ঝরা স্রোতধারা পর্ব-০৭

0
266

#ঝরা_স্রোতধারা
#পর্ব_৭
Tahrim Muntahana

১৮.
অজান্তার সকাল থেকেই মনটা কেমন করছে। আজ তার প্লেন হলো রিয়াবকে প্রপোজ করবে। রিহা তাই বলেছে। আর কতদিন এভাবে চলবে! এবার তো এগোনো দরকার। অজান্তার মনে হয় এই কয়দিনে রিয়াবের মনে কিছুটা হলেও জায়গা করতে পেরেছে। রিয়াবের চাহনী তো সে ইঙ্গিত ই দিচ্ছে। পাপাও বলেছে আজ রিয়াবকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। রিয়াব নিশ্চয় না করবে না। অনিন্দিতাও নেই এখন, বোনের কথা ভেবে হলেও রিয়াব রাজী হবে। এসব ভেবেই ফুরফুরা মেজাজে রেডি হতে চলে গেলো। বিকেল হয়ে গেছে। ওইদিকটাও সামলাতে হবে।

ফ্রেশ হয়ে এসে। সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে নিলো। ম‍্যাচিং গহনা পড়ে আয়নার নিজেকে বার বার দেখতে লাগলো অজান্তা। নিজের উপরে নিজেই ক্রাশ খাচ্ছে। রিয়াব নিশ্চয় ওর দিকে ড‍্যাবড‍্যাব করে তাকিয়ে থাকবে! লাজুক হাসি ফুটে উঠলো। একসময় অজান্তা জোরে হাসতে লাগলো। অসাধ‍্য কিছু সাধন করার যেমন আনন্দ হয় অজান্তার আজ তেমন আনন্দ হচ্ছে। ফোন বের করে একজনকে টেক্সট করে দিলো। আজ পার্টিতে এতদিনের পরিশ্রমের ফল পাবে সে। এতদিনের তৈরীকৃত সব পরিকল্পনা আজ একজনের সম্মতিতে শেষ হবে!

শেষ কি হবে! হলেও কি অজান্তার প্রেক্ষিতে হবে? না তার উল্টোটা হবে?

১৯.
অন‍্যদিকে মনমরা হয়ে গাড়িতে বসে আছে অনিন্দিতা। সেই বিয়ের দিন থেকে অনিন্দিতার মুখে হাসি দেখেনি তাহিব। একবার দেখেছিলো সেদিন। ওইবার ই প্রথম ওইবার লাস্ট। বড্ড আফসোস হয় এখন তার। কেন করতে গেলো কাজটা। কিন্তু সেও তো অপারগ ছিলো। তার যে কিছুই করার ছিলো না। সেও তো প্লেনের একটা গুটি মাত্র। তাহিব কি মনে করে যেন গাড়িটা থামালো। অনিন্দিতার কোনো ভাবাবেগ হলো না ওইভাবেই বসে রইলো। যেন কোনো এক জড়বস্তু। তাহিব অনিন্দিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে গালে হাত রাখলো। অনিন্দিতা শুধু একপলক তার দিকে তাকালো। কিছুই বললো না। তাহিব হাত সরিয়ে নিয়ে আচমকা কাঁদতে শুরু করলো। এবার অনিন্দিতা কিছুটা ভড়কে গেলো। ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে রইলো তাহিবের দিকে। যেন আশ্চর্য কিছু দেখেছে। একসময় তাহিব নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। অনিন্দিতা তখনো নির্জিব। দিনে দিনে মেয়েটা এবনরমাল হয়ে যাচ্ছে। অনুভূতিশূন‍্য! সবসময় চুপটি করে থাকে। হাজার কথা বললেও মুখ থেকে কথা বের করানো যায় না। এরজন‍্য যে তাহিব দায়ি তা ভালো করেই জানে সে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়।

হঠাৎ করেই তাহিব ফোনটা বের করে টেক্সট পাঠালো একজনের কাছে। তারা যাচ্ছে অজান্তাদের পার্টিতে। যদিও যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না তার। কিন্তু ওই যে সে অপারগ, তাকে যেতেই হবে হাজার অনিচ্ছা সত‍্যেও। কিন্তু তাহিব জানে আজ পার্টিতে কিছু ঘটবে।
কিন্তু কি ঘটবে?

