জবা ফুলের রঙ লাল পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
337

#জবা_ফুলের_রঙ_লাল

পঞ্চম ও শেষ পর্ব

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। এই লোকটাকে আমার ভাল লাগত! এত কোটি মানুষের ভিড়ে হুট করে দেখা হলেও যেন আমাকে দেখে তার মনে হয় ” এখনো কী সুন্দর ” এটা ভেবে নিজেকে সুন্দর রাখবার কত আয়োজন আমার! কোনদিন শোভনের ভাললাগায় নিজেকে দেখতে চাইনি। সব সুন্দর পোশাক গায়ে জড়াবার আগে কল্পনায় দেখতাম এই মানুষটার মুগ্ধতায় অবাক চোখ। মনে আছে নীতা একবার চুল খুলে ক্লাসে এসেছিল ভেজা বলে। কথায় কথায় খুব ভদ্রভাবে অমল স্যার বলেছিলেন যদিও মেয়েরা খোলাচুলে সুন্দর তবে বেঁধে রাখা চুলেও যে মেয়ে নিজেকে পরিপাটি করে রাখে মানতেই হবে সে সুন্দরী। এই কথাটা অবচেতন মনে এমন মোহ তৈরি করেছিল যে শোভন যতই বলুক চুল আমি খুলে রাখতাম না। নিত্য নতুন খোঁপা বাঁধা শিখেছিলাম ইউটিউবে। শোভন ওসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। আদর্শ স্বামীর মত আমার সবকিছুই তার কাছে অসাধারণ লাগত। অথচ সাধারণ বলারও অযোগ্য একটা মানুষকে দেবদূত ভেবে আমার স্মৃতি কলুষিত করেছি!

” আপনি! আপনি কী বলছেন? একটা মানুষ আত্মহত্যা করল অভিমানে! এটা আপনার কাছে এত তুচ্ছ লাগছে? ” আমি কিছুতেই বিস্ময় লুকোতে পারলাম না। ” মানি আমার দোষ ছিল। ঈর্ষা কাজ করছিল ওই মুহূর্তে। সেটাও আপনাকে পছন্দ করতাম বলে। কিন্তু আপনি তো তাকে ভালবাসতেন। তাহলে? ”

” দেখুন, ভালবাসা আর সংসার দুরকম। ত্রপা খুবই ইমোশনাল মেয়ে ছিল। কথায় কথায় হাত পা কাটত। ঘুমের ওষুধ খেত। প্রতিবার মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নেবার যে হ্যাঁপা সেসব আমার উপর দিয়েই যেত। সেজন্যে পোস্টিং নিয়েছিলাম বাড়ি থেকে দূরে। সেখানেও এসে হাজির হল। ভালবাসতাম না সেটা ভুল। তবে পুরনোকে আঁকড়ে থাকলে চলে না। আমার এখন দুটো যমজ বাচ্চা। বেশ বড় হয়ে গেছে। ভার্সিটিতে পড়ছে একসাথে। এক ছেলে এক মেয়ে। ” আমি লোকটার সংসারে তৃপ্ত মুখ দেখছিলাম। এই মুখ দেখে আমি কত রাতে কত চিত্রনাট্য কল্পনা করেছি ভাবতেই নিজের উপর করুণা হচ্ছিল। চেহারাটাও খুব সাধারণ ঠেকছে, হয়ত ভীষণ নিষ্ঠুর লাগছে আসলে।

আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হল না। ফেরি পৌঁছে গেল ঢাকার প্রান্তে। আমি ভদ্রতাসূচক বিদায়ও নিলাম না। তাতে ওই লোক খুব একটা গ্রাহ্য করল বলে মনে হল না। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল আর আমি ছুটিয়ে দিলাম স্মৃতির সাদাকালো রিল। মুছে দিতে লাগলাম অমল বিশ্বাসকে জড়িয়ে থাকা সব ভাল লাগা। পৌঁছে গেলাম ঠিক সেই মুহূর্তে। যেখানে আমায় ত্রপা প্রশ্ন করছিল আমি কেন এসেছি। আমি ঠিক আগের উত্তরটাই দিলাম। কারণ আমি এখনো চাইছিলাম মেয়েটা মরে যাক আর বেঁচে যাক ভীষণ অনুভূতিশূন্য এক পাথর হৃদয় থেকে। মৃত্যুর শীতলতাও ঢের ভাল পাথর হৃদয়ের সান্নিধ্য থেকে। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। অথচ আমি প্রতিবার কল্পনায় দেখতাম কী ভীষণ ব্যথা দুচোখে নিয়ে আবার আমার দেখা হবে অমল বিশ্বাসের সাথে। ভাবতাম এখনো সেই বিরহ কাটাতে পারবে না সে। হয়ত এখনো তার হৃদয়ের কোন জায়গা খালি পড়ে থাকবে মৃত মানুষগুলোর জন্যে। বুঝিনি আসলে কাউকে ধারণ করার হৃদয়ই তাকে দেয়নি ঈশ্বর! হঠাৎ কোন একদিন আমাকে দেখতে পেয়ে না পাবার একটা বেদনা যেন তাকে ছুঁয়ে দেয়, শুধু সেজন্যেই কি আমি নিজেকে ভালবাসছিলাম ভীষণ? নিজের জন্যে তবে বাসিন ভাল? নিজের মুখোমুখি হবার শক্তি ছিল না।

আমি বাড়ি ফিরলাম। যে আমি ফিরলাম সে আমিকে চব্বিশ বছর পর নতুন করে চিনলাম আমি। বাড়ি ফিরে দেখলাম আমার জন্মদিনকে ঘিরে নৈঋতার বিশাল আয়োজন। আমি প্রথমবার এবং প্রথমবারের মত নিজেকে বললাম এই মেয়েটা শুধু আমার নয়- আমাদের। আমার এবং শোভনের। এই আমিকে আমাদের মত করে অনুভব করতে দুটো যুগ চলে গেল! নিজের পছন্দ অপছন্দগুলো আলাদা করে বোঝার প্রয়োজনও বোধ করিনি। সংসারের নিয়মে সংসার করে গেছি। আমি আর আমার- এই ছিল আমার অভিধানে! সেখানে আমাদের আর আমরা ছিল না!

