জীবন রঙ্গমঞ্চ পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
228

#জীবন_রঙ্গমঞ্চ

#সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৬ ( সমাপ্তির প্রথম অংশ)

পরদিন সকালে রান্না করছিলাম আমি, আমাকে টুকটাক সাহায্য করছে আর গল্প করছে “মা”। এমন সময় রিনা মেয়েটা দৌ’ড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “ভাইজান আপ্নারে শীঘ্রই রুমে ডাকে আপা।”

আমি বাকি রান্নাটা রিনা’কে বুঝিয়ে দিয়ে দ্রুত রুমে’র দিকে পা বাড়ালাম। দিন পনেরো হয়েছে রিনাকে সাহায্যকারিনী হিসেবে রেখে দিয়েছে তাসনিম। তবুও সকালের রান্নাটা সব সময় আমিই করি। আমার মা, শ্বাশুড়ি মিলে বাকিটা সামলে নেয়।
রুমে কাছাকাছি যেতেই শ্বশুর আব্বু আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে আবদারের সুরে শুধালো , “আমায় একটা চা করে দিবে আম্মা?”

এতো মিষ্টি আবদার কি আর বারণ করা যায়? আমি মুচকি হেসে বললাম, “আচ্ছা আব্বু। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি চা করে নিয়ে আসছি।”
পাশ থেকে শ্বাশুড়ি পান চিবাতে চিবাতে ফোঁড়ন কে*টে শ্বশুর’কে বললো, ” এই সকাল বেলা উঠেই খালি পেটে তোমার চা খেতে হবে? যতসব আ’জা’ই’রা অভ্যাস।”

শ্বশুর মশাই মুখ বাঁকিয়ে শুধালো, উঁহু! তোমার কত সু-অভ্যাস! তুমি যে সকাল বেলা উঠেই এক গাল পান মুখে দিয়ে ফোঁ’স ফোঁ’স করো। যেখানে ডক্টর পান খেতে তোমাকে বারণ করেছে।”

“এই আমার পান নিয়ে একদম বাজে মন্তব্য করবে না তুমি! আমি খাইলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তাছাড়া পান খেলে দাঁত ভালো থাকে, ডাক্তার তো আর বুঝে না সেসব। কিন্তু চা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।” ভাব নিয়ে বললো আমার শ্বাশুড়ি।

এদের ঝগড়া দেখে আমি খানিকটা হেসে বলে উঠলাম, “আহা! ফুপি সকাল বেলা কি শুরু করলে?”

ফুপি আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন, “আমি কি করলাম? সবসময় তো তোর শ্বশুরই শুরু করে।

পাশ থেকে শ্বশুর মশাই খেঁকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ! হ্যাঁ! এখন সব দোষ তো আমারই। তুমি তো নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ে!”

আবার দু’জনের ত’র্ক লেগে গিয়েছে। এরা দু’জন এমনই! সারাক্ষণ একজন আরেক জনের পিছনে পড়ে থাকে।
এদের চিল্লাপাল্লা শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো তাসনিম, তাসফিয়া। দুই ভাইবোন বিরক্তিকর কণ্ঠে এক সাথে বলে উঠলো, “কি হয়েছে এখানে?”

ছেলে-মেয়েকে দেখে দু’জন থেমে গেলেন, কেউ কিছু বললেন না। আমি আস্তে করে বললাম, “কি আর হবে? যা সবসময় হয়।”

বিরক্ত হলো দুই ভাইবোন। এসবে যেন সবাই অভস্ত্যতো এখন! তাসফিয়া নিজের রুমে যেতে যেতে বললেন, “এরা আর ভালো হবে না!”

তাসনিম পরক্ষণে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছো জবা? আমি তোমায় ডেকে ছিলাম শুনতে পাওনি?”

“হ্যাঁ শুনেছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি বাবাকে একটা চা করে দিয়ে আসতেছি।”

তাসনিম দাঁত কটমট করে চলে গেলো। শ্বশুর মশাই খবরের কাগজে মুখ ডুবালো। শ্বাশুড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু দমকে বললেন, ” তাসনিম তোকে ডেকেছে না জবা, শুনতে পাসনি? একদম আমার ছেলেটার খেয়াল রাখিস না তুই। যা গিয়ে দেখ কি লাগবে ওর।”

“ফুপি আসলে চা……।”

“হয়েছে! হয়েছে! যা তো তুই। বুড়োর চা টা আমি করে দিচ্ছি।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না, মুচকি হেসে মাথা নাড়ালাম। ইদানীং ফুপির ব্যবহারটাও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো গমগমে স্বভাবটা আর নেই। আমি আনমনে হাসলাম, সবই টাকার খেল! টাকা! টাকা! টাকাই যেন সব!”

আমি আর এসবে মাথা ঘামালাম না। এক দৌড়ে রুমে চলে আসলাম। বর মহাশয় খাটে আধশোয়া হয়ে রিলাক্সে ফোন ঘাঁটছেন। আমি তার কিনারায় বসে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলাম, “কি বলবেন জাহাঁপনা? এতো জরুরী তলব যে?”

উনি ফোনের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো, “সে আর সময় মতো পেলাম কই?”

বুঝলাম রেগে আছে আমার বরটা। আমি বাধ্য বউয়ের মতো কানে হাত দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললাম, “স্যরি মায়ারাজ আমার! একটু লেট হয়ে গেলো,এখন বলুন না।”

“এখন ফিলিংস নষ্ট হয়ে গেছে।”

“মানে?”

“মানে আমার এতক্ষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছিলো। এখন পাচ্ছে না।”

“আচ্ছা এই ব্যাপার। এতটুকুতেই প্রেম ফুরিয়ে গেছে আপনার?” মুখ কালো করে বললাম আমি। উনি হাতের ফোন রেখে আমার চোখে চোখ রেখে নেশালো কণ্ঠে শুধালো, “তোমার প্রতি আমার এই প্রেম ফুরাবার নয় জবাজান! এই প্রেম আ’মৃ’ত্যু হয়েই থাকবে আজীবন।”

আমি দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে ততক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালাম। এই চোখের গভীরতায় তাকানোর সাধ্য আমার নেই। এই মায়াবী চোখ দু’টোয় যতবার চেয়েছি ঠিক ততবার নতুন করে প্রেমে পড়ছি তাহার। লোকটা ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ করে আমায়। উনার ভিতরে অলৌকিক শক্তি আছে বোধহয়! যা দিয়ে বারবার আকর্ষণ করছে আমায়। আমি শুকনো ঢোক গিলে ততক্ষণাৎ মিছে রাগ দেখিয়ে বললাম, “হয়েছে! সে তো দেখছিই আমি। পুরাতন হয়ে গিয়েছি কিনা! এখন তো আমাকে ভাল্লাগে না আপনার, সেটা সোজা বললেই পারেন।”

লোকটা শব্দ করে হাসলো। আমি মুখ বাঁকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলাম, পিছন থেকে হাত ধরে ফেললো উনি। ততক্ষণাৎ হাত ধরে টেনে কোলের উপর বসিয়ে, পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আমায়। উনার স্পর্শ পেয়ে আজও প্রথম দিনের মতো কেঁ’পে উঠলাম আমি। চটজলদি নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, “কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমায়।”

কিন্তু পুরুষটি ছাড়লো না, আরো একটু ঝাপটে ধরলো আমায়। মাথায় আলতো চুমু দিয়ে ফিসফিস করে ডাকলেন, “জবাজান?”

“হুম।”ছোট্ট করে জবাব দিলাম আমি।

উনি আমার রেসপন্স পেয়ে চুলে মুখ ডুবিয়ে পুনরায় বললেন,

“বুকে তুমুল ঝড়ের শব্দ শুনেছো কখনো?
সাগরের তীরে উথাল পাথাল ঢেউ আছড়ে পড়ে যেমন,তেমন।
রাত্রি নিশিতে নিকষ কালো আঁধার,পূর্ণিমাতে ভরা জোছনা।তুমি এলেই জ্বলে মনের বাতি,বেড়ে যায়
যে আমার বাসনা।
হৃদয়ের কোঠরে আহ্লাদী এক মেয়ে তুমি,ভীষণ জ্বালাও আমায় সারাক্ষণ।
অনুভবে মিশে থাকে শুধু,ভালোবেসে কেড়ে নেয় যে মন।আমার ভেতর তোমার বসবাস,তোমার ভেতর আমি থাকি যদি?
ভালোবাসার তুফান বয়ে যায়,বর্ষণে হয় গভীর একটা নদী।
কেমন করে বোঝাই আমি পাগল?তোমার ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পাই,আসলে কাছে আলো জ্বেলে রাখি।এই তুমি ছাড়া কোথায় পাবো আমি ঠাঁই?
ঠোঁটের চুমুর আবদারে তুমি অবুঝ,বোঝালেও যে বুঝ মানো না,
আমিও যে প’গ’ল হয়ে থাকি,তুমি কি’গো একটুও বোঝো না?”