২০.
সন্ধ‍্যে সাতটা বাজে। সবে গেস্ট আসা শুরু করেছে। রিয়াব অনেক আগেই চলে এসেছে। হঠাৎ ফোনের টুং শব্দে কিছুটা বিরক্তিভাব ফুটলো মুখে। তবুও কি যেন ভেবে ফোনটা হাতে নিলো। সাথে সাথেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো,

আসছি আমরা। আজকেই সবকিছুর অবসান হোক। আর পারছি না। আর কত সহ‍্য করবো! এবার শাস্তি দেওয়ার পালা।

কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো রিয়াব। মনের মধ‍্যে কি চলছে একমাত্র সেই জানে।সবকিছুর তদারকি করে বসতেই দেখলো অজান্তা এসেছে। মুচকি হাসলো সে। মেয়েটি আজকে সেজেছে দারুণ ভাবে। অপ্সরির থেকেও কম লাগছে না কিন্তু এই রূপ তো রিয়াব কে ঘায়েল করতে পারে না। রিয়াব যে একটা মেয়েতেই আসক্ত। যতদিন যায় আসক্তি বাড়ে। অজান্তা এসেই রিয়াবের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলো। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। রিয়াব অজান্তার আচরণ দেখে হাসলো। আজকে তাহলে এই খেলার শেষ হবে!

একটু পরেই রিহা মাহদী ওরা আসলো। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে কথা বলতেই রিহার চোখে পড়লো দরজা দিয়ে সেই চেনাপরিচিত মেয়েটি ঢুকছে। রিহা থমকালো! ও ভুল দেখছে কিনা বিশ্বাস করতে পারছে না। একসময় ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরলো। এতেও অনিন্দিতার ভাবাবেগ হলো না। রিহা কেঁদে দিয়েছে। অনিন্দিতা রিহাকে সামনে এনে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলো। তাহিব অবাক হয়ে দেখছে। অনিন্দিতা যে রিয়াব, রিহার কাছে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তার বুঝতে বাকি নেই।
অনিন্দিতা তাকিয়ে আছে রিয়াবের দিকে কিন্তু রিয়াব একবারো তার দিকে তাকায় নি। অজান্তার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, কখনো হাত ধরছে, আবার কখনো চুল ধরে টেনে দিচ্ছে। যা অনিন্দিতার বুকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। তবুও চুপ করে চেয়েই রইলো। জীবন তার সাথে খেলা খেলছে। কয়েকটা মাসে ভাগ‍্য তার জীবন থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে আবার অনেক কিছুই দিয়েছে। রিয়াব, রিহা নামক ভালোবাসা, সুখ, শান্তি গুলো কেড়ে নিয়েছে, তার পরিবর্তে একসাগর কষ্ট ফেরত দিয়েছে ভাগ‍্য তাকে। আচ্ছা ভাগ‍্যের উপর নিয়ন্ত্রণ চলে? ভাগ‍্য কি কথা শুনে? ভাবনা ছেড়ে রিয়াবের দিকে তাকালো। সে এখনো অজান্তা নামক রমনীকে নিয়ে ব‍্যস্ত। আচ্ছা সে কি এগিয়ে যাবে? কিই বা বলার আছে তার!

পার্টিতে সবাই নিজেদের মধ‍্যে আনন্দ করছে। হটাৎ ই লাইট অফ হয়ে যেতেই সবাই একপ্রকার চমকে উঠলো। সবার মধ‍্যেই চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। ইতিমধ‍্যেই খানিকটা হইচই শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মাঝখানটাই আবার লাইট জ্বলে উঠলো। সবাই একদম চুপ হয়ে গেলো। মাঝখানটাই রিয়াব দাড়িয়ে আছে তার সামনে হাটু গেড়ে বসে আছে অজান্তা। রিয়াব চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। অজান্তা মুচকি হেসে বলল,

জীবন তো কারোর জন‍্য থেমে থাকে না। আমাকে একটা সুযোগ দিবি। ভালোবেসে ফেলেছি তোকে। হারাতে পারবো না। একদম শেষ হয়ে যাবো। একটা সুযোগ দিয়ে দেখ, অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না। ভালোবাসবি?

