জবা ফুলের রঙ লাল পর্ব-০৩

0
181

#জবা_ফুলের_রঙ_লাল

তৃতীয় পর্ব

” দেখো, ত্রপা তুমি কেন এভাবে হুট করে চলে এলে এটাই এখনো মাথায় ঢুকছে না আমার,” এখানে দাঁড়িয়ে অমল স্যারের একপাশ দেখা যাচ্ছে কেবল। আর যে নারীর সাথে চলছে এই নিভৃত কথোপকথন তার মুখের আদলটা কেবল বোঝা যাচ্ছে, এমনভাবে দাঁড়িয়ে। তাঁতের খয়েরি পাড় হলুদ শাড়িটা খুব যত্ন করে পরা।

” তুমি জানো না বাসার কী অবস্থা? মামীকে তো চেনই। সে নিশ্চয়ই সন্দেহ করেছে কিছু একটা। একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে যেন আমি স্বীকার করে ফেলি তোমার ব্যাপারটা। আর তাতে মামাকে সে ইচ্ছেমত কথা শোনাতে পারবে।”

” আমার নতুন চাকরি ত্রপা। এখানে তোমার এভাবে আসাটা একদম পছন্দ করিনি।”

” আমার দিকটা বোঝ প্লিজ,” ত্রপা কাঁদছে।

” কেঁদো না ত্রপা। আমি আসলে বাসায় জানাতে পারিনি তোমার কথা। বড়দা এখনো বিয়ে করেনি৷ আমি কিভাবে এ কথা বলি৷ আর টানাটানির সংসারটা অনেক কষ্টে দাঁড়িয়েছে এতদিনে। আমি চাই একটু সময় দিতে। ”
ত্রপা ঘুরে দাঁড়াল।

” আর আমার এখানে একটা মানসম্মান আছে। হুট করে চলে এলে লোক জানাজানি হলে খুব বাজে হবে ব্যাপারটা৷ নতুন চাকরি,” অমল মাথা নিচু করে বলছে।

” আর আমার দিকটা তুমি একবারও ভাবলে না? আমি এই অবস্থায় কী করব? আমার মান সম্মানের কথা ভাবলে না একটুও? ” মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে কান্নার গতি রোধের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই দরজা দিয়েই বেরুবে৷ আমি সরে দাঁড়ালাম। আমার পায়ের নিচের মাটি টলে উঠল। মেয়েটার সিঁথিতে আমি রক্ত জবার মত লাল একটা ফোঁটা দেখলাম। আমার ভেতরটা যেন ভেঙেচুড়ে গেল। অমল স্যার বিবাহিত আর সেটা তিনি সবার থেকে আড়াল করেছেন!

আমি সরে দাঁড়ালাম দরজা ছেড়ে। তবে খেয়াল করিনি ওপাশে একটা চেয়ার ছিল। আমার পায়ে লেগে শব্দ হল। অমল স্যার আর ত্রপা দুজনেই আমাকে দেখতে পেল। আর ভীষণ অবাক হল। আমি চোখের পানি লুকোনোর সময়ও পেলাম না।

” তুমি এখানে কী করছ তুতুল? আজ প্রাইভেট হবে না সেটা তো জানিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি জানতে না?” অমল স্যারের কণ্ঠে বিস্ময়।

আমি চুপ করে রইলাম।

ত্রপা আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। আমার মুখ থেকে তার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি এসে থামল আমার হাতে থাকা জবাফুলগুলোয় এসে। আমিও তাকে দেখলাম। তার চোখে অবিশ্বাস ভিড় করছিল। আমার ভেতরটা জ্বালা করে উঠল। আমার ভীষণ পছন্দের মানুষটা তার একান্ত নিজের সেটা মনে পড়তেই ঈর্ষা অনুভব করতে লাগলাম।

” তোমার নাম তো তুতুল। তুতুল তুমি একটা সত্যি কথা বল তো। আজ প্রাইভেট হবে না জেনেই কি তুমি এসেছ? ” কণ্ঠটা এত শীতল যে আমার ভেতর হতে থাকা রক্তক্ষরণে যেন কেউ বরফ চেপে ধরল।

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

” কেন এসেছ?” প্রশ্নটা যেন শীতলতম অনুভূতি থেকে জন্ম নিল।

আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কেবল অমল স্যারের দিকে একবার তাকালাম৷ এই দৃষ্টি অলক্ষ্যে রইল না ত্রপার।