উনার ঘোর লাগা দৃষ্টি, নেশালো কণ্ঠের কাছে বরাবরের ন্যায় হার মেনে গেলাম আমি। হৃদয়ের মিছে রাগ, অভিমানকে উপেক্ষা করে টুপ করে চুমু খেলাম উনাকে। উনি আলতো হাসলো, যা দেখে উনার বুকে লজ্জায় মুখ লুকলাম আমি। তাসনিম আলতো করে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো আমায়। মাথায় চা*টি মে*রে মুচকি হেসে শুধালো, “পা’গ’লী!”
.
.
দু’জনের খুনসুটিতে কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। ইতোমধ্যে বেলা অনেকটা হয়েছে। অফিসের জন্য রেডি হচ্ছি আমি আর তাসনিম। এরিমধ্যে মা ডাকলো নাস্তা করার জন্য। দু’জন এক সাথেই বেড়িয়ে পড়লাম। ডাইনিং রুমে সবাই অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য। মা আমাদের দু’জনকে খাবার দিতে দিতে উসখুস করছে কিছু বলার জন্য। আমি লক্ষ না করলেও তাসনিম লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন,” আপনি কিছু বলবেন মামণি? কোনো কিছু দরকার আপনার? ”

মা ইতস্তত করে বললেন, “একটা কথা বলার ছিলো তোমাদের।”

সবার দৃষ্টি মায়ের দিকে, আমি চট করে বললাম, ” কি বলবে মা? বলো। ”

মা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমি ভাবছি এভাবে বসে না থেকে কিছু একটা কাজ করবো। এতে….”

মা’র কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি মৃদু রাগ দেখিয়ে বললাম, “তুমি কি করবে মা? এমনিতেই তুমি কত অসুস্থ। তাছাড়া আমি থাকতে তোমার কেন কাজ করতে হবে মা? আমি কি ম’রে গেছি।”

“ছি! সে কি কথা। রেগে যাচ্ছিস কেন মা। আসলে আমি…”

“উঁহু থাক! তুমি এসব চিন্তা করো না। আমি আছি না মা? তুমি অসুস্থ, বয়স হয়েছে। এখন এসব চিন্তা মাথা থেকে বের করে, নিজের কেয়ার করো।”

“আমি ঠিক পারবো জবা। বয়স হয়েছে তো কি হয়েছে? ইচ্ছে শক্তিই বড়! জানিস, ক্লান্ত শরীর আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেশিদূর পাড়ি দেওয়া যায় না। কিন্তু শক্ত মন আর সাহসী মানুষ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্তকে তোয়াক্কা করে না।”

“কিন্তু মা…..”

আমায় থামিয়ে দিলো তাসনিম বললো, “আহ জবা! চুপ করো না। মামণি কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরনির্ভরশীল না হয়ে নিজে কিছু করতে চাইলে করুক না। এতে মামণি’র বিষন্ন সময়টাও কে’টে যাবে ব্যস্ততায়, একরোখা কুৎসিত সমাজে নিজেরও কদর বাড়বে।”

মুহুর্তেই মায়ের ঠোঁট জুড়ে স্নিগ্ধ হাসি দেখা গেলো। সেই হাসির দিকে চেয়ে, মন জুড়িয়ে গেলো আমার। একে একে বাকিরাও সাপোর্ট করলেন মায়ের সিদ্ধান্ত’কে। আমি আর না করলাম না। আমার মা আরবি বিষয়ে ভীষণ অবিজ্ঞ। অতঃপর সকালে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, “মা ছোট -বড়দের সকাল বিকাল নিদিষ্ট একটা সময় আরবি শিখাবে।” এতে নিজের সময়টাও কে’টে যাবে অনায়াসে। বিনিময়ে হাদিয়া হিসেবেও কিছু পেলো।
_________

পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাসি আনন্দের মাঝে কেটে গেলো আরো তিনটে বছর। কি করে যে তিনটে বছর গত হলো টেরই পেলাম না আমি! আমার মায়ারাজ আষ্ঠেপৃষ্ঠে, পরম আদরে জড়িয়ে রেখেছে আমাকে। এতটুকু আঁচড় লাগতে দেয়নি আমায়। নিজেকে ভীষণ সুখী মানুষ মনে হচ্ছে আজকাল। ভাগ্য যেন সহায় হয়েছে আমার। আজ আমি একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। মাস ছয়েক হয়েছে জয়েন করেছি কাজে। এর পিছনে সম্পূর্ণটাই আমার মায়ারাজের অবদান। আমার মা’ও এখন শারিরীক, মানসিক ভাবে ভীষণ সুস্থ। মা গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চাদের পড়িয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছে কয়েক বছরে। মানুষটার বিষন্ন সময়টা কে’টে আলোর দেখে মিলেছে। এখন তার দিন যায় হাসি-আনন্দে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে। শ্বাশুড়ি মা’টাও নিজেকে পরিবর্তন করে নিয়েছে। আমার মায়ের সাথে তার বেশ ভাব হয়েছে। শুনেছি বাবাও নতুন বউ নিয়ে বেশ ভালো আছেন। বাবা’র সমস্ত সম্পদ তার নামে লিখে দিয়েছে। এতে আমার কিছু যায় আসে না। যে মানুষটা ঘৃণার আদুলী জুড়ে বসবাস করছে, তার জায়গা-জমি পাওয়ার আশা কখনো রাখিনি। আমি মনে করি আমার বাবা মৃ*ত্যু। এতে আমার দুঃখ হয় না আর! আমার আস্ত সুখের একটা রাজ্য রয়েছে। মানসিক শান্তি’র জন্য আমার মায়ারাজ রয়েছে।

আমাদের পরিবারে মানুষ গুলো আজ একটু বেশিই খুশী। আজ ডক্টর জানিয়েছে, আমার সুখের রাজ্যে নতুন অতিথি আসছে। প্রথমবার মা হওয়ার অনুভূতির সাথে পরিচিত আমি। এ যেন এক অন্য রকম সুখ! তাসনিমের ঠোঁটের কোণের হাসিটা সরছেই না যেন। ডক্টর দেখিয়ে আসার পর থেকে আমার পেট জড়িয়ে সুয়ে আছে লোকটা। এরিমধ্যে আমি উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “এবার তো ছাড়ুন আমায়। কেউ এসে এভাবে দেখলে, কি বলবে বলুন’তো?”

উনি আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে থামিয়ে দিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন, “হুঁশ! আমার বউ আমি জড়িয়ে রেখেছি, দরকার হলে কোলে করে রাখবো, তাতে কার বাপের কি?”

আমি উনার কথা শুনে হকচকিয়ে উঠে বলালাম “কিহ?”

উনি হাসলো। আমার পেট আলতো করে ছুঁয়ে বললেন,

“এখানে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন বেড়ে উঠছে জবা? ইশ জবাজান! আমার যে আজ কতটা আনন্দে লাগছে জান। তোমাকে বুঝাতে পারবো না। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জান! এত সুন্দর এক অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিবার জন্য। ভালোবাসি আমার বাচ্চার আম্মু!”

সুখে আজ অশ্রুকণারা ভির করছে আমার চোখে।উনি জলটুকু গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে দিলো। আবারও ব্যস্ত হয়ে,অনাগত সন্তানে’কে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন বুনছে, কখনো আনমনে হাসছে। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই হাসিটা কাছ থেকে উপলব্ধি করছি। আর আমার ছোট্ট সোনার আগমনের প্রহর গুনছি।

চলবে…….

#জীবন_রঙ্গমঞ্চ

লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৭(সমাপ্তির দ্বিতীয় অংশ)

দেখতে দেখতে প্রেগনেন্সির আটটি মাস কে’টে গিয়েছে। আর মাএ দু’টো মাস ! ছোট্ট একটা প্রাণ আসবে আমার ঘরে। আমাদের অস্তিত্বের আগমনের জন্য, স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে অবসরে আছি আমি। আজ দুপুরে খেয়ে সেই থেকে সুয়ে আছি আমি। ডক্টর সম্পূর্ণ বেট রেস্ট দিয়েছে।
বিকেল টাইমটায় বড্ড বোরিং লাগছে আমার। তাসনিম এখনো তার অফিসে, অনেকটা ব্যস্ত সময় পাড় করছে মানুষটা। তবুও অফিসে থাকাকালীন সময় বের করে বারকয়েক খোঁজ নিতে ভুলে না সে। লোকটার কথা ভাবতেই আনমনে ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির ঝলক দেখা গেলো।

আমি সোয়া থেকে উঠে বসলাম, অবসর সময় কাটাতে একটা উপন্যাসের বই হাতে নিলাম। এরিমধ্যে আমার মা গরম দুধ নিয়ে হাজির, তার পিছনে পিছনে ফুপি। আমাকে বসে থাকতে দেখে ফুপি ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, “এই অসময়ে কি পড়ছিস বসে? ভরাপেট নিয়ে এতো নড়াচড়া করিসনে জবা। আমার নাত/নাতনী যেন কষ্ট না পায়। খবরদার!”

