ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-০৮

0
104

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#অষ্টম_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

চিত্রা সাজিদের রুমে যাচ্ছিলো। কিন্তু সাজিদের রুমটা কোথায় তার জানা নেই। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না।”এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না।সাজিদ ভাইয়ার রুমটা খুঁজতে হবে।”

ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো একটা রুমের দিকে। দরজাটা ভেজিয়ে রাখা।চিত্রা রুমের দরজা একটু ফাঁক করে দেখে জেরিন জানালা পাশে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে!চিত্রা কোনো শব্দ না করেই চলে আসছিল এমন সময় ,”আপনার মধ্যে কি এমন আছে যা আমায় বার বার অবাধ্য করে! আপনি সামনে এলে আমার এতো এলোমেলো লাগে কেন?মনের ভেতরটা কেন এতো অশান্ত সমুদ্রের মতো হয়ে ওঠে।এই অনুভূতির নাম কি!কেন আমি এতোটা অবুঝ হয়ে পড়ছি!”

চিত্রা জুঁইয়ের সব কথা শুনে বুঝলো জেরিন কাউকে ভালোবাসে।অবশ্য বেশকিছু দিন ধরে লক্ষ্য করছে জেরিনের কথাবার্তায় বেশ পরিবর্তন।আগের চেয়ে ভদ্রভাবে কথা বলে।প্রেমে পড়লে বোধহয় এমনই হয়।চিত্রা সাহস সঞ্চয় করে জেরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।”একতরফা ভালোবাসা বড্ড কষ্টের।কাউকে কিছু বলা যায় না,বোঝানো যায় না।শুধু দূর থেকে একটা মানুষকে নিয়ে নিজের মতো করে স্বপ্ন বোনা যায়। এভাবে ভালোবেসে কষ্ট না পেয়ে যাকে ভালোবাসো তার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। মুখোমুখি হয়ে সে কি চায় জানার চেষ্টা করো। হয়তো তুমি যেমন কষ্ট পাচ্ছো ঠিক তেমনি সেই মানুষটিও কষ্ট পাচ্ছে।”

“কিন্তু সে যদি আমায় প্রত্যাখান করে তখন আমি কি করবো চিত্রা?”

“আগে থেকে খারাপটা ভাবছো কেন?ভালো কিছু ও হতে পারে।জেরিন একটা কথা মনে রাখবে জোর করে কারোর ভালোবাসা পাওয়া যায় না।সে যদি তোমায় না চায় তোমার উচিত তার দিক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু শুরুতেই তুমি খারাপ কিছু ভেবো না।যা হবার সব ভালো হবে।”

কথাগুলো বলে চিত্রা রুমে থেকে বেরিয়ে আসলো।পেছন থেকে জেরিন বলল,”অনেক ধন্যবাদ চিত্রা এভাবে সাহস দেওয়ার জন্য।”চিত্রা মুচকি হাসি দিয়ে চলে আসলো। “অনেক রাত হয়ে গেছে এখন আর সাজিদ ভাইয়াকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।কাল সকালে না হয়…”চিত্রা রুমের দিকে পা বাড়ালো।চিত্রার কথা শুনে জেরিন মনে মনে ঠিক করলো সে মিহানকে তার মনের কথা জানাবে।

পরের দিন সকালে চিত্রার ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসলো।আগের ফোন সাগরের বাসায় রেখে এসেছিল তাই শায়লা চিত্রাকে নতুন একটা ফোন কিনে দিলো। আননোন নাম্বার দেখে প্রথমে রিসিভ করে নি। দ্বিতীয় বার রিং হতেই চিত্রা রিসিভ করলো।কথা বলা শেষ করে শায়লার কাছে ছুটে গেল।”খালামনি একটা গুড নিউজ আছে।”

শায়লা চিত্রার দিকে তাকিয়ে দেখে চিত্রাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে।”আলহামদুলিল্লাহ।কি খুশির খবর মা?”

“আমি রেকর্ডিংয়ের সুযোগ পেয়েছি।”

“কিসের রেকর্ডিং?”

“গানের রেকর্ডিং খালামণি।ওনারা আমার গান শুনেছেন।একটু আগে কল দিয়ে বলল ওনাদের নাকি আমার ভয়েজ খুব ভালো লেগেছে। আগামীকাল ওনাদের অফিসে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন।”

“বাহ এটা তো দারুন খবর।তুই বস আমি সাজিদ আর তোর আঙ্কেলকে জানিয়ে আসি।”

জেরিন অনেক তাড়াতাড়ি ভার্সিটিতে চলে এসেছে।আজ মিহানকে সব কথা বলবে।এভাবে একা একা কষ্ট পাবে না।এসে দেখে আজ সিনিয়রদের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।সবাই বেশ সাজগোজ করে এসেছে।রুশা আর রকি এখনো আসেনি।জেরিন গিয়ে মিহানকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও পেলো না। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো মিহান এখনও আসেনি।জেরিন এক কোনায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।”কি রে ক্লাসে না গিয়ে এখানে কি করছিস?”

