জোয়ার-ভাটা পর্ব-২১+২২

0
311

#জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-২১
পূর্ব দিগন্ত থেকে ভেসে আসচ্ছে পূবালী বাতাস। মনমাতানো অচেনা-অজানা ফুলের সুবাস।মার্জান ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভেজা কাপড়ে ঠান্ডার প্রকোপ টা বেশিই। বুঝতে পেরে গ্রীষ্ম নিজের দেহের উষ্ণতা স্পর্শ করালো মার্জানকে। তুলতুলে নরম দেহের উপর ওঁর শক্তপোক্ত শরীরের ভরটা ছেড়ে দিলো। উষ্ণতা অনুভব হতে মার্জান সাড়া দিলো। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে মার্জান। গ্রীষ্মের এক অদ্ভুত শিহরণ খেলা করছে ওঁর শরীরে। দেহের সাথে দেহের কথপোকথন হতেই মার্জানের টেম্প্যারেচার নরমাল হতে লাগলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে আবিস্কার করলো প্রশস্ত লোমহীন বুক। মার্জান চকিতে তাকালো মুখখানা দেখবার জন্য ব্যক্তিটির। হঠাৎ হুঁশ ফিরতেই এমন পরিস্থিতিতে পেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে ও। কিন্তু পরক্ষণেই গ্রীষ্মের ক্লান্ত মুখটা দেখে হাফ ছেঁড়ে দিলো। গ্রীষ্মের নিজেরও চোখ লেগেছিল। মার্জান নড়াচড়া করতেই সচকিত হলো। চোখ খুলেই প্রশ্ন করলো,

” ঠিক আছো তুমি?”

মার্জান ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” ঠিক আছি।”

গ্রীষ্ম উঠে পড়লো। ছেঁড়ে দিলো ওঁকে। দু’জনের এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। নজর এদিক সেদিক ফিরাতে লাগলো। বুঝতে পেরে গ্রীষ্ম থমথমে গলায় বলে উঠলো,

” আমি তোমার সাথে তেমন ওসব কিছু করিনি। ডোন্ট প্যানিক।”

মার্জান খানিক অবাক হলো। এরপরেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

” হলেই বা কি? এক বাচ্চার মা তো আগেই করে দিয়েছেন!”

গ্রীষ্ম ওঁর কথাটা তেমন বুঝতে পাড়লো না। তবে ‘বাচ্চার মা’ কথাটি তার কানে পৌঁছেছে ঠিকিই পৌঁছায়। ভ্রু জোরা কুচকে ফেলে জিগ্যেস করলো,

“বাচ্চার মা মানে?”

মার্জান থতমত খেয়ে গেল। নিজেকে সামলে বলে উঠলো,

” আপনার কান বাজতেছে মি:”

গ্রীষ্ম ভ্রু কুঁচকিয়েই অন্য দিকে চাইলো। সাঁঝের বেলা।চতুর্দিকে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে। সাগরের ঢেউয়ের মন মাতানো উথাল-পাতাল ঢেউ আর ঝিঁঝি পোকার মতো ডাক ভয়ংকর গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে পেটের ভিতর পুরো দিন পরে নি। দু’জনেই ক্ষুধা কাতর। গ্রীষ্ম এবার আঁধারের মাঝেই উঠে পড়লো। ওঁর হাতের মাঝা একটা রিং এ চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে এক্টিভেট হতেই স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। এর পরেই হেঁটে হেঁটে এদিকে সেদিক করতে লাগলো খাবারের খোঁজ। কিছু খাবারের জোগার করে ফিরে আসতেই বিষ্ময়কর এক পরিস্থিতি পরে গেলো।আতঙ্কিত মুখে গুটি গুটি মেরে বসে আসে মার্জান। চোখে মুখে ভয় ফুঁটে। গ্রীষ্ম এগিয়ে যেতেই মার্জান চেঁচালো,

” এদিকে আসবেন না?”

