ডাক্তার মিস পর্ব-৪+৫

0
630

#ডাক্তার_মিস [০৪]
কলমেঃ Hasin Rehana

সারা গায়ে টুকটাক জখমের চিহ্ন আর ব্যান্ডেজ নিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঘরে ফেরে রায়হান। নামাজের সময় হওয়ায় এই অবস্থায় মায়ের সামনে পড়তে হয়না ওর। চুপিসারে নিজের ঘরে গিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ে বিছনায়। হাতমুখ ধুতে ইচ্ছা করে না। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোনটা উদ্ধার করে ও। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া আঙ্গুলটা ব্যান্ডেজ করা। অনেক কসরত করে লক খুলতেই ডজনদুই মিসডকল নজরে আসে। বেশিরভাগই দলের মানুষজনের। আরেকটা নাম্বার থেকে তেরটা ফোন এসেছে। কন্টাক্টনেম “বুড়ি?”

রেগেমেগে টমেটোর মত গাল ফুলিয়ে বসে আছে নিশ্চয় পিচ্চিটা। এক মুহুর্ত দেরি না করে কলব্যাক করল। আশ্চর্য ব্যাপার হল, একটা চেনা রিংটোন ভেসে আসছে দূর থেকে। কিছু একটা মনে হতেই ফোনটা কানে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও। দুইটা ঘর পরেই কাঙ্খিত ঘর যেটা বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে। রিংটোনটাও আসছে ওখান থেকেই। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বোনের ঘরে হানা দিল রায়হান। দরজা খোলাই ছিল।

“কখন আসছিস বুড়ি?”

আচমকা কারো কথা শুনে পেছনে ফিরল বুশরা। হাতে রুকাইয়ার ফোন।

“আপনি?”

“ডাক্তার মিস?”

“আচ্ছা ম্যানারলেস তো আপনি। অনুমতি ছাড়া একটা মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।”

“এটাতো রুকাইয়ার ঘর। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি রুকাইয়ার ভাই। আমি ভেবেছি রুকু এসেছে। ওর ফোনটাও বাজছে এখানেই। আর এই সেইম জামা ওর ও আছে। আমি বুঝিনি অন্যকেউ। এনিওয়ে, সরি।”

হনহন করে বেরিয়ে গেল রায়হান। একবার জিজ্ঞাসাও করল না বুশরা এখানে কেন? মনটা খচখচ করে বুশরার। আসলেই তো বোনের রুমে কয়জন আর নক করে আসে। শুধু শুধু ম্যানারলেস বলাটা উচিত হয়নি। হাসপাতালেও বেশ রাফ ব্যাবহার করা হয়ে গেছে। একই বাড়িতে থাকতে বারবার দেখা হবে। ফার্স্ট ইম্প্রেশনটা খুব খারাপ হল। সময়সুযোগ বুঝে একবার সরি বলে নিতে হবে।

“আম্মা… ও আম্মা।”

অসময়ে ছেলের গলা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন শিউলি বেগম। কিন্তু ছেলের কপালে, হাতে ব্যান্ডেজ দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। রায়হানের কপালে আলতো করে আঙ্গুল ছুয়ে বললেন,

“কি হইছে তোমার, বাজান?”

“ও কিছু না আম্মা। বুড়ি আসছে? কই সে? আমাকে কেউ বলল না তো।”

অসহায় মুখ করে শিউলি বেগম বললেন,

“কখন বলব আব্বা? বাড়িত আসো কখন, যাও কখন হুঁশই পাই না।”

“একটু ব্যাস্ত সময় যাচ্ছে, জানো তো আম্মা। কই রুকু?”

“তোমার ছোটচাচীর বাসাত গেছে।”

রায়হান বেরিয়ে যেতে নিলে শিউলি বেগম থামালেন তাকে।

“তুমি ঘরে যায়ে আরাম কর আব্বা। আমি তোমার চাচীরে বলতেছি ওরে পাঠায়ে দিতে।”

সুবোধ বালকের মত ঘরে চলে গেল রায়হান। সকাল থেকে শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা। দুপুরে এক্সিডেন্টটাও এড়ানো যেত শরীর ঠিক থাকলে। তাও ভাল যে ভ্যানে থাকা মানুষগুলোর কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এসব হালকা কাটাছেড়া কদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বুড়ি এসেছে ভাল হয়েছে। খাইশটা ডাক্তার মিসের কাছে ড্রেসিং করানোর জন্য যাওয়া লাগবে না আর। মনে মনে ভাবল রায়হান।

নাম নিতে না নিতেই ঝড়ের মত হাজির হল রুকাইয়া।

“ভাইয়া কি হইছে তোমার? এক্সিডেন্ট করছ বলে?”

“আরে ও কিছু না।“

“হুম। আয়রন ম্যান তো তুমি।“

“আছিস কয়দিন?”

“কাল সকালে চলে যাবো।“

“বলিস কি? দুদিনের জন্য আসছিস মাত্র?”