অনিন্দিতা ব‍্যাথাতুর নয়নে তাকিয়ে দেখছে শুধু।রিয়াব ফুলটা হাতে নিলো। সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। দুজন ভালোবাসার মানুষ এক হলে সবাই খুশি হয়। কিন্তু অনিন্দিতার চোখ আজও বাধা মানছে না। সবাই আড়চোখে তাকে দেখলেও তার এসবে কোনো পরোয়া নেই। তার মনের মধ‍্যে কি চলছে সেটা য‍দি কেউ জানতো!
রিয়াব ফুল নিতেই অজান্তা খুশিতে ঝাপটে ধরলো তাকে। রিয়াব আড়চোখে অনিন্দিতাকে দেখে নিলো। ওই চোখের পানি তাকে বড্ড পীড়া দেয়। অজান্তাকে ছাড়িয়ে নিলো নিজের থেকে। তখন অজান্তার বাবা এসে রিয়াব কে উদ্দেশ‍্য করে বললো,

তাহলে বিয়ের ডেট এনাউন্স করে দিই কি বলো?

রিয়াব ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

কার বিয়ে?

অজান্তা চমকে তাকালো রিয়াবের দিকে। শুধু অজান্তা নয় সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রিহা এগিয়ে এসে বলল,

কি বলো এসব ভাইয়া। তোমার আর অজান্তা আপুর বিয়ের কথা বলছে। এইমাত্র না ফুল গ্রহন করলে। মানে তুমিও ভালোবাসো আপুকে। তাহলে বিয়ে করবে না?

রিহার কথা শুনে রিয়াব হো হো করে হেসে দিলো। যেন সে কোনো মজার জোকস শুনেছে। হাসি থামছেই না। হাসির দাপটে শরীরটা মৃদ নড়ছে। অনিন্দিতাও একটু এগিয়ে এসেছে। একসময় রিয়াব হাসি থামিয়ে ফুলটা নিয়ে অনিন্দিতার সামনে দাড়ালো। ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এ চোখে আজ শুধু কষ্ট দেখতে পাচ্ছে। যে চোখে তাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন খেলা করতো সেই চোখ আজ হরানোর ব‍্যাথা প্রকাশ পাচ্ছে যা রিয়াবের রাগকে আরো বাড়িয়ে দিলো। অনিন্দিতার হাতে ফুল গুজে দিয়ে ঠাসসস করে থাপ্পড় বসালো অজান্তার গালে। সবাই চমকে দু’পা পিছিয়ে গেলো। অজান্তার বাবা রেগে কিছু বলবে তার আগেই রিয়াব বলে উঠলো,

আপনাকে আমি প্রচন্ড সম্মান করি আংকেল। তাই যা হচ্ছে হতে দিন।

অজান্তার বাবা আর এগোনোর সাহস পেলো না। সে যেমন তার মেয়েকে চিনে, রিয়াব নামক ছেলেটিকেও চিনে। কোনো কারণ ছাড়া কিছু করবে না। তাই চুপচাপ দেখতে লাগলো। রিয়াব অজান্তার সামনে দাড়িয়ে বলল,

কেন করলি এমনটা? তুই তো ভালো করেই জানতি এই রিয়াবের জীবনে অনিন্দিতা কি! বল জানতি না। তাহলে কেন দুটো আত্মাকে আলাদা করে দিলি?

অজান্তা কথা বলছে না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে তার সুখ আবার কেড়ে নিলো। এতকিছু করলো তবুও সে সফল হলো না। আর চুপ থাকতে না পেরে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