বলতে বলতে বইটা কেঁড়ে নিলেন উনি। তান্মধ্যে মা দুধের গ্লাসটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে আদেশ জারি করলেন, “গরম গরম দুধটা খেয়ে সুয়ে পড় দেখি।”

আমি মুখ কালো করে বললাম, “এখন খেতে ইচ্ছে করছে না মা, পেট ভরা লাগছে।”

কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। দুই মা মিলে দুধের, পুষ্টি ও উপকারিতা সম্পর্কে জ্ঞান জুড়ে দিলেন। আমি কথা না বাড়িয়ে খেয়ে সুয়ে পড়লাম। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, ফুপি তার অনাগত নাত/নাতনির সাথে কথা বলছে। এদের হাব-ভাব দেখলে মনে হচ্ছে দুনিয়ায় একমাত্র আমারই বাচ্চা হচ্ছে। আমি এসব ভীষণ এনজয় করছি। ভাগ্য করে এমন পরিবার পেয়েছি আমি। আলহামদুলিল্লাহ!
দিন যাচ্ছে যত, সবাই আবেগে আপ্লুত! বাচ্চা নিয়ে একেকজন একেকরকম প্লানিং করছে। সবার ভিতরে ভীষণ ইন্টারেস্ট কাজ করছে, প্রথম বাচ্চা বলে কথা। বাসার সবাই এখন আমায় ভীষণ যত্ন করছে। এদের পাগলামো দেখে আনমনে হাসি পায় আমার।
.
.
মায়ের আদুরে ছোঁয়া পেয়ে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম আমি। শেষ বিকেলে তাসনিমের ডাকে ঘুম ভাঙে আমার। উনার রাতে ফেরার কথা। এই সময়ে উনাকে দেখে একটু অবাকই হয়েছি আমি, তবে প্রকাশ করলাম না।
সারাদিন পর উনাকে দেখে চোখ জুড়ালো আমার, আমি কিঞ্চিৎ হাসলাম। লোকটা খানিকক্ষণ হলো ফিরেছে, ভেজা চুল দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, বোধহয় এসেই গোসল দিয়েছে।
আমি ভারি পেটটা নিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম, তান্মধ্যে তাসনিম এসে উঠতে সাহায্য করলো আমায়। পরক্ষণে আমার কাছে ঘেঁসে বসে মোলায়েম কণ্ঠে শুধালো, “ঘুম হয়েছে জবাজান? ”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “ভীষণ। কিন্তু, আপনি আজ এতো দ্রুত ফিরলেন যে?”

উনি আমায় আলতো করে জড়িয়ে ধরলো, কাঁধে চুমু খেয়ে বললেন, ” পুরুষ মানুষের ঘরে বউ থাকলে কি আর অফিসে মন টিকে? তোমার আদর পাওয়ার জন্য মনটা আনচান আনচান করছে। তাই চলে আসছি।”

আমি উনার চুল টেনে দিয়ে, চোখ পাকিয়ে বললাম, “এ্যাহ ঢং! মনে হয় আমি নতুন বউ।”

উনি আলতো হাসলো।আমার কোলে আলগোছে সুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম উনার কপালে, তাসনিম চট করে আমার হাত ধরে বললেন,

“তুমি আমার কাছে সবসময়ই নতুন জবাজান! ঠিক সেই প্রথম দিনের মতো। তুমি শুধু আমার ভালোবাসাই নও, তুমি আমার গন্তব্য। এই আমিই জানি একটু সময় আগে বাড়ি ফেরার স্বাদ!”

উনার কথা শুনে মনটা শীতল হয়ে যায় আমার, মাঝেমধ্যে ভাষাহারা হই আমি। এই মুহুর্তে এই মানুষটার কথার বিপরীতে কি বলা উচিত আমার? সত্যি জানি না আমি। আহ কপাল আমার! একটা পুরুষের এতো ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি আমি। এই মুহুর্তে আমি চুপ রইলাম, নিরব থেকে শুধু অনুভব করলাম আমার মায়ারাজ’কে।
উনি ফের আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সারাদিন কেমন কাটলো জান? তোমার কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”

“উঁহু! ঠিক আছি আমি।”

“সত্যি তো?”

“হুম একদম।”

তাসনিম পুনরায় চোখ বুঝলো। আমি উনার পাশ দিয়ে গামছাটা নিয়ে চুল গুলো মুছে দিলাম অবলীলায়। এরিমধ্যে হঠাৎ করে তাসনিম আনমনে বলে উঠলো, “জবাজান! কখনো তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো?”

হঠাৎ উনার এহেন কথায় আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,” মানে?”

“শুনো জান? আমি যদি কখনো পৃথিবীতে নাও থাকি, তুমি শুধু আমার হয়ে থেকো জবাজান! তুমি আমার, একান্তই আমার। তুমি আমার বড্ড শখের নারী। আমার রক্তজবা! আমি তোমাকে আকাশের মতো ভালোবাসি।”

তাসনিমের গলাটা জড়িয়ে আসছে,কন্ঠনালী কাঁপছে। আকষ্মিক উনার এহেন কথায় বুকের বাঁপাশটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। আমি উনাকে মৃদু দমকে বলে উঠলাম,

“একদম বাজে কথা বলবেন না আপনি। এসব আমার পছন্দ নয় তাসনিম । আমি.. আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না, না আমি কোথাও যাবো। আপনারে আমি বুকে মধ্যে যত্নে করে লুকিয়ে রাখবো, অন্য কেউ খুঁজেই পাবে না। কেউ না! আমি অসম্ভব ভালোবাসি আপনাকে! আপনি ছাড়া জবা অস্তিত্বহীন।”

বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। তাসনিম চটজলদি উঠে বসলো, আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অতঃপর ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,

“এই, এই.. জবা? আরে কাঁদছো কেন পাগলী? আমি তো জাস্ট এমনিতেই বললাম। আচ্ছা সরি! আর কখনো বলবো না। তুমি এতো হাইপার হইয়ো না প্লিজ! জবা তুমি অসুস্থ। তুমি উওেজিত হলে আমাদের সন্তানের অসুবিধা হতে পারে জান।”

“আমাদের সন্তান” কথাটা ভাবতেই নিজেকে সামলে নিলাম আমি। উনার বুকে মৃদু কি’ল দিয়ে আহ্লাদী হয়ে বললাম,

“মনে থাকবে তো? আপনার এমন কথায় আমার কলিজা কাঁপে মায়ারাজ!”

উনি হেসে বললেন, “অবশ্যই মনে থাকবে মহারানী! আর হবে না পাক্কা প্রমিস। ”

দু’জন মিলে খুনসুটিতে কেটে গেলো আরো একটি সন্ধ্যা। এখন ধরনীতে আঁধার নেমে এসেছে। পরিবার, প্রিয়জনদের নিয়ে রাতটাও ভালো যাচ্ছে, তবুও আজ অজানা কারণে বুকটা বড্ড পুড়ছে আমার। মনটা বারবার কু গাইছে। হৃদয়খানি জুড়ে হারানোর আন্দোলনে মেতেছে। ভিতরটা শীতল করতে, নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি।
নামাজ শেষে তবেই একটু স্বস্তি ফিরলো মনে। রাতে সবাই এক সাথে খেয়ে, মাএই সুয়েছি আমি। এরিমধ্যে তাসনিম আসলো, আমার পাশে সুয়েই আকস্মিক কাকুতি ভরা কণ্ঠে বললেন, “আমায় একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে জবা? একটুখানি অনুভব করতে দিবে তোমার বুকের স্পন্দন?”

আমি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সচারাচর এমন আবদার করে না তাসনিম। আজ লোকটার হলোটা কি? বাসায় আসার পর থেকে হঠাৎ হঠাৎ চমকে দিচ্ছে আমায়। মস্তিষ্কে শ-খানিক প্রশ্ন জট বাঁধলেও, এই মুহুর্তে প্রশ্ন করলাম না আমি। উনার এটা আবদারই ছিলো না, ছিলো একান্তই মিনতি। আমি বিনাবাক্যে সাবধানতা অবলম্বন করে উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তাসনিম গুটিসুটি মে’রে মুখ লুকালো তার প্রিয়তমার উষ্ণ বুকে। আজ এমন মুহূর্তেও ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় কাঁপেছে আমার! নিজেকে মানিয়ে নিলাম আমি, বুঝতে দিলাম না কাউকে কিচ্ছুটি।উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললাম, “আপনার কিছু হয়েছে তাসনিম? আজ কেমন জানি লাগছে আপনাকে।”

উনি এক গাল হেসে বললেন, আরেহ্ নাহ! তেমন কিছু না। তবে…।”

উনি অর্ধেক কথা বলে থেমে গেলেন। আমি তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করলাম, “তবে কি? বুলুন আমায়?”