গ্রীষ্ম আবারো ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলল। মার্জান বেহুঁশ থাকাকালীন গ্রীষ্ম শুকনো পাতা আর কাঠ জোগাড় করে জ্বালিয়ে ছিলো আগুন। আগুনের লকলকে আলোয় বোঝতে চেষ্টা করলো মার্জানে মুখভঙ্গি। মার্জানের নজর পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো ওঁ। কিন্তু মার্জানের পা পেঁচিয়ে বসা সাপটি থেকে এক প্রকার ছুটে কাছে চলে গেলো। এবং কোনো কিছু না ভেবেই সাপের লেজ ধরে টান দিতে ধূর্ত সাপ ফট করে কামড়ে দিলো গ্রীষ্মের হাতে। এবার আর্তনাদ করে উঠলো গ্রীষ্ম হাত মুঠ ঢিলে হতেই লেচ গুটিয়ে পালালো সাপটি। মার্জান চিৎকার করে উঠলো । পুরো বেপারটা কেমন জানি সিনেমাটিক মনে হলো। এক বার মনে হলো গ্রীষ্মে সিনেমার নায়কার মতো মার্জান দৌড়ে কাছে আসবে। গ্রীষ্মের হাত দু’টি ধরবে, চিন্তিত হয়ে চোখের জল ছাড়বে। নিজের জামার অংশ ছিঁড়ে বেঁধে দিবে হাত? কিন্তু তার ছিঁটেফোঁটা হলো না। মার্জান কাছে এসে শুধু বলল,

” এই কি করলেন? কে বলেছিলো হিরো সাজতে।আসুন? দিলো তো কামড়ে?”

গ্রীষ্ম মার্জানের কথায় হতাশার শ্বাস ছাড়লো। তাৎক্ষণিক উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগালো। ওঁ রুমালটা শক্ত করে বেঁধে দিলো কামগের অংশটুকু বাহিরে রেখে। এরপর ছোট একটি ছুঁড়ি আগুনে তাপ দিয়ে কেঁটে দিলো, ওই অংশটুকু। যদি বিষাক্ত হয় তাহলে এবার আর চিন্তা নেই। মার্জান গ্রীষ্মে এহেন কান্ড হতবাক। গ্রীষ্ম মার্জানের কাজে কিছুটা ক্ষুন্ন হলো বটে। কিছু ফল বের করে মার্জানকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্য পাশে বসে পড়লো। মার্জান নিজেও বুঝলো গ্রীষ্মের অভিমান। আড় চোখে বার কয়েক দেখেও না দেখার বান করলো ওঁ। মার্জান চায় না গ্রীষ্মকে বোঝাতে কতটা বিচলিত ওকে নিয়ে এ মুহূর্তে। কিন্তু গ্রীষ্মের অনেকক্ষন যাবত হালচাল না দেখে এবার আমতাআমতা করেই উঠে গেলো ওঁ। গ্রীষ্মকে হালকা ডাকলে সাড়া পেলো না। কিছুটা ভয় মিশ্রীত কন্ঠে এবার গায়ে স্পর্শ করে ডাকতে গ্রীষ্ম হেলে নিচে পড়ে যায়। মার্জানের গগনবিদারী এবার কে শোনে?? মার্জান গ্রীষ্মের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলো। গ্রীষ্মের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে গায়ে। এই জন্যই বুঝি হারিয়েছে জ্ঞান? মার্জান এবার গ্রীষ্মকে মাটিতে রেখে সাগর থেকে পানি নিয়ে এলো। গ্রীষ্মের মুখে ছিঁটে দিতেই নড়েচড়ে উঠলো এবার। পিটপিট করে চোখ খুলতেই গ্রীষ্ম অদ্ভুত নয়নে যেন তাকালো। মার্জানের গাল স্পর্শ করেই বলে উঠলো,

” তুলতুল, তুলতুল আমার তুলতুল, কোথায় ছিলে তুমি? কত খুঁজেছি তোমায়? তুমি আমাকে ফেলে কোথায় চলে গেলে? দেখো আজও তোমার অপেক্ষায়।”