হ‍্যা হ‍্যা আমিই করেছি সব। তোর থেকে অনিন্দিতাকে আলাদা করেছি আমি। সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে তোকে ভালোবাসি। তুই আমার ভালোবাসা বুঝিস নি। অনিন্দিতার সাথে রিলেশন গেলি যা আমার জন‍্য বড্ড কষ্টদায়ক। একসময় ঠিক করলাম দেশ ছেড়ে তোদের জীবন থেকে চলে যাবো। চলেও গেলাম। কিন্তু থাকতে পারছিলাম না। তোদের ভালোবাসাময় সময় গুলো আমার কাছে রাতের নিস্তব্ধতার মতোই বিভিষিকাময় লাগতো। অসহ‍্য যন্ত্রণা হতো। আমার নামের মতোই আমার ভালোবাসাটাও তোর কাছে অজান্তাই থেকে গেলো। মনের মধ‍্যে জেদ চেপে বসলো। ঠিক করলাম যেভাবেই তোকে আমার করবো। এরমধ‍্যেই হুট করে তাহিব আমাকে একটি মেয়ের ছবি পাঠালো তাকে সে ভালোবাসে। সে মেয়েটি আর কেউ না অনিন্দিতা। আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। প্লেন করলাম। তাহিবের সাথে অনিন্দিতার বিয়ে হলেই তুই আমার। কিন্তু অনিন্দিতার পিছু নিতে নিতে তোর সম্পর্কে তাহিব জেনে গেলো। পিছু ফিরে যেতে চাইলো। দিইনি আমি। অনিন্দিতার ক্ষতি করে দিবো বলে হুমকি দিতে থাকলাম। একসময় অপারগ হয়ে রাজি হয়ে গেলো তাহিব। আর তুইও কিছুতেই অনিন্দিতাকে ছাড়তে রাজি না। অনিন্দিতার পরিবার তোকে ইমোশনাল ব্ল‍্যাকমেইল করলেও তুই অনিন্দিতা কে ছাড়ার কথা ভাবিসনি। দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। যেকোনো উপায়ে তোকে আমার চাই ই চাই। গুন্ডা দিয়ে হুমকি দেওয়ালাম। অনিন্দিতাকে না ছাড়লে রিহাকে কিডন‍্যাপ করবো। র‍্যাপ করার হুমকিও দিয়েছি। রিয়াব থেমে গেলো। বোন ওর কলিজা আমি জানতাম। এটাই কাজে লাগিয়েছি। অবশেষে অনিন্দিতা রিয়াব আলাদা হলো। আমি বাবার অফিসে চাকরি পাইয়ে দিলাম যাতে তোর কাছাকাছি থাকতে পারি। রিহাকে বোঝালাম তোর জীবনে আমাকে দরকার। বুঝে গেলো। এর পর শত চেষ্টা করি রিয়াবের মনে জায়গা করার। পারছিলাম না। ওই অনিন্দিতা না থেকেও রয়ে গেছে। একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। শেষের দিকের আচরণে মনে হলো তুইও দুর্বল আমার প্রতি কিন্তু না আমি ব‍্যর্থ। আমি এত কিছু করেও ব‍্যর্থ। আর ওই অনিন্দতা কিছু না করেও রিয়াবের মনকুঠিরে রয়ে গেলো।

মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো অজান্তা। সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছে সব। রিহার নিজেকে অশার লাগছে। হাতপা নাড়াতে পারছে না। তার জন‍্য তার ভাই নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে দিয়েছে। অজান্তার কান্না দেখে রিয়াব আবার হেসে উঠলো। খানিক টা হেসে বললো,

