ঝরা স্রোতধারা পর্ব-০৬

0
300

#ঝরা_স্রোতধারা
#পর্ব_৬
Tahrim Muntahana

১৬.
অনেকক্ষণ হলো অজান্তা রিয়াব একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। অজান্তাই জোর করে নিয়ে এসেছে তাকে। আজকে অজান্তা রিয়াবকে তার কাজিন এবং কাজিনের বউ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। সেও আজ প্রথম দেখবে নতুন বউকে। বিয়ের সময় সে এব্রুড ছিলো। ছবি দিতে চেয়েছিলো কিন্তু অজান্তা চেয়েছে সরাসরি দেখবে তাই আজকে আসা। একটু পর রেস্টুরেন্টে ঢুকলো একটি ছেলে মেয়ে। মেয়েটির মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না তার ভেতর কি চলছে। হাটার গতিতে মনে হচ্ছে সে নিজের পা টাকে বহু কষ্টে এগিয়ে নিচ্ছে। একসময় অজান্তাদের সামনে আসতেই রিয়াবের মুখের আকৃতি পাল্টে গেলো। এতক্ষণ যে মুখটাই বিরক্ত ফুটে উঠছিলো এখন সে মুখটাই স্নিগ্ধ লাগছে। সামনে যে তার প্রেয়সী দাড়িয়ে আছে। এইতো সেদিন দেখা হলো। কেমন শুকিয়ে গেছে। অনিন্দিতা চোখ বড় বড় করে দেখছে রিয়াব অজান্তা কে। তার বুকের ভেতর কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে যদি বুঝতো কেউ। কিন্তু রিয়াব সে তো জানে তার প্রেয়সীর মনের ভেতর কি চলছে। অনিন্দিতার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আর অজান্তা হা করে তাকিয়ে আছে অনিন্দিতার দিকে। রিয়াব কিছু বলতে নিবে তার আগেই মনে পড়ে গেলো সেই অপ্রিয় সত‍্যি। আজ অনিন্দিতা অন‍্যকারো। ওই দুচোখের পানিটা তাকে বড্ড পোড়াচ্ছে। রিয়াবের আর সহ‍্য হলো না। উঠে দাড়িয়ে কাউকে কিছু না বলে হাটা ধরলো। অনিন্দিতা ছলছল নয়নে রিয়াবের যাওয়া দেখছে। সে কিছুই করতে পারছে না। মানুষটাকে দেখছে তবুও একটু ছুঁয়ে দিতে পারছে না, একটু কথা বলতে পারছে না। অজান্তার সামনে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায় না বলে অনিন্দিতা তাহিব কে বললো সে গাড়িতে বসলো তাহিব যেন আসে। ভালো লাগছে না তার। তাহিবকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না হাটা ধরলো। ওরা দুজন যেতেই অজান্তা তাহিবের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। হাসির কারণটা কি!

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই এক বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে কোথায় যেন নিয়ে গেলো। তাল সামলাতে না পেরে হাতের অধিকারি মানুষটাকে আকড়ে ধরলো অনিন্দিতা। বুক টিপটিপ করছে। হৃদয়ের অস্বাভাবিক স্পন্দন টা জানান দিচ্ছে তার খুব কাছে রয়েছে সে। ফট করে মাথা তুলতেই পরিচিত সেই মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মানুষটা ভালো নেই অনিন্দিতা জানে। অনিন্দিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না এমন করার কারণ। রিয়াব কিছুক্ষণ অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল,

শরীরের অবস্থা এমন কেন? এই অনিন্দিতাকে তো আমি দেখতে চাইনি। তাহলে কেন দেখতে হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়েছো, ঘুম বাদ দিয়েছো। তুমি কি ভুলে গেছো তুমি অন‍্যকারো বউ এখন। আমাকে নিয়ে পাগলামি গুলো বাদ দাও অনিন্দিতা। নিজের স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো। তাহিব খুব ভালো।

রিয়াবের কথায় অনিন্দিতার ঠোঁট অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। কিছু বলতে চায়ছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে গলাটা কেউ চেপে ধরেছে। রিয়াবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো অনিন্দিতা। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি বজায় রেখে বলল,

