জোয়ার_ভাটা পর্ব-১৯+২০

0
325

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
পর্ব-১৯

টিপটিপ করে পানির শব্দ ভেসে আসছে। ফ্লোরে গড়াগড়ি করছে জল। মার্জান আধো চোখ খুলে নিজের অবস্থান দেখে উঠতে চাইলো। সারা শরীরের তীব্র ব্যথায় দাঁড়াতে অক্ষম সে। নিজেকে ওয়াশরুমে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে খানিক চমকালো ওঁ। মুহুর্তেই মনে পড়তেই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো। কোনো রকম ঝড়না বন্ধ করে বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। হোটেল রুমের আলমিরা থেকে তয়লা বের করে নিজেকে মুছতে লাগলো তাতে। ধীরে পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে বসলো বিছনায়। পার্স থেকে ফোনটি বের করতে স্তম্বিত হল ওঁ। সোফিয়ার ১০০+ কল আর কিছু মেসেজ দেখে। মার্জানের ভ্রু জোরা কুচকে গেলো। পরক্ষণেই মনে পড়লো আজ ওদের শো এর রেটিং আসার কথা। সোফিয়ার এত কল আর মেসেজ দেখে কিছু ঘাবড়ে গেলো সে। সোফিয়ার লাষ্ট মেসেজ দেখে আত্মা এবার ধুকপুক করছে যেন,

” ইয়ার মার্জান? কোথায় তুমি? কত বড় ঘটনা ঘটে গেছে, যেখানেই থাকো জলদি অফিসে আসো।”

মার্জান এবার ঘামতে লাগলো। রিয়ানার শো কি তাহলে স্কোর বেশি করেছে? মার্জানে শো টা কি তাহলে এখানেই শেষ হচ্ছে? মার্জান এবার হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলো। সোফিয়াকে ফোন দিলো ও, ফোন বন্ধ। মার্জান হাটতে পারছে না ঠিক মতো। গায়ে জ্বর চলে এসেছে সারা রাত পানির নিচে থাকার জন্য। মার্জান কোনো রকম প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটলো অফিসে। অফিসে ঢুকতে সবাই মার্জানের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সায়ান নিজের কেবিন থেকে বের হয়ে মার্জানের সামনে এসে দাঁড়ালো। থমথমে মুখ দেখে গলা শুকিয়ে কাঠ ওঁর। সায়ানকে ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

” আমাদের শো চলবে তো স্যার?”

সায়ান সরাসরি তাকালো মার্জানের দিকে। এর পরেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো বাচ্চাদের মতো, যেন অনেক দিন অপ্রত্যশিত কোনো খেলনাটি হাতে নাগালে পেলো ও। বলল,

” মার্জান আমাদের শো পুরো সুপার ডুপার হিট হয়ে গেছে।রেটিং স্কোর হাই। ইনফ্যাক্ট তোমার জন্য অনেক শো থেকে অফার আসছে।”

মার্জানের মুখে হাত চলে গেছে, অবাকতায় আকাশচুম্বী। হাটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে, হু হু করে খুশির কান্নাটা কেঁদে উঠলো ওঁ। সোফিয়া কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে ঝাপটে ধরলো ওঁকে। কারো কান্না দেখলে ও নিজেও খুব কান্না করে। আজ তার ব্যতিক্রম হলো না। মার্জানের সাথে তাল মিলিয়ে ওঁর থেকে দিগুণ বেগে কান্না শুরু করলো ওঁ। একে বারে হেঁচকি তোলা কান্না। মার্জানের কান্নাটা সোফিয়া কান্ডে চট করেই থেমে গেছে। ড্যাবড্যাব করে দেখছে সোফিয়াকে। সোফিয়া ক্যার দেখি মার্জানের চোখের জল টুকু মুছে দিতে দিতে ক্রোদনরত কন্ঠে বলে উঠলো,

” ডোন্ট ক্রাই বেবি, ডোন্ট।”

মার্জান ভেবে ফেলো না ওঁ কি বলবে। তখনি সায়ান জানালো,

” আমার তরফ থেকে সকলকেই ট্রিট”

এবার হৈ চৈ শুরু হলো সকলের মাঝে। মেকি গুমোট আর থমথমে পরিবেশ মুহূর্তেই মুখোশ খুলে আনন্দ উল্লাসে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মার্জান এবার স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ওঁদের আনন্দ মুহূর্তটা নষ্ট করতে আগম ঘটল হিল পায়ে টকটক করে রিয়ানার। বরাবরের মতোই পেটের মাঝে হাতে রেখে এসে দাঁড়ালো ওঁর সামনে। মার্জান কিছুতেই বুঝতে পারে না, আসলেই কি মেয়েটি প্রেগনেন্ট? তাহলে এত উঁচু হিল কিভাবে পরে ওঁ? তাও আবার অত বড় পেট নিয়ে? মার্জান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। ক্ষিপ্ত হয়ে রিয়ানা বলে উঠলো,

” এন্টারটেইনমেন্ট জগতে তো টিকে গেছো? কিন্তু বাস্তব জগতে হেরে গেছো তুমি মার্জান।”

বলেই নিজের পেটের উপর হাত বুলাতে লাগলো। মার্জান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,

” আমি কোথায় হেরেছি, আর কোথায় জিতেছি? সময় তা প্রমাণ দিচ্ছে।”

রিয়ানা কিড়মিড় করে তাকালো,

” উড়ছো তো? উড়ো? এই জগত তোমার কত দিন সাথে থাকে আমি দেখবো। মনে রেখো আমি এই জগতের নাম করা অভিনেত্রী। ”

মার্জান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে হাসলো, রিয়ানার কানের কাছে কিছুটা এগিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
” আমার যা মনে রাখার তা আমি মনে রাখবো… আমার এক মাত্র ইচ্ছে, ছিটকে ফেলবো তোমাকে এই জগত থেকে আর সকলের সামনে মুখোশ খুলবো তোমাদের!”

