ডাক্তার মিস পর্ব-১০+১১

0
619

#ডাক্তার_মিস
পর্বঃ ১০
——————-
অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হল বুশরা। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অনেক রাত হয়ে গেছে। রাতটা চেম্বারেই কাটিয়ে দেবে নাকি ভাবছিল। তখনই চোখ পড়ল করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী মানুষটার দিকে। দুহাত পেছনে দিয়ে দেয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। করিডোরের আবছা আলোয় কি মায়াময় দেখাচ্ছে তাকে।

“আপনি? ফেরেন নি এখনো?”

“ধন্যবাদটা সামনাসামনি নিতে আসলাম মনে করুন।”

বুশরা লজ্জা পেয়ে বলল, “আসলে ওই সময় তাড়াহুড়ায়….”

কথা শেষ করার আগেই রায়হান থামিলে দিল ওকে।

“আপনার রোগীর কি অবস্থা?”

“এ যাত্রায় বেঁচে গেছে, আলহামদুলিল্লাহ।”

হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতাল গেইটে এসে বুশরা খেয়াল করল রায়হান বাইক নিয়ে আসেনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকালো ও। বাইকে ওঠার সময় বুশরার অস্বস্তিমাখা মুখ মনে করে বাইক আনেনি রায়হান। তবে সে কথা তুলে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি কউরতে চাইলো না।

“রাত বিরাতে গ্রামগঞ্জে হাঁটতে খারাপ লাগে না কিন্তু।”

ধীরপদে হাটতে হাটতে বুশরা প্রশ্ন করল,

“আমি আপনাদের অনেক ঝামেলা দিচ্ছি তাইনা?”

কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রায়হান বলল, “হঠাত এই প্রশ্ন?”

“এই যে আজকের ঘটনাই ধরুন। আপনার মত সম্মানী ব্যাক্তি, এই রাত বিরাতে আমাকে নিয়ে ছুটছেন।”

রায়হান সহসা উত্তর দিল না। এই মিষমিষে অন্ধকারেও একজোড়া কৌতুহলী চোখ উপেক্ষা করতে না পেরে বলল,

“আপনার মত ওয়েল স্কিলড ডঃ চাইলেই এই অজপাড়াগ্রামের পোস্টিং এড়াতে পারতেন। বা গঞ্জে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারতেন। আটটা-পাঁচটা ডিউটি করে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে পারতেন। গঞ্জে প্রাইভেট চেম্বার খুলে ব্যাবসা পেতে বসতে পারতেন। মেয়ে হওয়ার সুবিধা নিয়ে এই রাত বিরাতে হাসপাতালে আসা এড়াতে পারতেন। প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল উন্নত করা তো সম্ভব, ডেডিকেটেড ডাক্তার পাওয়া কি আদৌ সম্ভব?”

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল, “আজ যে ছেলেটা মরতে বসেছিল ওর আব্বা চায়ের দোকানদার। ক্লিনিকের বিল দূরে থাক, একটা গাড়ি ভাড়া করার টাকা তার সারা মাসের ইনকামের সমান। আবার টাকার কথা বাদ দিলাম, সেদিন আব্বাকে সময়মত চিকিৎসা দিতে না পারলে কি হত আমার চেয়ে আপনি আরো ভাল জানেন। আপনাকে বাসায় থাকতে দিয়ে আমরা উদ্ধার করছি, বা ছোট বোনের বান্ধবী জন্য উপকার করছি এরকম ভাববেন না।”

বুশরা চুপ করে আছে দেখে রায়হান থামল। ছোট্ট করে বলল, “নিজেকে বোঝা ভাববেন না। আমার এলাকার মানুষের জন্য আপনি যেভাবে করছেন সেটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। যেকোন হেল্প লাগলে অবশ্যই বলবেন।”

কথা শেষ করে রায়হান থামল। বুশরা একটু হাসার চেষ্টা করল।

“আচ্ছা আপনি তো শুনেছি ল নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। সব ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে নাম লেখালেন কেন? একদম রুট লেভেলেই বা কেন?”

