জলে ভাসা পদ্ম পর্ব-০৫

0
374

#জলে_ভাসা_পদ্ম
#পর্বঃ৫
#রেহানা_পুতুল
জোলেখা বানু চোখ কপালে তুলে ছেলের বউকে ধমকাতে লাগলেন। বউকে না থামাতে পেরে হন্তদন্ত হয়ে আরিয়ানের রুমে গিয়ে তাকে ডেকে আনলেন।

আরিয়ান লম্বা লম্বা পা পেলে দাদির আগেই রুমে চলে গেলো।

মেজাজ চড়ায় নিয়ে আম্মু কি হচ্ছে এসব? বলে পদ্মকে টেনে আলাদা করলো মায়ের হাত থেকে।

পদ্ম ওমাগো ওমাগো বলে বুক ফাটা কান্না কেঁদেই যাচ্ছে। জোহরা বানুও চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।

আম্মু পদ্ম’র অপরাধ কি?

আহিয়ানের পিছনে ঘুরে এই ছোটলোকের বাচ্চাটা।

তার প্রমাণ আছে তোমার কাছে? কি নিচু ভাষায় কথা বলছ তুমি।

নিচুজাতের সাথে নিচু ভাষায় কথা বলব নাকি উঁচু ভাষায় কথা বলব?
পরশু আহিয়ানের হাত ধরে এই ফকিরনি রিক্সায় করে রাস্তায় ঘুরেনাই? জিজ্ঞেস কর?

কে বলছে তোমাকে?

আমাকে পাশের বাসার ভাবি বলছে কথা প্রসঙ্গে। সে তার বাসার দোতলায় দাঁড়িয়েছিলো তখন। অমনি দেখেছে। সে ভেবেছ আমাদের ঘনিষ্ঠ কোন মেয়ে। তাই পজেটিভলি বলছে।

আরিয়ান আহিয়ানকে ফোন দিয়ে দ্রুত বাসায় আসতে বলল।
আহিয়ান এলে তার মা তাকে ধমক দিয়ে এই হারামজাদা কথা বল।

আহিয়ান গতরাতের চড় লাথির জন্য পদ্ম’র উপর ক্রোধান্বিত। মনে মনে ঠিক করলো, পদ্ম যেহেতু আমার কাছে ধরাই দিবেনা তাহলে সত্যি স্বীকার করে নিজে অপমানিত হওয়ার মানেই হয়না।

আহিয়ান দৃঢ়তার সাথে বলল, আম্মু ওর স্কুল ছুটি হওয়ার পরে আমাকে মাঠে দেখে একটু আবদার করেছিলো আমার সাথে রিক্সায় করে আসবে। তো না করি কিভাবে বল। তবে এটার জন্য এতটা টর্চার করা ঠিক হয়নি।

বুঝলিতো আরিয়ান। বিষকন্ঠে বলল আরিয়ানের মা।

আর সে ভাবি বলল হাত ধরা অবস্থায় দেখছে। আহিয়ানের দিকে মরিচ চোখে চেয়ে জানতে চাইলো তার মা।

আম্মু এটা মিথ্যা। ওই মহিলা বানিয়ে বলছে।

জোলেখা বানু কাতর স্বরে বলল,এবার থামো বউ। লঘু পাপে গুরু শাস্তি হয়ে যাচ্ছে।
একদম না মা। লঘু পাপে গুরু শাস্তি হয়ে যাচ্ছেনা। এর একটা ফয়সালা করতে হবে।

কি করতে চাও আম্মু? পাশ থেকে প্রশ্ন করলো আরিয়ান।

হয় এই মেয়ে কালকের ভিতরে আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যাবে। আর থাকতে হলে কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিব। তখন স্বামীর সাথে যা ইচ্ছে রং তামাসা করুক। নয়তো এখানে থেকে আমার দুটো জোয়ান ছেলের সাথে নস্টামি করতে চাইবে।

কথাগুলো পদ্ম’র কর্নকুহুরে প্রবেশ করা মাত্রই সে মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে শুরু করলো। নিজেকে কীটের চেয়েও নিকৃষ্ট কোন পতঙ্গ মনে হচ্ছে। জীবনে এই প্রথম এত বেশী অসহায় লাগছে নিজেকে নিজের কাছে। সে মূর্তির ন্যায় আহিয়ানের দিকে চেয়ে আছে।

আহিয়ান রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো। আরিয়াম উত্তেজিত গলায়, আম্মু যতটা ব্লেইম দিয়ে মেয়েটাকে শাসাচ্ছো, তার কিছুটার ভাগীদার ও কি আহিয়ান নয়। সে সাধু? ধোয়া তুলসীপাতা? তার স্বভাব সম্পর্কেও আমি তুমি কিছুটা ওয়াকিবহাল।

