জলে ভাসা পদ্ম পর্ব-০৪

0
358

#জলে_ভাসা_পদ্ম #পর্বঃ৪
#রেহানা_পুতুল
পদ্ম’র মনে কড়া বিরক্তি এসে যায় আহিয়ানের উপর। আহিয়ানকে কিছুটা একরোখা ছেলে মনে হচ্ছে তার কাছে। ঝাপটা মেরে আহিয়ানকে সরিয়ে দেয়। ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে যায় পদ্ম। কলিংবেল বেজে উঠতেই আরিয়ান দরজা খুলে দেয়।

পদ্ম’র মুখের দিকে চেয়ে আরিয়ান জিজ্ঞেস করে,
পদ্ম মুখ মলিন কেন? কোন সমস্যা?

নিরুত্তর পদ্ম হেঁটে চলে যায় জোলেখা বানুর রুমে। তার পড়ার টেবিল সে রুমেই। ফ্রেস হয়ে কিচেনে গিয়ে প্লেটে ভাত নিয়ে জোলেখা বানুর পাশে এসে বসে ভাত খেলো।

খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করে , নানু আন্টি, নোভাপু কোথায় গিয়েছে?

বউ তার বাবার বাসায় গিয়েছে নোভাসহ। এক সপ্তাহ থাকবে।আহিয়ানকে যেতে বলছে। গেলনা। তার নাকি কি কাজ আছে।

ফটকামি ছাড়া তার আর কি কাজ। ফোঁস করে বলে ফেললো পদ্ম।

কি করেছে তোর সাথে? কেন বলছিস একথা নানুভাই?

আমার সাথে গায়ে পড়ে ফাজলামো করতে চায়।

দাঁড়া সাবধান করে দিচ্ছি। আসলে উঠতি বয়সের পোলাপান। তাই একটু আধটু মস্করা করে তোর সাথে।

আমার এসব ভালোলাগেনা। থাক নানু তুমি কিছু বলতে যেওনা। আমি সাবধানে থাকব। আজ তোমার রুমে ঘুমাব নানু।

ঘুমাইস। কোন সমস্যা নেই।
নানু আন্টিরা দেশে আর কতদিন থাকবে?

ওরা ছয়মাস থাকে দেশে আসলে। এবার বুঝে নে। শুনলাম আরিয়ানের জন্য মেয়ে দেখতেছে এদিক সেদিক।

পদ্ম মোবাইল দেখায় নানুকে। মানা করে কাউকে যেন না বলে। মায়ের ফোনে ভিডিও কল দিয়ে আদরের ছোট দুবোন পরি আর পিহুর সাথে অনেক গল্প করে শুয়ে শুয়ে। মায়ের থেকে সব খবর নেয়। মা জানায় সেই ছেলে এখনো তাকে বিয়ে করার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এবং তার বাবাও। শুনে পদ্ম’র মনের আকাশে মেঘ জমে যায়। বুঝে নেয় তার মানে বাড়িতে গেলেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। তারচেয়ে এই বাসা বেশ ভালো। যদিও ইদানীং অল্পস্বল্প কিছু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

পদ্ম উঠে যায় চা তৈরি করার জন্য। নিজ হাতে মসলা চা তৈরি করে এক কাপ নিয়ে যায় আরিয়ানের জন্য। এই কয়দিন বাসা খালি। তাই অবাধে চলা যাবে আগের মতো । উফফস শান্তি। পদ্ম মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

আরিয়ান তার রুমে বসে গুনগুন করে গাইছে আর পিসিতে কাজ করছে।
ভাইয়া আসতে পারি? গরম গরম মসলা চা নিয়ে এসেছি আপনার জন্য।
আরিয়ান ইজি চেয়ার ঘুরিয়ে পদ্ম’র দিকে চায়।

কে বানিয়েছে চা পদ্ম?
আমি। আমার নিজের ও চা খেতে বেশ ইচ্ছে করছে।

তাহলে তোমার কাপ ও নিয়ে আসো একসাথে পান করি।

পদ্ম টেবিলে আরিয়ানের চায়ের কাপ রেখে ছুট দেয়। তৎক্ষনাৎ নিজের কাপ ও নিয়ে আসে।

পদ্ম একটি চেয়ার টেনে বসলো। রঙ চা খেতে খেতে আরিয়ানের জিজ্ঞেস করা সব প্রস্নের উত্তর দিলো বাধ্য ছাত্রীর মতো। এসি চলছে তাই রুমের দরজা বন্ধ।

আহিয়ান চাপানো দরজা ফাঁক করে পদ্মকে আরিয়ানের পাশে দেখে রেগে যায়।

কিরে আহিয়ান আয় ভিতরে। এসি অন। দরজা ফাঁক করে আছিস কেন?

