জলে ভাসা পদ্ম পর্ব-০৩

0
422

#জলে_ভাসা_পদ্ম
#পর্বঃ৩
#রেহানা_পুতুল
আমি পদ্ম। এ বাসায় ছয়মাস ধরে আছি।
ওও তার মানে তুমি আমাদের বাসার কাজের মেয়ে?
হুম আপনাদের বাসার কাজের মেয়ে। পদ্ম দ্রুত কিচেন থেকে পানি খেয়ে চলে যায়। যেহেতু সে আমাদের বাসা বলছে তাই আর কিছুই জানার দরকার মনে করলোনা পদ্ম।

কিছুদিন পর আরিয়ানের মা তার শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল,মা কিছু মনে করবেন না। পদ্ম মেয়েটাকে আজকাল নওশাদের সাথে বেশী মিশতে দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন যেন।

জোলেখা বানু বিরক্ত হলেন বেশ। বললেন, তোমার কথা কানাকড়িও আমার মনে ধরলোনা বউ। নওশাদ ওকে বোনের মতো জানে। মাথায় রেখো।

শেষ বিকেলে ট্রে থেকে উঠিয়ে পদ্ম সবাইকে চা দিচ্ছে বসার ঘরে। নোভার হাতে চায়ের কাপ দিতে গিয়ে সেই গরম চা পড়ে গেলো আহিয়ানের পায়ে। আহিয়ান দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলো পা ধোয়ার জন্য। নোভা বসা থেকে উঠে পদ্ম’র বাম গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলো।

বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো উপস্থিত ঘটনায় পদ্ম হতবাক হয়ে গেলো। এই প্রথম এই বাড়িতে সে মার খেলো। টলমল অশ্রুতে পদ্ম’র আখিঁকোন ভিজে চুপসে গেলো। দৌড়ে বাসার পিছনের বারান্দায় চলে গেলো।
আরিয়ানের মা বলল,এটা ঠিক হয়নি নোভা।

নোভা ফুঁসে আছে পদ্ম’র উপরে। আম্মু তুমি জানিনা। এ একটা অসভ্য মেয়ে। আমি ওকে এই কয়দিন পর্যবেক্ষণ করে চলছি। টুকটাক ভুল ও করেই যাচ্ছে। দাদী ওকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে। ও অধিকার নিয়েই চলাফেরা করে এ বাসায়। এমন ভাব যেন এটা তার মামুর বাড়ি।
আহিয়ান এতক্ষন বোনের অভিযোগগুলো শুনছিলো পদ্মর নামে।
বাইরে থেকে আরিয়ান এলো। জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? নোভা উত্তেজিত কেন?

আহিয়ান কিছুই বললনা। নোভা বড় ভাইয়ের কাছে ঝাঁপিভরে বদনাম করলো পদ্মকে নিয়ে।

আরিয়ান বলল,মেয়েটিকেতো আমি আজ অবধি দেখলাম ও না। অবশ্য আব্বুর বিজনেস নিয়ে আমিও বিজি টাইম পার করছি। নোভা মুখ গোঁজ করে বসে আছে সোফায়।

আরিয়ান পদ্মকে খুঁজতে কিচেনের সাথে লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় যায়। পদ্মকে দেখে তাকিয়ে থাকে পলকহীনভাবে।
তুমি পদ্ম?
হুম।
তোমার নামেতো অনেক অভিযোগ শুনলাম। যাইহোক মন খারাপ করোনা। নোভা একটু এমনি। আব্বু আম্মুর একমাত্র মেয়েতো তাই কিছুটা বেয়াড়া।
আরিয়ান চলে আসে পদ্মর সামনে থেকে।

পদ্ম এখন রোজ মন খারাপ করে থাকে। নোভা পারেতো সারাদিন ওকে মারে। সুফিয়া খালার সাথেই যা গল্পগুজব হয়। জোলেখা বানুর কাছেও বেশী ঘেঁষতে পারেনা। সামনে ফাইনাল পরিক্ষা তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। মাঝে মাঝে আরিয়ান ওর পড়া ধরে। বুঝিয়ে দেয় বিভিন্ন বিষয়। পদ্মর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আরিয়ান একটা মোবাইল ফোন কিনে দেয়। এটা কাউকে জানাতে না করেছে দাদী ছাড়া।

