ডাকপাড়ি পর্ব-১০+১১+১২

0
228

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১০
#আফনান_লারা
________
আনাফের কথাগুলো সব সঠিক। মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে কেবল ভাবছে কি করে এত কিছু সে জানলো।তাও এমন নিঁখুত ভাবে!
মেয়েটাকে চুপ করে থাকতে দেখে আনাফের মা যিনি আগে থেকেই চটে ছিলেন তিনি এবার মুখ খুললেন।জোরালো কন্ঠে বললেন,’এসব কি তবে সত্যি?আনাফ তুই জানতি এই মেয়েটার সম্পর্কের কথা?’

আনাফ মুচকি হাসছে শুধু।মিসেস প্রভা উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন।মেয়েটার মায়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেও গেলেন ওখান থেকে।আনাফ ও চললো মায়ের পিছু পিছু।
মেয়েটার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আনাফ এই বিয়েটা করতোনা।তার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই একেবারে।
———
সজীব ডিনার সামনে রেখে বসে আছে।সারথির কথাগুলো কানে বাজছে অনবরত। বিয়ের দু বছরে সে এই কথা বলেনি,হঠাৎ আজ বলে ফেললো।অর্থাৎ ওকে সামনের দিকে এড়িয়ে চললে আরও প্রশ্ন করবে।কপাল এক হাত দিয়ে টিপতে টিপতে অন্যহাতে সজীব খাবারের প্লেটের উপর চামচ নাড়ছিল।
তার পাশেই চেয়ার টেনে বসলো একটি মেয়ে।গায়ে লাল রঙের গাউন,চুল ছেড়ে দেয়া,ঠোঁটে কড়া রঙের লিপস্টিক।মেয়েটা সজীবের ঘাড়ে হাত রেখে বললো,’কি এমন হয়েছে যে আমার সজীবের মন খারাপ?আবার মাথা ধরাও?’

সজীব মাথা তুললোনা,যেমন করে চোখ বন্ধ করে ছিল তেমন করেই আছে।মেয়েটা ওর ঘাড়ে চাপ দিয়ে একটু কাছে এসে বসলো।কাজের লোকেরা সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেছে তখন।সজীব ঘাড় থেকে মেয়েটার হাত সরিয়ে বললো,’লেভেন লিভ মি এলন’

‘আমি অনেক কষ্ট বাবার চোখ এড়িয়ে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।আজ রাতটা আমাদের একসাথে কাটানোর কথা সজীব।বিয়েও করছোনা,লিভ ইনেও থাকতো চাইছোনা।ডোন্ট টেল মি, তুমি ঐ অন্ধ মেয়েটার জন্য দূর্বল হচ্ছো’

সজীব মাথা তুলে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলো লেভেনের দিকে।তারপর ঠাস করে টেবিলে হাত রেখে বললো,’আমি তোমার আর তোমার বাবার হাতের পুতুল না।আমার ব্যাক্তিগত একটা জীবন আছে।তুমি এখন যেতে পারো,আমাকে একা থাকতে দাও’

‘আমি পরেরমাসে বাংলাদেশ যাচ্ছি।
উর্মির বিয়েতে যাবোই।তুমি গেলে যাবে,না গেলেও আমি যাবো।বাধা দিতে পারবেনা’