মার্জানের কথাটায় ঘাবড়ে যায় রিয়ানা নিজেকে সামলে দূরে সরে আসে। মার্জানকে উদ্দেশ্যে বলে,

” তোমার স্বপ্নে”

মার্জান ঠোঁট দু’টি উঁচু করে কুটিল হাসলো। রিয়ানা পাত্তা না দিয়ে সবাইকে জানালো,

” আমার বেবি সাওয়ারে তোমাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ। ইস্প্যাশালি তোমার জন্য মার্জান।”

বাঁকা হাসলো রিয়ানা। মার্জান জানে আবার নতুন কোনো ফন্দি সে হয়তো আটবে। তবুও এবার যাবে। রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” হ্যাঁ আসবো তো অবশ্যই। সব থেকে বড় গিফট তুমি আমার থেকেই পাবে।”

রিয়ানা এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। মার্জানের কথার মানেটা কি? ধরতে পাড়ছে না কোনো মতেই।

—————–

অন্ধকার চারপাশ। নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রক্তে মাখা হাত-পা নিয়ে মাটিতে বসে আছে গ্রীষ্ম। চোখ জোড়া বড্ড লাল টুকটুকে। বাহিরের শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে ওঁ। পায়ের শব্দে হুঁশ ফিরে ওঁর। একজন বৃদ্ধা যে সফেদ সেলোয়ার সুট পড়া। মাথায় কাপড়। গৌড় বর্ণের দেহ জানান দিচ্ছে, বৃদ্ধার যৌবন কালে অনেক সুন্দরী ছিলেন। বৃদ্ধি পাশেই বসলেন গ্রীষ্মের। গ্রীষ্ম এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

” আমার কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে এসেছেন?”

বৃদ্ধা হতাশার শ্বাস ছাড়লো,

” তোমার কাছে প্রতিবার আমিই ভুল, তাই কেনো মনে হয় গ্রীষ্ম।”

গ্রীষ্ম ঘাড় ঘুড়িয়ে চাইলো। বৃদ্ধা চোখের দিক দৃষ্টি নিবিড় করে বলে উঠলো,

” আপনি কি জানেন না দাদিজান? কেন খেলছেন আমাদের সাথে??”

দাদিজান এবার দাঁড়িয়ে গেলেন। গ্রীষ্মের পুরো ঘর জোড়া পায়চারি করতে করতে বলে উঠলেন,

” তুলতুলকে ভুলে গেলে তুমি? এতো সহজে? ওঁর রিপ্লেসমেন্ট পেয়েছো বলে?”

গ্রীষ্ম চকিতে তাকালো। দাদিজান হাসলো,
” আমি সব জানি গ্রীষ্ম। তোমার ভাই সেইম কাজটাই করে ছিলো, আর দেখো, আজ ও নেই।”

গ্রীষ্ম হাতের মুঠ শক্ত করে ফেললো। সোজা হয়ে বসলো ওঁ,

” আপনি যদি পুরোনো কথা তুলতে আসেন তাহলে আমি কথা বলতে ইন্টারেস্ট নই।”

বলেই উঠে যেতে নেয় ওঁ। তখনি আবার ডাকে দাদিজান,

” গ্রীষ্ম আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চাই।”

” আর মা?”
দাতিজান চুপ হয়ে গেলেন। ওনার মুখটা ফেকাসে হয়ে গেলো। গ্রুপ তা দেখতে পেয়ে হাসলো। বললো,

” যে বাড়িতে আমার মায়ের জায়গা নেই, ওখানে আমি কখনো পা ফেলবো না।”

দাদিজান চেঁচালেন,

” গ্রীষ্ম, ভুলে যেও না আষাঢ় আর তুলতুলের গুম হওয়ার কারণ তোমার মা।”

” আমি মানি না.. বুঝলেন, আমি মানি না…! আপনি আসতে পারেন!”

বলেই গটগট পায়ে চলে গেলো গ্রীষ্ম। দাদিজান ওখানেই চোখের জল ছেড়ে দিলেন। বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,

” ভূঁইয়া বাড়ি ওঁর অংশিদার হারাবে? তা কিভাবে মানবে উনি?”

বলেই দাদিজান নিজেও ধীরে ধীরে নেমে চলে গেলেন সেখান থেকে।

—————–
বাংলাদেশের অরূপ সৌন্দর্য এক মাত্র দেখা মিলে এখন শহরের বাহিরে… গ্রাম সাইডে। যদিও দালানকোঠার আধুনিকতার স্পর্শ পেয়েছে। মার্জান গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। বড় বড় পাহাড় পর্বত আর গাছ-পালা ফেলে এগুচ্ছে সে। মার্জান বুকের মাঝে শক্ত করে হাত চেপে ধরে আছে। এত দিন পরে টগরের দেখা পাবে ভেবেই মনে কোনে আনন্দের রেশন। তবুও কোথাও একটা যেন ঠিক নেই মনে হচ্ছে মার্জানের। পাশেই রাফান বসা ওঁর। মার্জানকে ভাবুক দেখে কথা পাড়লো ওঁ,

” মার্জান ডোন্ট বি সেড। আন্টি নিশ্চই ভালো আছেন?”

