জবা ফুলের রঙ লাল পর্ব-০৪

0
185

#জবা_ফুলের_রঙ_লাল

চতুর্থ পর্ব

পরে শুনেছি ত্রপা আসার খবরটা যেন জানাজানি না হয় সেজন্যে কেয়ারটেকারকে আধবেলা ছুটি দিয়েছিল অমল স্যার। কিন্তু তার সাথে দেখা হয়নি ত্রপার, সে এসে দেখেছিল আমাকে। পরদিন কলেজে যেতেই শুনলাম গুঞ্জন। আর সেসবের বিষয়বস্তু আমি আর অমল স্যার। ওসব ছড়িয়ে গেল বাতাসের আগে। মা অবাক হলেন। বাবাও একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। অনেককিছুই বললেন আমাকে। আমিও শুনে গেলাম। যদিও তারা বিশ্বাস করেননি আমি এমন কিছু করব যাতে তাদের সম্মানহানি হয়। কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশির মুখ থেকে আসা শব্দগুলো আমার কানেও আসত। ” যে মেয়েগুলো চুপচাপ ভাল মানুষ সেজে থাকে সেগুলোই এসব অকাজ করে” – এমন শ্রাব্য অশ্রাব্য কত কথা শুনছিলাম। সবচেয়ে বাজে কথা শুনতাম অমল স্যারের নামে। ” কি ভাল মানুষ ভাবটাই করে থাকত, চোখ তুলে তাকাত না, আর বাড়িতে নিয়ে উঠেছে। ছি ছি!” আমার ভীষণ কষ্ট হত সেসব শুনে। কিন্তু পারতাম না সব সত্যিটা বলতে। যখন মিথ্যে ভিত গেড়ে বসে সত্য সেখানে ভাড়াটিয়া। সত্য মিথ্যে নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করলে সেটা হয়ে যায় ভাড়া কাটাবার ফন্দি। আমি মৌন দর্শক হয়ে রইলাম।

অমল স্যার মাস খানেক পর বদলি নিয়ে চলে গেলেন। যাবার আগে একবার তাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পারিনি। একটা চিঠি পাঠিয়েছিল লোক মারফত। তাতে লেখা ছিল, ” আমার এতবড় ক্ষতি হয়ে যাবে বুঝিনি। কাউকে দোষ দিতে পারি না। দিব না। তবে ত্রপা আর বাড়ি ফেরেনি সেদিন। ভগবানের কাছে চলে গিয়েছিল আমার অনাগত সন্তান নিয়ে! ভাল থেকো। শিক্ষক হিসেবে একটাই উপদেশ দেব, অন্যের কষ্টের কারণ হবার চেয়ে আনন্দের কারণ হও কারো জীবনে।”

চিঠিটা সময়ে হারিয়ে গেছে। কিন্তু চিঠির অক্ষরগুলো আমার মস্তিষ্কে সেঁটে গেছে সারাজীবনের জন্যে। বেরুতে পারি না সেখান থেকে এতদিনেও। খুব চেষ্টা করেছিলাম অন্যের জীবনে সুখের কারণ হতে। শোভন কিংবা আমার মেয়ে নৈঋতা আমাকে ভীষণ ভালবাসে। কিন্তু আমি কি সুখী হয়েছি? রোজ রাতে শোভন যখন ভীষণ আনন্দ নিয়ে বিছানার ওপাশ ফিরত, আমি খুলে ফেলতাম আমার সুখী নায়িকার ছদ্মবেশ। হয়ে উঠতাম অপরাধীর তকমা নিয়ে ফেরারি হয়ে ঘুরে বেড়ানো এক কিশোরী। শেষ না হতে চাওয়া এক সন্ধ্যেবেলায় আটকে যেতাম সময়ের চক্রযানে। ভাবিনি কোনদিন মুক্তি মিলবে। তবে মুক্তি মিলেছিল এত বছর পর, আমার একচল্লিশ বছর পেরুবার শেষদিনে!