কথাটা বলে লেভেন চলে গেছে।সজীব সামনের প্লেট আর গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো।বিশাল থাই গ্লাসের দেয়ালের ওপারে একটা সাগর।সাগরের পাশেই সজীবের বাংলো।
এই গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে শত ঢেউয়ের সাগরটা দেখা যায়।এখন রাত বলে অন্ধকার কিন্তু সাগরের স্রোতের উথাল পাতালের আওয়াজটা কানে এসে লাগছে সজীবের।গ্লাস হটিয়ে বের হয়ে গেলো সে।
হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের খুব কাছে এসে বালিতে বসে গেলো।লেভেনের সাথে সজীবের প্রেমের সম্পর্ক তিন বছরের।
মা বাবাকে অনেক হাতজোড় করেও সে তাদের বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি।কারণ লেভেন খ্রিস্টান। বিদেশে পড়ালেখা করতে এসে সজীবের সাথে লেভেনের প্রেম হয়েছিল।
এরপর বাবা মায়ের জোরজবরদস্তিতে সারথিকে দেখতে গিয়ে যখন সে জানতে পারে ও অন্ধ তখন সে রাজি হয়ে যায়।সে চেয়েছিল যাকেই বিয়ে করবে তার যেন কোনো না কোনো দূর্বলতা থাকে।সেই দূর্বলতাকে অস্ত্র বানিয়ে সে জীবন কাটাবে। যেমনটা এখন করে আসছে।
লেভেন আর ওর ইচ্ছে ছিল বিদেশে এসে বিয়েটা সেরে নিবে,তাছাড়া লেভেন বিদেশেই থাকে।বাংলাদেশে ও মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করে।ওখানে ওর দেশের বাড়ি।
কিন্তু আজকাল সজীবের মনে হয় সারথিকে সে ধোকা দিয়ে ঠিক করছেনা মোটেও।তার ইচ্ছে করে ওকে সব সত্যিটা জানিয়ে দিতে।কিন্তু সাহস কুলিয়ে পারছেনা।
এদিকে লেভেনের বাবা শর্ত দিয়ে বসে আছেন,যতদিন না সজীব একশো কোটি টাকার মালিক হচ্ছে ততদিন লেভেনের সাথে তিনি ওর বিয়ে দিবেননা।
লেভেনের বাবা এখনও জানেন ও না যে সজীব বিবাহিত
জানলে জীবনেও বিয়েটা হতে দিবেননা।সজীব ব্যাংক ব্যালেন্স বৃদ্ধি করার জন্য দুইটা বছর ধরে খাটছে।কিছুতেই একশোর কাছাকাছি পৌঁছোতে পারছে না।ব্যবসায় যেমন লাভ আছে তেমন লস ও আছে।সজীব নতুন বলে অনেকবার লস খেয়েছে।যদিও এখন আর লস খায়না।কিন্তু আগে যা হয়েছিল তার ঘাটতি পোষণ করতেই মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে।লেভেন অপেক্ষায় আছে কবে সজীবের সাথে ওর বিয়ে হবে।লেভেন মডার্ণ একটা মেয়ে।তার চিন্তাধারা বেশ অন্যরকম।যেখানে মেয়েরা বিয়ের আগে একসাথে থাকার বিরোধিতা করে সেখানে হেভেন পারেনা চব্বিশ ঘন্টা সজীবের বেডরুমে শুয়ে থাকে।সজীবকে কাছে পেতে যা করা লাগে সে করেছে।একদিন তো জামা ই খুলে ফেলেছিল ওর সামনে।কিন্তু সজীব তার চেয়েও অন্যরকম একটা মানুষ।সে এসবের ধারের কাছেও ঘেঁষেনা।সারাদিন একটা চিন্তা নিয়ে বসে থাকে।সারথিকে সে ফোন দেয়না এটা ঠিক কিন্তু সে সবসময় ওর কথাই ভাবে।একদিন তো হেভেনের ছোঁয়া পেয়ে মুখ ফুটে সারথির নাম নিয়েছিল।
সে নিজেও জানেনা কিসের উপর দিয়ে তার জীবন চলছে।
—–
সারথি রাতে কিছু খায়নি।উর্মি আর সজীবের মায়ের জন্য কোথাও শান্তিতে একটু নিরবে বসে থাকতে পারছেনা। ওরা সারথির মন ভাল করার জন্য একবার একটা করে।কিন্তু মন ভাল যে একমাত্র সজীবকে দিয়ে হবে সেটা ওনাদের কে বুঝাবে।
বারান্দায় বসে আকাশের দিকে বিপুল অভিমানের চোখে চেয়ে ছিল সারথি,যদিও এই আকাশ তার কাছে অন্ধকার।
তাদের যেদিন বিয়ে হয় সেদিন ছিল ভরা পূর্নিমার রাত।কথাটা সজীব বলেছিল।
বাসর ঘরের দরজা লক করে কথাটা বলে সে সোজা বারান্দায় চলে গিয়েছিল।ঠিক এই জায়গায়।সারথি অনেকক্ষণ বিছানায় বউ সেজে বসেছিল সজীবের অপেক্ষাতে। ও আসছেনা দেখে নিজে নিজে বিছানা ছেড়ে দেয়ালে হাত রেখে সজীবের নাম ধরে ডাক দিয়ে এগোলো।সজীব তখন পেছনে ফিরে বললো,’আমি তোমার পেছনের দিকটায়।সামনে না’

সারথি ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর কাছে আসলো।সজীব এক দৃষ্টিতে সারথির দিকে তাকিয়ে ছিল।লাল শাড়ী আর সোনার গহনায় তাকে নতুন বউ লাগছিল ঠিক কিন্তু লিপস্টিক লেপটে যাওয়ায় কেমন যেন লাগছিল।সজীব ওর লেপটানো লিপস্টিক হাত দিয়ে মুছতে যেতেই সারথি পিছিয়ে বললো,’কি করছেন!’

‘আমি খারাপ কিছু করতে চাইনি।তোমার লিপস্টিক লেপটে আছে।সেটা মুছে দিতেই!!!’

সারথি নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে বললো,’একটা মশা বসেছিল।তার কামড়ে চুুলকানিতে অতীষ্ঠ হয়ে ঘষাঘষি করছিলাম তাই হয়ত!
আচ্ছা আপনি এখানে কি করছেন?’

‘চাঁদ দেখি।বললাম না ভরা পূর্ণিমার চাঁদ’

‘চাঁদ অনেক সুন্দর হয় তাইনা?ফারাজ বলেছিল।ওর মতে আকাশে তারাদের রুপ হার মানাবে চাঁদের কাছে।’

কথাটা হাসিমুখে বললেও শেষের দিকে সারথির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল।এত সুন্দর জিনিস, তার দেখা হলোনা।
সজীব মাথা বাঁকিয়ে রুমের ভেতর ঘড়িটার দিকে তাকালো।রাত ১টা বাজে।অমনি সে তাড়াহুড়ো করে বললো,’ঘুমোতে হবে।আমি এত রাত জাগিনা’

কথা শেষ করেই সারথিকে সে কোলে তুলে নেয়।সোজা ওকে বিছানায় নামিয়ে, নিজে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে।
সারথি অবাক হয়ে বসে আছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো।বাসর রাত কি শুধুই কোলে তোলা নিয়ে সীমাবদ্ধ!

