলো না। সাগরের খটকা লাগলো।”কোথায় গেলো?”
শোয়া থেকে উঠে পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। কিন্তু চিত্রা কোথাও নেই।সাগর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।কি হয়েছে মনে করার চেষ্টা করলো।ধীরে ধীরে সব মনে পড়ছে।এ কয়েক দিন সে চিত্রাকে দেখতে পায় নি।একটা মানুষ বাড়িতে নেই আর সে বুঝতে পারলো না।এ কয়েকদিন খুব বেশি খাওয়া হয়েছেন।কোনো দিকে হুশ ছিলো না।মনে মনে একটা অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো।তবে এই আশংকা ভালোবাসার মানুষ দূরে চলে যাওয়ার জন্য নয়।তার টাকা আসার রাস্তা বন্ধ হওয়ার জন্য। পরক্ষণে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,”গেছে ভালোই হয়েছে আপদ বিদায় হয়েছে‌। এবার আমার যা খুশি তাই করতে পারবো। এতদিন কানের কাছে শুধু কাজ করো কাজ করো বলে ঘ্যান ঘ্যান করতো।বাপের টাকা-পয়সা দেখে বিয়ে করলাম। কিন্তু বুইড়া তো কিছুই দিলো না। এবার আরেকটা পাখি ধরার পালা। আগের মতো ভুল করা চলবে না।বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে।”

সাগর দরজায়…….

***চলবে***