মার্জানের এবার বুক কেঁপে উঠলো। তুলতুল? তুলতুল টা আবার কে? গ্রীষ্মের ভালোবাসা? রায়হান কি ওঁর কথাই বলে ছিলো? মার্জানের বুকে ভিতরটা তেতো হয়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো গ্রীষ্ম। এক ঝাটকায় উঠে বসে মুখ চেঁপে ধরলো মার্জানের। এদিক সেদিক মুখ করে দেখে চট করেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। মার্জান কিছু বলা বা করার আগেই গ্রীষ্ম ওই জায়গায় থেকে বের হয়ে সাগরের পাড়ে চলে যেতে লাগলো। মার্জান থম মেরে বসে রইলো। কি হলো মাত্র? এটা কি হয়ে গেলো? গ্রীষ্ম কি তাহলে ওঁর সাথে এতদিন নাটক করলো?? মার্জানের ভাবার মাঝেই স্পিড বোর্ডের শব্দ পেলো। ও নিজেও জলদি বেড়িয়ে সাগর পাড় এসে এবার সব থেতে বড় ধাক্কাটা খেলো। গ্রীষ্মের দল বল ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মার্জার জোরে জোরে ডেকেও লাভ হলো না। ওঁরা অনেক দূর চলে গেছে। মার্জান এবার ওখানেই হাটু মুড়ে বসে কাঁদতে লাগলো হাউ মাউ করে। এদিকে প্রভাত ফুটে উঠছে।চারপাশ নিরবতা ছেয়ে। মার্জানের ভয় করছে ভিষণ রকমের ভয়। এই নির্জন দ্বিপে ও মুধু এঁকা আর এঁকা… মার্জানের নিজেকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, কিন্তু ওঁর ছেলের জন্য বের হতেই হবে এখান থেকে।তা ভেবেই মার্জান এদিক ওদিক ছুটলো কিন্তু কোনো কোল কিনারা না পেয়ে ফোঁপাতে লাগলো। আকাশ পানে তাকিয়ে প্রার্থনা করলো মনে মনে। উধার করতে এই পরিবেশ থেকে।এই পরিস্থিতি থেকে বের হলে একবার, ওঁ আর কখনো গ্রীষ্মের মুখ দেখবে না। ঠিক তখনি আল্লাহ যেন কথা শুনলো ওঁর। একটি স্পীড বোর্ডের শব্দ কানে ভেসে আসতেই ধক করে উঠলো বুক। গ্রীষ্মটি ওঁকে নিতে এসেছে? ভেবেই রাজ্যের খুশি ঠোঁট স্পর্শ করে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো ওঁর মুখ। সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে বিষিয়ে উঠলো ওঁর মন। এমন এক পরিস্থিতিতে তাহলে কি গ্রীষ্ম সত্যি ছেঁড়ে চলে গেলো? ওঁকে! মনে পড়লো না একবারো? একবারো না??????

স্প্রীড বোটটি এসে থামলো এবার মার্জানের সামনে। তায়ানশাহ্ মুচকি হাসলো, কটাক্ষ করে বলল,

” কিহ্ ছেঁড়ে গেলো বুঝি? আমি আগেই জানতাম, ওঁর মতো ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসে না নিজেকে ছাড়া। ”

মার্জান রাগে, দুঃখ, ক্ষোভে জর্জড়িত। এ মুহূর্তে এখান থেকে বের হতে চায় সে। কিন্তু তায়ানশাহ্ কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা দিয়ে যেন বেশ মজা পাচ্ছে। তাই তিক্ত কন্ঠ বলল,

” আমি নিজে কি? মি: গ্রীষ্ম থেকেও আপনি অনেক নিকৃষ্ট। ”

হো হো হো করে হেসে উঠলো তায়ানশাহ্,

” ভাঙ্গবে তবে মচকাবে না? আই লাইক ইট। জানো তোমাকে আমার ভিষন পছন্দ হয়েছে। যেমন আমার গার্ল ফ্রেন্ড ঠিক তেমন তুমি। তোমার বাচ্চা না থাকলে তোমাকেও আমার করে নিতাম। দু’ বান্ধবী এক সাথে। ”

মার্জান ঘৃণিত দৃষ্টিতে চাইলো,

” আপনার মতো মানুষের উডর আমি থুতু ফেলি।”

তায়ানশাহ্ আবার হাসলো,

” হ্যাঁ তাতো মন চাইবেই, তোমার তো আবার ওই আধা পাগল গ্রীষ্মকে পছন্দ। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি জানো গ্রীষ্ম পাগল?”