মার্জান চোখের ইশারায় বোঝালো ওঁ ঠিক আছে আবারো বাহিরে তাকিয়ে রইলো সে। ঘন্টা পাঁচেক পাড় হতেই গন্তব্য পৌঁছায় তারা। কাঙ্ক্ষিত বাড়িটিতে পৌঁছে মার্জানের বুক ধকধক করতে লাগলো। ওঁর মা ঠিক আছে তো? মার্জান দরজা ধাক্কা দিলো। একটি ১৬/১৭ বছর বয়সের মেয়ে দরজা খুলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো,

” কি চাই?”

মার্জান পাত্তা দিলো না। মেয়েটিকে ঠেলে ভিতরে চলে গেলো। মেয়েটি চেচা-মেচি করে আসতে লাগলো পিছন থেকে। কিন্তু মার্জানের খেয়াল নেই সেদিকে।মার্জান ওঁর মায়ের ঘরে গেলো। টগরের নিথর দেহ বিছানায় পরে থাকতে দেখে ফুপিয়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই আতকে উঠলো। মার্জানের মায়ের ঘরের খাটের তলায়… কেউ সাপের ঝুঁড়ি রেখে গেছিলো। প্যারালাইজড টগরের শরীরে পেঁচিয়ে যেতে লাগলো তা। মার্জান তা দেখে এক চিৎকার করলো। পিছন থেকে এত দিন দেখ ভাল করা কাজের মেয়েটা ছুটে বাহিরে চলে গেলো। ঠিক তখনি ফেরেস্তার মতো কোথা থেকে হাজির হলো রাফান। এবং টগরের কাছে গেলো। সাপ গুলো দূরে সরিয়ে পাঁজো কোলে নিয়ে বেড়িয়ে আসার সময় ছোবল মারলো রাফানের হাতে। রাফান আহ্ করে উঠলো। মার্জান ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু রাফান নিজেকে সামলে টগরকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো ওখান থেকে। ততক্ষণে গ্রামের লোকজন জড় হয়ে গেছে। হাট্টা-গাট্টা যুবক এসে মারতে লাগলো সাপ। কিন্তু এদিকে রাফানের চোখের সামনে ঘোলাটে হয়ে উঠলো। পরমুহূর্তেই মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে…সময় নষ্ট না করেই হাসপাতালে আনা হয় ওঁকে। ডাক্তার বিস্মিত সুরে জানায়,

” আফ্রিকান জঙ্গলের একটি বিষাক্ত সাপ কামড় দিয়েছে রাফানকে, ওঁকে বাঁচাতে হলে একটা বিশেষ রকমের এন্টিডোট লাগবে যা শাহ্ ফার্মা থেকে পাবে, তাও আবার শাহ্ ফার্মা সহজে এটি সেইল করে না।”

মার্জান এখন কি করবে? ও জানে এই কাজে একজন ব্যক্তি ওঁকে সাহায্য করতে পারবে, কিন্তু ওঁ কি করবে? বেঁকে বসবে না তো?

—————

চার দেয়ালে বন্দি থাকা গ্রীষ্ম নিজ ঘর ছেড়ে আজ নিজের ভাইয়ের ঘরে প্রবেশ করলো। পুরোনো স্মৃতি তাজা হতে লাগলো ওঁর। গ্রীষ্ম আষাঢ়ে বিছানার পাশে বসলো। পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি ডায়রি বেড় করে পাতা উল্টাতে লাগলো। একটি পাতায় এসে থমকে গেলো ওঁ। তুলতুল, আষাঢ় আর গ্রীষ্মের একত্রে হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ওঁ যখন ১৬/১৭ বছর তখনের। ওঁর হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন আগে তোলা। সেদিন ওঁদের দু’ ভায়ের বার্থে পার্টি ছিলো। সারা দিন আর রাত আনন্দ উল্লাসে কেঁটে গেছিলো। কিন্তু হটাৎ কি হলো? সব উলোটপালোট হয়ে গেলো।গ্রীষ্মের চোখের কোনে জল জমা হয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই ওঁর শরীর গরম হতে লাগলো। গ্রীষ্ম বুঝে গেলো, ও নিজেকে হারাতে চলছে। চট জলদি ওখান থেকে সরে এলো। নিজ ঘরে এসে ঠান্ডা পানি ছেঁড়ে দিলো মাথার উপর। এর পর চোখ বুজতেই ভেসে উঠলো মার্জানের মুখখানা। কত মিল তুলতুল আর মার্জানের। এ-জন্যই তো প্রথম দেখাতেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলোওঁ। আটকে পড়ে ছিলো নজর মার্জানের মুখখানায়। শুধু তফাৎটা মুখের তিলের। তুলতুলের মুখের ডান পাশে ওঁর দাদিজানের মতো একটা তিল আছে। হবেই বা না কেন? দাদি জানের এক মাত্র আদরের নাতনি বলে কথা। তুলতুল হচ্ছে ওঁদের বংশের একটি মাত্র মেয়ে ওঁর ছোট চাচার ঘরের। আর কোনো সন্তান নেই ওনাদের কিন্তু ওই কাল রাত্রি সব তছনছ করে দিলো। গ্রীষ্ম এখনো খুঁজে চলেছে তুলতুল আর আষাঢ়কে। গ্রীষ্ম এবার বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। শরীরটা এবার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।কিন্তু রেডি হয়ে নিচে আসতেই বড় রকমের শক্ড খায় ওঁ,

” তুমি এখানে?”