“ক্লাস তো হবে না মনে হয়। দেখছিস না সাজানো হয়েছে প্রোগ্ৰাম আছে।”

“ওহ।তাহলে তো ভালোই। অনেক দিন পর তিনজন মিলে ঘুরতে যাবো।রকিকে বলি তাড়াতাড়ি আসতে।”

“না রে আমি যাবো না। আমার আরেকটা কাজ আছে তোরা যা।”

জেরিন রুশাকে না করে দিয়ে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছিলো।মিহানকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ওর বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করতে লাগলো।এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো মিহানের দিকে।কেমন এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার মধ্যে! হঠাৎ দেখলো মিহান একটা মেয়ের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করছে।গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা আসার পর মেয়েটা একটা পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। মিহান ওকে ধরে ফেলে। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে দেখছে।সবাই নিজেদের মধ্যে বলল এই মেয়ের সাথে মিহানের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কয়েকদিন পর ওদের বিয়ে।অথচ জেরিন এসবের কিছুই জানে না। চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারোর সাথে ভাগ করা যায় না। ভালোবাসার মানুষটি একান্তই ব্যক্তিগত।জেরিন আর দেরি না করে ওখান থেকে চলে আসলো। জেরিনের এভাবে চলে আসাটা কারোর চোখে না পড়লেও একজনের চোখ ঠিকই তা লক্ষ করেছে।জেরিন বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে দিলো।তার পৃথিবী বিষাদের ছায়ায় ছেয়ে গেছে।জেরিন নিজেকে সামলাতে পারছেন না।রাত পার হলো।দুজনের জীবনে এক নতুন ভোর।কারোর জন্য নতুন করে বাঁচার একমাত্র আশা আর কারোর জন্য এক বুক হতাশা আর একাকিত্বের অভিশাপ।

শায়লা নাস্তা খেয়ে চিত্রাকে নিয়ে গানের স্টুডিওতে গেল।জেরিন রাতে ঘুমায় নি।সারা রাত জেগে ছিলো।ভোর রাতে একটু ঘুম এসেছে কিন্তু খানিকক্ষণ পর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে চমকে ওঠে। অনেক সময় ধরে মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। চোখগুলো বেশ ফুলে গেছে। রুশাকে জানিয়ে দিলো সে আজ যাবে না।

—————————————————————–

বেশ কয়েকদিন ধরে জেরিনকে দেখতে না পেয়ে মিহান অবাক হয়। সেদিনের পর জেরিন চুপচাপ হয়ে গেছে। ভার্সিটি আর বাসা ছাড়া অন্য কোথাও যায় না।মিহান ক্লাস করাতে এসে রুশাকে বলল,”রুশা ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করবে।”

“জি স্যার।”

ক্লাসশেষ হওয়ার পর রুশা মিহানের রুমে গেল।”আসবো স্যার?”

মিহান বসে ছিলো। দরজার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে আসার অনুমতি দিলো।”বসো”

রুশা সামনে থাকা চেয়ারটা টেনে বসলো।মিহান হাতের কাজ থামিয়ে রুশাকে বলল,”জেরিনের কি হয়েছে? বেশকিছুদিন ক্লাসে দেখছিনা।”

“স্যার ওর কি হয়েছে তা ঠিক জানি না।তবে অনেকদিন ধরে অনেক অন্যরকম লাগছে।আগের জেরিন যেন ধীরে ধীরে অন্য একটা মানুষে পরিণত হয়েছে।তবে কি কারণে এমন হচ্ছে তা আমি জানি না।”

“ঠিক আছে তুমি এবার আসতে পারো।”

রুশা চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেল।মিহান খানিকক্ষণ ভেবে ভুবন ভোলানো হাসি দিলো।যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ।ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে কল দিয়ে বলল,” আমার দায়িত্ব শেষ।”

চিত্রার গানের রেকর্ডিং বেশ ভালো চলছে। চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে।সবাই বেশ প্রশংসা করতে লাগলো।আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। ইদানিং বাবার কথা বেশ মনে পড়ে। কিন্তু কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে চোখদুটো ছলছল করে।”চিত্রা আজ আমরা বাইরে ঘুরতে যাবো।রেডি হয়ে নে।”

“কোথায় যাবো খালামনি?”

“আজ আমার বান্ধবীর জন্মদিন।ওখানে যাবো।তুই রেডি হয়ে নে আমি জেরিনকে বলে আসি।”

“আচ্ছা।”

“জেরিন জেরিন।”

“হুম মম বলো।

“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।তোর রাশেদা আন্টির জন্মদিন।সবাইকৈ ইনভাইট করেছে।”

“মম আমি যাবো না।তোমরা গিয়ে ঘুরে আসো।”

“চল না মা।আমায় বার বার বলেছে তোকে নিয়ে যেতে।”

“আমার কোথাও যেতে ভালো লাগে না মম।”

“এই অস্থিরতা বিষন্নতা হয়তো কেটে যাবে।যা নিয়ে এতো মন খারাপ সব হয়তো দূর হয়ে যাবে। একবার চল ওখানে গিয়ে যদি ভালো না লাগে তবে চলে আসিস।”

শায়লার কথাগুলো শুনে জেরিন অবাক হলো।”মম কি বলে গেল এসব।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেডি হয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেল।সবাই কতো মজা করছে!অথচ তার মনে এক বিন্দু আনন্দ কাজ করছে না।জেরিন সবার মাঝখান থেকে উঠে গিয়ে গার্ডেনের দিকে যাচ্ছিলো। একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল।মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো……….

****চলবে****