সব সময় আমার সাথেই এমন হয় কেন বলতে পারবে? সেই কিশোরি বয়স থেকে তোমাকে ভালোবাসি। মনকুঠিরে একটাই নাম যত্ন করে রেখে দিয়েছি। রিয়াব! হা তোমার নামটাই হৃদয়ে ধারণ করেছি। সেখানে তাহিব নামক মানুষটাকে বসানো ইমপসিবল নয়? নাকি আমাকে তোমার সেসব মেয়েদের মতো মনে হয় যারা ঘন্টাই ঘন্টাই প্রেমিক পাল্টায়, শেষ বড়লোক ছেলে দেখে বিয়ে করে নেয়? বলো বলো কোনটা মনে হয়? আচ্ছা আমার কি মন নেই? কষ্ট হয় না? তাহিবের ওই ঘর আমার কাছে আগুনের লাভার মতো লাগে। হ‍্যাঁ এটা ঠিক তাহিব আর পাঁচটা স্বামীর মতো আমাকে কিছু বলেনা। বিয়ের প্রথম রাতে আমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেনি। একসাথে ঘুমাতে বলেনি। উনার আর আমার মাঝে বড্ড ফারাক। তবুও ওই মানুষটার জন‍্য আমি আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছি। ঘৃণা না করলেও ওই মানুষটাকে আমি পছন্দ করিনা। এখন বলবে? বিয়ে হালাল সম্পর্ক! কিন্তু মনের বিরুদ্ধে সম্পর্ক রাখা, বা ভালোবাসা একপ্রকার অভিনয় ই। যা আমি পারিনা। পারিনা একদম ভালো থাকার অভিনয় করতে। কল্পনায় তোমাকে নিয়ে ভাবি আমি। সংসার সাজাই। কল্পনায় ছুঁতে পারি তোমাকে। কিন্তু বাস্তবে পারিনা। কতটা কষ্ট হয় বুঝতে পারো তুমি? নাকি আমার ভালোবাসার কোনো মূল‍্য নেই তোমার কাছে। আমি কি তোমার সাথে পরকীয়া করছি? হা সেদিন শপিংমলে ভরা মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরাটা দৃষ্টিকটু লেগেছে, তার উপর স্বামীর সামনে পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরা! আরো দৃষ্টিকটু। কিন্তু আমি যে এখন বর্তমান সমাজের দৃষ্টির বাইরে আছি। পারিনা নিজের আবেগ কে সামলাতে। পারিনা স্বামীর সাথে সুখে সংসার করার অভিনয় করতে। ওই মানুষটার জন‍্য আমার কোনো ফিলিংস আসে না। মানতে পারিনা তাকে নিজের পাশে। তো মরে যেতে বলছো আমাকে। সহ‍্য করতে পারবে? আমি পারছি না তো। তুমি পারছো? নিজে ভালো আছো? তাই দয়া করে আমাকে ভালো থাকতে বলো না। আমি ভাসতে চাই কল্পনায়। তোমার কল্পনায় ভাসতে চাই! সবাই মানিয়ে নিতে শিখে নি রিয়াব। ভালো থেকো! পারলে চলে যাও দৃষ্টিসীমার বাইরে। তাহলে আর সেদিনের মতো ভুল হবে না। বড্ড পোড়ায় আমাকে!

গাড়ির দিকে হাটা ধরলো অনিন্দিতা। তার যাওয়ার দিকে ছলছল নয়নে অনিমেষ চেয়ে আছে রিয়াব। তার অনিন্দিতা বড্ড কষ্ট আছে। সে তো চেয়েছিলো অনিন্দিতা কিছু টা ভালো থাকুক। সুখে সংসার করে নয়, নিজের জন‍্য কিছুটা ভালো থাকুক। কিন্তু অনিন্দিতার পক্ষে ভালো থাকা সম্ভব নয় সে বুঝতে পারিনি। তার পরীটাকে কত কষ্ট দিয়ে ফেলছে। নিজেও আর দাড়ালো না। কিছু একটা মনে করে এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে।

গাড়ির কাছে আসতেই একটা চিরকুট চোখে পড়লো অনিন্দিতার। ভ্রু কুচকে এলো তার। এমনিতেই ভালো লাগছে না, খুব করে কান্না পাচ্ছে সেখানে চিরকুটের কৌতুহল তার মাঝে এলো না। নিরস মুখে চিরকুটটা খুলল,

রিয়াবের থেকে দূরে থাকো। তোমার, তাহিব, রিয়াবের জন‍্য এটা মঙ্গলজনক। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছো এখনো। যা আমার সহ‍্য হয়না। তাই দূরে থাকো। নাহলে সব শেষ করে দিবো আমি। তোমার সংসার, জীবন সব!