“আমার রুমমেট বুশরার পোস্টিং হইছে এখানকার হাসপাতালে।ওকে নিয়ে আসছি। রাতের খাওয়ার পর পরিচয় করায়ে দিচ্ছি।“

“কোনও দরকার নাই।“

বুশরার সাথে সারাদিনে দুই দুই বার বাজে অভিজ্ঞতার কথা বলল না রায়হান। তাই রুকাইয়াও কিছু জানলো না। বিজ্ঞের মত বলল,

“এক বাড়িতে বাস করতে হলে মিনিমাম পরিচয় লাগে ভাইয়া। আর বুশরা হচ্ছে তোমার এলাকার ডাক্তার আপা।”

বোনের কথা বলার ধরন শুনে হেসে ফেলল রায়হান।

“হাটুর বয়সী একটা মেয়ে কে তাহলে আপা ডাকতে বলছিস? ”
“কেন? সারা এলাকার বাপছেলেরা যখন তোমার ভাই, আমার ভাই, রায়হান ভাই রায়হান ভাই রায়হান ভাই বলে তখন?”

“আজাইরা প্যাচাল। মাথা ব্যাথা করছে, এক কাপ স্পেশাল চা খাওয়া তো।”

চা করা খুব একটা পছন্দের না হলেও ভাইয়ের বারংবার অনুরোধে এই কাজ করে রুকাইয়া। তবে আজকের কথা আলাদা। অনেক বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। এখন হয়ত বাড়ির নরম বিছানার বদলে হসপিটালেত কেবিনে মুখোমুখি হত ভাইবোন। কাজেই নিজের স্বভাববিরুদ্ধভাবে বিনা বাক্যব্যায়ে চা করতে ছুটল রুকু। তবে, দরজার কাছে পৌঁছাতেই শুনল,

“ডাক্তার মিসের সাথে এর মধ্যেই দুইবার কথা সারা আমার।”

চলবে..

#ডাক্তার_মিস [০৫]

“ডাক্তার মিসের সাথে এর মধ্যেই দুইবার কথা সারা আমার।”

ভাইয়ের কথা শুনে অবাক হল রুকু। তবে ওকে বেশি অবাক হওয়ার সুযোগ দিল না রায়হান।

“বুড়ি, হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চা খাওয়াবিনা? না খাওয়ালে বল, আমি পাড়ার মোড় থেকে খেয়ে আসি।”

“এই না না, আমি যাচ্ছি।“

পনের মিনিটের মধ্যে চা নিয়ে হাজির হল রুকু। চায়ে চুমুক দিয়ে রায়হান তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

“আহ… কতদিন পর তোর হাতে চা খাচ্ছি বল তো? একটু ঘন ঘন আসতে পারিস না বাড়িতে?“

“আমার ইন্টার্নি কি তুমি করে দিবা? তারচেয়ে একটা ভাবি নিয়ে আসলেই পারো তো।“
“রুকাইয়া…!!”

খুব রেগে গেলেই শুধু বোনকে পুরো নামে ডাকে রায়হান। ভুল যায়গায় ভুল কথা বলে ফেলায় দাঁত দিয়ে জিভ কাটল রুকু।

“ভাইয়া… বিয়ে তো করতে হবে একদিন তাইনা? কতদিন এড়িয়ে যাবা? তাছাড়া আব্বা আম্মা কতদিন মানবে?”

“আমি একটু ঘুমাবো পিচ্চি। লাইট টা অফ করে দিয়ে যা।“

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রুকু।

সবার সামনে খুব স্বাভাবিক কর্মচঞ্চল জীবনযাপন করলেও রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে দুঃখগুলো দুফোটা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে ত্রিশোর্ধ রায়হানের চোখের কোল বেয়ে। লাগামহীন মন ছুটে চলে যেতে চায় আজ থেকে এক দশক আগের সময়টাতে। আবার নিজেকেই বুঝ দেয়, “কি হবে এসব ভেবে। এই তো আছি বেশ। “

রুকু ঘরে এসে দেখল বুশরা ঘুমিয়ে গেছে গুটিশুটি মেরে। সারাদিন ভাল ধকল গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে। তাই ওকে আর জাগালোনা। ফোনে কিছুক্ষন খুটখাট করে রেখে দেবে এমন সময় রিংটোন বেজে উঠল। বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ল রুকুর চোখেমুখে। কলটা না ধরে ফোন সাইল্যান্ট করে দিল ও। কল না ধরলেও টেক্সট তো আসা আটকানো যায়না। এদিকে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে বুশরার।

“এসেছিস? আমি তো ঘুমায়েই গেছিলাম। তোর ঘরে এত শান্তি।”

এ কথা শুনে রুকু হাসলেও বুশরার কাছে সেটা অনেকটাই মেকি মনে হল। উৎকণ্ঠিত হয়ে বুশরা জিজ্ঞাসা করল,

“কিরে কোন সমস্যা?”

“কই না তো।“

রাতের খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল তখনই। খাওয়ার টেবিলে বাড়ির সবার সাথেই আলাপ পরিচয় হল। শুধু রায়হান ছাড়া। ঘুমের অযুহাতে নিজের ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে ও।

খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে ফিরল বুশরা আর রুকু। তখনই রুকু বলল,

“দোস্ত আমাকে কাল সকালে ঢাকা ফিরতে হবে।“

“কালই?”