উনি আলতো হাসলো। আমার মাথাটা উনার বুকের সাথে মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

“তোমার উষ্ণ আলিঙ্গণ পেতে ম’রি’য়া হয়ে যাচ্ছিলো মনটা। এখন শান্তি লাগছে জান। আমাকে শান্ত করতে তোমার একটা উষ্ণ আলিঙ্গণই যথেষ্ট!”

উনার হেলদোলহীন কথা শুনে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ালাম আমি। পাগল একটা! এরপর দু’জনের মাঝেই নিরবতা। তাসনিম ঠায় ঘা’প’টি মে’রে মুখ লুকিয়ে আছেন।
আমি চুপটি করে উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম ঘন্টা খানিক। এরিমধ্যে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছে তাসনিম। ঘুমের মধ্যেও একটা মুহূর্তের জন্য আজ ছাড়লো না আমায়। আমিও নড়াচড়া না করে উনার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলাম। এভাবে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। হঠাৎ রুম জুড়ে কারো গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। আমার ঘুমন্ত মস্তিষ্ক সচল হয়ে গেলো, দরফরিয়ে উঠে বসলাম আমি। একবার রুমে চোখ বুলিয়ে বিছানার বাঁপাশ ফিরতেই আতঙ্কে উঠলাম আমি। আমার তাসনিম কেনো জানি বড্ড ছটফট করছে। নীল রাঙা ডিম লাইটের আলোতে মুখটা মলিন দেখাচ্ছে। কেঁপে উঠলো আমার আ*ত্মা! আমি দিক-বিদিক শুন্য হয়ে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি…কি হয়েছে তাসনিম?”

তাসনিম মায়া ভরা চোখে চাইলো একবার আমার দিকে, আমার হাতটা নিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ছটফটিয়ে বললেন, “বুকের এখানটায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে জবা… জবা জান আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতো যন্ত্রণা করছে কেন? আমার বড্ড পিপাসা পেয়েছে, একটু পানি দেও।”

এই লোকটাকে কখনো এভাবে ভে’ঙে পড়তে দেখিনি আমি। আজ লোকটার বড্ড কষ্ট হচ্ছে! আল্লাহ, কি হলো আমার মায়ারাজের? উনার এমন ছটফটানো দেখে কেঁদে দিলাম আমি। আমার শরীরটা কাঁপছে, কাঁপা কাঁপা পায়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম আমি। উনি মুহূর্তেই উঠে ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে নিলো, লম্বা লম্বা শ্বাস ছাড়ছে বারবার। হয়তো নিজেকে সামলাতে চাইছে। এতো রাতে কি করবো আমি? বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে, উনার কষ্ট দেখে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। চোখ দু’টো দিয়ে অবিরত ঝরছে জল। আমি বসে উনার বুকে মালিশ করতে লাগলাম, তবুও উনাকে ভীষণ অস্হির লাগছে। লোকটা একদম নির্বাক হয়ে আছেন এখন। হঠাৎ আমার হাত ধরে থামিয়ে দিলো আমায়। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” এখন কেমন লাগছে তাসনিম? আপনার খুউব কষ্ট হচ্ছে তাসনিম? কি হলো আপনার? আচ্ছা দাঁড়ান আমি বাবা’কে ডাকছি।”

আমি চলে যেতে নিলাম। তাসনিম আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলো আমায়। চোখের জলটুকু আলগোছে মুছে দিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বললো, “আমি ঠিক আছি জবা। রিলাক্স জবা! রিলাক্স!”

উনার এলোমেলো কণ্ঠ স্বর শুনে কান্নার বেগ আরো একটু বাড়লো আমার। উনি এক হাতে জড়িয়ে ধরলো আমায়, থামাতে চাইছে। কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না এই মুহুর্তে। আজ উনার চোখের কোণেও জল। আমি অনুভব করলাম তাসনিম দুলছে, মুহূর্তেই ধরে ফেললাম আমি। উনার মাথা নিজের কাঁধে রেখে, “মা” বলে একবার চিৎকার দিতেই উনি আমার মুখ চেপে ধরে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। উনার ইশারায় আমি শান্ত হলাম।

হঠাৎ তাসনিম আমার উঁচু পেটটা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে এলোমেলো কণ্ঠে বললো, “এখানে আমাদের সন্তান তাই নারে জবাজান? আমার বোধহয় তাকে আর ছুঁয়ে দেখা হলো না। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে বউ। ওইতো ওরা.. ওরা দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়।”

উনার কথা শুনে হৃদয়ে এক কা’ল’বৈ’শা’খী ঝ’ড় বয়ে গেলো আমার। আমি এক চিৎকার দিয়ে বললাম,

“তাসনিম… প্লিজ শান্ত হোন। আপনার কিচ্ছুটি হবে না তাসনিম। মা,ফুপি,বাবা, তাসফিয়া কোথায় তোমারা? দেখো..দেখো আমার তাসনিমের বড্ড কষ্ট হচ্ছে।”

তাসনিম জোড়ে জোড়ে শ্বাস টানছে, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। নিভু নিভু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় আবারো বললো,

“জবা আমার অনুপস্থিতিতে আমার অনাগত সন্তান’কে তুমি কখনো অবহেলা করো না কিন্তু…. আমার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করো। আমি বাবা হয়েও তাকে একটিবার ছুঁতে পারলাম না, এই আক্ষেপ নিয়েই আমাকে ছাড়তে হচ্ছে পৃথিবী!”

“তাসনিম…..।”

“জবা শুনো? জবা আমার অনুপস্থিতে আমার বাবা-মা সহ পরিবারের সবাইকে দেখে রেখো তুমি। আমি সবার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে আজ বিদায় নিচ্ছি। আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি জবাজান! আমার খুব ইচ্ছে ছিলো, তোমাদের সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে অনেকটা বছর বাঁচবো। কিন্তু ওরা যে আমায় ডাকছে… আজ চলে যেতেই হচ্ছে। তুমি… তুমি চিন্তা করো না বউ। আমি ওখানেও তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।”

কথা বলতে বলতে নিস্তেজ হয়ে বিছানায় সুয়ে পড়লো আমার সুঠাম দেহের মায়ারাজ। আজ কত অসহায় লোকটা! আমি পাশে থেকেও তার জন্য কিছু করতে পারছি না। ওহ আল্লাহ! তার কষ্টটুকু আমায় দেও, তবুও তাকে আমার হয়ে পৃথিবীতে রেখে দেও।
আমি আল্লাহকে বারবার ডাকছি, আমার চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে বাসার সবাই দৌড়ে আসলো আমাদের রুমে। তাসনিমকে এভাবে ছটফট করতে দেখে উনারাও সবাই কাঁদছে। আমার ফুপি দিশেহারা হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো বুকে। তাসনিম হয়তো একটু হাসলো, ফুপির হাত ধরে মৃদু কণ্ঠে বললেন,

“আমাকে ক্ষমা করো মা। আমার জবাকে দেখে রেখো তোমরা। ভালোবাসি মা! বিদায় মা! বিদায় আমার জবাজান!”

অতঃপর আমার তাসনিম মুচকি হেসে চোখ বুঝে উচ্চারণ করলো, “লাই লাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) !”