সজীব ঘুমিয়ে পড়েছে।সারথি বেশি খারাপ লাগেনি,বরং আলাদা ভাল লাগা কাজ করছে মনের ভেতর।কি সুন্দর তাকে কোলে তুলে নিয়ে আসলো।লজ্জায় লাল হয়ে বিছানার চাদরটা খাঁমছে ধরলো সে।নিজের চোখে যদি দেখতে পারতো সজীব ওকে কোলে তুলায় কেমন লাগছিল।

সেই রাতটা সারথির সারাক্ষণ মনে পড়ে।সজীবকে শুরুতে ওর অদ্ভুত লাগতো।ভাবতো হয়ত ধীরে ধীরে কাছে আসতে চায়।কিন্তু আসলে সে কাছেই আসতে চায়না।
সেই রাতের কোলে তোলাটাই শেষ ছোঁয়া ছিল তাদের। এরপর আর দুজন দুজনের কাছে কখনও আসেনি।মাঝে মধ্যে সারথি চোট পেলে হাত ধরে ওকে রুমে নিয়ে আসতো সজীব।এর বাইরে কিছুইনা।
————–
ফারাজ গামছা পরে ছাদে নিজের জামাকাপড় শুকাতে দিচ্ছে।পূূর্ণতা ঐ সময়ে ছাদে বসে একটা আচারের বোয়াম খুলে আচার খাচ্ছিল প্রচণ্ড খিধে পেয়েছে বলে,রান্নাঘরে গিয়ে দেখে এসেছে রান্না এখনও হয়নি।
তাই আচার খাচ্ছে।ফারাজকে নিজের সব জামাকাপড় ধুয়ে শুকাতে দিতে দেখে পূর্ণতা এগিয়ে এসে বললো,’এত পানি পেলেন কই?নাকি ঐ ইউরিনের পানি দিয়ে ধুয়েছেন।ওয়াক থু!থু!

ফারাজ বালতি নিয়ে চলে গেছে চুপচাপ।পূর্ণতা ঝোলানো পাঞ্জাবি টেনে শুঁকে দেখলো ডিটারজেন্টের গন্ধ।তাই আবারও ফারাজের পিছু নিয়ে বললো,’পানি কই পেলেন?এখন তো সাপ্লাই পানি আসে নাই তাই না?’

ফারাজ থেমে পেছনে ফিরে বললো,’পুকুর থেকে ধুয়ে এসেছি,পাশেই পুকুর আছে।গিয়ে আপনিও চুবে বসে থাকুন’

‘আমি তো সাঁতার জানিনা’

‘তাহলে এই টাংকির পানি দিয়ে করেন।আমাকে বিরক্ত করবেননা প্লিজ’

ফারাজ দ্রুত হেঁটে চলে গেলো।পূর্ণতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুকুরটা দেখতে এসেছে।বেশ ভালোই।প্রয়োজনীয় কাজ করা যাবে পুকুরের পানি দিয়ে।
খুশি হয়ে হাতটা ধুয়ে নিলো সে পুকুর থেকে।
এরপর আবার হাবিজাবিতে ফেরত আসলো।ফারাজ তার রুমের দরজা লাগিয়ে রেখেছে পূর্ণতার ভয়ে।মেয়েটা এত জ্বালাতন করে!
———
বানু এক বোতল পানি নিয়ে হাবিজাবি মেনশনে এসে হাজির।দরজা খুলেছে মতিন।বানুকে দেখে তার চোখে মুখে ভালোবাসার ছড়াছড়ি হয়ে গেছে।

‘মতিন কেমন আছো?’

‘এই তো তোমার আদরে ভালই আছি বেশ।তুমি কেমন আছো? ‘

‘আমিও তোমার ভালোবাসাই ভালো আছি।এই নাও বোতল।তোমাদের বাড়িতে নতুন যে আপা আইছে তারে দিও’

‘তুমি ক্যান কষ্ট করলা বানু?আমাকে ডাক দিলেই হতো,জানালা দিয়ে’

‘তোমায় কষ্ট দিতে চাই নাই।তাছাড়া অনেকদিন তোমায় দেখা হয়না।চা খাইবা?’

মতিন নাক মুখ খিঁচালো।বানু মুচকি হেসে বললো,’দোকানের চা।আমাদের বাড়ির ও না,তোমাদের বাড়ির ও না।চলো যাই’

মতিন ও ধেই ধেই করে চললো।দুজনে চা খাবে,হাঁটা হাঁটি করবে।হালকা পাতলা প্রেম হবে তারপর যে যার বাড়িতে ফিরে আসবে।

পূর্ণতা মতিনের থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ওদের দুজনকে প্রেম করতে দেখে মিটমিট করে হাসছিল ওমনি কারোর হাঁচির আওয়াজ পেয়ে উপরে চেয়ে দেখলো ফারাজ বারান্দা থেকে সরে চলে যাচ্ছে।এতক্ষণ এগুলো দেখছিল সে।ভুলবশত হাঁচি এসে যাওয়ায় থতমত খেয়ে পালিয়েছে।
চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১১
#আফনান_লারা
________
খুব ভোরে সারথি একা একা সিড়ি বেয়ে ছাদে এসে বসে।এটা তার অনেক পুরোনো নাহলেও প্রায় এক বছরের অভ্যাস।ছাদে এসে তার শখের ফুলের টব গুলোর পাশে বসে ফুলের গন্ধ নিতে তার দারুণ লাগে।দিনটা সে ঐ ভাল লাগা দিয়েই শুরু করে সবসময়।আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।দোলনায় বসে ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে মন এলিয়ে দিয়েছিল সে।
আনাফ যে আতর ব্যবহার করে সেটার ঘ্রান বাতাসে বইছিল, সারথি এখানে আসার পর থেকেই।কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি বলে সে ধরে নিয়েছে এটা তার মনের ভুল।দোলনায় দোল খেতে খেতে সে সজীবের কথাই ভাবছিল।সজীব এখন কি করে তা নিয়ে ওর কত জল্পনাকল্পনা।
আতরের গন্ধটা এবার খুব কাছ থেকে আসছে।সারথি বেশ নিশ্চিত আনাফ দাঁড়িয়ে আছে আশেপাশে।সে মুচকি হেসে বললো,’আনাফ ভাইয়া লুকোচুরির মানেটা বুঝাবেন?’