“হুম রে। যেতে হবে।“

“আচ্ছা। কি আর করার।“

“আমি এসে পড়ব যলদি। চিন্তা করিস না। তখন সব ঘুরিয়ে দেখাবো। তোর কোন সমস্যা হলেই আমাকে ফোন করিস।“

“আচ্ছা ঠিক আছে। চিন্তা করিস না।“

আরো কিছুক্ষন টুকটাক গল্প করে ঘুমিয়ে গেল দুজনেই। পুরো বাড়িতে নিশুতি রাত নেমে আসতে ঘুম বেশি সময় লাগল না। তবে নির্ঘুম আরেকটা রাত পার করল একজোড়া চোখ।

রুকু চলে গেলেও খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না বুশরার। রুকুর মা নিজের মেয়ের মত করেই দেখছেন ওকে। অন্যের বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকতে কারোরই ভাল লাগার কথা না। তবে শুরু থেকেই মানুষগুলোর আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। আর হসপিটালে সারাদিন কিভাবে কেটে যায় সেটা টেরই পাচ্ছেনা বুশরা।

তবে এতকিছুর মাঝে একটা বিষয় মনের মধ্যে খচখচ করে ওর। রায়হান সাহেবকে একটা সরি বলা দরকার। কিন্তু দেখাই হয় না। খাওয়ার টেবিলেও না। এই লোক বাড়িতে আসে কখন, খায় কখন কে জানে। এক্কেবারে বাউন্ডূলে। অথচ এই ছেলেকে নিয়ে প্রশংসায় মূর্চ্ছা যান এ বাড়ির মমতাময়ী গৃহকর্ত্তী শিউলী বেগম। অবশ্য মায়ের কাছে সব সন্তানই সোনার টুকরা।

দুদিন বাদে আউটডোরে রোগী দেখার সময় হাসপাতালে হাজির হল রায়হান। অন্য রোগীরা নিজেদের সিরিয়ালের আগে রায়হানকে দেখার জন্য জোড়াজুরি করল। তবে রায়হান বিনয়ের সাথে তাদেরককে জানালো যে এর কোন প্রয়োজন নেই।

“রায়হান সাহেব, আপনি আমার চেম্বারে গিয়ে বসতে পারেন হাতে সময় থাকলে। নাহলে লাঞ্চের সময় আসুন। একটু সময় লাগবে রোগী দেখা শেষ করতে।“

“আমাকে রোগী মনে হচ্ছে না আপনার? এনিওয়ে, আমি আপনার চেম্বারে বসছি। বেশিক্ষন অপেক্ষা করাবেননা প্লিজ। একটা মিটিং আছে।”

রোগী দেখা শেষ করে চেম্বারে গেল বুশরা। খুব বেশি সময় লাগে নি। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল রায়হান নামক লোকটি বার বার ঘড়ি দেখছে।

“আমি তো ভাবলাম আপনি চলে গেছেন। সন্ধায় বাসায় গিয়ে ড্রেসিং করে দিতে পারতাম।“

“ডাক্তার মিস, আমার একটা মিটিং আছে দুপুরে। ব্যান্ডেজ যতটা পারেন কমিয়ে দিন।“

“চাইলেই কি ব্যান্ডেজ কমানো যায় নাকি? ইনফেকশন হবে তো।“

কথা বলতে বলতেই ড্রেসিংয়ে মনযোগ দিল বুশরা। কিছুক্ষন বাদে অকপটে বলল,

“সরি।“

অবাক চোখে তাকালো রায়হান, “কেন?”

“আগের দিনের বাজে ব্যাবহারের জন্য।“

“ও আচ্ছা। ইটস ওকে।“

কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে বুশরা আবার বলল, “একটা কথা বলব?”

“বলেন।“

“না মানে আপনাকে প্রথমদিন হসপিটালে দেখার পরে মনে হয়েছিল আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি।“

“হয়ত রুকুর কাছে ছবি দেখেছেন।“

“না মনেহয়। তাহলে আমার মনে থাকত না?”

“আপনি ভাল বলতে পারবেন। এত চিন্তার চেয়ে বরং ড্রেসিংটা তাড়াতাড়ি করুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।“

হ্যা এত তাড়াহুড়া করেন দেখেই তো এক্সিডেন্ট হয়। মনে মনে বলল বুশরা। তবে হাত চালানোর গতি বাড়িয়ে দিল। ড্রেসিং শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগল না। চেকআপ শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো রায়হান।

“রাস্তাঘাটে চোখকান বন্ধ রাখেন নাকি মিস? এভাবে চললে কোনদিন আমার মত এক্সিডেন্ট করে বসবেন কে জানে।“

রহস্যময় হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল রায়হান। রায়হানের বলা কথার মাথামুন্ডূ না বুঝে হা করে তাকিয়ে রইলো বুশরা।

চলবে…