মার্জান আমতা আমতা করতে লাগলো। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছে। গ্রীষ্ম ঘন্টা খানেক আগ পর্যন্ত রেগে থাকলেও ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্টের পাঠানো ভিডিও দেখে পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেছিলো সে। ওই ভিডিওতে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো মার্জান অন্য একটি মেয়েকে রুমে ঢুকিয়ে বেড়িয়ে যেতে। কিন্তু রাগটা ওঁর এখানে নয়.. রাগটা ওঁর এই জায়গায়, কেন মার্জান ওঁকে বলল না কিছু। কেন মার্জান ওঁকে চায় না? কেন? মার্জান এবার মুখ খুললো,

” আই নিড অ্যা হেল্প। এর বদলে আপনি যা চাইবেন তাই হবে।”

গ্রীষ্ম বাঁকা হাসলো, ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠলো,
” যা চাইবো তাই?”

মার্জান শিউরে উঠলো। ওঁর কাছে কোনো পথ খোলাতো নেই। ওঁতো প্রথমে শীপ্রার কাছেই গেছিলো। কিন্তু ওঁদের বাসায় তালা দিয়া। রাফি নিজেও আউট ওফ টাউন। ওঁকে ফোন দিয়েও লাভ নেই। কি করবে না করবে ভেবেই এখানে আসা। গ্রীষ্ম ছাড়া আর কোনো রাস্তায় যেন দেখছে না মার্জান। গ্রীষ্ম এবার ওঁর কাছাকাছি এলো। মার্জানকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে চুটকী বাজালো মুখের সামনে, মার্জান ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকালো ওঁর দিকে। গ্রীষ্ম মার্জানকে এভাবে নাস্তানাবুদ করতে পেরে সেই মজা পাচ্ছে। কিন্তু মুখ তার তখনো গম্ভীর। মার্জানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গ্রীষ্ম আরো কাছে চলে গেলো। মার্জানের কানের কাছে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

” আর ইউ রেডি?”

মার্জান চোখ বড় বড় করে ফেললো। কি করতে চাইছে গ্রীষ্ম মার্জানের সাথে? সত্যি মার্জানকে ওঁ সাহায্য করবে? নাকি ছয় বছর আগের রাত আবারো আসবে? শুধু এবার হয়তো তফাত হবে সজ্ঞানে! কিন্তু মার্জান তা মোটেও চায় না। মার্জানের বড়বড় চোখ জোড়ায় নেমে এলো তীক্ষ্ণতা। তা দেখে হো হো করে হেসে ফেললো গ্রীষ্ম। পরক্ষণেই দাম্ভিক পূর্ণ মুখখানা ঠান্ডা, শীতল হয়ে গেলো। মার্জান এবার ঘাবড়ে গেলো। তোতলানো সুরে বলে উঠলো,

” আপনার কি চাই?”

কুটিল হাসি ফুঁটিয়ে বলে উঠলো,

” আমার তোমাকে চাই।”

বলেই মার্জানের আরো কাছে চলে গেলো। হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

” খুব করে চাই। অনেক কাছে চাই । আমার পাশে চাই।”

মার্জান শিউরে উঠলো। চোখ তুলে তাকাবার সাহস আর করলো না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। তা দেখে রেগে গেলো আবার গ্রীষ্ম। ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো তাকে। থমথমে কন্ঠে বলে উঠলো,

” তবে তোমার ইচ্ছায় জান..।”

বলেই উপড়ে চলে গেলো সে। মার্জান শুধু গ্রীষ্মের যাওয়ার পানেই তাকিয়ে রইলো। কি চায় এই লোকটা? কেন এত রহস্য এই লোকের মাঝে? কেন মার্জান যত যত ভাবে এই লোকটিকে নিয়ে ততই নিজেকে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ওঁর মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে এখনো প্রশ্ন…

” ওঁ রাতে কি গ্রীষ্ম ছিলো? যদি হয়? তাহলে কেন মনে নেই ওঁকে??? নাকি ওঁর ভুল?”

চলবে,

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
পর্ব-২০
সুবহে সাদেক উজ্জ্বল হয়ে উঠে পুব আকাশে। শীতল হাওয়া ঝাপটা মেরে গা স্পর্শ করে। সাগরের বুকে নীল জলের বুক চিঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্প্রীট বোর্ড। মার্জানের খোলা চুল উড়ে যাচ্ছে অবাধ্য ঢেউ এর মতন। সাদা টপস আর নীল জিন্স, গলায় ঝোলানো ওড়না দিয়ে আবরণ দেহখানি। হয়তো বা শীত শীত করছে মার্জানে। গ্রীষ্ম ওঁর সজাগ দৃষ্টিতে সুক্ষ্ম ভাবে দেখছে মার্জানকে। মার্জানের আনচান মন, অশান্ত পলক, চিন্তিত মুখ ওঁকে যেন আর-ও অতুলনীয় সুন্দর লাগছে। গ্রীষ্ম বুকে হাত রেখে শ্বাস ছাড়লো। বুকে ভিতর চিনচিন ব্যথা করছে যেন। গ্রীষ্ম তাকিয়ে থাকে এই অপরূপ সুন্দর তন্বীর দিকে। ওঁর তন্ময় মন গেয়ে যায় বার বার,