*
বেল বাজল। রাত দুটো। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে দরজা খুললাম।

” হ্যালো, বিউটিফুল। হ্যাপি বার্থডে। দেরি হয়ে গেল। ক্লায়েন্টরা এলেভেন্থ আওয়ারে ডিল ক্যান্সেল করার পাঁয়তারা করছিল,” লিভিংরুমের সামনে বড় আয়নায় দাঁড়িয়ে টাইয়ের নটটা ঢিলে করছিল শোভন।

” এক কাপ কফি দাও। তারপর ফ্রেশ হই,” সোফায় বসল শোভন টিভির রিমোটটা নিয়ে। ক্রমাগত চ্যানেল পালটে যাবে সে। কিছুই দেখবে না জানি আমি।
আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল কিশোরী বয়সে পড়া উপন্যাসের নায়িকার মত কিছু করে বসি। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। শোভনের কফিতে দুধ চিনি আর কফিমেট সব বেশি লাগবে। সবসময় আমি বানালে কিছু না কিছু কম পড়বেই। নৈঋতাটা একদম পারফেক্ট কফি করে বাবার জন্যে। ” বিয়ের এত বছরেও পারফেক্ট কফিটা বানালে না আমার জন্যে। মেয়েটা না হলে উপায় ছিল আমার? ” হাসতে হাসতে অভিযোগ করত শোভন। আমি সেসব কানে তুলতাম না। তখন আমি কল্পনা করতাম অন্য কাউকে। হয়ত কিশোরী বয়সে ভুল মানুষকে ভালবেসে ভুল করার প্রায়শ্চিত্ত করতাম।

আজ বেয়াল্লিশের মাঝবয়েসী নারী আমি ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্রীর মত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামীর জন্যে কফি বানালাম। চোখের নোনা জলের কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে গেল কফিকাপে। তাতে কি স্বাদ বদলে যাবে? জলদি চোখ মুছে নিলাম। কফি নিয়ে গিয়ে দেখলাম শোভন ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি সেদিন অনেকক্ষণ দেখলাম ঘুমন্ত শোভনকে। শোভনকে ঘুমালে এতটাই নিষ্পাপ লাগে সবসময় নাকি আজ লাগছে? নাকি আমিই দেখিনি কখনো? শোভনকে দেখছিলাম সূর্যের প্রথম আলো তার কপাল ছুঁয়ে যাওয়া পর্যন্ত।
ছাদে গেলাম। ছাদে আমি ফুলের গাছ লাগিয়েছি। সেখানে জবাফুলের সংখ্যাই বেশি। আমার ভীষণ প্রিয় জবা। নতুন সূর্যের মত লালরঙ নিয়ে জবাগুলো হাসছিল। আমার মনে পড়ছিল এক বর্ষাবিকেলে আমার মুঠোয় নির্জীব হয়ে পড়া জবাফুলের কথা।

” এ কী? জন্মদিন তোমার, আমাকে ফুল দিচ্ছ কেন? হয়েছে কী তোমার বল তো” ঘুম ভেঙে একগাদা জবাফুল চোখের সামনে দেখে ভীষণ অবাক হল শোভন। তার ঘুমঘুম চোখে যেন স্বপ্ন।

” আমি একবার প্রেমে পড়েছিলাম জানো? যার প্রেমে পড়েছিলাম তাকে জবা দিতে চেয়েছিলাম।” আমি থামলাম।
শোভন চিরকালের আমুদে মানুষ। চোখে তার কৌতুক। ” তারপর কী হল? ” স্ত্রীর কিশোরী বয়সের প্রেমকাহিনী শোনার জন্যে আরাম করে পা দুলিয়ে বসল সে সোফায়।

” মনে হল এই ফুল যে-সে পাওয়া উচিত না না। অপেক্ষা করি। আজ বুঝলাম ওটা বয়সের দোষ ছিল। এখন মনে হচ্ছে না দিয়ে ভাল করেছি। এমন প্রেমিক কোথায় পেতাম নাহলে? ” আমি গাঢ়স্বরে বললাম।

” ও তাই বুঝি? বিয়ের এত বছর পেরিয়ে বুঝতে হল আমিই আসল প্রেমিক। আরো এক যুগ পর যদি মনে হয় আরো বেটার প্রেমিক পেয়েছ অন্য কাউকে? তখন?” শোভন আমার খোলাচুল নিয়ে খেলা করছে।

” নিজেকে আপডেট করা বন্ধ করবে কেন? সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বিয়ে করেছি তো এজন্যেই!”, আমি তখন অনুভব করলাম… ভুল বলছি, আমরা দুজন তখন প্রথমবারের মত অনুভব করলাম জবা ফুলের রঙ হৃদয়ের রঙে লাল!

(সমাপ্ত)