“আব্বা সবসময় চাইতো আমি ডাক্তার হই। গ্রামের মানুষের সেবা করি। কিন্তু সায়েন্স ব্যাপারটা আমাকে টানেনি কখনো। ভার্সিটিতে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতি তে জড়িয়েছিলাম। সময়ের প্রয়োজনেই বলতে পারেন। হলে অনিয়ম, ছাত্রদের অধিকার আদায় এইসব নিয়ে। তখন বুঝলাম বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে রাজনীতি একটা ভাল অস্ত্র। ব্যাস, বাবার ইচ্ছাটা যদি অন্য উপায়ে পূরন করা যায় ক্ষতি কি?”

মাথা নেড়ে সায় দিল বুশরা। এভাবে কখনো চিন্তা করেনি ও।

“কেউ বাধা দেয়নি? অনেক ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলেন তো শুনেছি।”

প্রশ্নটা করেই বুশরার মনে হল অনধিকার চর্চা হয়ে যাচ্ছে এবার। তৎক্ষনাৎ সরি বলল তাই। রায়হান স্মিত হেসে বলল,

“ইটস ওকে। বাড়ি চলে এসেছি। এই গল্প পরেরবারের জন্য তোলা থাক?”

এবারে ধন্যবাদ দিতে ভুলল না বুশরা। রায়হান মাথা নেড়ে বলল ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। বুশরাকে বাড়িতে রেখে বেরিয়ে গেল রায়হান।

ঘরে এসেই বুশরা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগেই মনে পড়ল জামা কাপড় চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুতে হবে। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে হিচড়ে কলপাড় পর্যন্ত নিয়ে গেল ও। শুরুতে হাতমুখ ধোয়ার কথা চিন্তা করলেও চট করে একটা গোসল করে ফেলল। ক্লান্তি ধুয়েমুছে বেশ ফুরফুরে লাগল শরীরটা।

ঘুম পালিয়ে যাওয়ায় টেবিল থেকে একটা একটা বই নিয়ে জানালার পাশে বসল। মৃদুমন্দ বাতাসে চুলগুলো উড়িয়ে নিচ্ছে। বই রেখে বাইরের পরিবেশে মনযোগ দিল ও। চাঁদের আলোয় অস্পষ্টভাবে একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে পুকুরপাড়ে। পরনে সাদা ফতুয়া টাইপ কিছু। চিনতে অসুবিধা হলনা বুশরার।

বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকবার সেদিকে তাকালো বুশরা। ভোরের আলো ফুটছে তবু বাড়িতে আসার নাম নেই মানুষটার মাঝে। একটার পর একটা সিগারেটের সূক্ষ্ম ধোয়ায় কোন দুঃখ উড়াচ্ছে কে জানে। চেইনস্মোকার হয়ত। অথচ আজ এত কাছে বসেও তো নিকোটিনের গন্ধ পায়নি বুশরা।

চলবে…

#ডাক্তার_মিস
পর্বঃ ১১
——————–
সুক্ষ্ম ধোঁয়া ছড়াচ্ছে রায়হানের আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরা শলাকা থেকে। সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। বারবার স্মৃতি হাতড়ে পৌঁছে যাচ্ছে আজ থেকে সাত কি আট বছর আগের দিনগুলোতে।

ক্যাম্পাস, রাজনীতি,পরাশুনা, বন্ধু নিয়ে টালমাটাল সময়টাতে অন্যরকম একটা সম্পর্ক হয়েছিল কথার সাথে, পুরো নাম রূপকথা। ওটাকেই সম্ভবত ভালবাসা বলে। রূপকথার রাজকন্যার মতই সে ছিল সুন্দরী।

সারাদিনের ছোটাছুটির ক্লান্তি ধুয়েমুছে দিত রূপকথার সাথে কাটানো সুন্দর বিকেলগুলো। ক্লাসরুম, টিএসসি, চারুকলা, শহীদ মিনার সবখানে ছিল ওদের অবাধ বিচরণ। বন্ধুমহলের সবাই কমবেশি জানত ওদের সম্পর্কে। বন্ধু, জুনিয়র, ক্যান্টিনের বয় থেকে পরিচিত রিকশাওয়ালা পর্যন্ত রূপকথা ছিল জাতীয় ভাবী।

