জীবন রঙ্গমঞ্চ পর্ব-০৫

0
160

#জীবন_রঙ্গমঞ্চ

#পর্বঃ৫

লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

জীবন থেকে আরো চার’টে দিন পাড় হলো। এই চার’টে দিনে মা নিজেকে সম্পূর্ণ ঘর বন্দি করে রেখেছে। তবুও এখানকার লোকের কানাঘুঁষা থেকে নিস্তার নেই যেন। দিন পেরোতেই ছড়িয়ে পড়েছে আমার মা-বাবার সেপারেশনের সংবাদ। লোকজন আড়ালে বিভিন্ন কথা বলেই চলছে, কিন্তু তাসনিমের ক’ড়া জবাবের ভয়ে কেউ মা অথবা আমার সামনা-সামনি কিছু বলছে না। তবে তাদের ক’টু’দৃ’ষ্টি যেন বলে দিচ্ছে, “তুমি ডিভোর্সি নারী মানেই তুমি নি’কৃ’ষ্ট জীব! যাই হয়ে যাক, দিনশেষে নারী তুমিই দোষী। ” অথচ একজন নারী নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে সংসার আগলে রাখতে চায়। আবার সেই নারীকেই নিমিষেই সংসার থেকে বিতারিত করে কিছু পুরুষ।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে, হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। কবে, এই সমাজের চিন্তা ভাবনা শুদ্ধ হবে? আদৌও কি হবে?জানা নেই আমার! বেলকনি থেকে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া আঁচড়ে পড়ছে আমার শরীরে। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলাম আমি। হঠাৎ করে তাসনিম এসে পিছন থেকে আমায় আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। ঘাঁড়ে মুখ ঠেঁকিয়ে উনি ফিসফিসিয়ে বললো, “কি এতো ভাবছেন আমার জবাজান?”

আমি তাড়াক করে চোখ খুলে নিলাম। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “উঁহু! তেমন কিছু নয়।”

“মনে হচ্ছে যেন।”

চুপ রইলাম আমি। তাসনিম আমার দিকে ঘুরে এসে গাল ছুঁয়ে পুনরায় আবারো বললেন, “এতো কিছু ভেবো না জবাজান! তোমার ভাবনার জন্য তাসনিম আছে না।”

“তাই তো কিছু ভাবছি না, মায়ারাজ। যার আস্ত একটা “তাসনিম” রয়েছে তার এতো ভাবনা কিসের।”

আমার কথা শুনে এক চিলতে হাসি ফুটলো মানুষটির ওষ্ঠদ্বয়ে। দিনের শুরুতে, এই হাসিটাই যেন আমার প্রাপ্তি। আমিও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসির সঙ্গ হলাম। তাসনিম দু’হাতে জড়িয়ে নিলো আমায়। আমিও চুপটি করে অনুভব করতে লাগলাম তাকে। এই সময়টা শুধু আমাদের, একান্তই আমাদের। আমার মনটাও হুট করে উড়ন্ত কিশোরীর ন্যায় বলে উঠলো, “এই সময়টা এখানেই থেমে যাক।” আমার চঞ্চল মনটাও যেন আজ মানুষটাকে নিয়ে ডুব দিলো অথই ভাবনার মাঝে।

“জবাজান, ভালোবাসি!”

সময়টাকে আরো একটু রাঙিয়ে দিতে প্রিয় পুরুষটি নেশালো কণ্ঠে থেকে বেরিয়ে আসলো সুমধুর কিছু অনুভূতি প্রকাশ। এতটুকুই যথেষ্ট আমার আ’ত্মা’কে হিমশীতল করতে। আবেশে লোকটাকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমি। অতঃপর তার কপালে শব্দ করে এক চুমু দিয়ে মিহি কণ্ঠে শুধালাম,

“মায়ারাজ?”