” হামে তুমছে প্যায়ার কিতনা,
এ হাম নেহি জানতে, মাগার জি নেহি সাকতে
তোমহারে বিনা…”
গ্রীষ্মর ঠোঁটে আনমনেই সুরের মূর্ছনায় পুরো পৃথিবীর গতিপথ পাল্টে ফেললো। মার্জান নিজেও হকচকিয়ে উঠলো। অবাক নয়নে হাজারো প্রশ্ন ঘিরে ধরলো ওঁকে। জেঁকে বসলো ছয় বছর আগের রাতের সেই চারদেয়ালে বন্দি ঘরটির মাঝে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত রাত। মনে পড়ে গেলো সেই ঘরটির নরম তুলতুলে বিছানা। মনে পড়ে গেলো আসবাবপত্রে ভরা ঘরটির জানালার পাশের উইনজারের টং টং করে বেজে ওঠা ধ্বনি। মনে পড়ে গেলো আঁধারিয়া অম্বরের আবছায়া আলোয় দেখা সেই মানব মূর্তি। মার্জান এবার নিজেকে ধাতস্থ করলো। গ্রীষ্মের সাথে করাবে ওঁ মৃণালের ডি এন এ টেস্ট। যদি মিলে যায়? তাহলে কি করবে মার্জান? গ্রীষ্মকে মেনে নিবে? নাকি দূরে সরিয়েই রাখবো? আচ্ছা যদি জানতে পারে মৃণাল ওঁর ছেলে, কেঁড়ে নিবে না তো? মার্জানের মনে কোনে হুহু করে উঠলো। শুকনো ঢুক গিলে তাকালো পাশের দীর্ঘকায় দেহের লোকটিকে। গ্রীষ্ম নিজেও তাকিয়ে দেখছে মেয়েটিকে। কতটা বিচলিত ওঁর চোখ জোড়া। সবই কি ওই রাফানের জন্য? আচ্ছা মার্জানের মনে কি গ্রীষ্মের জন্য এক ফোঁটা অনুভূতি নেই? গ্রীষ্ম আর মার্জানের ভাবাবেগ চুড়ান্তয় পৌঁছাবার আগেই একটি আইল্যান্ডে পৌছে গেলো ওঁরা। নাবিক এসে জানালো,

” স্যার আমরা পৌঁছে গেছি!”

দু’জনের ধ্যান ভাঙ্গল। নেমে গেলো তারা। আই ল্যান্ডের ডান পাশ ধরে বিশাল এক অট্টলিকা তৈরি করেছে তায়ানশাহ্। এই আইল্যান্ডে মুলত তারই। চাতুর্দিকের সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। মার্জান গ্রীষ্মের পিছনে হাটা ধরলো। বিশাল বড় গেইটে সামনে এসে দাঁড়াতেই ছুটে এলো কিছু গার্ডস। গ্রীষ্মকে দেখেই সম্মান জানালো ওঁরা। মার্জান ভ্রু কুচকে ফেললো। তায়ানশাহ্ আর গ্রীষ্মের কোনো কানেকশন নেই তো? কিন্তু মনের খুঁতখুঁতো ভাবটা মনে চাপা দিয়ে পিছনে হাটতে লাগলো ওঁ।

ভেজা মাটির তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রাস্তার পাতা-লতার মর্মর শব্দ গা শিহরণ করিয়ে দেবার জো। মার্জান এই সুবহে সাদেকের হালকা প্রভাতে কদম মিলাচ্ছে গ্রীষ্মের। বাড়ির কাছে পৌঁছাতে কর্ণপাত হলো, মিষ্টি-মধুর একটি ধুন..

” ওরে পিয়া…. রে হায়… ওরে পিয়া….”

তালের সাথে তাল মিলিয়ে ভেসে আসছে নুপুরের নিক্কণ আওয়াজ দূর দূর পর্যন্ত ভেসে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্ম দরজায় নক করলো। থেমে গেলো সব। সেই ধুন, নুপুর রুণুঝুণু শব্দ। যেন কাকপক্ষী ছিলো না কখনো। মার্জানের মুহুর্তে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই নিস্তব্ধতা শরীর এক থমথমে ভাব দিয়ে গেলো। অথচ সাবলীল ভঙ্গি গ্রীষ্মের। পেটের মাঝে কথা চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলো ওঁ,

” কে নাচ করছিলো?”

গ্রীষ্ম একপলক তাকালো। কিছু বললো না। পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। মার্জান নিজেও চুপ। তখনি গেইট খুললো বয়স্ক এক সাদাসিধা লোক। গ্রীষ্মকে দেখেই চওড়া হাসিতে বলে উঠলো,

” গ্রীষ্ম বাবা যে, ছয় বছর পর এলে যে? ভুলেই গেছো আমাদের?”