আনাফ জোরেসোরে কপালে একটা চড় দিয়ে জিভ কামড়ে বললো,’কি করে যে বুঝে ফেলেন!’

‘আতর লাগানো বন্ধ করেন,হয়ত আর বুঝবোনা।আচ্ছা, এই ভোরে ছাদে কি করেন আপনি?’

আনাফ হাত ভাঁজ করে বললো,’আমারও একই প্রশ্ন আপনার কাছে’

‘আমি তো আসি মন ভাল করতে।আপনি কিসের জন্য আসেন?’

‘আমি আসি দেখতে,ভোরে কে আগে ওঠে সেটা।সবসময় এমন আসেন নাকি আজকেই?’

‘সবসময় আসি।’

আনাফ আর কথা বাড়ালোনা।ছাদের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।সারথি কি করে সেটাই দেখবো সে।
হয়ত এখন আর আতরের গন্ধ সে পাবেনা।ঠিক তাই।সারথি মনে করেছে আনাফ চলে গেছে তাই সে দোলনা থেকে উঠে হাত সামনে নিয়ে এগিয়ে এসে টবগুলোর কাছে ঘেঁষে দাঁড়ায়।হাত দিয়ে ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করে।যদি ফুল দেখা যেতো কতই না ভালো হতো।
———-
পূর্ণতা পানির খালি বোতল দশটা খুঁজে বের করেছিল,এখন ফারাজের কথামতন সাপ্লাই পানি আসায় বসে বসে বোতলগুলো ভর্তি করছে।ফারাজ তার জিনিসপাতি গুছিয়ে নিচ্ছে সারথির বাসায় যাবে বলে।এখানে তার কোনোদিনই মন টিকেনা,এখন আবার জুট ঝামেলা এসে পড়েছে।এবার সে আর থাকবেইনা।আজই এই বাড়ি ছাড়বে।
ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে সে বাইরে বের হতেই বাবার সামনে পড়লো।
জনাব মানিক ফারাজকে ব্যাগ হাতে বাইরে বের হতে দেখে জানতে চাইলেন সে কোথায় যাচ্ছে।তাও এই ভোরবেলা সবার অগোচরে।

ফারাজের গলায় কথা আটকে গেছে।বাবাকে সে প্রচণ্ড ভয় পায়।এখন তো ভয়ের সীমানা পেরিয়ে গেছে।মুখ ফুটে দু দণ্ড কথাও বলতে পারছেনা সে।

‘কি হলো ফারাজ?কথা বলছোনা কেন?আমি তোমায় একটা প্রশ্ন করেছি’

‘বাবা আমি মেসে ফিরে যাচ্ছিলাম’

‘কি জন্যে?

‘আমি তো সেখানেই থাকি বাবা।এটা তো নতুন না’

‘আর থাকতে পারবেনা।বয়স হয়েছে তোমার।নিজের দায়িত্ব বুঝে নেয়া শেখো।তোমার ভাই ফাহাদকে দেখোনি কেমন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে?তাহলে তুমি এভাবে মুখ লুকিয়ে থাকলে কি করে চলবে?বয়স তো কম হয়নি তোমার’

ফারাজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।পূর্ণতা তিনটা বোতল নিয়ে পিলারের ওপারে দাঁড়িয়ে ফারাজকে বকুনি খেতে দেখে মিটমিট করে হাসছিল,ওমনি তার হাত পিছলে একটা বোতল বিকট শব্দে মেঝেতে পড়ে গেছে।
তখনই জনাব মানিক পেছনে ঘুরে দাঁড়ালেন।পূর্ণতা বোতলটা তুলে ওনাকে দেখে সালাম দিলো।

‘তুমি কে?’

‘আমি পূর্ণতা রহমান।আমি হলাম অরিন্দম কর্মকারের মেয়ে’

‘কর্মকারের মেয়ে রহমান?’

পূর্ণতা কথা বলতে যাবে তখনই বেলায়েত হোসেনের আগমন ঘটে।তিনি মানিকের কথা শুনে ফেলেছিলেন।জবাবে বললেন,’তাতে তোমার সমস্যা আছে?কর্মকারের মেয়ে রহমান হতেই পারে যদি কর্মকারের বউ রহমান হয়ে থাকে তো।তোমার কোনো আপত্তি আছে? ‘

মানিক আর কিছু বলেনি।ফারাজের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওখান থেকে চলে গেলো।ফারাজ আবার ব্যাগ হাতে নিতেই এবার বেলায়েত হোসেন পাকড়াও করলেন ওকে।
‘মেসে যাইতেছো?’

‘হুম’

‘যাবেনা,চুপচাপ রুমে য়াও।এখন অনেক সকাল,ঘুমাও আরও।নামাজ পড়ে না থাকলে নামাজ পড়ে নাও,এরপর ঘুমাও।আমি যেন তোমায় আর বাইরে ঘুরতে না দেখি।’