ওই যে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো আর চোখ খুললো না আমার মায়ারাজ। ফুপি ডাকলো, বাবা ডাকলো, কতো করে সবাই ডাকলাম তাকে। কিন্তু.. আমার মায়ারাজের ঘুমই ভাঙছে না।

চলবে……

#জীবন_রঙ্গমঞ্চ

লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৮ (সমাপ্তি শেষ অংশ)

হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেলাম আমি। আমার তাসনিমের কিচ্ছুটি হয়নি। না,না কিচ্ছু হয়নি! আমার মায়ারাজ কথা দিয়েছে আমাকে, আমাকে একা রেখে কোথাও যাবে না সে। কিন্তু আশ্চর্য! আমার তাসনিমকে ঘিরে কাঁদছে সবাই। ফুপির হুঁশ নেই, বাবা মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছে। আমি বুঝলামই না, উনারা কাঁদছে কেনো? আমার তাসনিমের বুকে বড্ড ব্যথা, কই একটু শান্তিতে ঘুমোচ্ছে লোকটা তাও সহ্য হয় না উনাদের। আমি, আমি এবার উনাদের সবাইকে দমক দিয়ে কড়া গলায় বললাম,

” কি সমস্যা তোমাদের? উনাকে ঘুমাতে দিচ্ছো না কেনো? জানো এতক্ষণ কত কষ্ট সহ্য করেছে লোকটা, সবেই আমার মায়ারাজ দু’টো চোখ এক করেছে একটু । থাক না উনি ঘুমাক একটু…. উনার ঘুম ভা’ঙ’লে’ই আমি উনাকে হসপিটাল নিয়ে যাবো। তারপর দেখবে সে একদম সুস্থ। বুঝেছো তোমরা? এতো কান্নাকাটি করো না তো।”

আমি মুচকি হেসে বসলাম তাসনিমের পাশে। উনার মাথাটা আমার কোলে উঠিয়ে হাত বুলিয়ে দিলাম কপালে। এই জিনিসটা তার ভীষণ প্রিয়! তান্মধ্যে মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“আমাদের তাসনিম আর উঠবে না’রে মা। আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে রবের ডাকে। ম’রে গেছে তাসনিম, ম’রে গেছে।”

আমি বিরক্ত হলাম৷ কি সব বাজে বকছে মা?এমনটা হওয়ার নয়! কস্মিনকালেও না!আমি এক্ষণি উনাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো। আমার পাগলামি দেখে নি’থ’র তাসনিম’কে হসপিটালে নিতেই হলো। আমি তার হাত ধরে রেখেছি, এই হাত ছাড়বোই না!

এখন রাত দুইটা। হসপিটালে পৌঁছাতেই আমি দৌড়ে খুঁজতে লাগলাম ডক্টর। মা-ও আমার পিছনে ছুটছে, শান্ত হতে বলছে আমায়। ওদের কি করে বুঝাই? আমি কাছ থেকে,খুব কাছ থেকে আমি আমার মায়ারাজের তীব্র ছটফটানি দেখেছি, কষ্টে চোখের জল দেখেছি। এখন আমি কি করে শান্ত হই?

কিন্তু, এতো খুঁজেও পাচ্ছি না ডক্টর। বহু খুঁজে একজন আসলো তাসনিমের কেবিনে। আমি ডক্টরের কাছে কাকুতি মিনতি করে বললাম, “উনি যেন আমার স্বামীকে সুস্থ করে দেয়, তার বুকে বড্ড ব্যথা!”

উনি কিছুক্ষণ পরিক্ষা করে সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে দিলেন আমার তাসনিমকে। সাথে জানিয়ে দিলো, আমার তাসনিম, আমার মায়ারাজ “হা’র্ট অ্যা’টা’ক” করে মা’রা গিয়েছে। আমার পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছে,মাথার উপর থেকে বিশ্বস্ত হাতটা সরে গেলো। লোকগুলো এতো পাষাণ! ওরা বড্ড পাষাণ মানব! আমার তাসনিমকে মৃ*ত্যু মানুষ বলছে, ওদের কলিজা কাঁপছে না?

চারপাশের সবাই আমার স্বামীকে মৃ*ত্যু ঘোষণা করছে, কিন্তু আমার অচেতন মন মানতে নারাজ! এমনটা হওয়ার নয়,তবুও হয়েছে। এমনটা কেন হলো? আমাদের তো এখনো একসাথে বহু পথ চলা বাকি।আমার সন্তান পৃথিবীতে আসবে, আধোঁ আধোঁ কণ্ঠে বাবা-মা বলে ডাকবে আমাদের। তাকে নিয়ে কত স্বপন দেখেছি দু’জন। সবই যেন আজ বৃথা। আমার সন্তান কাকে বাবা বলে ডাকবে? জন্মের আগেই বাবা হা’রা হলো আমার বাচ্চাটা! আমি মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে ধাপ করে বসে পড়লাম, চোখে কেন জানি সব অন্ধকার লাগছে।
.
.
শেষ রাত এখন,আজ অন্ধকার রাতে হুতুম পেঁচারা বিষাদের গান গাইছে। আমার সুখের রাজ্যে শো’ক নেমেছে, সবার বুকে প্রিয় হারানোর হা’হা’কা’র। এতক্ষণ কি হয়েছে খেয়াল নেই আমার, অচেতন অবস্থায় ছিলাম বোধহয়। চোখ মেলতেই নিজেকে আমার রুমে আবিস্কার করলাম। আমি ধীরস্থির হয়ে উঠে বসলাম, চারপাশে মানুষের আনাগোনা।
চারপাশে এতক্ষণে ছড়িয়ে গিয়েছে আমার মায়ারাজের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। আমার তৃষ্ণার্ত চোখ দু’টো বেকুল হয়ে খুঁজছে প্রিয় সেই মুখটাকে। দূর থেকে দেখলাম আমার শখের পুরুষটিকে ওরা ঠান্ডা ফ্লোরে রেখে দিয়েছে। তার পাশে বসে হৃদয় নিঙড়ানো কান্নায় কাঁদছে ফুপি,তাসফিয়া আরো আত্মীয়রা। সে-কি আহাজারি, সে-কি আ’র্ত’না’দ!
কিন্তু আমার মা’কে দেখলাম না আর আশেপাশে।

আমি টলতে টলতে ছুটে গেলাম আমার তাসনিমের কাছে। এরিমধ্যে হঠাৎ করে আরো একটি পরিচিত মুখ দেখা গেলো। উনার মামা। আমার আব্বাজান, আজ এসেছে তাহলে! কি দেখতে এসেছে আমার প্রিয় মানুষটার লা*শ? আমি একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম, উনি এগিয়ে আসলো ধরলো আমায়। বহুদিন পরে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো, “আম্মা!”

এসব কিছুতে আজ বিতৃষ্ণা লাগছে আমার, আমি উনার হাত সরিয়ে দৌড়ে চলে গেলাম তাসনিমের কাছে। ভরা পেটটা নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এই কষ্টের চেয়ে হৃদয়ে র’ক্ত’ক্ষ’র’ণ যে বড্ড বেশি। আমি মেজেতে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সেই স্নিগ্ধ মুখো পানে। আজ উনাকে আরো আকার্ষণীয় লাগছে, রুপে মোহগ্রস্ত হয়ে আমি চোখ ফিরাইতে পারছি না! কিন্তু একি, আমার চোখের অশ্রুগুলো অনবরত ঝড়ে ভিজে দিচ্ছে উনার মায়াবী মুখটা। আমি দেরী না করে ভীষণ যত্ন করে শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছে দিলাম জলটুকু। আমি জানি লোকটা আমার কান্না সহ্য করতে পারে না। তবুও কেন কাঁদছি আমি? আমি তো কাঁদতে চাই না! তড়িঘড়ি করে নিজের চোখটা মুছে উনার গাল ছুঁয়ে ভাঙা কণ্ঠে ডাকলাম,

“এই তাসনিম? আমার মায়ারাজ? উঠো তুমি, আর কতো ঘুমাবে?”

কিন্তু আমার প্রিয় পুরুষটি আজ বড্ড পাষাণ! হৃদয়হীন লোকটা আর উঠলোই না। এতো ডাকছি তাও আমার ডাকে একটি বার সাড়া অবধি দিলো না।
“সে পাষাণ!হ্যাঁ সে বড্ড পাষাণ।
এলোমেলো, ছন্নছাড়া বিপর্যস্ত মেয়েটাকে দেখেও তার হৃদয়ে লাগছে না টান। সে তো পাষাণ.!”