আমার আদুরে কণ্ঠে শুনে চোখ তুলে তাকালো তাসনিম, বুকে হাত দিয়ে মিহি কণ্ঠে শুধালো, ”

“উফফ! এভাবে এতো মুগ্ধতা মিশিয়ে কেউ ডাকে জবাজান? জাস্ট বুকের বাঁপাশে এসে লাগছে।”

উনার কথা শুনে ফিক করে হাসলাম আমি, অতঃপর আগের ন্যায় বললাম,

” মায়ারাজ দেখুন না? লালচে-সোনালি রশ্মির এক চিলতে রোদ পরেছে আপনার চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিপাশে.!
নেশা আছে আপনার ওই দুচোখে.!!
প্রিয়তম ভালোবাসি আপনাকে।
এত কেনো মুগ্ধতা আপনার মাঝে.!!
.
.
আমাদের দু’জনে দুষ্ট -মিষ্টি সময়টার ভাঁটা পড়লো শ্বশুরের ডাকে। বাবা ডাইনিং টেবিলে বসে হাঁক ছেড়ে বললেন, “জবা মা। আমার নাস্তাটা দিয়ে যাও মা। আমার একটু তাড়া আছে আজ।”

উনার কথা শুনে আমার দু’জনই হকচকিয়ে উঠলাম। মিনিট খানিক সময় নিয়ে নিজেদের সামলে ডাইনিং রুমে আসলাম আমি। আমার পিছনে পিছনে তাসনিম ও এসেছে।
আজ শুক্রবার! ছুটির দিন। সেই সুবাধে আজ এখন অবধি কারো খাওয়া হয়নি। তান্মধ্যে তাসনিম বললেন, “জবা সবার জন্য নাস্তা রেডি করো। আজ সবাই এক সাথে খাবো।”

“আচ্ছা।”

বলে সবার জন্য নাস্তা রেডি করে নিলাম আমি। তাসনিমই একে একে মা, বোন, শ্বাশুড়ি’কে ডাকলেন। মিনিট দু’ই’য়ে’ক পরেই চলে আসলো সবাই। আজ মা ও এসেছে। তাসনিমের ডাক উপেক্ষা করতে পারেনি। আমি সবাইকে খেতে দিয়ে নিজেও বসলাম খেতে। তাসনিম খাবার মধ্যেই আমার শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন, ” মা তোমার শরীরটা কেমন যাচ্ছে এখন?”

উনি এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে খেয়ে যাচ্ছিলেন। আমার মা’কে যে তার সহ্য হয় না, তা তার আচরণেই বলে দিচ্ছে। শুধু তাসনিমের জন্য কিছু বলতে পারছে না। ছেলের কথা শুনে উনি মুখ কালো করে ততক্ষণাৎ বললেন, ” আমার খোঁজ নেওয়ার সে সময় কি আর তোর আছে? কত মানুষ হয়েছে আজকাল! হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে।”

মায়ের “কত মানুষের” ইঙ্গিত বুঝতে বেগ পেতে হলো না তাসনিমের। উনি চাইলো আমার দিকে, একবার চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “তুমি ও না মা! তোমার সাথে কারো তুলনা চলে বলো? মা’তো সন্তানের কাছে সবার উপরে। তোমার হাঁটু’র ব্যথা যে বেড়েছে আমাকে আগে বলবে না?”

“তুই তো সারাদিন ব্যস্ত থাকিস তাই বলিনি।”

“আচ্ছা আজ, কাল দু’দিন ফ্রী আছি আমি। বিকেলে তৈরী থেকো মা, আমি ডক্টরের চেম্বারে নিয়ে যাবো তোমাকে।”

শ্বাশুড়ি মা আর কথা বাড়ালেন না। তাসনিম নিজের প্লেটের খাবার মুখে দিতে দিতে আমার মায়ের দিকে তাকালো। মা মাথা নিচু করে খাবার নেড়ে যাচ্ছে। তাসনিম ডাকলো,

“মামণি?”

মা চোখ তুলে তাসনিমের দিকে তাকিয়ে বললো, “জ্বি বাবা।”

“শুনলাম ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করছেন না আপনি? সারাদিন রুম বন্ধ করে থাকেন। এভাবে হলে কি চলে বলুন? নাকি ছেলের বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে আপনার?”

