ডাক্তার মিস পর্ব-০৩

0
663

#ডাক্তার_মিস [০৩]
কলমেঃ Hasin Rehana

রাউন্ড শেষ করে চেম্বারে ফিরে এসে বুশরা দেখল ডেস্কের উপর একটা টিফিনবক্স রাখা। সাথে একটা চিরকুট।
“দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নিস।”

হাতমুখ ধুয়ে এসে এক লোকমা খাবার মুখে পুরবে এমন সময় নার্স এসে জানালো ইমার্জেন্সিতে পেশেন্ট এসেছে। ডঃ ইকবাল চেম্বারে নাই। তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। বুশরা হাত ধুয়ে চলে গেল তড়িঘড়ি করে। খাবার পড়ে রইল খাবারের যায়গায়।

বাইক এক্সিডেন্ট। হাতে খুব সম্ভবত ফ্র্যাকচার হয়েছে। এক্সরে করতে হবে। হাতে পায়ে অনেক যায়গায় ছিলে গেছে। যা হইয় আর কি বাইক এক্সিডেন্টে। উঠতিবয়সী বড়লোকের পোলাপানদের কি এক শখ, দাড়িগোঁফ গজানো শুরু করলেই বাইক নিয়ে মস্তানি করে বেড়াতে হবে। সকালেও এরকম একটা কেইস হ্যান্ডেল করেছে। ক্ষুধার পেটে সবকিছু বিরক্ত লাগছে এখন বুশরার। সকাল থেকে হাসিমুখে রোগী দেখলেও এই বেলায় এসে নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে কষ্ট হয় ওর। ব্যান্ডেজ করতে করতে ঝাঁঝের সাথে বলে ফেলে,

“ভালবাবে বাইক চালাতে না শিখে দাদাগিরি করে বেড়ান কেন? পা টা ভাংলে কি হত?”

“সরি! আপনি কি আমার গার্ডিয়ান?”, চোখ মুখ কুচকে প্রশ্ন করল রোগী।

“আমি ডাক্তার, গার্ডিয়ান হতে যাবো কোন শখে?”

“তাহলে আপনার কাজ করুন প্লিজ।”

“করছি তো। তবে আপ্নারা যারা বাইক চালান একটু সাবধানী হলে কিন্তু আমাদের চাপ কমে। তাই নয় কি?”

“আপা আপনি ডাক্তার মানুষ, চিকিৎসা করেন, এত্ত কথা কইতাছেন ক্যান? ভাই দাদাগিরি করে বেড়ায় আপনারে কেডা কইছে? আর বাইক চালানি তার মত এই এলাকায় কেউ পারে না। বুচ্ছেন?”

“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। অনেক চ্যালা নিয়ে ঘোরেন উনি সেটাও দেখতে পাচ্ছি।”, এমার্জেন্সি রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল বুশরা। কথা বললেও নিজের কাজটা মনযোগ দিয়েই করছে বুশরা।

“আপনি জানেন কারে নিয়ে কি বলতেছেন? আইজকা ভাই বাইক সামলাইতে পারছে দেখে বিশাল একটা একসিডেন্ট থেকে বাইচ্যা গেছে কতগুলান মানুষ।”

“আহ হাসান, চুপ কর তো।”

হাসান বলে ছেলেটা চুপ করল। ব্যান্ডেজ করা শেষ। ক্ষুধায় পেটের মধ্যে সব নাড়িভুড়ি পাক খাচ্ছে বুশরার। না চাইতেও মুখ দিয়ে তেতো কথা বেরিয়ে আসছে যেটা মোটেই ভাল জিনিস না। ডঃ ইকবাল আসতেই এক্সরে করতে বলে বেরিয়ে গেল ও। যেতে যেতে ডাঃ ইকবালের কথা কানে আসে,

“রায়হান ভাই! আপনার এই অবস্থা কেমনে? আমাকে একটা ফোন……”

এই রোগী যে এলাকায় খুব হোমড়াচোমড়া কেউ সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না বুশরার। হাত ধুয়ে আরেকদফা খেতে বসে কেন জানি মনে হয় ঐ চেহারাটা আগে কোথাও দেখেছে ও। নামটাও চেনা চেনা। কিন্তু, কিছুতেই মনে করতে পারছে না। মস্তিস্কের উপর বেশি চাপ না দিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দিল শেষমেশ। কথায় বলে না “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
খাওয়া শেষ করার আগেই ফোন বেজে উঠল বুশরার। স্ক্রীণে ভেসে উঠল দুই মানিকজোড়ের মুখ ভেংচানো ছবি। ফোন রিসিভ করে কানে ছোঁয়ানোর আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এল তীব্র চেচামেচি।

“তুই কি একদিনেই হাসপাতাল উদ্ধার করতে নামছিস? তিনটা পর্যন্ত বসে ছিলাম তোর চেম্বারে। খাওয়াদাওয়া করছিস?”