এভাবে কত সময় কেটে গেলো জানি না। চারপাশে রোদের আলো লুকোচুরি খেলছে। লোকজন আয়োজন করছে মৃ*ত্যু দেহটা তার আসল ঠিকানায় পৌঁছে দিতে। আমার মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে একটা সময় ওরা আমার মায়ারাজ’কে নিয়ে গেলো আমার কাছ থেকে । আমি কাঁদলাম, হাতজোড় করে নিতে বারণ করলাম। তাও ওরা নিয়ে গেলো। আমার চোখের সামনে আমার প্রিয় পুরুষটাকে সাদা কাফনে মু’ড়ি’য়ে দিলো। আমি অসহায় হয়ে দু-চোখ মেলে দেখলাম শুধু, এতো চেয়েও কিচ্ছুটি করতাম পারলাম না আমি। কত স্বপ্ন! কত ইচ্ছে ধুলোয় মিশেয়ে আমার মায়ারাজ আরাম করে সুয়ে আছে মাটির ঘর খানিতে। সে আর ফিরবে না!আমাকেও আর কেউ ডাকবে না সেই প্রিয় নাম ধরে, কারণে অকারণে কেউ বলবে না ভালোবাসি। হায় আফসোস! নিজের ভাগের সবটুকু ভালোবাসা দেওয়া হলো না তাকে। ফিরে এসো তুমি, ফিরে এসো আমার মায়ারাজ।
থেকে যাও আমার সঙ্গে, ভে’ঙে দিয়ে সব নিয়ম নীতি।যেখানে তাকাই, সবখানেই তো তোমার স্মৃ’তি।

পরক্ষণে মস্তিষ্ক জানান দিলো,মৃ*ত্যু মানুষ গুলো চাইলেও আর ফিরে আসতে পারে না। আচ্ছা, প্রিয় মানুষ গুলো কি এভাবেই অ’কালে হারিয়ে যায়?
বিধাতা এ কোন খেল খেললো! জীবন রঙ্গমঞ্চে রঙ কি ক্ষণে ক্ষণে বদলায়? হ্যাঁ বদলায় তো, এই যে বদলে গেলো। জীবনের রং কখনো রঙিন, কখনো ধূসর। মানসিক শান্তি দেওয়ার মানুষগুলো অবেলায় হারিয়ে যায়।
_________________

চার বছর পর……
অবসরে’র এক বিকেলে ব্যালকনির গ্রিল ধরে বিষাদ উড়াতে ব্যস্ত আমি। মনের ক্যানভাসে আজও ভেসে উঠছে আমার প্রিয়তমের হাস্যোজ্জল মুখখানা। কতদিন ছুঁয়ে দেখা হয়না তাকে, কতদিন শোনা হয়না প্রিয় কণ্ঠের টোন! তার কথা ভাবতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা জল।
এমন সময় গুটি গুটি পায়ে ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে দু’হাতে ঝাপটে ধরলো আমায়। আধোঁ আধোঁ মায়া ভরা কণ্ঠে শুধালো, “মাম্মা! আমাল মাম্মা। তুমি একানে? আমি তোমায় কতো দায়গায় (জায়গায়) কুজেচি (খুঁজেছি)।”

আমি নিজেকে সামলে মলিন হেসে কোলে নিলাম বাচ্চাটাকে। মাথায় স্নেহেতু হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বললাম, “মাম্মা এখানে বাবাই! কেনো খুঁজেছো তাকে?”

আমার চোখের কোণের জলটুকু বাচ্চাটার চোখের আড়াল হয়নি, পরক্ষণেই সে ব্যস্ত হয়ে মায়ের চোখের জলটুকু মুছে দিয়ে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আবালো কাঁদচো মাম্মা? তুমি কাঁদলে তোমাল বাবাইল(বাবাইর) কষ্টু লাগে, তুমি জানো না?”

“কাঁদছি না তো বাবাই। চোখে পোকা পড়েছে বোধহয়।”

“কই দেকি কোতায় পুকা?আমাল দিকে তাকাও মাম্মা।”

পরমুহুর্তে উতলা হয়ে পোকা খুঁজেও যখন পেলো না ছেলেটা, তখন বুঝে গিয়েছে তার মা কাঁদছে। ছোট ছোট হাত দিয়ে মাম্মার চোখে জল মুছে দিয়ে কপালে আদুরে ছোঁয়া দিয়ে, আদুরে কণ্ঠে শুধালো,

“আমাল ভালো মাম্মা! কাঁদে না , আমার সোনা মা। এই যে তোমাল বাবাই তোমাল চোকেল জল মুচে দিয়েতে। আবাল কাঁদলে কিন্তু আমি মেলা লাগ(রাগ) কলবো (করবো)।”

এতো মায়া,এতো আদর পেয়ে কি আর মা কাঁদতে পারে? এ যেন, শত ব্যথা, শত য’ন্ত্র’ণা’র মাঝে এক টুকরো সুখ! আমি পরম মমতায় বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলাম আমার বাচ্চাটাকে। আমার রাজ্যের এক অনাথ রাজপুত্র সে!
হ্যাঁ এটাই আমাদের বাচ্চা! অভাগী মায়ের অভাগা ছেলে “তুর্য”। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন!

সেই কালো আমাবস্যার রাতটা আজও বুকে জড়িয়ে বেঁচে আছি আমরা।
যে রাতে আমাকে সম্পূর্ণ একা করে চলে গিয়েছে, আমাদের নিঃস্ব, ফি’কে করে চলে গিয়েছে আমার মায়ারাজ। তাকে ছাড়া জীবন থেকে চারটা বছর পার হতে চললো। প্রথম দিকে আমি বড্ড উম্মোদ ছিলাম, শারীরিক, মানসিক ভাবে প্রচুর অসুস্থ হতে লাগলাম। একমাস পেরোতেই বাচ্চাটা বাঁচানোও রিস্ক। সবদিক বিবেচনা করে সময়ের একমাস আগেই ডক্টর সিজার করে দুনিয়ায় আলো দেখালো আমার রাজপুত্র’কে। যদিও আমরা মা-ছেলে দু’জনই ভীষণ অসুস্থ ছিলাম। তবুও রব বাঁচিয়ে দিলো আমাদের। আমি আমার বাচ্চার মায়াবী মুখটা দেখে এক নিমিষের জন্য সমস্ত দুঃখ ভুলে গেলাম। আমার মস্তিষ্ক তখন জানান দিলো,

“আমার বাঁচতেই হবে! আমার ছেলেটার জন্য হলেও নিজেকে সামলাতে হবে। পূরণ করতে হবে, আমার মায়ারাজের শেষ ইচ্ছে। আমার কাঁধে যে অনেক দায়িত্বের ভার।”

আমি মৃ*ত্যু*র সাথে পা*ঞ্জা ন*ড়ে বাঁচলাম, সময়ের সাথে শক্ত খোলসে মানিয়ে নিলাম নিজেকে। না তাকে আমি এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারিনি,তার স্মৃতি আমার চারপাশ জুড়ে বিচারণ। শুধু প্রয়োজনে বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে যাই, আবারো ডানাঝাপটে উড়ে বেড়াই।

পরিবারের সবাই প্রিয় হারানোর শো’ক ভুলে গিয়ে আবারো ব্যস্ত নিজেদের কাজে। কিন্তু নিজেকে আজও মানিয়ে নিতে পারেনি আমার ফুপি। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে, শো’কে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে বদ্ধঘরে। ছেলে হারিয়ে মা আর কখনো হাসেনি। যে অনাগত মেহমানের জন্য সবাই ছিলো উতলা, তার আগমনে কেউ আর উল্লাস করেনি। ফুপি আমার ছেলেটাকে সহ্য করতে পারে না, আঘাত করে বাচ্চাটাকে, পাগলামো করে। তার ধারণা, এই বাচ্চার আগমনের জন্য তার ছেলে হারিয়ে গেছে। এই বাচ্চা তার পরিবারের অ’ভি’শা’প! কিন্তু আমি তো এই বাচ্চার জননী, আমি কি করে ফেলে দেই তাকে?

বছর ঘুরতেই আমারও স্কুল পরিবর্তন হয়েছে নতুন জেলায়। বাচ্চার কথা চিন্তা করে পুরনো শহর ছেড়ে নতুন শহরে এসেছি আমি, আমার মা, তুর্য। বাড়িতে থাকছে ফুপি, মা, তাসফিয়া। এদের দেখাশোনা করার জন্য রিনা আজও আছে। আমিও যাই মাঝে মাঝে দেখে আসি তাদের। আজ সবার দায়িত্ব আমি নিয়েছি।

পুরনো স্মৃতিচারণে বুক চিরে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো আমার। আমার বাচ্চাটা মায়ের কোলে চুপটি করে লেগে আছেন। তান্মধ্যে রুমে থাকা মুঠোফোনটা খটাখট আওয়াজে বেজে উঠলো কয়েকবার। আমি তড়িঘড়ি করে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন,

” হ্যালো ম্যাম! আপনি জবা বলছেন?”

“জ্বি।”

“আমি মেন্টাল হসপিটাল থেকে “সৌম্য” বলছি। আপনার পেসেন্ট বড্ড উম্মোদ। সামলানোই যাচ্ছে না আজকাল। আপনি একবার এখানে আসুন ম্যাম, একটু দরকার। আর হ্যাঁ উনি “প্রিয়তা” নামে একজনের নাম ধরে ডাকছে বারংবার। উনি কে হয় তার?”

“তার প্রণাক্ত স্ত্রী।”

“তাকে একবার নিয়ে আসা যাবে ম্যাম? আমার মনে হয় তাকে দেখলে উনার সুস্থ হওয়ার চান্স আছে।”

“তা সম্ভব নয়। আমি আসতেছি। রাখছি এখন।”

লাইন কেটে দিলাম আমি। তুর্য কে মায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে পড়লাম।
.
.
“সকল বাঁধা বিকিয়ে তুমি একবার এসো প্রিয়তা, ফিরে এসো একবার! তোমাকে দেখার লাইগা পরাণটা বড্ড আনছান করছে। একটিবার আমায় ক্ষমা করো প্রিয়তা! প্রিয়তা! প্রিয়তা! বলো তুমি আসবে? প্রিয়তা! আমার প্রিয়তা!”