আহিয়ান রুমের ভিতরে ঢুকে। পদ্ম তুই ভাইয়ার পাশে বসে চা খাচ্ছিস? নোভাপু ঠিকই বলছে। তুই দাদির লায় পেয়ে মাথায় উঠেছিস। বের হ বলছি। এক দমেই গলা খেঁকিয়ে কথাগুলো বলল আহিয়ান।

আরিয়ান শক্ত চোয়ালে বলল,আমি বলছি ওকে এখানে বসে চা খেতে। সামনে ওর এসএসসি। তাই চা খেতে খেতে ওর পড়াশোনার খবর নিচ্ছি। তোর সমস্যা কি?

সমস্যা যে কার কি সেটা পরে টের পাবা বলে আহিয়ান ঠাস করে দরজা লাগিয়ে বের হয়ে যায়।

কি ব্যাপার পদ্ম ও এমন কথা বলল কেন?
জানিনা ভাইয়া বলে পদ্ম ও বের হয়ে গেলো।

আরিয়ান বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো আহিয়ানের কথায়। কিন্তু কারণ কিভাবে জানবে।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। পদ্ম ও এক বুক মন খারাপ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার ভালোলাগে আরিয়ানকে। আবার আহিয়ান পছন্দ করে তাকে। কি একটা তালগোল পেকে যাচ্ছে। সেতো আরিয়ানের কাছে প্রকাশ করছেনা তার অব্যক্ত চঞ্চলা অনুভূতি।

কিছু স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন ভেবেই উড়িয়ে দিতে হয়। সবার জীবনে সব ইচ্ছে,আশা,চাওয়া পূর্ণ হয়না। এই অপূর্ণতার ভিতরেও অমোঘ সুখ রয়েছে। সে সুখের নাম বিরহের সুখ। আকাশ আর জমিনের মতই ব্যবধান পদ্ম আর আরিয়ানের। পদ্ম’র নিজের অজান্তেই ভালোলেগে গিয়েছে আরিয়ানকে।

মনের উপরে কারো হাত নেই। তবুও পদ্ম চেষ্টা করে আরিয়ানকে মিস না করে থাকতে। প্রয়োজনে সে এগিয়ে আসে সেইতো আপন। সেইতো বন্ধু। সেইতো প্রিয়জন হয়ে উঠে। না চাইতেই আরিয়ান মোবাইল কিনে দিলো। নিজ থেকে যেচে পড়াশোনার খবর নেয়। জটিল চ্যাপ্টারগুলো ধীরস্থিরভাবে বুঝিয়ে দেয়। জন্মদিনেও পাশে রেখেছে। পাশে বসিয়ে চা খায়। এসব কল্পনা করতেই পদ্ম’র মনে আবার রঙধনুর সাত রঙ ভেসে উঠে। কল্পনার সরোবরে ডিগবাজি খেতে খেতে পদ্ম’র দুচোখ জুড়ে তন্দ্রা নেমে আসে।

আহিয়ান ছেলেটা দুস্ট প্রকৃতির। সাহসীও৷ পদ্মকে পছন্দ করে। কিন্তু বন্ধু হিসেবে নয়। অন্যভাবে। রাতে ঘুমাচ্ছেনা সে। আস্তে আস্তে দাদির রুমের সামনে গেলো। দরজায় হাত দিয়ে বুঝে নিলো ভিতর থেকে চাপানো। বন্ধ নয়। একটু ফাঁক করে উঁকি মেরে দেখলো দাদী কাত হয়ে অন্য পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে দাদির খাটে। রুমে ডিম লাইটের মৃদু আলোতেও সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পদ্মর দিকে হাত বাড়ায় ডেকে তোলার জন্য। কিন্তু পদ্ম যদি চিৎকার দেয় চোর বলে। তখন কি হবে এই ভেবে আবার থেমে যায়। নিজের রুমে ফিরে আসে। নিরুপায় হয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসছেনা। কেমন যেন অশান্তি লাগছে মনে।

পরের দিন পদ্ম স্কুল থেকে ফেরার সময় আহিয়ান সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আহিয়ান ভাইয়া আপনি?