গ্রীষ্ম প্রত্যুত্তর বলে উঠলো,
” আপনাদের তায়ান বাবা যে বড্ড ভালোমানুষ, তাই আর আশা হয় না।”

লোকটির মুখ চুপসে গেলো। আর কথা বাড়ালো না। গ্রীষ্ম আর সময় ব্যয় না করে হাটা ধরলো ভিতরের দিকে। হল ঘরটা খুব বড়… রাজা জমিদারের আমলের বসার ঘরের মতো বড় আর সাজানো গোছানো। গ্রীষ্ম ভিতরে ঢুকেই চেচাঁলো,

” তায়ান?? তায়ান??”

তায়ান বা*র সাইডেই ছিলো। গ্রীষ্ম এসেছে খবর সে আগেই পেয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে হাতে একটা ড্রিংসের গ্লাস নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে লাগলো ওঁ। পরনে ওঁর সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট। শার্টের তিনটি বোতাম খোলা। দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে ওঁকে। গ্রীষ্মকে দেখে চওড়া হাসি ফুঁটে উঠলো,

” আজ আমার বাড়ির রাস্তায় ভুল করে পা ফেলে দিলি মনে হচ্ছে? ”

গ্রীষ্ম গম্ভীর। দাম্ভিকপূর্ণ মুখ খানায় আরো কয়েক গুন গম্ভীরতা ভেসে উঠলো। এদিক ওদিকের কথা না বলে আসল কথায় চলে এলো,

” আই নিড এ অ্যান্টিডোট। ”

তায়ান সোফায় হেলে বসে পড়লো আরামে বলল,

” আমি কি করতে পারি?”

” তুই দিবি আমায়?”

” আর তা কেনো?”

গ্রীষ্ম হেসে ফেললো। পাশের সোফায় বসে পরে বলল,

” তুই দিতে বাধ্য ”

পরক্ষণেই দু’জন দু’জনকে খেয়ে ফেলবো লুকে দেখতে লাগলো। মার্জান এদের এভাবে রাগে একে অপরকে দেখতে দেখে নিজেই ভয় পেতে লাগলো। আল্লাহ মালুম, একে ওপরকে যেন এখনু খু*ন করে ফেলে। মার্জান ঢুক গিললো। এখন ওঁ বুঝতে পারছে কতটা ভয়ানক লোকের সাথে থাকছে শীপ্রা। মার্জানের মস্তিষ্কে শীপ্রার কথা আসতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো তাকে। হটাৎ করে ওঁর চোখ যা দেখলো মার্জানের পায়ের নিচে থেকে যেন মাটি সরে গেলো নিমিষেই। মার্জান “শীপ্রা” বলে এক চিৎকার করে ছুটলো সেখানে। মার্জানের চিৎকার চমকে উঠলো গ্রীষ্ম নিজেও। কিন্ত ভাবলেশহীন তায়ানশাহ্ ড্রীংকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে।

শীপ্রা ঘুমিয়ে ছিলো। ক্লান্ত শ্রান্ত ওঁর মুখ। হাত পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধা। তার উপর সোনালি খাঁচার ভিতর বন্দী ওঁ। মার্জানের চিৎকার ওঁর ঘুম ভেঙে যায়। মার্জানকে এখানে দেখে অবাক কন্ঠে বলে উঠে,

” মার্জান? তুই এখানে কি করছিস?”

মার্জানের ডাগর ডাগর চোখ জোড়ায় জল টলমল করছে। শীপ্রার হাত দু’টি ধরে বলে উঠলো,

“এ’কি হাল তোর? নিশ্চিত ওঁ ল*ম্পট আর ই*তরটা তোকে আঁটকে রেখেছে?”

শীপ্রা ফিকে হাসলো। মার্জানের চোখের জল মুছে দিবার চেষ্টা করে বলে উঠলো,

” নাহ্ মার্জান আমি আমার কর্মের ফল ভোগ করছি।”

মার্জান এবার জল ছেঁড়ে দিলো দু’চোখের। তায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” আপনার মা-বাবা আপনাকে বুঝি এসব শিখিয়েছে? একটা মেয়ের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয় জানেন না? খুলুন ওঁকে।”

মার্জানের কথায় তায়ান শাহ্ চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো। হাতের গ্লাসটুকু শক্ত করে চেপে ধরলো। গ্রীষ্ম তা দেখে এবার নিজে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে পড়লো। তা দেখে রাগে তপ্ত হলো আরো তায়ানশাহ্,

” আমার বাবা-মাকে এর মাঝে টানবে না মিস”

মার্জান শোনবার পাত্র নয়,

” কেন টানবো না হাজার বার টানবো, ১০০ বার টানবো। ওনাদের ও জানা উচিত? তাদের সন্তান কেমন কাপুরষ হয়েছে।”

তায়ান গ্লাসটি ছুঁড়ে মারলো। উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে এসে দাঁড়ালো খাঁচার সামনে। খাঁচা থেকে বের করে আনলো শীপ্রাকে। শীপ্রা ঘাবড়ে গেছে আরো। শীপ্রাকে মার্জানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলে উঠলো,

” জিগ্যেস করো তাকে, এই সব ট*র্চার পাওয়ার যোগ্য সে কিনা? ওঁর তো সুভাগ্য আমি ওঁকে জেলে পাঠায়নি।ওঁর পরিবারকে ধং*স করিনি।”

মার্জান চোখ বড় বড় করে চাইলো শীপ্রার দিকে। তখনি পিছন থেকে গ্রীষ্ম থমথমে কন্ঠে বলে উঠলো,

” তায়ান তোর এইসব উদ্ভট কান্ডের জন্যই আজ আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছে। তোকে আমি সেদিন ও বলেছিলাম আজও বলছি, এই মেয়েটির সাথে তুই এসব ঠিক করছিস না।”

তায়না চিল্লালো,

” বাপ-মা আমার হারিয়েছে তোর না। ওঁর জন্যই আজ আমার জীবনে জোয়ার-ভাটা।”

শীপ্রা ফোপাঁতে লাগলো। মার্জান একে অপরকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। গ্রীষ্ম আর তায়ান বন্ধু? এজন্যই বুঝি ওঁরা প্রায় একই রকম? শীপ্রার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” শীপ্রা? সত্যি করে বল? হচ্ছে কি এসব?”