চিরকুটটা পড়ে তাচ্ছিল্য হাসলো অনিন্দিতা। যে চিরকুটটা দিয়েছে সে হয়তো জানেনা সংসার তো দূরের থাক সে এখন নিজের জীবনের পরোয়াও করে না। হঠাৎ ই ম‍্যাসেজের টুং শব্দে নড়েচড়ে উঠলো অনিন্দিতা। এতেও আগ্রহ নেই। সবকিছুতেই বিষাদ। ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পড়লো,

আমার হৃদয়হরিণীর চোখ থেকে যে পানি ঝরিয়েছে তাকে ভালো থাকতে দিবো না! এক আত্মার দুজন মানুষকে আলাদা করে, হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে; তারা কি সুখে থাকতে পারবে? না, পারবে না! ভয় নেই যে তোমার সে তোমারই আছে! আর তুমি তো অন‍্যকারোর হয়েও আমারি আছো!

অনিন্দিতার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে বুঝে গেছে ম‍্যাসেজ টা কে পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রথম কথাগুলোর অর্থ বুঝলো না। তাহলে কি এসবের পেছনে অন‍্যকেউ আছে। প্ল‍্যান করে করেছে সব! কেনই বা করবে? মাথায় এলো না অনিন্দিতার। চিরকুটটা নিজ ব‍্যাগে ঢুকিয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। পুরোনো ক্ষত টা আজ আবার তাজা হয়েছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে!

১৭.
কেটে গেছে ১৫ দিন। অজান্তার সাথে রিয়াবের সম্পর্কটা আরো গাঢ় হয়েছে। অজান্তা রিয়াবকে সবসময় আগলে রাখে।আগের আগলে রাখার থেকে এই আগলে রাখাটা রিয়াবের কাছে ভিন্ন লাগে। এখন অজান্তার চাহনীটাও কেমন উদ্ভট লাগে রিয়াবের কাছে। কিরকম অধিকার ফলাতে চায়। রিয়াব ওসব পাত্তা দেয়না। কিন্তু কিছুদিন ধরে রিয়াব বোনের মতিগতি বুঝতে পারছে না। সবসময় অজান্তার গুনগান করে মাথা খেয়ে ফেলছে। বোনকে কিছুই বলতে পারে না। তাই চুপ চাপ শুনে যায়। আস্তে আস্তে কোম্পানিটারও উন্নতি হচ্ছে। একটা বড় অঙ্কের ডিল পেয়েছে। ভালো ভাবে ফুলফিল করতে পারলে কোম্পানি আগের পজিশনে ফিরে আসবে। যা একমাত্র সম্ভব হয়েছে রিয়াবের জন‍্য।

কিছুদিন ধরে রিয়াব খেয়াল করছে তার বোন তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে। যেমন সেদিন রাতে অফিস থেকে ফিরেই বোনের ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ পেলো। কার সাথে যেন রেগে কথা বলছিলো। তার আসার শব্দ শুনেই চুপ হয়ে যায়। কোনো সমস‍্যা হয়েছে কি? নাকি কেউ ডিস্ট্রাভ করছে। এসব মনে করে রিয়াব ভেবে রেখেছে বোনকে ফলো করবে আজ। তাই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বোনের কোচিং এর পাশে দাড়িয়ে আছে। একটু পর রিহার ছুটি হলো। রিহা বের হতেই একটা ছেলে দৌড়ে তার কাছে আসলো। রিহা বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো। ছেলেটি রিহার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। ভালোবাসার অনুনয় করছে। কিন্তু ওইযে রিহা পণ করেছে এসব থেকে দূরে থাকবে। রিহা জারি দিয়ে কিছু বলবে তার আগে ছেলেটি বলে উঠলো,

প্লিজ প্লিজ রিহুপাখি একটা সুযোগ দাও না আমায়। আই প্রমিজ একটুও দুঃখ পেতে দিবো না। তোমার সরল চাহনীর মায়ায় পড়ে গেছি।