আহিয়ানের ঘাড়ের রগ ফুলে যায়। চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটোকে ভিজিয়ে নেয় আহিয়ান। পদ্ম’র দিকে চেয়ে বলে লাস্ট এন্ড ফাইনাল বলে দিচ্ছি, এই মুহুর্তের পর হতে আর যদি ভাইয়া আপনি তাহলে….

বাক্য শেষ না হতেই পদ্ম বলে তাহলে কি, তোমাদের বাসা থেকে তাড়িয়ে দিবে এইতো? আমিই চলে যাব পরিক্ষা শেষ হলে।

আহিয়ান বলে এখন থেকে ভাইয়া নয় আহিয়ান বলে ডাকবে। আপনি নয় তুমি বলবে।

বলতে বলতে যদি সবার সামনেই মুখ ছিটকে বেরিয়ে আসে আহিয়ান তুমি। তখন?

তখন বলবে আমি বলেছি বলতে।

পদ্ম সারামুখে চিনিগুড়া হাসি দিয়ে বলল,তাহলে আর সমস্যা নেই আহিয়ান।

আহিয়ান বলল, চলো একসাথে রিক্সায় করে যাই দুজন।

মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় পদ্ম। রিকসায় যেতে যেতে আহিয়ান পদ্ম’র সরু হাতখানি টেনে নিজের হাতের ভিতর পুরে। পদ্ম মুখ কালো করে ফেলে। তা দেখে আহিয়ান বলে,ওই আর জাস্ট ফেন্ড পদ্ম। আই রিয়েলি লাইক ইউ।

পদ্ম বলে তোমাকেও আমার মন্দ লাগেনা। সেদিন তোমার পায়ে চা পড়ে গিয়েছে। তুমি কিছুই বলনি। তখনি মনে হলো তুমি খোলা মনের ছেলে। আর নোভাপু…

বাদ দাও পদ্ম। তোমার গল্প বল। তোমার সম্পর্কে শুধু জানি তুমি দাদীর কেমন জানি দূর সম্পর্কের আত্মীয় হও। এর বাইরে আর কিছুই জানিনা। যেমন তোমার পরিবার মা বাবা এসব।

পদ্ম বলে উঠে এটাতো বোঝ তুমি আমি নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে। তা না হলে কেন শহরে আসা হলো আমার। বাবা আর পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারছেনা। বিয়ে দিয়ে দিতে চায়। তাই নানুর কাছে চলে আসি। মানে তোমার দাদী। পদ্ম এর বেশী কিছু আহিয়ানকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলোনা।

রিকশা চলে এলো বাসার সামনে। দুজন নেমে গেলো।

পদ্ম সময় সুযোগ করে আমার রুমে এসো। জরুরি কথা আছে।

আচ্ছা বলে পদ্ম রুমে ঢুকে গেলো। আহিয়ান একটু পরে ঢুকলো যেন আরিয়ান বা দাদী টের না পায়।

পদ্ম রাতে ঘুমানোর আগে আহিয়ানের রুমে যায়। আহিয়ানের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে শিকারির মতো পদ্মকে দেখে। পদ্ম’র হাত টেনে বিছানায় তার পাশে বসালো।

কি বলবা তাড়াতাড়ি বল। ঘুমাতে যাবো।
পদ্ম তুমি কি কোন কারণে আমার উপর ক্ষেপে আছ?
একদম না।

পদ্ম আসলে আমরা এখনকার ছেলেমেয়ে। যা বলি আর করি সরাসরি। রাখঢাক পছন্দ না আমার। শুনো তোমাকে আমার খুব পছন্দ। আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই সময় হলেই। বাকিটা তোমার চাওয়ার উপর নির্ভর করে। এখন তোমাকে একটা চুমু খাই?

পদ্ম’র মেজাজ তেতে যায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু শুনে। আহিয়ানের গালে চড় বসিয়ে দেয়। আহিয়ান নিজেকে দমন করতে পারছেনা। পদ্মকে ঝাপটে ধরে সারাগালে চুমু খেতে থাকে প্রানভরে। পদ্ম আহিয়ানের পেটে লাথি মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। অঝোরধারায় কাঁদতে থাকে ওয়াশরুমের মেঝেতে বসে।

পদ্ম এখন আর আহিয়ানের সাথে কথা বলেনা। দিন গুনতে থাকে এস এস সি ফাইনালের। তারপরই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

সপ্তাহে ফুরোলে আরিয়ানের মা বোন আসে। তার মা বাসায় ঢুকেই শাশুড়ীর রুমে গিয়ে পদ্ম’র চুলের মুঠি ধরে আছাড়ি পিছাড়ি মারতে থাকে।
চলবে….