শীপ্রা মাটিতে বসে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে ওঁর,

” মার্জান আমি খু*ন করেছি। আমি খু*ন করেছি।”

মার্জান বরফের মতো জমে গেলো। শীপ্রার দিকে হাজার প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। শীপ্রা বলতে শুরু করলো,

” আমি যখন ঢাকায় আসি? যে আঙ্কেল আমায় নিয়ে আসে উনি আমাকে দু’জন ব্যক্তিকে চাপে ফেলে জঙ্গলের রাস্তায় আটকাতে বলে। আমি সেদিন টাকার জন্য আর আমার চাচা-চাচির পেশারে ওই কাজ করে বসি। আঙ্কেল আমার সামনে ওঁনাদের খু*ন করে। আমি কিছু করতে পারিনি। ওই আন্টি আমার কাছে ভিক্ষা চেয়েছিলো তাঁদের বাঁচাতে কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। আঙ্কেল আমাকে বের করে দিয়ে ছিলো। বিশ্বাস কর মার্জান আমি চেয়েছিলাম বাঁচাতে। ওই ঘটনার পর থেকে আমি রোজ রোজ মরছি। আমি চেয়েছিলাম। এই ঘটনার ছ’মাসের মাথায় আঙ্কেল আমাকে তায়ানশাহ্ এর কাছে বেঁচে দেয়। আর কাল জানতে পারি ওই যুগল ওঁর বাবা-মা ছিলো। এরপর আর ইচ্ছে নেই এই পৃথিবীতে থাকার। তায়ান যা করবে আমি মাথা পেতে নিবো জান। আমি যে বড় পাপ করেছি। খুব বড় পাপ।”

বলেই মুখ চেঁপে কাঁদতে লাগলো শীপ্রা।

” তায়ান?”

একটি মেয়েলী কন্ঠ ভেসে আসতেই সবাই চুপ হয়ে গেলো। অন্ধ একটি মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়ালো।ওঁ তায়ানের বোন আর লাভের মা মালতি গ্রীষ্ম তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো,

” দিদিভাই, কেমন আছো?”

মালতির ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠলো,
” এত বছর পর দিদিভাইকে মনে পড়লো?”

” আমি জানতাম না তুমি দেশে ফিরেছো। কিন্তু এখানে পা দেবার পর তোমার গলার সুর শোনে বুঝলাম তুমি এসেছো।”

মালতি হাসলো। তায়ানের উদ্দেশ্য এবার বলে উঠলো,

” তায়ান, তুই মেয়েটিকে ছেঁড়ে দে।”

কন্ঠে আদেশের সুর পেয়ে তায়ান মাথা নোয়ালো। বলে উঠলো,

” সরি দিদিভাই। আমার প্রাণ চাইলে দিতে পারি কিন্তু ওঁকে ছাড়বো না।”

বলেই মাটি থেকে টেনে তুললো শীপ্রাকে। শীপ্রা বাধা দিলো না। মার্জান বার কয়েক পিছনে ডাকলো কিন্তু বাঁধা দিলো গ্রীষ্ম। বলে উঠলো,

” ডেকে লাভ নেই মার্জান। ওঁ কারো কথা শুনবে না।”

মালতি এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,
” ভাইটা আমার কি থেকে কি হয়ে গেলো। তোমরা বসো। আমি তোমাদের চা-পানির ব্যবস্থা করছি। ”

বলেই উনি ভিতরে চলে গেলেন। মার্জান তখনো ভ্রমের মাঝে আছে। এত কিছু হয়ে গেছে এ ছ’বছরে ভাবতেও পারছে না মার্জান।

কিছু সময়ের ব্যবধানে আবার ফিরে এলো তায়ানশাহ্। ঠোঁটের কোনে শয়তানী হাসি ঝুলে আছে। বলে উঠলো,

” এবার আসল কথায় আসি? অ্যান্টিডোট চাইতো তোর? গেইম খেলতে হবে আমার সাথে একটা…”

ভ্রুকুচকে ফেললো গ্রীষ্ম,

” কি গেইম?”

তায়ানশাহ্ একটি ব*ন্দুক এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

” এই বন্দুকে একটি গুলি আছে। আর সামনের ফ্লাওয়ার পটে একটি গোলাপ। তুই যদি ওঁটা শুট করতে পারিস? অ্যান্টিডোট তোর। না হলে তোর গার্ল ফ্রেন্ড আজ রাতের ডিনার হবে আমার কুকুরদের। তবে শর্ত হচ্ছে তোর চোখ বাঁধা থাকবে।

মার্জান বিস্মিত হলো। এমন একটা সিচুয়েশনে এসব? তায়ানশাহ্ কি মজা করছে? গ্রীষ্ম দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,

” তায়ান তুই তোর লিমিড ক্রস করছিস..”