মার্জানের এবার বিরক্তি লাগলো,

” ফালতু কথা না বলে এখানে কেন এসেছেন তা বলুন?”

তায়ান শাহ্ সিগারেট জ্বালালো। দু’ঠোঁটের মাঝকানে নিয়ে টান দিয়ে ভুরভুর করে ধোয়া ছাড়লো। বলে উঠলো,

” আমি দেখেছি গ্রীষ্মকে যেতে বুঝে গেছে পাগলের আবার এ্যাটাক এসেছে। ফেলে গেছে তোমাকে। আর তুমি তো আমার প্রিয় শীপ্রার জান। তাই ভাবলাম হাল চাল জিজ্ঞেস করে যাই?”

মার্জান ক্ষেপে গেলো,
” দেখেছেন? খুশি এবার?”

তায়ানশাহ্ সপ্তপর্ণে শ্বাস ছাড়লো,

” তুমি চাও, তো তোমার গন্তব্য পৌঁছে দিতে পারি আমি!”

মার্জানের চোখে মুখে আশার ঝলক দেখা গেলো,

” সত্যি? ”

তায়ানশাহ্ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। এবং মার্জানকে তুলে নিলো বোডে। পুরো সময় চুপ থাকলেও ওঁর গন্তব্য পৌঁছায় দিয়ে বলে উঠলো তায়ানশাহ্,

” মনে রেখো, তুমি কিন্তু ঋণি আমার কাছে!”

মার্জান তেমন পাত্তা দিলো না। পারে এসেই ছুটে চললো হসপিটালের দিকে।
——-

দিনক্ষণ কেঁটে গেলো আবারো গ্রীষ্ম হারিয়ে গেলো। সেদিনের পর অনেক দিন কেঁটে গেছে, রাফান এখন সুস্থ। কিন্তু ওঁর শরীরে বিষের প্রবেশের কারণে মৃণালের কোনো হেল্প করতে পারবে না ওঁ। আবারো ডোনার খুঁজে চলছে মার্জান। এসব ভাবতে ভাবতেই
এসে বসলো পার্কে। শীতল বাতাস গা ঘেসে যেতেই। মার্জানের সামনে এসে দাঁড়ালো এলোমেলো চুল আর নোংরা কাপড়ের একটি চিকন মেয়ে। মার্জানের কাছে এসেই হাত পেতে বলে উঠলো,

” আমাকে ভাত কিনে দিবে, খাবো? অনেক দিন খাইনি!”

মার্জানের খুব কষ্ট হলো। মুখ তুলে তাকাতেই কিছুটা চমকে গেলো। মেয়েটির মুখমন্ডল একে বারে ওঁর মতো। মেয়েটি নিজেও চমকে গেলো। মার্জানকে দেখে এক প্রকার ছুটে চলে গেলো। মেয়েটি দৌঁড়াবার সময় ওঁর হাত থেকে কিছু একটা খুলে পড়লো। মার্জান তা তুলতেই বিষ্ময়ে বুঁদ হয়ে দৌঁড়াতে লাগলো মেয়েটির পিছনে। কিন্তু বড় রাস্তার ধারে এসেই হারিয়ে গেলো মেয়েটি। মার্জান তন্নতন্ন করে খুঁজলো। পেলো না। কিন্তু মেয়েটির ফেলে যাওয়া বেসলেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো ওঁ। ওখানে দু’টি অক্ষর আড়াআড়ি ভাবে লাগলো,

” টি, স”

মার্জান ভাবনায় পরে গেলো, কে এই মেয়ে? কেন ওঁকে দেখে পালিয়ে গেলো ওঁ? মেয়েটি অনেকটা ওঁর মতো দেখতে! কোনো কানেকশন আছে কি ওঁদের মাঝে??