পদ্ম নিতে না চাইলেও নিতে বাধ্য হয়। কারণ সত্যিই তার নিজের একটা মোবাইল প্রয়োজন ছিলো। শুধুমাত্র মা বোনদের সাথে কথা বলার জন্য।
পদ্ম মনে মনে ভাবে নওশাদ ভাইকে দেখলে নিজের ভাইয়ের মতই মনে হয় কিন্তু আরিয়ান ভাইয়াকে দেখলে কেমন যেন অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। পদ্ম বুঝে এ অনুভূতিকে গাঢ় হতে দেয়া যাবেনা। এ অনুভূতিকে পিষে ফেলতে হবে।

পদ্ম দিনে দিনে সুন্দর আর সতেজ হয়ে যাচ্ছে সদ্য গজিয়ে উঠা সবুজ ঘাসের মতো। কি সুন্দর বইয়ের ভাষায় কথা বলে। হাঁটাও ছন্দময়। কি কোমল একটা মেয়ে। মন চায় কোলে তুলে আদর করি। কিন্তু এমন করতে গেলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। বাসায় ওর সাথে কথা বলতে গেলেও বিপদ। স্কুলে যাওয়ার সময় একটু কথা বলতে হবে। গভীর রাতে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে তরুন আহিয়ান কল্পনা করতে থাকে তরুণী পদ্মকে নিয়ে।

নওশাদ এখন তাদের বাসায় থাকে। নানার বাসায় এখন এমনিতেই লোকজনে মুখরিত। কিন্তু আজ আসবে। কারণ মামি যেতে বলছে আরিয়ান ভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে ।
খুব ঘরোয়াভাবে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়৷ রাতে কেক কাটা হবে। সবাই নতুন পোশাক পরেছে। শুধু সুফিয়া খালা আর পদ্ম তাদের রোজকার পোশাকেই রয়েছে।

আহিয়ান চুপি চুপি পদ্মকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,পদ্ম নতুন জামা পরবেনা?

পদ্ম মুখ অমাবস্যার মতো করে বলে,
আমার জন্মদিন? না আমি আপনাদের পরিবারে কেউ?

ইউ আর রাইট। আজ তোমার জন্মদিন ও না। তুমি আমাদের পরিবারের ও কেউনা।বাট তুমি কারো বিশেষ কেউ। এটা জানো?

বেশ জানি। আপনার আগে থেকেই জানি। আহনান উল্লসিত হয় শুনে। ভাবে তারমানে পদ্ম ও আমাকে আমার মতো বন্ধু ভাবে। কিন্তু ওর অবস্থান চিন্তা করেই হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারেনা।

আরিয়ান গিয়ে পদ্মকে সবার সামনেই বলল, পদ্ম নতুন ড্রেস পরে রেডি হও।

নোভা বলল, ভাইয়া জন্মদিন তোমার। কিন্তু এই মেয়ে নতুন ড্রেস পরবে কেন?

বাকিরা যেই কারণে পরবে ঠিক সেই কারনে। ও আমাদের পরিবারের একজন। কেককাটার সময় সেও থাকবে। আনন্দকে ভাগ করে উপভোগ করতে শিখ নোভা ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে। নোভা গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।

আরিয়ান পদ্ম’র কাছে গিয়ে গালে আলতো ছোঁয়া দিয়ে,পদ্ম তুমি শুধু আমার আর দাদীর কথা শুনবে। আর কারো নয়। যাও তোমার মত করে তৈরি হয়ে নাও।

পদ্ম এক দৌড়ে ওয়াশরুমের ভিতরে চলে গেলো। আরিয়ান চাপা হাসি হাসলো তা দেখে।

কেককাটা হলো। আহিয়ান কৌশলে পদ্ম’র কাছে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি সেলফি তুলে নিলো। সবাই সবাইকে কেক খাওয়াচ্ছে। পদ্ম নানুকে খাওয়ালো। আহিয়ান বলল,আমাকে খাওয়াও তোমার হাতে। পদ্ম মুচকি হেসে আহিয়ানের মুখে কেক পুরে দিলো।
আহিয়ান তখনি পদ্ম’র হাত ধরে তার আঙ্গুলে লেগে থাকা কেকের গ্রেভিগুলো চুষে খেলো। পদ্ম আঃ লাগছেতো বলে আহনানের মুখের ভিতর থেকে নিজের হাতকে উদ্ধার করলো।

আহনান চোখ টিপ দিলো পদ্মকে।
পদ্ম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। কিছুই বললোনা।

এদিকে আরিয়ান পদ্মকে ডেকে, তুমি আমাকে কেক খাওয়াবেনা? পদ্ম’র চোখে মুখে লাজুকতার শিহরিত আবরণ। আরিয়ানের কাছে গিয়ে কেক তুলে দিলো তার মুখে। আরিয়ান ও পদ্মকে কেক খাইয়ে দিলো। তার দাদী এ দৃশ্য দেখে আপ্লুত হলো। কিন্তু আহিয়ান জেলাস ফিল করলো। নোভা কেক কাটা শেষ হলেই চলে গিয়েছে অন্যরুমে।

নওশাদ পদ্মকে জিজ্ঞেস করলো কিরে পদ্ম কেমন আছিস? এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস কেন?