” তুমি একা আসতে বলেছিলে এই মেয়েটাকে? এজন্যেই আমি আসাতে এত অবাক হয়েছ? এতটা বিরক্ত হয়েছ? ” ত্রপা অমল স্যারের মুখোমুখি দাঁড়াল। কথা বলছে সে দ্রুত।

” যা তা বলে যাচ্ছ। আমি কেন ওকে আসতে বলব। আমাকে এতদিন এই চিনেছ তুমি? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে ত্রপা। এই মেয়ে, তুমি সব সত্যি বলে দিচ্ছ না কেন? আমি ডেকেছি তোমাকে নাকি তুমি নিজের ইচ্ছেয় এসেছ? একদম মিথ্যে বলবে না। “, আমি অমল স্যারের এমন উত্তেজিত কণ্ঠস্বর জীবনেও শুনিনি। রাগে তার শ্যামবর্ণ মুখ কেমন মলিন হয়ে গেছে।

আমার জিহবা পাথর হয়ে গেছে যেন। একটা শব্দ বের করতে পারছিলাম না আমি। চোখগুলো হয়ে উঠেছিল প্লাবিত নদী। আমি মাথা নিচু করে দেখছিলাম আমার ভেঙে পড়া। আমার গড়িয়ে পড়া চোখের জল শুষে নিচ্ছিল সিমেন্ট বাঁধানো মেঝে। আমার সমব্যথী হয়েই বোধহয় জবাফুলের তিনটে পাঁপড়ি পড়ল মেঝেতে।

” তোমাকে আমি আসলেই চিনতে পারিনি অমল। ছোটবেলা থেকে ভালবাসি। তুমি আমাকে ভালবাসো তাই জানতাম। বাবা মা বেঁচে থাকলে এতটা নিরুপায় হয়ত হতাম না। এখন বুঝতে পারছি না। আসলে ভালবেসে বিয়ে করেছ নাকি মামীর বাসায় আমি টিকতে পারছিলাম না বলে দয়া করে গোপনে বিয়ে করেছ বুঝতে পারছি না। ” শব্দ করে কাঁদছে ত্রপা। আমিও কাঁদছি। তবে নিঃশব্দে।

” এই মেয়ে আমার ছাত্রী ত্রপা। বিশ্বাস কর। আমি কোনদিন তোমার বিশ্বাস ভাঙিনি। সম্ভব না সেটা। আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি প্লিজ এমন কোর না। এই অবস্থায় এমন উত্তেজনা ভাল কিছু না,” সবসময় প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলা অমল স্যার কেমন অনুনয় করছিল ত্রপার সামনে। আমার আবার ঈর্ষা হল। পাথর হয়ে গিয়েছিলাম যেন। উদ্ভূত এই ভুল বোঝাবুঝি আমার মৌনতায় ডালপালা ছাড়ছিল বুঝতে পেরেও কিছুই বললাম না।

” যে মানুষ নিজের সততা রাখতে পারে না। তার সন্তান না জানুক এমন কেউ তার বাবা,” ত্রপার কণ্ঠ শুনে আমি যত না চমকে গেলাম, তারচেয়ে বেশি অবাক হলাম তার বলা শব্দগুলো শুনে।

অমল স্যারকে কিছুই না বলার সুযোগ দিয়ে চলে গেল মেয়েটা। অনেকবার আটকানোর চেষ্টা করেছিল অমল স্যার। পারেনি। ত্রপার পিছু নিয়েছিল অনেকদূর।

আমি অনেকক্ষণ বসেছিলাম। সন্ধ্যে হল। কেউ এল না। ধীরপায়ে বেরিয়ে এলাম। বের হতেই দেখা হল ওবাড়ির কেয়ারটেকারের সাথে। সে অযাচিত কিছুর সাক্ষী হয়ে গেছে এমন একটা ভঙ্গি করে চলে গেল। হাতের জবাফুলগুলো ততক্ষণে মৃত পাখির মত নিথর হয়ে পড়ে আছে আমার মুঠোয়। ফেলে দিলাম ওগুলো। শুধু পারলাম না ভেতরে জমা বিচ্ছিরি অনুভূতিটা উপড়ে ফেলতে…

(চলবে)