জোলেখা বানু স্তব্ধ হয়ে বিছানার এককোনে বসে আছেন। তিনি বলার মতো কোন ভাষাই খুঁজে পাচ্ছেননা।

ওকে জিজ্ঞেস করেন মা কোন শর্তে ও এ বাড়িতে থাকতে রাজী। এই বলে হনহন পায়ে রুম থেকে চলে গেলো আরিয়ানের আম্মু।

পদ্মকে হাত ধরে টেনে তুললো আরিয়ান। খাটে তার ও দাদির পাশে বসালো পদ্মকে। জোহরা বানু আঁচল টেনে পদ্ম’র চোখমুখ মুছে দিলেন।

জিজ্ঞেদ করলেন, কি করবি এখন পদ্ম?

পদ্ম ম্যাড়মেড়ে গলায় জানালো। চলে যাবো নানু। এতবড় মিথ্যে অপবাদ নিয়ে এ বাসায় আর নয়। আহিয়ান এই কয়দিন আমার পিছনে পাগলের মতো ঘুরছে। সেদিন সেই আমাকে অনুরোধ করে রিকশায় তুললো। হাত ধরলো। আমি গরিব ঘরের মেয়ে। তাদের বাসায় থেকে তার কথা অমান্য করতে পারিনি। অথচ কত অবলীলায় আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলো।

একটা গল্পে পড়েছিলাম সমাজে নিচুতলার মানুষের উপর উঁচুতলার মানুষেরা কিভাবে নিজের দোষ চাপিয়ে ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। আজ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। বলে পদ্ম দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

আরিয়ান হতবাক হয়ে গেলো ধনীর উপর পদ্ম’র দুঃখ আর ক্ষোভ দেখে। নিজের মাথাটাও হেঁট হয়ে গেলো । উঠে গিয়ে আহিয়ানকে ডেকে আনলো তার মায়ের রুমে। এবং পদ্ম’র বলা কথাগুলো বলে দিলো। তার মা আহিয়ানকে চড়া গলায় ঝাড়লেন। আরিয়ানকে বললেন, তবুও আমার শর্তই বহাল থাকবে।

আরিয়ান পদ্মকে তার রুমে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। কোথায় যাবে জলে ভাসা পদ্ম?

পদ্ম আরিয়ানের পায়ে লুটিয়ে পড়লো। ভাইয়া এ বাসায় নানু আর আপনি ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই। নানু বুড়ো মানুষ। কিইবা করতে পারবে আমার জন্য। আপনি কিছু একটা করুন প্লিজ। আমি পড়াশোনা করতে চাই। বিয়ে বসতে চাইনা। বাবা বিয়ে দিতে চেয়েছিলো বলেই পালিয়ে এই শহরে চলে এসেছি। নওশাদ ভাইয়ার কল্যাণেই আপনাদের বাসায় আশ্রয় হলো আমার।

আরিয়ান পদ্মকে দাঁড় করালো ধরে। একজন অভিভাবকের ন্যায় পূর্ন স্নেহময় দৃষ্টিতে পদ্ম’র মাথাটাকে টেনে আলতো করে নিজের বুকে চেপে ধরলো। মাথায় ঘন চুলের মাঝে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বললো, তুমি গিয়ে বিস্রাম নাও। আমি যা করার করছি এই রাতের ভিতরেই।

পদ্ম চলে গেলো তার থাকার রুমে। এদিকে আরিয়ান ভাবতে থাকে একটা মেয়ে কতটা শিক্ষানুরাগী হলে শহরে চলে আসতে পারে পালিয়ে। মেয়েটার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটা কিছু করতেই হবে।

আরিয়ান নওশাদকে সব জানালো। এবং পদ্ম’র স্কুলের নিকটবর্তী কোন ছাত্রী হোস্টেল আছে কিনা খোঁজ নিতে বলল। ফোনে আরিয়ান ও নওশাদ যার‍ যার মতো করে ছাত্রী হোস্টেল খুঁজছে বা কোন ফ্যামিলির এক রুম ভাড়া দিবে কিনা খবর নিচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছেনা কিছুতেই।

পদ্ম’র দুচোখে ঘুম নেই। দূর হতে ভেসে আসছে বেহালার করুন সুর। সে সুরে পদ্ম’র হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হলো। বুঝে নেয় তার ও কি ব্যথা অন্তরে। তাই বুঝি নিদ্রাহীন রজনীতেও অমন বেদনার সুরে সুরে একটু প্রশান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আরিয়ান পদ্মকে ফোনে মেসেজ দিয়ে রাখে,
ভোর পাঁচটায় তোমার সব নিয়ে বাসার নিচে চলে যেও।