পদ্ম স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলল এইতো ভাইয়া ভালো। আপনাকে মিস করি।

আমিওরে। মামারা চলে গেলে আমি আবার চলে আসবো।

পদ্ম ক্লাস টেনে উঠলো ভালো রেজাল্ট করে। যদিও পড়াশোনা করতে হয়েছে কস্ট করে। কারণ বাসায় এখন কাজ বেশী। আর শুধু বসে বসে খেলে নোভার চোখের বিষ হয়ে উঠবে। এমনিতেই মানসিক প্রেসার দিতে ভুল করেনা নোভা সুযোগ পেলেই। ক্লাসে অনেক বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছে। বাসার চেয়ে ক্লাসেই বেশী ভালোলাগে। বন্ধুদের সাথে নানারকম আড্ডায় বাড়ির কথা কম মনে হয়। কম কস্ট হয়।

একদিন পদ্ম স্কুল থেকে কোচিং করে বাড়ি ফিরছে। বাসার কাছাকাছি আসতেই দু তিনটে বখাটে ছেলে তার পথ আটকায়।
তাদের মধ্যে এক ছেলে পদ্ম’র দিকে চেয়ে,
কন্যা তুমি কচি ডাবের মতো। একটু একটু সর হয়েছে। তোমার সাথে আমরা তিনজনই প্রেম করতে চাই। রাজী?

পদ্ম ভয়ে খিঁচে যাচ্ছে । এদিক সেদিক চায়। দেখে আহিয়ান আসতেছে এদিকে। চট করে তার মাথা খেলে গেলো।
কথায় আছে সমস্যায় পড়লে মানুষ কৌশলী হয়।
সে আহিয়ানকে দেখিয়ে বলল,ওই যে ছেলেটা আসছে। সে আমার বয়ফ্রেন্ড। সে যদি অনুমতি দেয় তবেই আমি রাজী।

পদ্ম আহিয়ান বলে গলা ছেড়ে ডাক দিলো। আহিয়ান পা চালিয়ে তাদের সামনে এলো। পদ্ম’র হাত মুঠোবন্দি করলো। একজন জিজ্ঞেস করলো তুমি আকরাম আংকেলের ছেলে না?

আহনান বলল। হুম। কিন্তু রাস্তায় অন্যের গার্লফ্রেন্ডকে একা পেয়ে অসভ্যতামি করছেন কেন? দ্বিতীয়বার যদি শুনি বা দেখি তাহলে এলাকা ছাড়তে হবে।

তারা প্রতিউত্তর করলোনা। দ্রুত হেঁটে চলে গেলো।

পদ্ম মনে মনে বুঝে নিলো এলাকায় আহিয়ানদের সম্মান ও অবস্থান কতটা শক্তিশালী।

আহিয়ান পদ্ম’র হাত ছেড়ে দিলো। বলল,দেখলে উপস্থিত বুদ্ধি কাকে বলে।
পদ্ম বলল,ধন্যবাদ আহিয়ান ভাইয়া।

ভাইয়া বলতে হবেনা। তুমি করে বলবে আমাকে সবার আড়ালে। আমরা সম্ভবত সেইম এইজের হবো। মেয়েদের বয়স জানতে নেই। তাই জিজ্ঞেস করলাম না বার্থডে কবে তোমার।

পদ্ম বলল কি বলছেন আহিয়ান ভাইয়া? কিছুই বুঝতেছিনা। তুমি করে বলার কি কারণ?

আহিয়ান পদ্মকে নিয়ে বাসার নিচে চলে গেলো। দেয়ালে চেপে ধরে বলল,
মেয়েদের বুক ফাটে মুখ ফাটেনা। এটা আমি জানি পদ্ম। সেদিন কিচেনে আমিই গিয়েছি তোমাকে দেখার জন্য। আর তুমিতো বলছিলে তুমি জানো তুমি কার বিশেষ কেউ? তাহলে এত হ্যাংলামো করছো কেন?

হ্যাঁ বলছি সেদিন। এখনো বলছি। আমি নানুজানের বিশেষ কেউ!

সো হোয়াট পদ্ম! ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সাথে?

চলবে….