ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-০৪

0
129

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#চতুর্থ_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

মেয়ের এমন করুন পরিনতির কথা শুনে মিনহাজ সাহেব অস্থির অস্থির করতে লাগলো। একমাত্র মেয়েকে দেখার তৃষ্ণা যেনো বহুগুণ বেড়ে গেল।”আঙ্কেল আমার যা বলার বলে দিয়েছি। আমি এবার আসি।”

সাজিদ বসার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।উঠোন পেরিয়ে গেটের কাছাকাছি চলে আসতেই পেছন থেকে মিনহাজ সাহেবের ডাক শুনতে পেলো।”দাঁড়াও।”

সাজিদ পা চালানো বন্ধ করে দিলো।”আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে চাই!নিয়ে চলো আমায়!”

“হুম নিয়ে যাবো।তবে এখন নয়।আমি শুধু আপনাদের চিত্রার ব্যাপারটা জানাতে এসেছি। আপনারা ওকে বুঝতে পেরেছেন তাতেই অনেক।আঙ্কেল আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।”

“কি অনুরোধ?’

“আমি না বলা পর্যন্ত আপনারা চিত্রার সাথে দেখা করবে না।”

“এ হতে পারে না। আমার মেয়ের এই অবস্থায় আমি বাবা হয়ে দূরে থাকি কি করে!এ তোমার অন্যায় আবদার তাছাড়া আমি তো অক্ষম পিতা নই। নিজের মেয়েকে খাওয়ানোর সামর্থ্য আমার আছে। সারাজীবন যা কিছু অর্জন করেছি সব মেয়ের জন্যই।ও তোমার কাছে কেন থাকবে? তুমি ওকে বাঁচিয়েছো তার জন্য তোমার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমার মেয়ে আমার বাড়িতে আমার সাথেই থাকবে। আমি অন্য কোথাও রাখবো না।”

“আঙ্কেল আপনাদের দেখলে তার নিজের প্রতি ঘৃণা বাড়বে। আত্মগ্লানিতে ভুগবে।ওর শরীরের যা অবস্থা এখন ওকে সবসময় হাসিখুশি থাকতে হবে। আপনার মেয়ে আপনার কাছেই থাকবে। শুধু কটা দিন যাক।আমি এসে চিত্রাকে দিয়ে যাবো।প্রমিস করছি।”

মিনহাজ সাহেব সাজিদের কথা মানতে চাইছে না।সাজিদ অনেক বুঝিয়ে রাজি করালো। ওনি কন্ঠস্বর ছোট করে বললেন,”ঠিক আছে।আমি তবে দূর থেকে একবার আমার মেয়েকে দেখবো। তুমি ওকে বাঁচিয়েছো তাই তোমার কথা রাখলাম। কিন্তু বেশিদিন আমার মেয়েকে দূরে রাখতে পারবো না।”

“ঠিক আছে আঙ্কেল আমি আপনাকে কাল এসে নিয়ে যাবো।”

মিনহাজের সাথে কথা বলা শেষ করে সামনের দিকে পা বাড়াবে এমন সময় টিনার কল।”হ্যালো স্যার,ম্যামকে খুঁজে পাচ্ছি না। টেবিলে একটা চিরকুট রেখে কোথায় যেনো চলে গেছে।”

“চিরকুটে কি লেখা?”

“আহত পাখি ফিরছে তার নীড়ে, ক্ষত বিক্ষত যাই হোক থাকবে তারই দ্বারে।”

“আপনি চিন্তা করবেন না আমি জানি সে কোথায় গেছে।আমি চিত্রাকে নিয়ে ফিরবো।”

গাড়ির স্প্রিড বাড়িয়ে চালানো শুরু করলো।”আচ্ছা মেয়েরা এমন কেন যারা তাদের কষ্ট দেয়,যন্ত্রণার অনলে একটু একটু করে মেরে ফেলে তাদের কাছেই বার বার ছুটে যায়। ভালোবাসা কি তবে এমন নির্লজ্জ বেহায়া!যে অবহেলা করে তাকে মনটা ভালোবেসে যায়!”

চিত্রা সাজিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা ভাড়া করলো।রিকশায় উঠে হুড তুলে দিল। একবার তাকে শেষ চেষ্টা করতে হবে। সাগরের কাছে গিয়ে বাচ্চার কথা বলবে।হয়তো বাচ্চার কথা শুনে সাগরের সুবুদ্ধি হবে।একটা ক্ষীণ আশা যেন তাকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে। গরমে ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছে।বৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।চিত্রার খুব পিপাসা পেয়েছে। বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি পান করে নিলো।ভাগ্যিস আসার সময় পানিটা নিয়ে এলো। রিকশা ভাড়া ছাড়া তার কাছে অতিরিক্ত টাকাও নেই। অনেক অলিগলি ঘুরে রিকশা তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছালো।রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। আনন্দ আর ভয় মিশে যেন এক অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে।মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর দরজার সামনে পৌঁছালো। গিয়ে দেখে দরজাটা হা করে খোলা।তার বেডরুম থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।চিত্রা রুমের আরো কাছাকাছি গেল। রুমের দরজারটা পুরোপুরি বন্ধ নয়। ভেতরে লাইট জ্বলছে। ফাঁক দিয়ে দেখে সাগর আর একটা মেয়ে। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল।সাগর নেশাগ্রস্ত,মাতাল কিন্তু সে যে চরিত্রহীন তা চিত্রার অজানা ছিল। দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো। বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজের উপর রাগ হতে লাগলো চিত্রার।এমন একটা জঘন্য মানুষকে সে কি করে ভালোবাসলো!!গলাটা ধরে আসছে। চোখ দুটো পানিতে ভরে গেল। চোখের পাতা ফেললেই যেন পানি গুলো ঝর ঝর করে ঝরে পড়বে।