তায়ান হাসলো,

” নো ব্রো। ভেবে নে তোর ভালোবাসার পরিক্ষা চলছে ”

গ্রীষ্ম বিনা বাক্য ব্যয় করে নিয়ে নিলো। চোখ বেঁধে শুট করতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো মার্জান। কিন্তু অবাক কান্ড। গ্রীষ্মের হাতের বন্দুকে কোনো গুলিই ছিলো না । তা দেখে আবারো ভ্রুকুচকায় ওঁ। তা দেখে হেসে লুটোপুটি খেলো তায়ান। বলল,

” তোর ভালোবাসা সফল হোক।”

আধঘন্টার মাঝেই ওঁর বের হলো আইল্যান্ডে থেকে। মাঝ নদীতে আসতেই গ্রীষ্মের ফোনে তায়ানের মেসেজ এলো,

” নিজ ভালোবাসা বাঁচাতে পাড়লে, বাঁচা এবার গ্রীষ্ম”

গ্রীষ্ম এই মেসেজে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লো। ওঁর জানা ছিলো, তায়নশাহ্ এতো সহজ যেতে দিবে কাউকে! নাহ্। মোটেও না। পরক্ষণেই টিপ টিপ কিছু শব্দ হতে শোনা গেলো স্প্রীট বোর্ডে। বুঝতে বাকি রইলো না বো*ম লাগিয়েছে তায়ান। সপ্তপর্ণ শ্বাস ছাড়লো গ্রীষ্ম। মার্জানের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো,

” মার্জান? আমার উপর বিশ্বাস আছে তোমার? ”

মার্জান চকিতে বলল,
” একদম না।”
গ্রীষ্ম ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,

” তাহলে ম*রো এই মাঝ সাগরে।”

মার্জান চোখ বড় বড় করতেই, গ্রীষ্ম আবার বলে উঠলো,

” বো* ম লাগিয়েছে তায়ান।”

মার্জান ভীত গলায় বলে উঠলো,

” আমি মরতে চাই না। আমার মৃণালের কি হবে আমি মরে গেলে?”

এক ঝাঁক দুশ্চিন্তা চেপে ধরলো ওঁকে। কিন্তু গ্রীষ্ম সময় দিলো না। ঝাপ দিলো মাঝ সাগরে। পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে গ্রীষ্ম জিজ্ঞেস করলো,

” ঠিক আছো?”

মার্জান ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলো,

” ফূর্তিতে আছি।”

গ্রীষ্ম হেসে ফেলো। তা দেখে মার্জান আরো বলল,

” এভাবেই সাঁতরে পাড়ে যাবার ইচ্ছে? ”

গ্রীষ্ম রোমান্টিক গলায় বলে উঠলো,
” আপাতত তোমাতেই ভাসতে চাই।”

মার্জান পানিতেই লাথি বসালো গ্রীষ্মের পিছনে। গ্রীষ্ম হতভম্ব,

” তুমি আমায় লাথি মারলে?”

মার্জান রেগে মেগে বলল,
” তো কি করবো? আদর করবো? সোহাগ করবো? কে বলেছে, এমন তাঁরছিড়া লোকেদের সাথে মিশতে? ভুগতে হচ্ছে এবার?”

গ্রীষ্ম হেসে বলে উঠলো,

” তায়ান বরাবরই এমনি।”

মার্জান তেতে উঠে বললো,

” বড্ড গুনোগান হচ্ছে।”

তায়ান মার্জানের দিকে তাকিয়ে আবারো হাসলো। তবে রহস্যময় সেই হাসি। মার্জান তা দেখে ভেঙ্গচি কাঁটলো। মনে মনে ভাবলো,

” ভাগ্যিস ওঁরা সাঁতার জানতো। আর স্পিড বোর্ড এর লাইফ সাপোর্ট জেকেট ছিলো। নয়তো কখন তলিয়ে যেতাম। ”

কিন্তু মার্জান আর পাড়ছে না। গ্রীষ্মকে কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,

” কি করবো আর আমি আর পাড়ছি না।”

গ্রীষ্ম বলে উঠলো,

“সামনে একটা ছোট্ট দ্বিপ আছে। ওই পর্যন্ত যেতেই হবে।”

মার্জান মাথা নাড়লো। কিন্তু ওঁ শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে লাগলো। গ্রীষ্ম তা বুঝতে পেরে আগলে নিলো ওঁকে। আরো কিছুক্ষণ সাঁতার কাঁটার পর দ্বিপে এসে পড়লো ওঁরা। দ্বিপটা ছোট খাট জঙ্গলের মতো। যার পাশেই বিশাল পাহাড়। মার্জানকে পাশেই বড় গাছের নিচে শুয়ে দিলো ওঁঁ। ক্লান্ত হয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো পাশে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে যেন সাগরের নিচে। সূর্যের পরন্ত আলোয় গায়ে লাগছে মার্জানের। মার্জানের সফেদ মুখ, ফেকাসে ঠোঁটে উপচে পড়ছে লালিমা। গ্রীষ্ম এমন এক দৃশ্যে ঘোরে চলে গেলো। আনমনায় ডুব দিলো অতল গহ্বরে মতো তলিয়ে যেতে লাগলো মার্জানের ঠোঁট জোরায়…..।

চলবে,

……🥺