ফারাজ গাল ফুলিয়ে রুমে চলে গেছে।পূর্ণতা বোতল তুলে সেও নিরুদ্দেশ।
———
কাজের লোকের ডাকাডাকিতে সজীবের ঘুম ভাঙ্গে।লেভেন নাকি এক ঘন্টা ধরে ওর অপেক্ষা করছে ড্রয়িং রুমে।সজীব আজ অফ ডে বলে দেরি করে ঘুমাচ্ছিল কিন্তু লেভেন এসে ওর ঘুমে পানি ঢেলে দিছে।যতক্ষণ না সে উঠবে ততক্ষণ সে এখান থেকে নড়বেনা।
বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে সজীব।চোখে ঝাপসা লাগে সব।কাল দেরি করে ঘুমিয়েছিল।সমুদ্রে বালিতে বসেই তিন ঘন্টা সময় নষ্ট করে এসেছিল।তাই এখনও চোখে ঘুম।
কোনোমতে উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেছে সে।লেভেন কাজের লোকদের বাধা অমান্য করে সজীবের বেডরুমে ঢুকে পড়ে।তারপর এসে ওর ফোনটা নেয়।লাস্ট কল সারথির ছিল,এটা দেখে তার ভীষণ রাগ হলো।রাগের বশে সে সারথিকে একটা কল করলো।
সারথি সেসময় খাবার খেতে বসেছিল মা আর উর্মির সাথে।সজীবের কল এসেছে শুনে আনন্দে আত্নহারা হয়ে সে রিসিভ করে।ওপাশ থেকে লেভেন শুধু বললো,’কেমন আছো সারথি?’
এটা বলেই সে কেটে দেয় লাইন।তারপর মুচকি হেসে ফোনটা রেখে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে সজীবের।সজীব তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হতেই দেখে লেভেন মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

‘বাইরে অপেক্ষা করো।আমি চেঞ্জ করবো এখন’

‘কেনো?আমার সামনে চেঞ্জ করতেই পারো।কি সমস্যা? ‘

সজীব লেভেনের হাত ধরে রুম থেকে বের করে দরজা লক করে নিলো ভেতর থেকে।

ওদিকে সারথি মূর্তির মতন বসে আছে দেখে উর্মি আর মা একই প্রশ্ন করে যাচ্ছেন কি হয়েছে।সজীব কি বলেছে।

‘না কিছুনা।হয়ত নেটওয়ার্ক সমস্যা’

সারথি ওনাদের কিছুই বলেনি।চুপচাপ সবটা হজম করে ফেলেছে।পরে সজীবের কাছে এ ব্যাপারে সে জানতে চাইবে।এখন তো সজীবের ঘুমানোর সময়।এ সময়ে একটা মেয়ে ওনার ফোন থেকে কোনোই বা তাকে কল করেছে।আবার ওর নামও জানে।অদ্ভুত লাগলো বিষয়টা।
———-
সজীব রেডি হয়ে নাস্তা করতে বসে লেভেনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’কি এমন কাজ যে এত সকালে আসলে?’

‘কি কাজ আবার?আমি আসতে পারিনা?আমি বিনাকারণেও আসতে পারি।চলো আজ ঘুরতে যাই।লং ড্রাইভ।’

‘আমার মুড নেই।অফিস থেকে একবার ঘুরে আসবো।ব্যস এর বেশি না’

‘আজ তোমার অফ ডে সজীব।অফিসে যেতে দেবোনা আমি।জলদি খেয়ে নাও।দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো’

সজীব খাবার খেয়ে নিজের অসম্পূর্ণ ফাইল নিয়ে বসে গেছে।লেভেন বিরক্ত হয়ে ওর সামনে বসলো।মুখে হাসি ফুটিয়ে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, ওকে মানানোর জন্য।
———–
আনাফ আচারের বোয়াম নিয়ে কলিংবেলে চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।উর্মি এসে দরজা খুলেছে তখন।

‘হাই’

‘হ্যালো,আপনি কে?’

‘আমি বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে আনাফ।সারথি ম্যাম আছেন?’

‘ভাবী তার রুমে।কি দরকার?’

‘এই আচারটা ওনার জন্য মা পাঠিয়েছে,তাকে দিয়ে দিয়েন’

উর্মি আচারের বোয়ামটা নিয়ে বললো,’আসুন ভেতরে আসুন,আমি ভাবীকে ডাকছি’

আনাফ সহজবোধ করছিলনা বলে ভেতরে গেলোনা।চলে আসলো ওখান থেকে।উর্মি না থাকলে হয়ত যেতো।এখন তার যাওয়াকে সারথির ননদ আবার কোন নজরে দেখে তাই ভেবে সে গেলোনা।
———-
পূর্ণতা নাস্তা খেতে বসে গিলতে পারছেনা কিছুই।সবাই গোগরাসে সব গিলে গেলেও পূর্ণতা কিছুতেই গিলতে পারেনা,শেষে ফারাজকে দেখে তার যেন দম ফিরলো,এতক্ষণ বুঝি আটকে ছিল।
ফারাজ বসার সাথে সাথে বাকিদের মতন সেও খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।পূর্ণতা ভাবছে ফারাজ নিজেও তো ওর মতন, তাহলে সে খাবারগুলো কি করে খাচ্ছে।

মিসেস সোনালী পূর্ণতার পাতে আরেকটা রুটি দিয়ে বললেন,’মা খাচ্ছো না কেন?’