“কান্না করার মতো কিছুই হয়নি মেয়ে। জীবনটা অনেক বড়।এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে চলবে না।গলির মুখে গাড়ি আছে গিয়ে বসে পড়ো।”

“আমি আপনার সাথে যাবো না।”

“ঠিক আছে যেও না।”

সাজিদ চলে গেল। সাজিদের এমন নির্লিপ্ত জবাবে চিত্রার আরো বেশি কান্না পেলো।কোনো বাঁধাই যেন মানতে চাইছে না।”এখন আমি কি করবো?কার কাছে সাহায্য চাইবো।বাবা তো সে কবেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিয়ের পর বন্ধু বান্ধবী সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।”

সাজিদ আড়াল থেকে বেরিয়ে বলল,”এই নাও রুমালটা দিয়ে চোখ মুখ মুছে নাও।”চিত্রা কাঁপা কাঁপা হাতে রুমালটা নিলো।চোখ মুখ মুছে সাজিদকে ফেরত দিলো।

“কোথায় যাবে তা ঠিক করেছো?”

চিত্রা মাথা নেড়ে জানালো ঠিক করে নি।”আমার সাথে যেতে চাইলে গাড়িতে গিয়ে বসো। আগামী দুই মিনিটের মধ্যে আমি চলে যাবো।”

সাজিদের কথা বলা শেষ হতেই না হতেই চিত্রা সুরসুর করে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো। সাজিদ চিত্রাকে নিয়ে ফিরে আসে।”মিস টিনা চিত্রাকে নিয়ে ভেতরে যান।কোনো দরকার হলে আমায় কল দেবেন!”

“জি স্যার।”

সাজিদ চলে যেতেই টিনা চিত্রাকে রুমে নিয়ে গেল।”টিনা আপু আমি একটু একা থাকতে চাই।”

“কিন্তু ম্যাডাম!”

“প্লীজ আপু।”

চিত্রার চোখ মুখ দেখে টিনা বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে।টিনা আর কথা বাড়ালো না।চিত্রাকে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।চিত্রা এসে দরজা লাগিয়ে দিলো।বার বার সাগরের করা বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে পড়তে লাগলো। ভুল মানুষকে ভালোবাসার শাস্তি পাচ্ছে।”আমি এত বড় একটা ভুল কি করে করলাম।একটা মানুষকে চিনতেই পারলাম না। তাহলে কি বাবা ঠিকই বলতো এ রংচঙ মাখা শহরে মানুষ চেনা যায় না।কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ তা জানা খুব কঠিন।বাবা ও বাবা আমায় তুমি মাফ করে দেবে তো বাবা।আমি কোন মুখে তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো বাবা। তোমার চেয়ে বেশি কেউ আমায় ভালোবাসে না।জানো তো বাবা তোমার মেয়েটা সত্যি একটা বোকা। মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করে ফেললাম বাবা। আচ্ছা বাবা ওরা কিভাবে পারে এমন করে ঠকাতে। ওদের কি একটু কষ্ট হয় না!”

চিত্রা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মানুষটা ভুল কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসাটা তো ভুল নয়।সে তো সাগরকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল কিন্তু চিত্রা কোনো সাড়াশব্দ নেই।টিনার খুব টেনশন হতে লাগলো। কয়েকবার এসে ডেকে গেল কিন্তু চিত্রা কোনো উত্তর দেয় নি। সাজিদ ও কল রিসিভ করছে না।কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।টিনা গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতে লাগল। একটু পরে চিত্রা এসে দরজা খুলে দিলো।”ম্যাডাম আপনি দরজা খুলছিলেন না কেন! আমার খুব টেনশন হচ্ছিল।”

“টিনা আপু তুমি টেনশন করো না আমি ঠিক আছি।আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

“দুপুরে তো কিছুই খান নি।হাতে মুখে পানি দিয়ে আসুন আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।”

চিত্রা খাওয়া দাওয়া শেষ করে টিনার সাথে গল্প করতে লাগল। অফিসের কাজগুলো শেষ করতে করতে রাত প্রায় নয়টা বেজে গেছে।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে টিনার অনেকগুলো কল।”ওহ শীট। কাজের চাপে ফোনটা যে সাইলেন্ট বুঝতে পারলাম না। ওদিকে সব ঠিকঠাক আছে তো!সবুজ সবুজ!

“জি স্যার!”

“ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে।আমি এক্ষুনি বের হবো।”

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে টিনা এসে দরজা খুলল।দরজা খুলে টিনার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো।”কি হলো এমন ভয় পাচ্ছো কেন?আমি কি বাঘ যে তোমায় খেয়ে ফেলবো?সরো দরজা থেকে”

“বড় ম্যাডাম আপনি”

“সাজিদ কোথায়?ওকে ডাকো।”

“ম্যাডাম, স্যার তো এখানে আসে নি।”

চিত্রা এসে বলল,”টিনা আপু কে এসেছে?”

দরজায় চোখ পড়তেই………..

****চলবে****