রিহা ছেলেটির চোখের দিকে তাকালো। নাহ স্বচ্ছ চোখটাই ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। রিহা নিজেও ছেলেটির উপর দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রত‍্যেকদিন দাড়িয়ে থাকা। ম‍্যাসেজে ভালোবাসার কথা জানানো। ফোন করে জ্বালাতন করা। এমন করলে কে না মায়ায় পড়বে। কিন্তু সে কোনো ভাবেই তার ভাইকে কষ্ট দিতে পারবে না। তাই আর সময় ব‍্যয় না করে রিকশাই চেপে বসলো। বোনের কাজে রিয়াবের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। পরক্ষণে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে একটু খারাপ লাগলো। সে তো জানে ভালোবাসা হারালে কেমন লাগে। এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির কাঁধে হাত রাখলো। বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে রইলো ছেলেটি। রিয়াব কে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো। ছেলেটি কিছু বলবে তার আগেই রিয়াব বলে উঠলো,

ভালোবাসো মেয়েটিকে? বিয়ে করতে পারবে?

ছেলেটি চমকে তাকাল রিয়াবের দিকে। রিয়াব মুচকি হেসে একটি কার্ড হাতে দিয়ে বললো,

কাল দুপুরে বাবা-মাকে নিয়ে চলে এসো!

রিয়াব আর দাড়ালো না চলে আসলো। ছেলেটিকে একসাগর প্রশ্নের মুখে ফেলে।
পরদিন সকালে রিয়াব অজান্তাকে ফোন দিয়ে ডেকে এনেছে। রিয়াবের বিশ্বাস আজ ছেলেটি তার বাবা মা নিয়ে আসবে। কালকে সারাদিন ছেলেটির খুঁজ নিয়েছে রিয়াব। নাম মাহদী হাসান। কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা রিটায়ার্ড, সেনাবাহিনী অফিসার ছিলেন। বর্তমানে ছেলেটি ভালো কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি করছে। রদিও চাকরির বয়স কিছু মাস রিয়াব না করেনি। বোনকে ভালো ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলে সে শান্তিতে মরতে পারবে অন্তত। সকাল থেকে এসবের ব‍্যবস্থায় করছিলো। রিহাকে রিয়াব সব বলেছে। ভাই এর খুশিতেই রিহা খুশি তাই না করেনি।

রিয়াবের বিশ্বাস ই ঠিক হলো। দুপুরের দিকে ছেলেটি বাবা মা নিয়ে হাজির। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। রিয়াব তাদের যত্নসহকারে গেট থেকে নিয়ে আসলো। রিহাই সব রান্না করে রেখেছে। অজান্তা গোজগাজ করে নিজেও ভালো একটি শাড়ি পড়ে হালকা সেজেছে। হালকা চেষ্টা রিয়াবের জন‍্য। রিয়াব একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অজান্তার মন বিষণ্ন হয়ে গেলো। আজ ও ধরা দিলো না রিয়াব। ও তো ঠিক অনিন্দিতার মতো করে সেজেছে আজ যেভাবে রিয়াব পছন্দ করতো তবুও রিয়াবের চোখ ওর দিকে ১ মিনিট স্থায়ী হলো না। মেহমানদের দেখে মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে কথা বলতে লাগলো। মাহদীর মা একসময় বলে উঠলো,

তুমি রিয়াবের স্ত্রী?

মায়ের কথায় মাহদী চমকে রিয়াবের দিকে তাকালো। সে যে বিশ্বাস করেনি মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। অন‍্যদিকে কথাটি শুনেই অজান্তার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। রিয়াবের স্ত্রী! কথাটি মনে মনে তিন-চার বার আওড়ালো। কি সুন্দর মায়া মাখানো শব্দদুটো। এতদিন এত পরিশ্রম তো এর জন‍্যই! অজান্তা কিছু বলবে তার আগেই রিয়াব বলে উঠলো,

রিয়াবের স্ত্রীর জায়গাটা একমাত্র অনিন্দিতা নামক মেয়েটার। ভাগ‍্যক্রমে সে এখন অন‍্যজনের অর্ধাঙ্গিনী! কিন্তু মন যে কথা শুনে না!

অজান্তার ভেতরটা একদম জ্বলে উঠলো। সেই সাথে মনের কোণায় রাগ এসেও ভর করলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে মুচকি হেসে কথা বলতে লাগলো। মাহদী যেন আকাশ থেকে পড়লো রিয়াবের কথায়। কি শুনছে সে। এও সম্ভব!
রিয়াব অজান্তার মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। সে তো এটায় চায়! কষ্ট পাবে! সবাই কষ্ট পাবে! রিহা কে নিয়ে আসলো অজান্তা। তারা খুঁজ নেওয়ার সময় পায়নি। সেটি রিয়াব জানে তাই রিয়াব নিজেই বলা শুরু করলো,

আমার বোন এতিম। মাথার উপর বাবা-মা’র ছায়া নেই। ভাইয়ার টাকা নেই! এই বাংলোটা দেখছেন কোম্পানি থেকে দিয়েছে। নিজের বলতে কিছুই নেই। ভেবে দেখবেন!