“না। না বাবা। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না আমার। নিজেকে সামলাতে একটু সময় নিচ্ছি আমি। চিন্তা করো না, সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিবো আমি।”
এতটুকু বলেই মা অনবরত কাশতে শুরু করলো। শ্বাস কষ্টটা বেড়েছে মায়ের। এতটুকুতেই হাঁপিয়ে গিয়েছে। আমি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম তাকে। মা কিয়াৎ ক্ষণ পরে স্হির হলো। আমি ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ঠিক আছো মা?”

“হুম। এখন ঠিক আছি।”

তান্মধ্যে তাসনিম বললো,” মামণি আপনার শ্বাস কষ্টটা তো অনেক বেড়ে গিয়েছে। জবা? এক কাজ করিও। তুমিও মামণি’কে নিয়ে বিকেলে আমাদের সাথে যেও। মামণি’কে ভালো ডক্টর দেখানো উচিৎ। আগে উনার সুস্থ হওয়াটা ভীষণ জরুরী।”

তাসনিমের কথা শেষ হতেই মা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,

“না না। আমি ঠিক আছি তাসনিম। একটু শ্বাস কষ্টটা বেড়েছে এটা এমনিতেই সেড়ে যাবে বাবা। চিন্তা করো না আমার জন্য, তুমি বরং আপা’কে নিয়ে যেও। উনার ব্যথাটা একটু বেশিই বেড়েছে।”

পাশ থেকে তাসফিয়া বললেন,” মামণি এখানে মানে মেয়ের বাড়ি থাকতে, খেত বোধহয় আনইজি ফিল করছে ভাইয়া। আমরা তো উনাকে সেরকম ভাবে দেখছি না। আর শুনুন মামণি? সবকিছুতে এতো অস্বস্তিবোধ করবেনা আপনি। নিজের বাড়ির মতো থাকবেন। এখন আপনিও আমাদের পরিবারের একজন সদস্য। এখানে আপনার পুরো স্বাধীনতা থাকছে। বুঝছেন?”

তাসফিয়ার সাথে তাল মিলেয়ে আমার শ্বশুর বললেন, হ্যাঁ আপা। তাসফিয়া কিন্তু ঠিকই বলেছে।”

মা চুপ করেই রইলেন। আজকাল কথা বলতেও যেন তার বড্ড অনিহা! এদের কথার মধ্যে আমি তাসনিম’কে বললাম, “তাসনিম আমিও যাবো মা’কে নিয়ে ডক্টরের কাছে। আপনি সবকিছুর ব্যবস্হা করবেন।”

তাসনিম সম্মতি দিলো। আমি ফুপির দিকে চাইলাম, বেচারা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। তার সংসারে আরেকটা উঁটকো বোঝা জুটেছে এই চিন্তায় ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার প্রতি আবার কত দরদ একেকজনের। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ালাম আমি। আমার মায়ের দিন পাল্টে যাবে, আমি সব অন্য রকম করে দিবো। তবে এখনকার সবার আচরণ গুলো মনেই গেঁথে রবে আ’মৃ’ত্যু! আমি ফুপিকে একটু খোঁচা দিয়েই বললাম,

“ফুপি শ্বাস নেও। দ’ম আঁটকে যাবে তো। চিন্তা করো না, তোমার ছেলের টাকা-পয়সায় ভাগ বসাবে না আমার মা। আমার মায়ের চিকিৎসার সমস্ত খরচ মায়ের টাকা থেকেই হবে।”

ফুপি চোখ কটমট করে তাকালেন আমার দিকে। খানিকটা রাগ নিয়ে বললেন, “জবা? বেশি কথা শিখে গেছিস তুই।”

আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, “বেশি কি বললাম ফুপি? তোমাকে জাস্ট সতর্ক করে দিলাম। যে হা’রে তুমি চিন্তায় পড়ে গেছিলে। যে কোনো দূর্ঘটনা ঘটে’ই যেতো! তোমার ভাতিজী না আমি! মানুষের মন পড়তে জানি।”

