জবা ফুলের রঙ লাল পর্ব-০২

0
206

#জবা_ফুলের_রঙ_লাল

#দ্বিতীয়_পর্ব

আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে লাল জবাফুলে নুয়ে পড়া গাছ আর তার আড়ালে অবাক একটা মুখ দেখতে পাই আমি-অমল বিশ্বাস! গার্লস কলেজের লেকচারার অমল বিশ্বাস যেদিন প্রথম ক্লাস নিতে এল আমি সব উচ্ছলতার কাছে হার মেনে তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠের প্রেমে পড়ে গেলাম কোন কিছু না ভেবেই। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রাখা ছাত্রীটা হুট করে ফার্স্ট বেঞ্চের লোভ সামলে পেছনের সিট দখলের জন্যে হুড়োহুড়ি করে দিল। কারণ স্যার ক্লাসওয়ার্ক করতে দিয়ে পেছনের সিটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকত ক্লাসের বেশিরভাগ সময়। হতে পারে এক ক্লাস মেয়ের সামনে সারাটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে তার কিছুটা সংকোচবোধ হত। সব মেয়েরা অমল স্যারকে প্রথম দেখায় মন দিয়ে দিল। স্যারের জন্যে কেউ দুবেণীর বদলে এলোচুল ছড়িয়ে বসে থাকত ক্লাসটাইমে- কেউ কেউ ব্রেক টাইমে টিচার্স রুমের সামনে তার দেখা পাবার জন্যে অকারণ হাঁটাহাঁটি করত। তাতে অমল স্যারের ভাবভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন হত না। সে যেন বুঝেও না বোঝার মত করে গম্ভীর ভঙ্গিতে রসায়নের বিক্রিয়া বুঝিয়ে যেত। একুয়া রেজিয়া আর রাজঅম্লের সংকেত গুলিয়ে ফেলতাম আমরা কিন্তু কোন রঙের পাঞ্জাবি তাকে সবচেয়ে বেশি মানাত সেটায় ভুল হত না কারো। আমার অবশ্য সহ্য হত না অন্যদের এত আদিখ্যেতা।
আমি স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করলাম। স্যার অসাধারণ পড়াতেন। তবে আমার মস্তিষ্ক বেনজিনের গাঠনিক সংকেত যে স্বপ্নে পাওয়া সে গল্প শুনে মোহিত হত না যতটা হত অমল স্যারের কপালে জমা তুষারের মত বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে। আমার তখন খুব ইচ্ছে হত হাজারী নাগের বই ফেলে তার দিকে ঘড়ির হিসেব তুচ্ছ করে চেয়ে থাকি নির্বাক। কিন্তু হত না কিছুই।

সাজ না জানা আমি তার জন্যে বেশি করে সাজ করতাম। গালে দুপরত পাউডার বেশি বুলাতাম। তারপর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখের পরে কাজল। মাঝে মাঝে ভাললাগাটা অনেকখানি বাড়িয়ে প্রকাশ পেত কপালে আঁকা বিন্দুর মত টিপে। মা সব দেখতেন। কিন্তু মা অমল স্যারের ব্যাপারটা না জানলেও বুঝতেন এসব বয়সের হাওয়া। তবে আমি জানতাম আমার ভেতর কী চলছে। উলোটপালোট করে দেয়া অচেনা সেই অনুভূতির জন্ম তখন থেকে একটু একটু করে।
উড়ো চিঠিগুলো স্যার আবিষ্কার করতেন কেমেস্ট্রি বইয়ের ভাঁজ থেকে, কখনো বা তার খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিত অতি উৎসাহী কিছু প্রেমিকা৷ কাগজের প্লেনগুলো তার সেগুন কাঠের টেবিলে বিশ্রাম নিত। মেয়েলি সুবাস ছড়ানো চিঠিগুলো পেয়ে তিনি যে খুব বিরক্ত হতেন মনে হয়নি আমাদের। কারণ হেডস্যার নিজে তাকে চিঠি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন বেশ কবার। নীতা গুহ’র মা নিজেও কলেজ টিচার। সেখান থেকেই জেনেছেন। টিচার্স কমন রুমে এ নিয়ে বেশ আলাপ চলে। অমল বিশ্বাস মাথা নিচু করে শুনে যান কেবল। সৌজন্যবোধের একটা হাসি ঝুলে থাকে সৌম্যসুন্দর মুখশ্রীতে-মাসের প্রথম চাঁদের মত।
আমার তখন নিজেকে আবিষ্কারের সময়। কৈশোরে পা দেয়া শরীর ফুঁড়ে তরুণী অবয়বটা একটু একটু করে দৃশ্যমান হচ্ছিল। নিজেকে গল্প উপন্যাসের নায়িকা ভাবছিলাম আর নায়ক অবধারিতভাবেই অমল বিশ্বাস। শরৎবাবুর অচলা -পার্বতী কিংবা কমলা হয়ে উঠতাম আমি কল্পনায়, সেখানে আমার জন্যে দেবদাস আর সুরেশ হয়ে ঘুরে বেড়াত অমল স্যার।