চলবে,

#জোয়ার_ভাটা
#পর্ব-২২
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি

” পৃথিবীতে একই রকম মানুষ দেখতে সাত জন হয়। তুই এত কেন ভাবছিস?”

শীপ্রা জুসের গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে তাকালো মার্জানের অশান্ত মুখের দিকে। মার্জান বলল,

” আমি জানি না, কিন্তু ওঁকে দেখার পর বড্ড উথাল পাথাল হচ্ছে মনে।”

শীপ্রা ওঁর হাতের উপর হাত রাখলো,

” তুই বেশি ভাবছিস?”

মার্জান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,
” তোর কথা সত্যি হোক শীপ্রা। বাই দ্যা ওয়ে তোকে ছেড়ে দিলো তায়ান শাহ্?”

শীপ্রা ম্লান হাসলো,
” ওঁ আমাকে মরার আগ পর্যন্ত মনে হয় না ছাড়বে, তবে হ্যাঁ কয়েদিনের শান্তি অবশ্যই পেয়েছি। ”

ফিচেল হেসে আবার বলে উঠলো,
” বাদ দে আমার কথা, তোর কথা বল। তোদের শো তো সুপার ডুপার হিট হচ্ছে। শুনেছি নমনেটেড হয়েছিস তুই? ”

মার্জান এতক্ষণে হাসলো একটু,

” সায়ান স্যার তো তাই বললেন!”

ওঁদের কথার মাঝেই ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়ালো। মার্জান বিল পে করে উঠবে ঠিক তখনি পাশের একজনকে এসে ওয়েটারকে ধাক্কা মেরে দেয়। মার্জানের শরীরে বেচে থাকা জুসটুকু টুপ করে পড়ে যায়ম ওয়েটার আতঙ্ক মাখা কন্ঠে বলে উঠে,

” ম্যাম আম সরি।”

মার্জান “ইটস ওকে বলে ওয়াশরুমের দিকে ছোটে। শীপ্রা সেখানেই বসে রয়। মার্জান ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের ড্রেস পরিস্কার করতে লাগলো। ঠিক তখনি উপস্থিত হলো রিয়ানা। মার্জানের বুঝতে বাকি নেই কিছুক্ষণ আগের ঘটনা টা ওঁর ফাঁদ। মার্জান রূঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,

” কি চাই?”

রিয়ানা স্বভাব মতো ওঁর পেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,

” তোমাকে ইনভাইট করতে এলাম। কাল আমার বেবি সাওয়ার সময় মতো চলে এসো।”

মার্জান বাঁকা হেসে বলে উঠলো,

” আসবো তো অবশ্যই। ”

রিয়ানা থতমত খেয়ে গেলো ওঁর হাসি দেখে। বলল,

” এভাবে হাসছো কেন?”

মার্জান রিয়ানার কাছে আসতেই রিয়ানা পিছনে চলে যেতে নিলো ওঁর উঁচু হিলের জন্য পরে যেতে নিলো। মার্জান টেনে ধরে ফেললো। রহস্যময় কন্ঠে বলে উঠলো,

” আরে, আরে সামলাও নিজেকে? এখনি এই অবস্থা? কাল কি করবে?”

রিয়ানা ভ্রু কুচকে তাকালো,
” কি বলতে চাইছো?”

” এটাই যাষ্ট। নিজেকে সামলে চলতে শিখো, সামনে কি হবে বলা যায় না।”

বলেই বেড়িয়ে যেতে নেয় ওঁ। তখনি কারো সাথে ধাক্কা লেগে যায় ওঁর। এবং ওঁর পার্স ছিটকে পড়ে কিছু দূর, এবং একটি বেসরেটও বেড়িয়ে এলো। মার্জান মাথা তুলে দেখলো রিয়ানার চামচি চৈতি। ওঁ চৈতির দিকে তাকাতেই দেখলো চৈতি ওই বেসলেটের দিকে তাকিয়ে। মার্জান দেড়ি করলো না সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে চলে গেলো। ওঁর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো শুধু।