তুই কি ভেবেছিলি এতসব করবি জানতে পারবো না। গুন্ডা দিয়ে হুমকি দেওয়ার পরেই তো বুঝেছিলাম কিছু চলছে। ষড়যন্ত্র চলছে দুজনকে আলাদা করার। একদিন একটি চিরুকুট আসলো। যেখানে লিখা ছিলো তোর কথা। তোর হারিয়ে যাওয়ার কারণ ই বলে দিবে আসল সত‍্য। আগের কোম্পানিতেও জব কনফার্ম হয়েছিলো। কেন্সেল করে তোরটাই নিলাম। তুই ও না বুঝে সেদিন ই ট্রান্সফার হলি। তোর সাথে মিশতে শুরু করলাম। তোর সামনে অনিন্দিতার কথা বলে কষ্ট দিতাম। বড্ড জ্বালা করতো না? বোনের জন‍্য চিন্তা হতো। তাই বিয়ে দেওয়ার ব‍্যবস্থা করলাম। এরপর মূল পয়েন্টে এসে তোর সাথে একটু নরম হওয়ার অভিনয় করলাম। ব‍্যাস তুই বুঝে গেলি আ’ম টোটালি এডিকটেড ইউ! রিয়েলি! আমি তো এক অনিন্দিতাতেই বার বার মরি! সেখানে তুই? আজ আমি জানতাম তুই প্রপোজের প্লেন করেছিস। তোকে হাজারটা কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে রাখার জন‍্য আজকের নাটকটা। বলেছিলাম আমাদের যে একসাথে থাকতে দিলো না তাকে সুখে থাকতে দিবো। তাহিব তোর কথায় করলেও একটা কথা কিন্তু লুকিয়ে গেছে সে। সে আগে থেকেই জানতো আমাদের কথা। কিন্তু এটা জানতো না আমাদের ভালোবাসাটা খুব প্রখর। আর খুঁজ নিয়ে সে জেনেছিলো তোর আর আমার বন্ধুত্বের কথা। কিন্তু তোর মনে যে এসব ছিলো জানতো। তাই অনিন্দিতার ছবি তোকে দিয়েছিলো আমাকে পরীক্ষা করার জন‍্য। আমি সত‍্যিই অনিন্দিতাকে ভালোবাসি কিনা! একসময় সে বুঝে গেলো রিয়াব-অনিন্দিতা দুজন আত্মা। তাই পিছু হটে গিয়েছিলো। কিন্তু তুই দিস নি। ব্ল‍্যাকমেইল করেছিস। কিন্তু আরেকটা কথা কি জানিস তাহিব যে কাজটা বিয়ের পর করেছে। আমাকে সত‍্য খুঁজতে সাহায‍্য করেছে সে কাজ করার অনেক সময় ছিলো। বিয়ের আগেই সে এই পদক্ষেপ নিতে পারতো। কিন্তু হয়তো বুঝতে পারেনি, নয়তো বুঝেই করেছে! সে প্রত‍্যক্ষ দোষী না হলেও পরোক্ষ ভাবে সে দোষী। সে তার পরোক্ষ ভাবে শাস্তি পাচ্ছে। নিজের বউ সারাক্ষণ অন‍্য একজনকে নিয়ে মেতে থাকলে কার সহ‍্য হয়? আর তুই এতকিছুর পরেও আমাকে না পেয়ে, সবার সামনে অপমানিত হয়ে ধুকে ধুকে কষ্ট পাবি বাকিটা জীবন। এটাই তোর জন‍্য শাস্তি! আমার মনে অনিন্দিতা নামক মেয়েটার স্থান শীর্ষস্থানে।

রিয়াবের কথায় অনিন্দিতার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার রিয়াব তার ই আছে।
তাহিব মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। রিয়াবের কথা গুলো একদম সত‍্য। সে প্রত‍্যক্ষ দোষী না কিন্তু পরোক্ষ সে দোষী। তার শাস্তিও সে পাচ্ছে। হয়তো সারাজীবন পেতে হবে। কিন্তু একজনের মনে কোনো গিল্টি ফিল নেই। অজান্তা কান্না থামিয়েছে অনেক আগেই। রিয়াবের কথায় রেগে তেড়ে এলো অজান্তা;

সব কিছু এই মেয়েটির জন‍্য হয়েছে। ও রিয়াবের জীবনে আসার পর থেকেই রিয়াব আমাকে ভুলে গেছে। ছাড়বো না ওকে আমি। শেষ করে দিবো।

কথা গুলো বলেই ভারি একটি ফুলদানি অনিন্দিতার দিকে ছুড়ে মারলো। রিয়াব আতকে উঠে ওকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু নিজেকে সরাতে পারেনি, ফুলদানিটা সোজা কানের পাশে লেগে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। আতকে উঠে সবাই। অজান্তা নিজেও আতকে উঠে। সে রিয়াবের কিছু হোক চায়নি। অনিন্দিতার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। ভালোবাসার মানুষটাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে কে ঠিক থাকতে পারে। অনিন্দিতা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসে। রিয়াবের মাথাটা নিজের কোলে রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। অনিন্দিতার কান্নায় যে কেউ বলে দিবে কতটা ভালোবাসা রয়েছে।