পদ্ম ঘুমন্ত জোহরা বানুর মুখে চেয়ে টপটপ করে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। পায়ে হাত দিয়ে সালাম দিলো। জোহরা বানু নড়েচড়ে উঠে বসলেন পায়ে পদ্ম’র স্পর্শ পেয়েই। পদ্ম’র মাথায় চুমু খেলেন। হাতে জোর করে গুঁজে দিলেন কিছু টাকা নিজের জমানো থেকে। বললেন,আমি জানি আরিয়ান কিছু একটা ব্যবস্থা করছে। আরিয়ান নওশাদ এই দুই নাতি আমার অনেক ভালো। আহিয়ান একটা হারামি হইছে।

পদ্ম নিঃশব্দ পায়ে বাসার নিচে চলে যায়। আজ রাতে কেয়ার টেকার নেই। নয়তো বিপদ হয়ে যেতো। গেটের বাইরে পা রেখেই দেখে আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের নির্জন পথ ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন। রিক্সা নিয়ে দুজন চলে গেলো বেশকিছু দূরে। একটি বাসার সামনে থামলো রিক্সা। পদ্ম দেখে সামনে একটি সিএনজি থেকে বের হলো নওশাদ। নওশাদের দিকে ছলছল চোখে তাকাতেই আরিয়ান বলল, তোমার থাকার বন্দোবস্ত করার কৃতিত্ব পুরোটাই আমার ভাই নওশাদের।

নওশাদের প্রতি উপচে পড়া কৃতজ্ঞতায় ছলছল করা পদ্ম’র নয়ন দুটি থেকে অশ্রুর সূক্ষ্ম স্রোতধারা গড়িয়ে পড়লো মাটিতে৷

আরিয়ান নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। বলল,এটা নওশাদের বন্ধুর বাসা। বাবা মা সহ থাকে। যাও সমস্যা নেই। ভালো মন্দ অবশ্যই মেসেজে জানাবে। তোমার সম্পূর্ণ খরচ আমিই বহন করবো।

নওশাদ পদ্মকে নিয়ে উপরে একটি বাসায় চলে যায়। দশমিনিট পর বের হয়ে আসে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পদ্ম’র পড়াশোনা নিয়ে দুজনে বেশ কথাবার্তা বলল। প্রভাত শেষে ভোরের আলো ফোটতে শুরু করলো। তারা দুজন একটি হোটেলে ঢুকে নাস্তা করে যে যার মতো বিদায় নিলো।

আরিয়ান বাসায় এসে নিজের রুমে শুয়ে পড়ে। পদ্মকে না দেখে আরিয়াননের মার এতটুকু ভাবান্তর হলোনা। বরং ভাবখানা এমন যেন আপন বিদায় হয়েছে। তবুও মনের কৌতুহল নিবারনের জন্য আরিয়ান ও শাশুড়ীর কাছে জানতে চাইলো, পদ্ম কোথায় যেতে পারে।

জোলেখা বানু বুদ্ধি করে হাপিত্যেশের সুরে বলল,
পদ্মর মুখে শুনেছি ঢাকায় তার কোন আত্মীর রয়েছে। হয়তো তাদের কাছেই গিয়েছে। আহিয়ানের বেশ মন খারাপ হলো পদ্ম’র জন্য। আফসোস করলো দাদীর কাছে গিয়ে।

অন্যের বাসায় আর কতদিন থাকা যায়। তাই নওশাদ ও আরিয়ান মিলে একটি ছাত্রী হোস্টেলে পদ্মকে উঠিয়ে দেয় এক সপ্তাহ পরেই। পরিচয় দেয় তাদের আত্মীয় বলে। পদ্ম নিয়মিত তার মায়ের সাথে কথা বলে। নওশাদ ও আরিয়ানের সাথেও যোগাযোগ করে। জোলেখা বানুকে খুব ইচ্ছে করলেও ফোন দেয়না। যদি উনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় পদ্মর সাথে কথা হয়েছে এমন কিছু।

দুদিন বাদেই পদ্ম’র এসএসসি পরিক্ষা শুরু। বুক দুরু দুরু কাঁপছে পরিক্ষা কেমন হয় কে জানে এই ভেবে।

আরিয়ান হোস্টেলের নিচে গিয়ে পদ্মকে ফোন করে ডেকে আনলো। জানালো,
পদ্ম কাল বিকেলের ফ্লাইটে আমরা সবাই চলে যাচ্ছি। নওশাদ তোমার সব দেখাশুনা করবে। আমার সাথে নেটে কন্ট্রাক্ট হবে। মন দিয়ে পরিক্ষা দিও। কেমন?

পদ্ম কোন কথাই বলতে পারছেনা। তার বুকের ভিতরটা এত ফাঁকা লাগছে কেন । চেনা দুঃখগুলো আবার ও দলাবেঁধে গলায় আটকে যাচ্ছে কেন।
চলবে….