————————-

শীত নেমে এসেছে। চারপাশের বইছে শীতল বাতাস। পরিস্কার আকাশ মেঘাছন্ন। মার্জান করিডরে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের। ঠিক তখনি রাফি এসে বলল,

“মার্জান আমি খুব জলদি আবার ব্যাক করছি। আমার মতে মৃণালকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাওয়া উচিত। ওখানে আমার এক বন্ধু আছে স্টিফেন ওঁর সাথে ম্যাচ করে গেছে ওর ব্রোন ম্যারো। এখন তোমার সম্মতি বাকি।”

মার্জান দোনোমোনোয় পড়ে গেছে। কি করা যায় ভাবছে। তা দেখে আবার রাফি বলে উঠলো,

” এক সপ্তাহ সময় আছে তোমার হাতে মার্জান!”

“ঠিক আছে।”

মার্জান ছোট করে শ্বাস ফেললো। এর মাঝেই ওঁর সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। ওঁ তো মুলত এসেই ছিলো প্রতিশোধ নিতে, আর মৃণালের ডোনার খুঁজতে। আর কোনো কাজ নেই বাকি ওঁর জীবনে। সে না হয় আবারো নতুন জীবন শুরু করবে। নতুন ভাবে! তাই ভেবেই মৃণালের কেবিনের দিকে চলে গেলো। মার্জান মৃণালের পাশে এসে বসলো। ছেলেটা শুঁকিয়ে গেছে। ফ্যাঁকাসে লাগছে মুখ। মার্জানের ভিতর টা ফুপিয়ে উঠলো। ছেলের হাত ধরে নিরবে কেঁপে উঠলো। মৃণালের ঘুম ভেঙে গেলো। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,

” জান তুমি কেন কাঁদছো? আঙ্কেল সামার কি তোমায় বুলি করেছেন? কষ্ট দিয়েছেন তোমাকে?”

মার্জান ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল,

” নাহ্ বাচ্চা। ”

“তাহলে কেন কাঁদছো?”

“তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না?”

“নো জান, তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।”

মার্জান চোখের পানি মুছে ফেললো,

” নাউ আর কাঁদবো না।”

বলেই হাসলো। মৃণাল তখনি এক অভাবনীয় প্রম্ন করে বসলো,

” মম আমার পাপাকে?”

মার্জান মৃণালের অবলীলায় বলা কথায় থমকে গেলো। জিজ্ঞেস করলো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে,

” হঠাৎ এমন কেন বলছো মৃণাল?”

মৃণাল চুপ করে রইলো মন খারাপ করে। হয়তো ওঁর মাকে আবার কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবেই চুপ করে গেলো ওঁই?

———–

আজ কাল গ্রীষ্মের সাথে নির্ঝোরকে দেখা যাচ্ছে খুব। গুঞ্জন হচ্ছে গ্রীষ্মের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা। আজও দেখা যাচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেলের একটি রেস্টুরেন্টে ডিনার করছে ওঁরা । এই খবরটি মার্জান অনেক আগেই পেয়েছে কিন্তু আজ স্বচোক্ষে দেখতেছে। মার্জান কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছে এইখানে রিয়ানার বেবি সাওয়ারে। নির্ঝোর আর গ্রীষ্মকে দেখে থম মেরে গেলো ওঁ। পাত্তা না দিয়ে নিজের গন্তব্য এগিয়ে চলে গেল। জমকালো সন্ধ্যা। চারপাশের আলোয় আলোকিত রিয়ানার বেবি সাওয়ারের অনুষ্ঠান। রিয়ানা বউয়ের মতো সেজে আছে। পাশেই বসে আছে সুরভি। মার্জানকে দেখেই কালো হয়ে গেলো ওঁর মুখ। কিন্তু রিয়ানা হাসলো। উপহাসের হাসি।বেবি স্টেপে এগিয়ে এলো মার্জানের কাছে। সকলকে আকর্ষণ করে বলে উঠলো,

” দেখো আমার বড় বোন এসেছে। ”

নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়লো চার পাশে কিছুক্ষণের জন্য, তারপর পরই কে এক জন বলে উঠলো,

” এতো মার্জান। ওঁর নাকি ছেলে আছে একটা?”