আমাদের কথোপকথন শুনে আমার শ্বশুর, ননদ মুখ টিপে হাসছে। আমাদের মধ্যে এমন প্রায়ই হয়। এতে তারা অভস্ত্য। ফুপি আজ রেগে আছেন। পরিস্থিতি সামলাতে তাসনিম গলা খাঁকারি দিয়ে আমাকে বললেন,

“আহ! জবা কি শুরু করলে? তোমাদের ফুফু- ভাতিজীর সা’পে’নে’উ’লে সম্পর্ক আর গেলো না।”

“দেখলি তো তাসু? মেয়েটা আজকাল বড্ড কথা বলে।” অভিযোগ নিয়ে বললেন ফুপি।

তাসনিম অসহায় দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তো একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। অহেতুক মাথা চুলকিয়ে বললেন, “উঁহু! আমাকে তোমাদের মধ্যে টেনো না মা। তোমরা ফুপু-ভাতিজী একই বংশধর। আমি কিছু বললে আমার র’ক্ষা নেই। তোমরা দু’জন মিলে বুঝো। বাপু!”

উনার অসহায় মুখটা দেখে হেসে উঠলো সবাই। এরিমধ্যে যে যার খাবার শেষ করে চলে গেলো রুমে। আমি সব চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত নিজের কাজে মন দিলাম।
.
.
পর দিন সন্ধ্যায় তাসনিম বাদে পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছেলাম আমরা। তাসফিয়া মা’কে ও জোর করে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন। আজ খেলা চলছে। সবাই মিলে বাংলাদেশের খেলা দেখছি। এরিমধ্যে তাসনিম ও এলো আমাদের মাঝে। আড্ডার এক ফাঁকে তাসনিম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আব্বু -আম্মু তোমাদের কিছু বলা ছিলো?”

সবার দৃষ্টি এবার তাসনিমের দিকে। কৌতূহল হয়ে কিছু শোনার অপেক্ষা করছে সবাই। তান্মধ্যে, তাসনিম কোনো বণিতা ছাড়াই বললেন, “জবার জন্য আমি একটা চাকরি’র ব্যবস্হা করেছি। আগামীকাল ওর ইন্টারভিউ। আ…”

তাসনিমের কথা শেষ না হতেই আমার শ্বাশুড়ি ফুঁসে উঠে বললেন, “কিহ! এখন বাড়ির বউকে দিয়ে চাকরি করাতে হবে তাসনিম? এতো অধঃপতন হয়েছে তোর! জবা চাকরি করলে এই সংসার সামলাবে কে শুনি?”

“এতো রিয়েক্ট করছো কেন আম্মু? জবা অবশ্যই চাকরিতে জয়েন করবে। জবা এই বাড়ির বউ হবার আগে ও কোনো মায়ের একমাত্র সন্তান। সন্তান হিসেবে আমি যেমন তোমাদের দায়িত্ব নিয়েছি তেমনি জবাও মামণি’র দায়িত্ব নিবে। তাছাড়া, বাড়ির বউ একা কেন সারাদিন সংসার সামলাতে ব্যস্ত থাকবে? তোমরা সবাই আছো না মিলেমিশে সামাল দিবে।তাও যদি না পারো, দরকার হলে আমি একজন সাহায্যকারিনী রেখে দিবো।”

নিজের কথা শেষ করে তাসনিম বাহিরে চলে গেলেন। আমার শ্বাশুড়ি ছেলের কথা শুনে বিলাপ শুরু করে দিলেন। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” দেখলে তো? তোমার ছেলে আজকাল কিভাবে বউয়ের হয়ে কথা বলে। আমাকে খাবারের খোঁটা দিচ্ছে। এই দিন দেখার আগে কেন আমার ম’র’ণ হলো না গো!”