‘না মানে, এই তো খাচ্ছি’

ফারাজ বুঝতে পেরেছে পূর্ণতা কেন খাচ্ছেনা।তার ভীষণ আনন্দ হলো পূর্নতাকে এমন ভয় পেতে দেখে।ওকে মিটমিট করে হাসতে দেখে দাদাজান বলেন,’কি হলো ফারাজ?প্রেম-টেম করতেছো নাকি?অকারণে হাসা তো নয়া প্রেমের লক্ষণ ‘

মিসেস সোনালী তখন দাদাজানকে বললেন,’মনে হয় করেও।বাবা একটু খোঁজ নেন তো।ফারাজ ঠিক কোন প্রেয়সীর প্রেমে পড়ে এমন চুপচাপ হয়ে গেছে।আমরা তো আর প্রেমের বিরুদ্ধে যাব না।একয়ে একয়ে দুই করে দিবো,ব্যস’
চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১২
#আফনান_লারা
________
বেলায়েত হোসেনের খাওয়া বন্ধ হয়েছে। ফাহাদ তার বড় আদরের নাতি ছিল,কিন্তু সে প্রেম করে একটা মেয়েকে বিয়ে করে একদিন হঠাৎ বাড়ির চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়।মেয়েটার সব দিক সবার ভাল লাগলেও বেলায়েত হোসেনের ভাল লাগেনি একটা বিষয়।আর তা হলো মেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েনা।সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়।এ নিয়ে প্রচুর জুটঝামেলা হয়েছিল।শেষে মেয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করে।যদিও এখন সে পাঁচ ওয়াক্ত পড়ার চেষ্টা করে তাও বেলায়েত হোসেনের মন জয় করতে পারেনি।তবে অর্ককে ওনার অনেক পছন্দ।ওকে দেখলে ওর মায়ের প্রতি রাগ অনেকটাই কমে যায় তার।যাই হোক সেই থেকে প্রেমের বিয়েতে বেলায়েত হোসেন কোথাও সাঁই দেন নাই।এখন ফারাজের পছন্দের মানুষ আছে শুনে তিনি অবাক হলেন।খাবার খাওয়ার সময় পানি খাননা কখনও অথচ আজ ভবঘুরে এক গ্লাস পানি খাবারের মাঝখানেই খেয়ে নিলেন।তার এমন অবস্থা দেখে সোনালী বিষয়টাকে সরিয়ে নিতে ভাজি এক চামচ ওনার পাতে ঢেলে বলে,’বাবা আর কিছু লাগবে?’

বেলায়েত হোসেন উঠে যেতে যেতে বলে গেলেন নাস্তার পরে যেনো ফারাজ ওনার রুমে আসে।
পূর্ণতা মনে মনে ভীষণ খুশি।ফারাজকে এখন দাদাজান অনেক বকা দেবে আর সে লুুকিয়ে ওগুলো দেখবে।কি যে মজা হচ্ছে তার।
ফারাজ দেখে ফেলেছে পূর্ণতার এক গাল হাসি।তার বোঝাও বাদ বাকি নেই যে ও কেন হাসছে।
খাবারটা আজ শেষ হচ্ছেনা,ফারাজ ইচ্ছে করেই শেষ করতে চাইছেনা।দাদাজানকে কি করে সত্যিটা বলবে।সত্যিটা বললে আজ এই মূহুর্তে বাসা থেকে বের করে দিবেন তিনি।এই কঠিন সত্য মুখেও আনা যাবেনা,প্রয়োজনে দশটা মিথ্যে দিয়ে লুকাতে হবে।অনেক ধীরে সুস্থে নাস্তা শেষ করে হাতে দাদার জন্য চায়ের কাপ নিয়ে ফারাজ তার রুমে এসে হাজির হলো।
প্রতিদিনের মতন তিনি ধ্যান করছেন।দরজাটা খুলতেই সেই ভূতুড়ে পরিস্থিতিতে পড়লো ফারাজ।গটগট করে আওয়াজ হয়ে এরপর দরজা খুলে গেলো।দাদা চৌকিতে বসে ধ্যান করছেন,
ফারাজ চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে দাদার একটু কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।পায়ের শব্দ করলো যেন তিনি ধ্যান ছাড়েন।

বেলায়েত হোসেন আগে চায়ের কাপটা নিলেন হাতে।

‘দাদাজান কিছু বলবেন?’

‘কোনো?তোমার কি তাড়া আছে?’

‘না তা নয়।’

এবার চোরের মতন দাঁড়িয়ে রইলো ফারাজ।দাদা ধীরে ধীরে চা খাচ্ছেন।ফারাজ বার বার হাতের ঘড়ি দেখছে।এই রুমে আসার পর বিশ মিনিট হলো,অথচ দাদাজান কেন ডাকলেন তা নিয়ে কিছুই বলছেননা।বিরক্ত লাগছে তার।ওদিকে দরজার ওপারে উঁকি দিতে থাকা পূর্ণতাও বিরক্ত। কি কারণে ডাকলো ফারাজকে সেটা ওর জানাই হচ্ছেনা।
———-
সারথি খেজুরের আচার নিয়ে বিছানায় বসে বসে সজীবের কথা ভাবছিল।এসময়ে সজীবের বাসায় থাকার কথা,আর আজ তো অফ ডে।ফোন করা কি ঠিক হবে?তা নিয়ে প্রচুর ভাবনা চিন্তার পরে সে সজীবকে কল করে।
সজীব লেভেনের সাথে যুদ্ধে হেরে বাধ্য হয়ে সি বিচে এসেছে ঘুরতে।সেখানে সারথির কল এসেছে দেখে লেভেনকে অফিসের কথা বলে একটু দূরে চলে আসলো সে।

‘কি হয়েছে?’

‘আমার কিছু কথা ছিল’

‘আমি বাসায় গিয়ে রাতে ফোন করবো, এখন ব্যস্ত আছি’

‘সমুদ্রে ঘুরতে এসেছেন?’

সজীব আঁতকে উঠলো সারথির কথা শুনে।সারথি আবার বললো,’অন্ধ বলে কি আশেপাশের খোঁজ রাখতে পারবোনা?সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে পারছি।’

‘হ্যাঁ,এসেছি।সারাদিন কামলা খাটি,বন্ধের দিনে ঘুরবোনা তো কি করবো?’