এক বিকেলের কথা। সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছিল আকাশ ভেঙে৷ সেদিন বিকেলে প্রাইভেট পড়া ছিল অমল স্যারের কাছে। নব্বইয়ের দশকে সব খবরগুলোকে পায়ে হাঁটা মানুষের মাধ্যম হয়েই আসতে হত, অনলাইন নামক ব্যাপারটা সেকালের অভিধানে তখনো জায়গা করে নেয়নি। খবরটা যখন এল তখন দুপুর। মেঘের দল ততক্ষণে বিশ্রামে গেছে। সূর্য অবসর কাটিয়ে উঠেছে। তবুও কেন প্রাইভেট পড়ানো বাদ গেল এই ব্যাপারটা মানতে পারছিলাম না। সামনেই আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা ছিল। আর অমল স্যার যথেষ্ট সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক ছিলেন। এটাই ভাবাল আমাকে সবচেয়ে বেশি। অদ্ভুত একটা ভাবনা আমার মাথায় এল। বাতাসে কীসের সম্মোহন টের পাচ্ছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল যা ভাবনার অতীত আজ তা বর্তমানে রূপ নিতে পারে। এই সম্ভাবনা আমার আমিকে চালিত করল তার কাছে।

প্রাইভেট হবে না জেনেও ওবাড়িতে গেলাম আমি। স্যারের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি এখানে। বাড়িটার কাঠামো নড়বড়ে হয়েছে সময়ে। মালিক প্রবাসী। একজন কেয়ারটেকার দেখভাল করে সে বাড়ির। এই দোতলা বাড়িটার নিচতলাটা প্রাইভেট পড়ানোর জন্যে গুছিয়ে নিয়েছেন অমল স্যার। সব সংকোচ আবেগের আলমিরায় তালাবদ্ধ করে আমি এসে দাঁড়ালাম তার বাড়ির উঠোনে৷ মাকে বলে এলাম নীতাদের বাড়ি যাচ্ছি নোট আনতে। কেবল মনে হচ্ছিল আমার ভেতর তোলপাড় করে দেয়া এ কথাটা আজ যদি না জানাতে পারি মস্ত ভুল হয়ে যাবে।

কাদামাটিতে দেবে যাচ্ছিল আমার জুতো। নরম মাটিতে জুতোর ছাপ রেখে আমি এগুচ্ছিলাম স্যারের বাড়ির দিকে। তখন বিকেলটা সন্ধ্যের গান গাইবার প্রস্তুতি নেয়া যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু তা হল না। সারাদুপুর বৃষ্টি ডেকে ক্লান্ত মেঘ সরে বেরিয়ে এল অপেক্ষায় থাকা সূর্যটা। সে বিকেলটা হারিয়ে যেতে দিচ্ছিল না। অমল স্যারদের বাড়ির আঙিনায় যখন পৌঁছুলাম সামনের উঠোনটায় তখন কোলাব্যাঙ ঝাপাঝাপি করছে। সামনের জবাগাছ থেকে তখনো বৃষ্টি ঝরছে। নুয়ে পড়া অগুণিত রক্তজবা থেকে কয়েকটা ছিঁড়ে নিলাম। উত্তেজনায় আমার ভেতরের উলোটপালোট কথাগুলো যেন বারবার হারিয়ে যাচ্ছিল। আমি ঢোক গিলে ভেতর বাড়িতে পা দিলাম।

আমাদের পড়ানোর রুমটা বিশাল। এক সাথে অনেক জন বসে পড়ার মত চেয়ার টেবিল সাজানো। দোতলার একটা রুম কোন রকম চলনসই করে নেয়া হয়েছে অমল স্যারের থাকার জন্যে। এই ঘরটা পেরিয়ে কেয়ারটেকারের রুম। সেখানে কেউ নেই। তারপর একটা দরজা দিয়ে যাওয়া যায় বাড়ির পেছনের অংশে। ফাঁকা জায়গাটা নানা রকম আগাছা পরগাছায় জঙ্গলের মত হয়ে আছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ অহংকারী রূপবতীর মত দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির শেষ সীমানা চিহ্নিত করে৷ আমি যখন কেয়ারটেকারের রুমের কাছে গেলাম, সেখানে দাঁড়িয়েই শুনতে পাচ্ছিলাম একটি নারী ও পুরুষ কণ্ঠের নিচু স্বরের আলাপ৷ ভীষণ অবাক হলাম। এ বাড়িতে কোন নারী থাকে না। অমল স্যার বিবাহিত নন সেটাই সবাই জানে…

(চলবে)