আমার শ্বশুর টিভির দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন,
“আহা,রেহনা! খেলা দেখতে দেও তো। তাছাড়া, তাসু ভুল কিছু তো বলেনি।”

স্বামীর কাছে আশকারা না পেয়ে পুনরায় ফুঁসে উঠলেন উনি। এখন আমার শ্বশুর’কে একের পর এক কথা শুনাবে সেই ভয়ে লোকটাও ছেলের পিছনে পিছনে বাহিরে চলে গেলো। আমরাও আর বসলাম না, সবাই যে যার রুমে চলে গেলাম। শুধু বসার ঘরে বসে কিচ্ছা গাইছে আমার ফুপি।
.
.
বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে সিগারেটে একের পর এক সুখটান দিচ্ছেন আসলাম শেখ। লোকটার দিন বেশ ভালোই যাচ্ছে। নতুন বধূ’র নতুনত্ব স্বাদ পেয়ে এক নিমিষেই ভুলে গিয়েছেন সব কিছু। আজকাল মুখ থেকে মুচকি হাসি সরছেই না তার।
কিয়াৎ ক্ষণ পরেই এক কাপ চা হাতে সেখানে উপস্থিত হলেন তার নববধূ। যুবতী মেয়েটা লাল রঙা শাড়ী খানা পড়েছে আজ, শাড়ীর আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা ছড়িয়ে আছে। দু-হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ির রিনঝিন শব্দে মুখরিত পরিবেশ। আসলাম শেখ হাতের সিগারেট ফেলে উঠে দাঁড়ালো। যুবতী বউয়ের রূপের মোহ ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ করছে তাকে। ওষ্ঠের হাসি দ্বয় আরো একটু গাঢ় হলো তার। তার বয়স্ক মনটাও যেন আজকাল বিশ বছরের যুবকে পরিণত হয়েছে। মেয়েটা বোধহয় জাদু জানে! ধীরপায়ে মেয়েটার কাছে এগিয়ে আসলো আসলাম শেখ। তান্মধ্যে “রুপা” নামক নতুন বধূ চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে মিহি কণ্ঠে বললেন, “আপনার চা।”

আসলাম শেখ হাত বাড়িয়ে চা টা টি-টেবিলে রেখে সকল দূরত্ব চুকিয়ে বউয়ের কাছে এগিয়ে আসলেন। রুপার কানে কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা ফিসফিস করে বলতেই, মেয়েটা লজ্জায় মুখ লুকালো স্বামীর কাঁধে। আসলাম শেখ হাসলো। পুনরায় বসে চা শেষ করে নিলো। এরিমধ্যে নতুন বউ আবদার করে বসলেন, “আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। ”

তাকে আরেকটু আনন্দিত করতে আসলাম শেখ বললেন, ” পার্কে যাবে রুপা? আজ এই স্নিগ্ধময়ী সন্ধ্যায় তোমাকে নিয়ে ঘুরবো।”

মেয়েটা খুশীতে লাফিয়ে উঠলো। স্বামীর কাছে রিনিঝিন কণ্ঠে বললেন, সত্যিই যাবেন? আমাকে কিন্তু আজ, অন্নেক গুলো মার্কেট করে দিতে হবে।”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন আসলাম শেখ। অতঃপর দু’জনে বেড়িয়ে পড়লেন ব্যস্তহীন পায়ে। যুবতী কন্যার সঙ্গ দিতে উড়ন্ত বালক হয়ে গেলেন তিনি।
____________

সেদিন আমাদের দুই মা’কে শহর থেকে বড় ডক্টর দেখিয়ে এনেছি আমরা। এখন আমার মা আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছেন। ডক্টর জানিয়েছেন, নিয়মিত ঔষধ ও তার দেওয়া রুলস ফলো করলে মা একদম সুস্থ হয়ে যাবেন। এখন মা মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। তবে নিজের সংসার ত্যাগ করার পর মা’কে কখনো হাসতে দেখিনি আমি।
আমি ও একমাস হলো একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেছি। প্রথমে আমার শ্বাশুড়ি অমত করলেও ছেলের সাথে জোর খাটাতে পারেনি।তাসনিম বরাবরই তার সিদ্ধান্তে অটল, তার নেওয়া সিদ্ধান্ত কখনো নড়বড়ে হয় না । এই মানুষটাকে আমি আমার জীবনে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। যে মেয়ের এমন একটা জীবন সঙ্গী পায়, তার আবার দুঃখ কিসের? এখন আর আমার কোনো কিছু ভেবে কষ্ট হয় না।