*
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল, শহরের মানুষগুলোকে নিয়ে বর্ষা যাচ্ছেতাই খেলে যাচ্ছিল যেন। একবার থামছে তো আরেকবার জোরেশোরে নামছে। আমিও খুব বিরক্ত ছিলাম। বৃষ্টি নামবে ভেবে একটা জর্জেট শাড়ি পরে বেরিয়েছিলাম সকালে। অথচ ঘণ্টাখানেক বাদেই রোদ উঠল আর গায়ের শাড়িটার জন্যে আফসোস হতে লাগল আমার। অফিসে রুমের এসিটা সেদিনই নষ্ট হতে হল। কিছুক্ষণ অফিসে থেকে বের হলাম। ফিল্ড ওয়ার্ক ছিল ফরিদপুরে। ভাগ্য ভাল ফেরি জলদি পাওয়া গেল। কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যে হল। তখনো ভ্যাপসা গরম৷ একটা এনজিও পরিদর্শনের কাজে বেরিয়েছিলাম। মাথায় রোদ নিয়ে কাজ করে গেলাম। একটা সুতির শাড়ির তীব্র অভাব বোধ করছিলাম। লাঞ্চ আওয়ারে ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি৷ তখনো কাজ বাকি। সব গুছিয়ে বের হতে হতে সন্ধ্যেবেলায় পৌঁছুলাম ফেরিঘাটে।
ফেরিতে ওঠার পর আমার হৃদয় অনন্তকাল পর জানল তার গোপন বসতকারীর কথা! আমি অমল বিশ্বাসকে দেখলাম ঠিক চব্বিশ বছর পর। একচল্লিশ বছরের নারী যেন সতের বছরের কিশোরী হয়ে দৌড়ে গেল তার সাথে কথা বলতে, ” স্যার কেমন আছেন? ” নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হলাম। এতটা আবেগ কত বছর নিজের মধ্যে টের পাইনি। কতগুলো দিন যেন ভালবাসিনি!
অমল বিশ্বাস অবশ্য আগের মতোই ছিলেন। ব্যক্তিত্ব সময়ের সাথে প্রখর হয়েছে। চোখে চশমা জুড়েছে। মুখের হালকা বলিরেখাগুলো চেহারার মাধুর্য আরো বাড়িয়েছে। আরো কি শুকিয়ে গেছে? হয়ত। আমি যেন অনেক বছরের তৃষ্ণা নিয়ে দেখছি তাকে!
” ভাল আছি। আপনি ? ঠিক চিনতে পারছি না। ”
” আমি তুতুল। আব্দুল করিম গার্লস কলেজ, পিরোজপুর? মনে পড়েছে? ”
” হুম, আপনি কেমন আছেন? ” বলে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে আপনি সম্বোধনটা চালিয়ে গেলেন তুমি বলার অনুমতি দেবার পরেও। খারাপ লাগল আমার। আচ্ছা একটা ব্যাপার বুঝে উঠতে পারলাম না। তার কণ্ঠটা আগের মত লাগছে না কেন? সব কি তাহলে বয়সের দোষ? কেমন কথা বললেই মনে হত আবৃত্তি করছেন। এখন তো খুব সাধারণ লাগছে। আর হাইটটাও যেন কমে এসেছে। নাকি আমিই বেশি ছোট ছিলাম বলে তেমন লম্বা মনে হত? তবু কৈশোরের ভাললাগাগুলো বৃত্তের মত ঘিরে ধরছিল তাকে।

তার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে পারলাম না কী ভীষণ খারাপ লাগা থেকে আজ এত বছর পর আমি ভীষণ ভাল আছি। এত ভাল কোনদিন থাকিনি যেন এই দুই যুগে। সৌজন্যবোধের হাসিতে বুঝিয়ে দিলাম ভাল আছি আমি। ততক্ষণে বাতাস জানান দিচ্ছে বৃষ্টি হবে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নেমেছে। আমরা ফেরির গেস্টরুমে বসলাম।

আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে দেখা হওয়ায় খুশি হননি অমল স্যার। সংকোচ ভর করেছে তার কথায়-ভাবভঙ্গিতে। কিন্তু আমার ভাল লাগছিল। তার উঁচু চিবুক আর রুপোলি হয়ে আসা ঘন চুল সব ভাল লাগছিল। নিজের ভেতরের কিশোরী যেন আজ আর মাঝবয়েসী নারীর শরীরে লুকিয়ে থাকতে চাইছিল না। আমার অনেক কথা বলার ছিল। কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে কবিগুরুর কবিতার মত।

” স্যার আমার কিছু বলার ছিল আপনাকে।
” বলুন তুতুল।, ” একদম নীরস কণ্ঠ তার। আপনি সম্বোধনটা আমায় বারবার আহত করছিল।

” আমি সেদিন ইচ্ছে করে করিনি কিছু বিশ্বাস করুন। নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না আমার। আমি…”
কথাটা শেষ হবার আগে উনি হাত তুলে থামতে বললেন।
” দেখুন পুরনো কথা তোলার সময় এটা না। আমার যা ক্ষতি হবার হয়েছে। সেটা সময়ে মানিয়ে নিয়েছি। এখন ভাল আছি। আমার দ্বিতীয় স্ত্রী বেশ ভাল মানুষ। কথার কথা বলছি না। সুতরাং আফসোসের কিছু নেই। আর তখন বৌ-বাচ্চার দায়িত্ব নিলে আমার আজকের এই এস্টাবলিশমেন্ট হত না। হয়ত খুব রুড মনে হচ্ছে তবে ভগবান যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। আমি ভাল আছি,” স্ক্রিপ্ট আউড়ে গেল যেন মঞ্চে বিবেক চরিত্র করা বিবেকহীন এক অভিনেতা!

(চলবে)