ওমনি লেভেন পেছন থেকে ছুটে এসে সজীবকে জড়িয়ে ধরে বললো,’আই লাভ ইউ সজীব’

সারথির কানে স্পষ্ট শোনা গেলো কথাটা।তার মনে হলো ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।চোখে পানি এসে গেছে মূহুর্তেই।সজীব ফোনে হাত দিয়ে ইশারা করে লেভেনকে চুপ থাকতে বলে দূরে সরে গিয়ে ফোন আবার কানে ধরলো।
সারথি তখন চোখের পানি মুছে বললো,’সকালে আপনার ফোন থেকে একটা মেয়ে কল করেছিল আমায়।সে আমার নাম জানে।সেই মেয়েটি হয়ত এখন আপনার আশেপাশে আছে।এবং সে আপনার ভালবাসার মানুষ,সে চোখেও দেখতে পায়।তবে সারথির কি প্রয়োজন মিঃ সজীব?’

সজীবের মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে।কি বলবে বুঝতেছে না।সারথি আবার বললো ‘আপনার দোষ নেই।অন্ধ মেয়েকে আপনি না পারতে বিয়ে করেছিলেন।বিদেশে আপনার ভাল লাগা থাকতেই পারে।আমি বুঝি।আমাকে কিছু বুঝাতে হবেনা।শুধু একটা কথা বলি শুনেন,যে মেয়েটা আপনাকে ভালবাসে,যার কোনো ত্রুটি নাই তাকে হাতে রাখেন।সারথি আপনার জীবনে না থাকলেও চলবে’

কথাটা বলে সারথি কল কেটে দিয়েছে।

সজীব ফোন আছাড় দিয়ে ভেঙে হনহনিয়ে কারের দিকে ছুটলো।লেভেন ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বললো,’হোয়াট হেপেন্ড সজীব??কার সাথে কথা বলছিলে?’

সজীব থেমে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো হেভেনের দিকে।শক্ত গলায় বললো,’তুমি সকালে আমার ফোন ধরেছিলে?’

‘হ্যাঁ,সারথির জানা উচিত আমি কে’

‘কেন এমন করেছো?তোমায় আমি সব এফোর্ট দিই না?’

‘স্ত্রীর অধিকার দাও না,সেটা পেতে আমাকে যা যা করার লাগে আমি তা করবো।’

‘সে আমার বিয়ে করা বউ।তার সাথে তুমি নিজের তুলনা করছো?আজ পর্যন্ত যা করেছি আমি কেবল তোমার জন্য করেছি।সারথিকে রেখেছি আমার বাবা মায়ের জন্য।তাহলে তোমার আর কিসের সমস্যা? ‘

‘আমি চাইনা তোমার জীবনে আমি ছাড়া ২য় কোনো নারী থাকুক’

‘তাকে আমি আজ পর্যন্ত ছুঁয়েও দেখিনি’

‘তাও সে তোমার স্ত্রী।আমি চাই উর্মির বিয়েতে তুমি আমার সাথে বাংলাদেশে ফিরবে এবং ওকে ডিভোর্স দেবে।আর কোনো কথা আমি শুনতে চাইনা’
———-
ড্রাইভারকে দিয়ে নিজের ব্যাগপত্র সব নামিয়ে সারথি কলিংবেলে চাপ দিলো।
মতিন পুরোনো কাপড় দিয়ে সোফা মুছতেছিলো,কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে ছুটে আসলো দরজা খুলতে।দরজা খুলে সারথিকে দেখে ইয়া বড় হা করে বললো,’আম্মা,আব্বা,আপা সবাই দেখে যান,সারথি আপা আইছে’

সারথি দেয়ালে হাত রেখে চৌকাঠ পেরুলো।সিয়াম আর পিয়ালি ছুটে আসলো সারথির নাম শুনে।মিসেস সোনালী রান্নাঘর থেকে সারথির নাম শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি,পরে হইহুল্লড় শুনে উঁকি দিয়ে দেখলেন সত্যিই সারথি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
হাত থেকে স্টীলের চামচটা পড়ে গেলো হঠাৎ।দুইটা বছর পর নিজের মেয়েকে চোখের সামনে দেখে তিনি দিশেহারা হয়ে গেছেন।চোখের পানি বাঁধ মানছেনা।
সারথি সোফা ধরে বসলো তারপর মতিনকে বললো সাপ্লাই পানি দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে আনতে।সোনালী এসে এক দৃষ্টিতে সারথিকে দেখছেন।মেয়েটা কত সুন্দর ছিল,কেমন যেন শুকিয়ে গেছে,গায়ের রঙের উজ্জ্বলতা কমে গেছে।রোগা রোগা লাগে দেখলে।এত কাছে তাও ওকে ছোঁয়ার সাহস কুলিয়ে পারছেন না তিনি।
সজীবের সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়া ছিল ওনাদের অপরাধ।সারথি বারবার করে বলেছিল অন্ধ মেয়েকে এমন ভাল পরিবার বউ করে নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা মানে গাফলা আছে।কেউ তার কথা শোনেনি।তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলেই যেন তারা বেঁচে যেতো।এসব মনে করে তার হাত কাঁপছে।চেয়েও সারথিকে তিনি ধরতে পারছেননা।সারথি মায়ের উপস্থিতি টের পেয়েছে।তাও কিছু বলেনি।সিয়াম আর পিয়ালি টেনে হিঁছড়ে সারথির ব্যাগ সব ভেতরে আনছে।
ওদিকে দাদাজান এখনও ফারাজকে কিছু বললেন না।
পূর্ণতা দরজার ওপারে মেঝেতে গাপটি দিয়ে বসে আছে গোপন কথা শোনার অপেক্ষায়।বিরক্ত হতে হতে এখন তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
———-
সজীব কারে বসতেই ওপাশ থেকে লেভেন ও উঠে পড়লো।সজীব কিছু বলতে যাওয়ার আগেই লেভেন কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।খুব শক্ত করে ধরে ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বললো,’আমার ভালবাসা সত্যি সজীব’