রিয়াবের কথা শুনেই মাহদীর বাবা বুঝে গেলো রিয়াব কোন ধাঁচের মানুষ। তাই তিনি বললেন,

আমাদের আর খুঁজ নিতে হবে না। যা বুঝার বুঝে গেছি। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হোক।

রিয়াব তবুও মুচকি হেসে বলল,

রিহা সংসারের সব কাজ জানে। নিপুণতর সাথে সব কাজ করতে পারে। তাই আপনাদের সেরকম সমস‍্যা হবে না। আমি শুধু বলবো আমি আমার বোনের জন‍্য একজন বাবা-মা চাই শশুড়-শাশুড়ি না। একটু ভালোবেসে দেখবেন আমার বোন হাজারগুন ভালোবাসা ফেরত দিবে। বোনটা অনেক কষ্ট সহ‍্য করেছে জীবনে। অভাবে বড় হয়েছে। কোনো আবদার ই সেরকম পূরণ করতে পারিনি। বোন আমার আবদার করতেই ভুলে যেত। কিন্তু আমার বোন আমার আত্মা। ওর জন‍্য আমি আমার নিজের সুখ কেন নিজের জীবনটাও বিসর্জন দিতে পারি। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ আমার বোনটাকে সুখে রাখবেন! নাহলে যে ব‍্যর্থ ভাইয়ের তকমাটা আমার নামের পাশে আজীবন থেকে যাবে।

রিয়াবের চোখ ছলছল করছে। এই বুঝি পানি গড়িয়ে পড়বে। রিহা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও পারলো না রিয়াবের বুকে হামলে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। হালকা কান্না থেমে আসতেই কান্না গলায় রিহা বলল,

আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না ভাইয়া। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তুমি জানো না তোমাকে ছাড়া আমি খাইনা। আমার বিয়ের দরকার নেই। তুমি থাকলেই হবে। আমি কোথাও যাবো না। যাবো না। বিয়ে করবো না আমি। কে রান্না করে দিবে! বুয়ার হাতের রান্না যদি ভালো না হয়। আমি যাবো না কোথাও।

ভাই বোনের এরকম ভালোবাসায় সবার চোখই ভিজে এলো। অজান্তার বুকে দৃশ‍্যটা ধাক্কা খেলো। মনের ভেতর কিছু একটা নিয়ে গিল্টি ফিল হচ্ছে। পাত্তা দিলো না সে। মাহদী এবার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

আপনার বোনকে আমি বিয়ে করবো কিন্তু একটা শর্তে!

মাহদীর বাবা-মা চমকে উঠলো। কিসের শর্ত! তাদের ছেলে কি যৌতুক চাইবে নাকি? একজন সরকারি অফিসার হয়ে নিতিবিরুদ্ধ কাজ! সে কিছুতেই মানবে না। রিয়াব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহদী মুচকি হেসে বললো,

আপনাকেও আমার ভাই হয়ে আপনার বোনের সাথে যেতে হবে! রাজি থাকলে ১ চাপুন নাহলে উঠছি! নো মোর ওয়ার্ড অনলি হা অথবা না!

মাহদীর বাবা-মার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আকাঙ্ক্ষার সহিত তাকিয়ে আছে দুজন। রিয়াব নিজের অবস্থান থেকে উঠতেই মাহদী ঝটপট করে উঠে সোফার পেছনে চলে গেলো। রিয়াবের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। রিয়াব এগিয়ে যেতেই মাহদী দৌড়ে ডাইনিং টেবিলের চারপাশ ঘুরতে লাগলো। সারা রুম টা দৌড়াদৌড়ি করে একসময় রিয়াব মাহদীকে ধরে ফেললো। আর সবাই বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ওরা দুজন কি পূর্ব পরিচিত!