মানসিক হাসপাতালে একজন পাগল বারংবার করুণ সুরে ডাকছে তার প্রিয়তমা’র না ধরে। আমি পৌঁছাতেই ডক্টর শিকল আবদ্ধ এক পাগল’কে নিয়ে এসেছে আমার কাছে। লোকটার বিপর্যস্ত চেহারাটা দেখে মনটা বি’ষয়ে উঠলো আমার।এরিমধ্যে আমাকে দেখে পাগলটা বিচলিত হয়ে বললেন, “প্রিয়তা! প্রিয়তা তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আসবেই।”

আমি উনার হাত ধরে মলিন হেসে বললাম, “আমি প্রিয়তা নয় আব্বা! আমি জবা! আপনার মেয়ে জবা।”

লোকটা আশাহত হলো। আবারো পাগলামো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
উনি আর কেউ নয়, আমার জন্মদাতা পিতা! একটা সময়, একটু সুখের আশায় ছেড়ে দিয়েছিলো আমার মা’কে। সময়ের ব্যাবধানে আজ লোকটা সব হারিয়ে, হারিয়েছে মানসিক ভারসাম্য।

এইতো বছর দু’য়েক আগে তার যুবতী স্ত্রী পালিয়ে গিয়েছে তার পুরনো প্রেমিকের সাথে। সঙ্গে করে নিয়েছে তার সমস্ত সম্পত্তি, টাকা-পয়সা যতটুকু ছিলো। ক্ষণিকের মোহে পরে তার সবটুকুই তার নামে করে দিয়েছিলো আব্বা। মেয়েটা চলে গেলো, বাবা সব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। সর্বহারা হয়ে বুঝলো নিজের ভুল।কয়লার পিছনে ছুটে আসল হিরে ছুঁড়ে দিয়েছে সে। মস্তিষ্ক তখন অপরাধবোধ অনুভব করলো, নিজের ভুল বুঝতেও পারলো। তখন মরিয়া হয়ে উঠলো আমার মায়ের জন্য, তার প্রিয়তার জন্য। কিন্তু, সময়টা বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে যে। সময় থাকতে কদর বুঝলো না, নিজেই ছেড়ে দিয়েছে ভালোবাসার হাতটি। এখন শত চেয়েও আর পাওয়া হলো না হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে। ছেড়ে যাওয়া মানুষটা যে তাকে বড্ড ঘৃণা করে। সেদিনের পর আর কখনো তার মুখও দর্শন করেনি মা। তাদের
এই মিল আর সম্ভবও নয়। এরপর থেকে আব্বা নিজের সাথে যু*দ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলো,চারপাশ থেকে পাপ গুলো ঘিরে ধরলো তাকে। এরপর মাস ছয়েক যেতেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে আব্বা। তাকে দেখার আর কেউ থাকলো না। বাবা একটা সময় নিজের কথা ভেবে আমাদের ছুঁড়ে ফেললেও তার অসময়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারিনি আমি। যাই হোক না কেন? বাবা তো! তার র’ক্তইতো শরীর বইছে আমার। সন্তান হিসেবে তাকে দেখা-শোনা করার দায়িত্ব আমার। তাই দায়িত্ব হিসেবেই তার পাশে দাঁড়ালাম আমি। যতটুকু করি দায়িত্ব থেকেই, ভালোবেসে নয়। বাবার প্রতি ভালোবাসা, টান আর আসে না। কেননা, ভালোবাসা পাওয়া যোগ্যতা সবার থাকে না।

প্রায় আড়াই বছর হলো, চিকিৎসার জন্য মানসিক হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দিলাম তাকে। কিন্তু, তার উন্নতি নেই। আর হওয়ার চান্সও নেই। অন্যায় ভাবে কাউকে ঠকানোর শাস্তি রব তাকে দিয়েছে। সর্বহারা করিয়ে প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কের সাথে লড়াই করার অসুখ দিয়েছে। এই মস্তিষ্ক তাকে এক মুহূর্ত ভালো থাকতে দিচ্ছে না, ধুঁকে ধুঁকে পিড়া দিচ্ছে। হয়তো এভাবেই তাকে শেষ নিশ্বাস ছাড়তে হবে। আমি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম লোকটাকে। আগের মানুষটা আর নেই, চেনাই যাচ্ছে না। শরীরে হাজারো আঘাতে দা’গ, ফর্সা চেহারাটা কালশিটে, উস্কো-খুস্কো দাঁড়ি চুলে মুখটা ডেকে গেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ডক্টরের বিল গুলো বুঝিয়ে দিলাম। অতঃপর এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে পড়লাম নিজের গন্তব্যে।
.
.
প্রকৃতির নিয়মে চলছে দিন। রাত পেড়িয়ে ভোর হয়, আবার দিন পেড়িয়ে রাত। এভাবেই চলছে জীবন। জীবন তো আর থেমে থাকে না! কে’টে গিয়েছে আরো একটি মাস। আজ নতুন শহর থেকে ছুটছি পুরনো সেই স্মৃতির শহরে। শ্বশুর মশাই তাসফিয়ার বিয়ে ঠিক করেছে। সেখানেই যাচ্ছি আমরা। মনটায় আজ হাজারো আকুপাকু করছে। কখন পৌঁছাবো আমি, কখন ছুঁয়ে দিবো প্রিয় মানুষটার ক’ব’র। আমার মায়ারাজ যে পথ চেয়ে, অপেক্ষা করছে আমার। উ’ওে’জ’না’য় দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তবুও লম্বা শ্বাস ছেড়ে, দমিয়ে নিলাম নিজেকে। তুর্যকে কোলে নিয়ে থম মে’রে বসলাম বাসের সিটে, পাশে বসলেন মা।
দীর্ঘপথ পাড়ি জমিয়ে ভরদুপুরে কাঁপা কাঁপা পায়ে অবশেষে পা রাখলাম বাড়ির আঙিনায়। গেইটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো শ্বশুর আব্বু, তাসফিয়া। অনেকদিন পরে তুর্যকে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তারা। আমি ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম ভিতরে, আমার সাথে মা। বাড়িটা আজ অন্যরক সাজসজ্জায় সজ্জিত, বাড়ি ভর্তি মানুষের আনাগোনা। সবাই আমাদের দেখে এগিয়ে আসলো, আমিও সবার সাথে কৃত্রিম হেসে কথা শেষ করে পুনরায় এগিয়ে গেলাম ভিতরে। বসার ঘরে আয়েশ করে বসে আছেন আমার বড় ফুপা শ্বাশুড়ি। আমি তার দিকে এগিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছেন ফুপি?”

উনি একবার আমাকে আগাগোড়া পরখ করে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, “ওমা! তুমিতো আগের চেয়েও ভীষণ সুন্দর হয়ে গেছে, মনে হয় বড় সুখেই দিন কাটছে। শাড়িটাও বেশ ভালো! আলহামদুলিল্লাহ! আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ”

বিয়ে উপলক্ষে মায়ের জোড়াজুড়িতে আজ একটা নীল রঙা শাড়ী পড়েছিলাম আমি। উনি এটা দেখেই বুঝে নিলো, আনন্দে আছি আমি।
বি’ধ’বা’র কি আর নীল শাড়িতে যায়? তিরস্কার করতেও ছাড়লো না আমায়। আমি কথা বাড়ালাম না। ছোট্ট করে বললাম, “জ্বি আমিও ভালো আছি।”

“হ্যাঁ! হ্যাঁ! সে দেখেই বুঝা যাচ্ছে,আমাদের ছেলেটা ছাড়া তুমি ভালোই আছো। আজকাল কত সাজসজ্জা বেড়েছে!”