সজীব কিছু করতেও পারছেনা।একদিকে সারথি আর অন্যদিকে লেভেন।এটা সত্যি যে, সে লেভেনকে ভালবাসে।কিন্তু সারথিকে এভাবে দিনের পর দিন ধোকা দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছে।সারথি মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই।

লেভেন গাড়ীর ভেতর সজীবের খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে আজ।সজীব কিছুতেই আজকে ওকে সরাতে পারছেনা,নিজের সিট ছেড়ে সে পুরোটাই সজীবের কাছে চলে এসেছে।
সজীব ওকে সরানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল ওমনি কারের জানালার কাছে একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো।সজীবের ভাঙ্গা ফোনটা তুলে এনেছে সে।লেভেন ছেলেটাকে দেখে সরে বসলো।ছেলেটার থেকে ফোন নিয়ে বসে বসে সেটা ঠিক করতে গিয়ে দেখলো পুরো ড্যামেজ হয়ে গেছে।নতুন ফোন কিনতে হবে।সিমটা খুলে রেখে সে কার স্টার্ট করেছে ফোনের দোকানে যাওয়ার জন্য।লেভেন বিরক্তি নিয়ে চুপ করে থাকলো।যা একটু আজ সজীবের খুব কাছে চলে গিয়েছিল ওমনি এই ছেলেটা এসে গেলো!আরও পরে আসতে পারলোনা!
———-
দাদাজান বিছানা থেকে নামলেন।এরপর ফারাজের দিকে চেয়ে বললেন,’দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে রইলে কোনো প্রকার উহঃ না করে, আমি সন্তুষ্ট হলাম।আগেও ছিলাম,নতুন করে আবার হলাম।যাকেই পছন্দ করো না কেন সে যেন ৫ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।এর বেশি কিছু আমার চাইনা।এখন যাও’

পূর্ণতা কথাগুলো শুনে উঠে দৌড় দিতেই যাচ্ছিল ওমনি ফারাজ বের হয়ে ওকে দেখে ফেলে।পূূর্ণতা মেঝেতে বসে থেকে দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।ফারাজ সেসময় কোমড়ে হাত রেখে বলে,’দাদাজান দেখে যান।পূর্ণতা আমাদের কথা আড়ি পেতে শুনছিল।এটা ওর পুরোনো অভ্যাস,
ভাল হয়ে যেতে বলুন’

দাদাজান বাইরে বেরিয়ে দেখলেন পূর্ণতা মেঝেতে বসে আছে।ওনাকে দেখে সে বললো,’আরে না।আমি তো আমার পা ধরে দেখছিলাম।প্রচণ্ড ব্যাথা করছে।হোচট খেয়ে পড়ে গেলাম তারপর আর উঠতে পারিনি।আহঃ!! প্রচুর ব্যাথা,আপনারা কেউ ধরুন,আমাকে উঠান।সত্যি ব্যাথা’

দাদাজান ঠোঁটজোড়া খিঁচিয়ে ফারাজের দিকে চেয়ে বললেন,’ওকে ধরে তুলো’

‘দাদা আপনি বিশ্বাস করছেন ওকে?’

‘ওকে দেখে তোমার মনে হয় মিথ্যে বলছে?মুরব্বির সমানে কেউ নাটক করে?’

ফারাজ গাল ফুলিয়ে পূর্ণতাকে ধরে উঠালো।পূর্ণতা পা নাড়িয়ে বললো,’হাঁটতে পারবোনা মনে হচ্ছে।আমাকে প্লিজ, রুমে দিয়ে আসুন’

ফারাজ ওমনি হাত ছেড়ে দিলো আর পূর্ণতা ধপাস করে আবার পড়ে গেছে, এবার সত্যি সত্যি পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।

দাদাজান রেগে বললেন,’এটা কেমন বেয়াদবি ফারাজ?তোমাকে না বললাম পূর্ণতার সাথে ভাল ব্যবহার করবা।তাহলে এই তার নমুনা?’

ফারাজ দাঁতে দাঁত চেপে পূর্ণতাকে ধরে উঠালো।তারপর দাদার দিকে চেয়ে বললো,’তবে কোলে করে দিয়ে আসি রুমে?মেহমান বলে কথা,আদরের মেহমান’

দাদাজান যেতে যেতে বললেন,’যেমনে সুবিধা হয়’

পূর্ণতা ফারাজের হাত ধরে রেখে বললো,’কোলে তুলতে হবেনা।ধরে রুমে দিয়ে আসলেই হবে।অচেনা ছেলের কোলে ওঠা আবার আমার শখ না’

‘আপনার শখ আমি মেটাচ্ছি’

কথাটা বলে ফারাজ পূর্ণতাকে কোলে তুলে নিছে।তারপর হনহনিয়ে ওর রুমের দিকে চললো।
সারথি দেয়াল ধরে ধরে আসছিল এদিকে।তখনই ওর সামনে দিয়ে ঝড়ের গতিতে কাউকে হেঁটে যেতে শুনে চমকে বললো,’কে??’

অর্ক বই হাতে ফারাজ আর পূর্ণতাকে ওভাবে দেখে বলে,’ফারাজ চাচ্চু নতুন আসা পূর্ণতা ম্যামকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে’

চলবে♥