“এত প্রশ্ন একসাথে করলে উত্তর দিব কি করে? খাচ্ছি। না মানে, শেষ খাওয়া।”

“বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। দেরি হবে তোর? ভাবছিলাম তোকে একটু গ্রাম ঘুরে দেখাবো, তা আর হচ্ছে না মোটে।”

“আজকে হবে না রে মনেহয়। কাল যাই?”

“আচ্ছাহ… বাই।”

খট করে ফোনটা কেটে দিল রুকাইয়া। আরেকটা নাম্বার ডায়াল করল। কয়েকবার কল হয়ে কেটে গেল। সকাল থেকে ডজন খানেক কল করেও লাভ হয়নি। কিসের এত ব্যাস্ততা।

“ভাইয়্যু, আমি বাসায় আসছি ২৪ ঘন্টা পার হতে চলল। কই তুমি?”

টেক্সট টা সেন্ড করেই রুকুর মনে হল অনর্থক ইনবক্স ভারি করা হল শুধু। রাগ করে ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলল। ঘরময় পায়চারী করল অনেক্ষন। এক সময় হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মায়ের ঘরে উঁকি মেরে জানিয়ে গেল যে ছোট চাচীর কাছে যাচ্ছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসবে। অবশ্য্য শিউলি বেগম ভাল করেই জানেন তার মেয়েটা ছোটচাচীর নেওটা। তাই ঘন্টাখানেক শব্দটা নেহায়াতই ফাকা বুলি।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরল বুশরা। ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সারাদিন অনেক খাটাখাটনি গেছে আজ। ভাবল একটা ফ্রেশ গোসল করলে ভাল লাগবে। যেই ভাবা সেই কাজ। জামাকাপড় নিয়ে কলপাড়ে চলে গেল ও। তখনই শিউলি বেগমের সাথে দেখা হল ওর।
“চলে আসছো মা? হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যাও। আমি নাস্তা পাঠায়ে দিচ্ছি উপরে।”

“না না আন্টি ক্ষুধা নাই। একটু আগে ভাত খেয়েছি। ভাবলাম একটু গোসল করি।”

“দুপুরের খাবার এইবেলা খাইছো? শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো।”

“সমস্যা নাই আন্টি।”

“কাজ কাজের যায়গায় মা। আগে খাওয়াদাওয়া। চাদের মত চেহারাটা শুকায়ে এক চিমটি হইয়ে গেছে। যাও যাও তাড়াতাড়ি, গরম পানি লাগবে?”

“না আন্টি লাগবে না।”

শিউলি বেগম আড়াল হতেই চোখজোড়া ছলছল করে উঠল বুশরার। অচেনা অজানা মানুষটা কত আদর করছে। মায়েরা কি এমনই হয়? অসুন্দর না হলেও বুশরার শ্যামা গোলগাল চেহারা দেখে তো কখনো কেউ চাঁদের মত বলেনি। বরং সবসময় শুনেছে সোনার বরন মায়ের পেট থেকে কাকের মত এক মেয়ে হয়েছে কিভাবে। বুশরা মাঝে মাঝে ভাবে, ওর মা ও কি মেয়েকে দেখলে এমন বলতেন? মাগরিবের আজানে সম্বিত ফিরে বুশরার। ঝটপট গোসল করে, একবারে ওজু করে নেয়। ঘরে ফিরে দেখল রুকাইয়া এখনো ফেরেনি। আছে হয়ত কোথাও, ভেবে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে ও। কায়ামনোবাক্যে দোয়া করে অদেখা মায়ের জন্য। মায়ের মত এই নতুন আন্টিটার জন্য ও।

সারা গায়ে টুকটাক জখমের চিহ্ন আর ব্যান্ডেজ নিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঘরে ফেরে রায়হান। নামাজের সময় হওয়ায় এই অবস্থায় মায়ের সামনে পড়তে হয়না ওর। চুপিসারে নিজের ঘরে গিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ে বিছনায়। হাতমুখ ধুতে ইচ্ছা করে না। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোনটা উদ্ধার করে ও। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া আঙ্গুলটা ব্যান্ডেজ করা। অনেক কসরত করে লক খুলতেই ডজনদুই মিসডকল নজরে আসে। বেশিরভাগই দলের মানুষজনের। আরেকটা নাম্বার থেকে তেরটা ফোন এসেছে। কন্টাক্টনেম “বুড়ি?”

চলবে…