অন্য একজন বলে উঠলো,
” আমি তো এটাও শুনেছি, ও খুন করেছে ওঁর মাকে?”

” আমিও শুনিছি। এও কানে এসেছিলো ওঁর নাকি বাচ্চা আছে। অথচ ও অবিবাহিত। ”

এঁকে এঁকে নানাম কন্ঠ ভেসে আসতে লাগলো। মার্জান পাত্তা দিলো না। রিয়ানার কাছে গিয়ে বলে উঠলো,

” আমি তোমার জন্য, পৃথিবীর সব থেকে বড় গিফট এনেছি।”

রিয়ানা কিছুটা অবাক হলো বটে,
” আচ্ছা তা কি?”

মার্জান, ‘এক মিনিট ‘বলে পার্স থেকে একটি পেইন ড্রাইভ বের করে নিলো। এবং সামনে প্রজেক্টরের কাছে চলে গেলো। পেইন ড্রাইভ লাগিয়ে অপেন করতেই উপস্থিত সবাই থমকে গেলো। ঠিক তখনি উপস্থিত হলো ভাদ্র, ফুলের তোড়া হাতে। আপত্তিকর কিছু শব্দ রিয়ানার চোখের সামনে অন্য কারো সাথে রাত কাঁটাতে দেখেই রিয়ানা মাটিতে বসে পড়লো। অপলক দৃষ্টি স্কীনের উপর। ভাদ্রের হাত থেকে ফুলের তোড়া পড়তেই ওখানে তাকালো সবাই। রিয়ানা রাগে ক্ষোভে উঠে গেলো ভাদ্রের দিকে। পর পর থাপ্পড় পড়লো ওঁর গালে। রিয়ানা বলতে লাগলো,

” তুমি আমাকে ঠকালে, আমি তোমাকে কত ভালোবাসলাম আর তুমি। কেন করলে, বলো।”

ভাদ্র এত মানুষের সামনে এভাবে হেনস্তা হতে হচ্ছে দেখে ধাক্কা দিয়ে সরালো রিয়ানাকে। রিয়ানা কাঁচের টেবিল নিয়ে পেটের উপর পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বাল্ড বেড়িয়ে গেলো। রিয়ানা নিজের পেটে হাত দিতেই চমকে উঠলো। কয়েকটি কাঁচের টুকরো গিথে গেছে ওঁর পেটে। তা দেখেই ঘাবরে গেলো ভাদ্র। দৌঁড়ে কাছে আসতেই রক্তে রাঙ্গা লাল হাতটা উপরে তুলে থামতে বলল। সুরভি দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” মা আমার বাচ্চাকে বাঁচাও। আমি মরে গেলেও আমার বাচ্চাকে বাঁচাও।”

সুরভি সহ কয়েকজন কাছে এসে তুলে বেড়িয়ে গেলো ওঁকে। পিছন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ভাদ্র। এই হল ঘরের মানুষ জন কমতে লাগলো ধীরে ধীরে। রয়ে গেলো ওঁরা মার্জান আর ভাদ্র। মার্জানের মন অবশ্যই খারাপ হয়েছে। যতই হোক রিয়ানা তার বোন। কিন্তু ওঁর সাথে যা হয়েছে তার জন্য কাুকে কি মাফ করা যায়? মার্জান উচ্চস্বরে হাসলো। হল ঘরটিতে প্রসারিত হতে লাগলো আওয়াজ।

” কথায় আছে মি: ভাদ্র পাপ বাপকেও ছাড়ে না। কি হবে এবার তোমার? এই বাচ্চা পৃথিবীর মুখ না দেখছে তুমি সারা জিবন বাচ্চার জন্য কাতরাবে তাই না? তাই তো ভাবছো? ঠিক বলছি?”

ভাদ্র ভ্রমে ছিলো। ঘটে যাওয়া ঘটনাতে নিজেকে দোষ দিতে লাগলো ওঁ। কিন্তু মার্জানের কথাতে হুমড়ি খেয়ে গেলো যেন।

” তুমি কি সব বকছো?”