উনার ব্যাঙ্গ বার্তায় তড়তড় করে রাগ বেড়ে গেলো আমার। কঠিন মুখ করে কিছু বলতে উদ্যতো হবো এরমধ্যে আমার মা উনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“আপা। একটা মানুষ দিব্যি হাসছে ঘুরছে বলে কি সে ভালো আছে? না এমনটা সব সময় নাও হতে পারে।
অনেক মানুষ ক্ষ’ত লুকাতে হাসে,ভালো থাকতে না পারলেও বেঁচে থাকার খাতিরে হলেও এদের মুখের হাসি খুব দরকার।
কারণ, জীবন রঙ্গমঞ্চ ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়, কখনো ঘন অন্ধকারে নিস্তব্ধতা নেমে আসে আবার কখনো রঙিন।
তবে সবাই কি আর বাঁচার স্বাধ পায় পায়? না কেউ কেউ মিথ্যা আশা মিথ্যা মায়ায় বাঁচে।
এরা সবাই কি আর জীবিতদের দলে? কেউ কেউ সব হারিয়ে ম’রা’র আগেই চলে যায় লা’শের ভীড়ে।”

মা উনার উওরের অপেক্ষায় আর দাঁড়ালো না। আমার হাত ধরে চলে গেলেন ফুপির রুমে।
.
.
বিয়ে বাড়ির চারদিকে এতো আয়োজন, এতো হাসি গান। কিন্তু আমার কাছে সবকিছু ধূসর, ফ্যাকেসে লাগছে। আমি নিজেকে আড়াল করতে দৌড়ে গেলাম আমাদের রুমটাতে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম রুমের প্রতিটা জিনিস। এখানে লেগে আছে আমার প্রিয় পুরুষের ছোঁয়া। আলমারি থেকে উনার একটা শার্ট বের করে নিজের শরীরে জড়িয়ে নিলাম৷ মনে হচ্ছে, উনাকে জড়িয়ে আছি আমি। দীর্ঘ জার্নির পর শরীরটা ক্লান্ত লাগছে। সুয়ে পড়লাম বেডে। একি বিছানার বাঁপাশটা যে খালি। নিস্তব্ধ রুমে হৃদয় জুড়ে শুরু হলো তী’ব্র হাহাকার! এক বুক আহাজারি নিয়ে চোখ লেগে আসছে আমার। হঠাৎ করে উনি আমায় দূর থেকে যেন প্রিয় নাম ধরে ডাকলো,

“জবাজান? ”

আমি আনমনে জবাব দিলাম, “হু মায়ারাজ!”

উনি দূর থেকেই মায়াময় কণ্ঠে আবারো বললেন,

“জবাজান! ভুলে গেছো, ভুলে যেওনা আমায়! আজও বড্ড ভালোবাসি তোমায়। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারিনি, তো কি হয়েছে? এইতো আমি আছি মাতাল হাওয়া হয়ে তোমার সঙ্গে।

দেখো? আমি তোমার সঙ্গে থেকে যাবো, আদিগন্ত নীল জলরাশি হয়ে।সবুজ পাতার নরম রোদ হয়ে থেকে যাবো, আজীবন থেকে যাবো তোমার হাসির সহস্রধারা ঝর্ণা হয়ে!

জবাজান! তোমার ঘরের মানুষ হয়ে আমি নেই, তো কি হয়েছে? আমি আছি তোমার জানালা বেয়ে গড়িয়ে পড়া জ্যোৎস্না হয়ে। আমি থেকে যাবো তোমার গায়ের নকশী কাঁথা হয়ে। তোমার ডায়রির ভাজে রাখা রূপোর কলম হয়ে থেকে যাবো, থেকে যাবো তোমার চশমার কাচে জমা কুয়াশা হয়ে।
আমি অন্ধকারে আলো না হতে পারলেও,তোমার সাহস হয়ে থেকে যাবো।

জবাজান! এখন তোমার হাত ধরতে পারছি না আমি, তো কি হয়েছে?
আমি আছি তোমার ছায়ার সঙ্গে। আমি আজীবন তোমার গলার কাছে আ’টকে রাখা কা’ন্না হয়ে থেকে যাবো,গো’পন দী’র্ঘশ্বা’স হয়ে থেকে যাবো। আমি আজও আছি তোমার বুকের প্রকোষ্ঠে রাখা মস্ত বড় আকাশ হয়ে! আমায় যদি দেখতে চাও, তাহলে ঐ দূর আকাশের পানে তাকাও….!”

বলতে বলতে দূরে মিলিয়ে গেলো লোকটা। আমি আর দেখতে পারছি না তাকে। হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে আমি বললাম , ” মায়ারাজ, মায়ারাজ যেও না। যেও না তুমি! তোমার জবাজান তোমায় একমুহূর্তের জন্য ভুলে যায়নি।”

উনি থাকলোই না। হাওয়ায় মিলে গেলো। এরিমধ্যে মা ডাকলো আমায়, ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো, “কি হয়েছে জবা? চিৎকার দিয়ে উঠলি কেন?”

আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁদে কেঁদে বললাম, “মা! মা! আমার তাসনিম এসেছে। ওই দেখো? উনি আবার চলে যাচ্ছে। উনাকে যেতে বারণ করো মা।”

মা আমায় জড়িয়ে ধরলো, পাশে দাঁড়িয়ে আমার বাচ্চাটা কাঁদছে। তুর্যর কান্না কানে আসতেই হুঁশ ফিরলো আমার। পিটপিট করে চোখ মেলে দেখলাম, রুমে আলো জ্বলছে, কোথাও আমার তাসনিম নেই। তার মানে উনি আমার স্বপ্নে এসেছিলে। দরদর করে ঘামছে আমার শরীর। বড্ড জলতৃষ্ণা পেয়েছে। তান্মধ্যে মা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন, “দুঃস্বপ্ন দেখেছিস মা? ভয় পাসনা এই যে মা কাছে। নে পানিটা খেয়ে নে সোনা।”

আমি তড়িঘড়ি করে খেয়ে নিলাম পানিটা। লম্বা শ্বাস ছেড়ে দ’ম নিলাম ,কোলে তুলে নিলাম বাচ্চাটাকে। ছেলেটা কোলে নিয়ে ছুটে গেলাম বারান্দায়, আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললাম,

” মায়ারাজ! রাতের আকাশে মেঘের দেখা নেই,অথচ মনের আকাশ জুড়ে শুধু তোমার দেখা পাই।ঝিঝি পোকার ডাক,শহরের ল্যাম্পপোস্টের আলো,চাঁদের সাথে জোছনার নিবিড় আলিঙ্গন,ক্লান্ত পথিকের বাড়ি ফেরা দেখি।কিন্তু কই?তোমায় তো দেখি না?
কল্পনায় কতবার তোমায় ছুঁয়ে যাওয়া,তীব্র আলিঙ্গনে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়!ফের চোখ তুলে তাকাতেই দেখি তুমি নেই!এদিকে কথা জমতে জমতে আমি বোবা হতে চলছি!
কত আকুতি ভরা চোখে তাকিয়ে থাকি দরজায়।
তুমি আসবে,দড়জায় কড়া নাড়লেই যেন উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিবো।তুমি আসো না,ভালোই বাসো না!
একা একা চাঁদ দেখি,জোনাক পোকাদের সাথে কথা কই,পূবাল বাতাস অনুভব করি,কিন্তু কই?তুমি তো আসো না?অথচ তুমি এলেই সব ঠিকঠাক।রাতের খাবার,সকালের নাস্তা,দুপুরের খাবারের রুচি ফিরে আসে।রং চায়ের পুরোনো স্বাদ,মন ভালো,শরীরের সমস্ত অসুখ;কতকিছু সেরে যায়।তুমি আসো না বলেই আজ আমি দুরারোগ্য ব্যা’ধি’গ্র’স্থ! একটি বার আসো মায়ারাজ!আমাকেও নিয়ে যাও তোমার কাছে।”

কিন্তু, মায়ারাজ আর জবাব দিলো না। আমি হাজার ডেকেও পাই না তাকে। আমার বাচ্চাটা এখনো মাম্মা, মাম্মা বলে কাঁদছে। ওর কান্না শুনে মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে উনার কোলে নিলো তুর্য’কে। একহাতে আমায় ধরলো। মা আমার মন ভালো করতে জোর করে নিয়ে গেলেন বাহিরে।
চারদিকে সন্ধ্যার আঁধারে ছেয়ে গেছে প্রকৃতি, ঠান্ডা শীতল হাওয়া বইছে গায়ে। আমরা মা মেয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাত ধরে হাঁটছি, সামনেই ফুসকার দোকান দেখা যাচ্ছে। মা আমায় নিয়ে গেলো সেখানে। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে , নিজের জন্য ও আমার জন্য বেশি ঝাল দিয়ে ফুসকা অর্ডার দিলো। যদিও মা এসব খায় না, তবুও আজ মেয়ের মন ভালো করতে কত উতলা মা। আমি এই মুহুর্তে সব বিষাদ ভুলে গিয়েছি। একফালি মুগ্ধতা নিয়ে দেখছি একজন মমতাময়ী মা’কে। এদের জন্য হলেও ভালো থাকবো আমি। জীবন রঙ্গমঞ্চে আমার রঙিন আলো ফুরিয়ে গেছে অবেলায়, আমি না-হয় সাদা-কালো নিয়েই বাঁচবো! তবুও আমি বাঁচবো!

(সমাপ্ত)