রিহার বর্তমানে নিজেকে অনুভূতিশূণ‍্য লাগছে। একমাত্র তার জন‍্য তার ভাই এত কষ্ট সহ‍্য করেছে। ভাবতেই নিজেকে দোষ দিতে লাগলো। অজান্তা এগিয়ে আসবে তার আগেই রিহা খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেললো। ঠাসস ঠাসস করে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলো নরম গালে। একসময় কান্না করতে করতে মাটিতে বসে পড়লো রিহা।

কেন করলে এমনটা। তোমাকে তো আমি বড় বোন ভেবেছিলাম। আমার ক্ষতি করার কথা ভাবলে। আমার থেকে আমার ভাইকে কেড়ে নিলে। কেন? কেন আমার ভাইয়ার জীবনটা এমন করলে?

মাহদী এসে রিহা কে টেনে তুললো। রিয়াব কে তাহিব হসপিটাল নিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি। নাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অনিন্দিতা এক ধ‍্যানে রিয়াবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়াবের দেহটা নিস্তেজ হয়ে আছে একদম। তাড়াতাড়ি অপারেশন সেন্টারে নিয়ে গেলো। চেকআপ করে ডক্টরের মুখ মলিন হয়ে এলো। ডক্টর বের হতেই মাহদী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই ডক্টর মলিন মুখে বললো,

আমাদের কিচ্ছু করার নেই। এর আগে উনি একবার মাথার জখম করেছিলেন। হয়তো উঁচু স্থান থেকে পড়ে গিয়েছিলেন বা শক্ত কিছুর সাথে বারি খেয়েছিলেন আবার আজকে সেখানেই লেগেছে। রক্তজমাট বেধে গেছে। একটু পর থেকে নার্ভ কাজ করা বন্ধ করে দিবে। উনার হাতে আর মাত্র দু’এক ঘন্টা সময় আছে!

চমকে উঠলো সবাই। মাহদীকে ধরে বিলাপ করছে রিহা। মাহদীর নিজের অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে। এতদিন বড় ভাইয়ের জায়গাটাই বসেছিলো রিয়াব। খবর পেয়ে ইতোমধ‍্যে মাহদীর বাবা-মা ও চলে এসেছে। তারা দুজনো কাঁদছে। আরেক ছেলে হয়ে উঠেছিলো রিয়াব। অজান্তাকে তাহিব পুলিশে দিয়েছে। ওর মতো জগন‍্য মেয়ের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর কোনো অধিকার নেই। তাহিব তাকিয়ে আছে অনিন্দিতার দিকে। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তাহিবের সাহস হচ্ছে না সামনে যাওয়ার। তারও যে খুব কষ্ট হচ্ছে। আর অনিন্দিতা শুধু ভাবছে ডক্টরের সেই কথাটি এর আগেও একবার জখম হয়েছিলো। অনিন্দিতার মনে পড়লো সেই দিনটার কথা..

একদিন ঘুরতে গিয়েছিলো দুজন। রিয়াব মানা করলেও অনিন্দিতার জোরাজুরিতে গিয়েছিলো। বখাটে কিছু ছেলে ওদের ডিসট্রাব করছিলো। একসময় অনিন্দিতা সহ‍্য করতে না পেরে ওদের সাথে ফাইট করতে বলেছিলো রিয়াবকে। প্রেয়সীর মন রক্ষার্থে রিয়াব সেদিন গিয়েছিলো কিন্তু ফাইট করতে না বুঝাতে। কিন্তু এত অপ্রিতীকর কথা বলছিলো রিয়াবের সহ‍্য হয় না। হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। না পেরে একসময় ছেলেগুলো রিয়াব কে জোরে একটা ধাক্কা দেয় যার ফলে ছিটকে গাছের সাথে বারি খায় সে। লোকজন জড়ো হওয়ার আর কিছু করতে পারেনি বখাটেরা। তখন রিয়াব নিজেকে স্ট্রং দেখালেও পরে বাড়ি ফিরে অসহ‍্য ব‍্যাথায় অজ্ঞান হয়ে যায়।

এসব মনে করেই অনিন্দিতার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো। সেদিন সে জোর না করলে এমন কিছুই হতো না। হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে কেবিনে ঢুকে পড়লো সে। তাহিবের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো……

চলবে….?