” আমি সত্যি বলছি। ইনফেক্ট প্রুভ আছে আমার কাছে। রিয়ানাকে তুমি মোটেও ভালোবাসো না। অন্য সব মেয়েদের মতো কবে ছুঁড়ে দিতে তাকে। কিন্তু দেখো কি খেল কয়েক মাস আগের একটি এক্সিডেন্টে বাবা হবার শক্তি হারিয়ে ফেলো তুমি? কি? সত্যি বললাম তো?”

ভাদ্র বড় বড় চোখ করে তাকালো। শুকনো ঢুক গিলে বলে উঠলো,

” বাজে বকছো তুমি!”

এবং ওই স্থান ত্যাগ করলো সঙ্গে সঙ্গে। মার্জান নিজেও বেড়িয়ে যেতে লাগলো। কষ্ট লাগছে রিয়ানার জন্য, যাই হোক ওঁ একজন মা, আরেকজন মায়ের কষ্ট বুঝে। কিন্তু ওঁর জিবন নষ্ট করে আর কত সুখী করতে চায়? কিন্তু মার্জান চায় নি,বাচ্চার কিছু হোক। এমন কিছু হয়ে যাবে চিন্তা করে নি মোটেও। কিন্তু যা হবার তাই হয়। কে আটকাতে পারবে এসব? কেউ না। একদম না। মার্জানের ভাবনায় ফাটল পড়লো। নির্ঝোর আর গ্রীষ্মকে একই সাথে একটি রুমে যেতে দেখে থমকে গেলো ওঁ। চোখ জোড়ায় টলমল জল। মার্জান না চাইতেও গ্রীষ্মের উপর দূর্বল হয়েই পড়েছে। কিন্তু নির্ঝর ওঁর বন্ধু হয়ে এসব কিভাবে করতে যাচ্ছে?

মার্জান চোখের জল মুছলো। শীপ্রাকে কল করলো। শীপ্রাকে ওঁর বাসায় আসতে বলে বেড়িয়ে গেলো।

____________

হসপিটালের করিডোর সুরভি চিন্তিত মুুখে বসে আছে। রিয়ানার অপারেশন চলছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাদ্র আর ওঁর বাবা-মাকে কটাক্ষ করে বলছে,

” আমার এক মাত্র মেয়ে, ওঁর কিছু হলে কাউকে ছাড়বো না কাউকে না।”

নিরবভাবে শুনছে ভাদ্র। ডাক্তার এগিয়ে আসতেই তাদের দিকে সুরভি জিজ্ঞেস করলো,

” ডাক্তার এখন কেমন আছে ওঁরা?”

“সরি আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচতে পারিনি।”

ভাদ্র ধপ করে বসে পড়লো। সুরভি ক্রোদন কন্ঠে বলে উঠলো,

“রিয়ানা…!”

” ওঁ কমোয় চলে গেছে।”

সুরভি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। করিডোরের নিস্তব্ধতার বুক চিঁড়ে কান্নার শব্দ ভেসে ভেসে যাচ্ছে যত দূর পর্যন্ত যাওয়া যায়…..

শীতের রাতে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তার ধার ঘেঁষে। থেকে থেকে একটা দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। মার্জান এবার দু’টি লাইন আওয়রালো,

” আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো।
কে এল মোর অঙ্গনে, কে জানে গো।
​​ হৃদয় আমার উদাস ক’রে
​​ কেড়ে নিল আকাশ মোরে,
বাতাস আমায় আনন্দবাণ হানে গো।
দিগন্তের ওই নীল নয়নের ছায়াতে
কুসুম যেন বিকাশে মোর কায়াতে।
​​ মোর হৃদয়ের সুগন্ধ যে
​​ বাহির হল কাহার খোঁজে,
সকল জীবন চাহে কাহার পানে গো।”

মার্জান আপন মনে হাটছে। অথচ একটি অবয়ব ওঁর পিছন পিছন চলছে। মার্জান একবারের জন্যও বুঝলো না। ব্যক্তিটি কে?

——————

চলবে,