রিয়াব মাহদীর কান টেনে ধরতেই মাহদী মুখ কুচকে বলে উঠলো,

ভাইয়া দিস নট ফেয়ার। হবু বউয়ের সামনে এইভাবে ইজ্জতের ফালুদা করো না প্লিজ।

মাহদীর কথায় সবাই বুঝে গেলো এরা আগে থেকেই একে অপরকে চিনে। রিয়াব মাহদীর কান ছেড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

কতদিন পর দেখা তোর সাথে। এখনো আগের মতোই আছিস।

তুমি পাল্টে গেছো ভাইয়া!

মাহদীর কথায় রিয়াব বুঝতে পারলো কোন দিকে ইঙ্গিত করেছে। তাই হালকা হেসে বলল,

কালকে তো শকট খাইয়ে দিয়েছিলাম। কেমন লাগলো? আমার বোনের পেছনেও ঘুরা হচ্ছে।

উফ ভাইয়া আমি আসলেই শকট হয়েছিলাম। তোমাকে এতদিন পর দেখে। আবার তাড়াতাড়ি চলে গেলে তাই আজকে চলে এসেছি।

মাহদী এতটুকু বলে থামলো। এবার বাবা-মার দিকে তাকিয়ে বলল,

আম্মু-আব্বু তোমাদের বলেছিলাম না রিয়াব ভাইয়ার কথা যে আমাকে ভার্সিটি ছুটির পর পড়াতো তাও বিনা পয়সায়। এই সেই রিয়াব ভাইয়া।

মাহদীর আব্বু আম্মু শিতল চোখে পর্যবেক্ষণ করে নিলো রিয়াবকে। নিজের ছেলের মুখে অনেক শুনেছে রিয়াবের কথা। আর কোনো বাঁধা’ই রইলো না বিয়েতে। এতকিছু হচ্ছে কিন্তু অজান্তা এখনো বুঝতে পারছে না। রিয়াব যেন অজান্তার মনোভাব বুঝতে পারলো। তাই হালকা হেসে বলল,

তুই চিনিস না মাহদীকে। তুই জানতি না ওকে পড়াতাম আমি। কিন্তু অনিন্দিতা জানতো।

কথাটি কানে যেতেই অজান্তার বুকটা ধক করে উঠলো। এই অনিন্দিতা না থেকেও সর্বক্ষেত্রে রয়ে গেছে। হঠাৎ করেই মাহদী রিয়াবের হাত ধরে বলে উঠলো,

তোমাকে আগেও বলেছিলাম মেসে না থেকে আমাদের বাড়িতে থাকতে। তখন তুমি শুনোনি। কিন্তু আজ শুনতেই হবে। না হলে বউ সহ বড় শালাকে তুলে নিয়ে যাবো।

মাহদীর কথায় সবাই হেসে দিলো। রিয়াব এত ভালো পরিবার কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না। আর ছেলে পূর্বপরিচিত, তার বোন খুব সুখে থাকবে। এসব ভেবে মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। সবার মুখেই প্রাপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো সামনের শুক্রবার। মধ‍্যে তিনদিন আছে। স্বল্প পরিসরে বিয়েটা সম্পন্ন হবে। কোনো আনুষ্ঠানিকতা হবে না।

১৮.
রিয়াবের অফিসে আজ সন্ধ‍্যায় পার্টি। ডিলটা ফুলফিল হয়ে গেছে। কোম্পানি আবার আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে। সব সম্ভব হয়ে রিয়াব আর অজান্তার জন‍্য। দুজনে এই দুটো মাস নাওয়া খাওয়া ভুলে পরিশ্রম করে গেছে। রিয়াবের খেয়াল রাখার জন‍্য রিহা আর অজান্তা সবসময় প্রস্তত ছিলো। রিহার বিয়ে হয়ে গেছে। রিয়াব বাংলো ছেড়ে রিহাদের সাথেই থাকে। নতুন পরিবার পেয়েছে। মাহদীর মাকে মা বলে ডাকতে রিয়াবের বড্ড মায়া লাগে। কেমন মা মা গন্ধ আছে উনার শরীরে। সব মিলিয়ে রিয়াব রিহার জীবন সুখে কাটছে। কথা হচ্ছে সত‍্যিই কি রিয়াব সুখী! রাতের আধারে বুকের মাঝখানটাই যে হাহাকার করে উঠে। হৃদপিন্ডটা মনে হয় কেউ খুবলে তুলে নিতে চায়। কি অসহ‍্য যন্ত্রণা। এর থেকে রেহাই তো একমাত্র মৃত‍্যই সম্ভব।

চলবে….?