অবশেষে দীর্ঘ একমাস কাজ করার পর আজই প্রথম বেতন পেলাম। মাস শেষে এইটুকু প্রাপ্তিতেই সব পরিশ্রম দূর হয়ে যায় যেন। আজ থেকে আমি আমার মায়ের সব দায়িত্ব পালন করবো। ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে গেলো।
প্রথম বেতন পেয়ে চলে গেলাম মার্কেটে। একে একে সবার জন্য আজ নিজের টাকায় কেনাকাটা করে বাসায় চলে আসলাম।

বসার ঘরেই বসে ছিলেন সবাই। মা আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো, আমি মাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলাম। মা আমার ক্লান্ত মুখটায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে মা? আজ এতো খুশী কেন তুই?”

আমি মায়ের হাত ধরে হাসিমুখে বললাম “আজ থেকে তোমার সব দায়িত্ব তোমার মেয়ে নিবে মা। তোমার কোনো চিন্তা নেই, তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবো আমি।”

আজ অনেক গুলো দিন পরে মা বোধহয় একটু হাসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “পাগলী মেয়ে আমার!”

আমি মায়ের হাত ধরে ভিতরে চলে আসলাম। মা’কে দাঁড় করিয়ে মায়ের জন্য আনা শাড়ীটা গায়ে জড়িয়ে দিলাম। আজ মায়ের চোখে আনন্দে’র অশ্রুকণা চিকচিক করছে। মা মন ভরে দোয়া করলো আমার জন্য। একে একে সবা’র জন্য আনা গিফট গুলো বুঝিয়ে দিলাম। আজ সবার মুখে স্নিগ্ধময়ী হাসি। এই হাসিটুকু’র আড়ালে রয়েছে আমার স্বামীর অবদান।
.
.
রাত দশটায় তাসনিম এলো। গোসল করে বেরোতেই তার জন্য আনা একটা পাঞ্জাবি প্যাকেট হাতে দিয়ে বললাম, ” আমার মায়ারাজ। দেখুন তো পছন্দ হয়েছে কিনা?”

উনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ” কি এটা?”

“আরে খুলেই দেখুন না।”

উনি কথা না বাড়িয়ে বিছানায় বসে নীল রঙা পাঞ্জাবিটা দেখে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। উনার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে আমি মুখ কালো করে বললাম, “কি হলো, পছন্দ হয়নি তাই না?”

উনি আমার কথা শুনে হঠাৎ হাসলো কিঞ্চিৎ। আমাকে উনার পাশে বসিয়ে গাল ছুঁয়ে বললেন,

“উঁহু, কি বলছো জবাজান? তুমি জানো আমি কতটা খুশী হয়েছি। আমি জাস্ট সারপ্রাইজ হয়ে গিয়েছি।”

আমি উনার কথায় খানিকটা লজ্জা পেলাম। বিয়ের পর এটাই ছিলো উনাকে দেওয়া আমার প্রথম গিফট। উনি ততক্ষণাৎ উঠে পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আর আমি আড় চোখে দেখছি আমার মায়ারাজকে। মানুষটার মুখ থেকে হাসিটা সরছেই না।
উনার মুখের হাসিটা বলে দিচ্ছে, মানুষটা সামান্য গিফটে কতটা খুশী হয়েছে। এই হাসিটা দেখার জন্য হলেও, মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষটাকে গিফট দিলে মন্দ হয় না।
আজ খুব করে উপলব্ধি করলাম আমি, সংসারের পাশাপাশি একটা মেয়ের কিছু উপার্জন ভীষণ দরকার। ভীষণ!

চলবে…..