তারপরেও অজানা কারনে মেয়েটা মাঝে মাঝেই ইনসিকিউরড ফীল করত। রায়হানের সাথে কোন সুন্দরী মেয়ে একটু হেসে কথা বললেই, সদা হাস্যময়ী মেয়েটার মনের আকাশে মেঘ জমতো। রূপ ছিল একটা পাগলী। রায়হানের পাগলী।

আর পাঁচটা সাধারণ বিকেলের মতই এক বিকেলে রূপকথার জন্য অপেক্ষা করছিল। বরাবরের মতই লেইট রূপকথা। অপেক্ষার প্রহর কাটাতে এলোমেলোভাবে হাটাহাটি করছিল রায়হান। তখনই দেখা হল স্কুলের বান্ধবী মিতুর সাথে, প্রায় পাঁচ বছর পর। বহুদিন পরে পুরোনো বন্ধুকে দেখে উচ্ছ্বসিত দুজনেই।

গল্পে গল্পে জানা হলো রায়হানের মত মিতুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ে। ফার্মেসী ডিপার্টমেন্টে। ফোন নাম্বার বিনিময় করে বিদায় নিতে চাইলে রায়হানই মিতুকে বলল রূপকথার কথা, পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু সেদিন গোধুলি বেলায়ও দেখা মিলল না রূপকথার। মিতুকে বিদায় জানিয়ে হাটতে হাটতে রূপকথাকে ফোন করল রায়হান। কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ধরল ও।

“রূপ..”

ওপাশ থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে রায়হান আবার বলল,

” কি ব্যাপার? কথা বললছো না কেন?”

“তোমার কথা বলার মানুষের অভাব?”

ফোনের ওপাশের আবহাওয়া উত্তপ্ত, বুঝল রায়হান। এক মুহুর্ত থেমে বলল,

“আমার কথার অভাব। রূপকথা।”

ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসলো না। তবে মেঘ গলছে বুঝতে পারে রায়হান। আলত করে বলল,

“একবার হলের গেইটে এসো। কি করেছি বলে যাও এট লিস্ট।”

ফোন কেটে দিল কথা। হাফ ছেড়ে বাঁচলো রায়হান। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঝড়ের গতিতে ছুটে আসলো মেয়েটা। পরনে মিষ্টি রঙের সুতির শাড়ি। হাতে, গলায় মাটির গয়না। ওয়াটারপ্রুফ কাজলের আড়ালে ফোলা ফোলা লাল টকটকে চোখ নজর এড়ালোনা রায়হানের।

অভিমানী মেয়েটার হাত আলতো করে ধরে জিজ্ঞাসা করল রায়হান,

“কি হয়েছে কথা? এত অভিমান কিসের?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কথা বলল,

“মেয়েটা কে?”

“কোন মেয়েটা?”

কথা উত্তর দিল না। পুরো ঘটনা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল রায়হানের। অন্য কোন ছেলে হলে হয়ত এত সন্দেহবাতিকতার জন্য রাগারাগি করত। কিন্তু রায়হানের কাছে এটা কথার অবুঝ ভালবাসা। হো হো করে হেসে বলল,

“তাহলে এই কাহিনী? ওইটা মিতু। আমার স্কুলের বন্ধু। হঠাতই দেখা হল। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলাম। তুমি তো……….. তা কবে তোমার এই ইনসিকিউরিটি যাবে?”

“জানিনা।”

“বিয়ের পরে?”

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো কথা। মায়াময় সেই অভিব্যাক্তি দেখে নাকটা টেনে দিয়ে রায়হান বলে বসলো,

“তাহলে বিয়েটা করে ফেলি? কি বলো?”

কাঁদোকাঁদো হয়ে কথা বলল, “ফাইজলামি করো আমার সাথে? ফাইজলামি করো?”

কথার হাতদুটো শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রায়হান বলল,

“রূপ…., রুমে যাও। আমি আসি।”

মেয়েটাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল রায়হান। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রাগে অভিমানে কথার দুচোখে অবাধ্য জলধারারা রাজত্ব ঘোষণা করল আবার।

ঘরে ফিরে ফোনটা সুইচ অফ করে বিছানায় ছুড়ে ফেলল কথা। তারপর ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়ল।

ঠিক তার দুঘন্টা পরে আবারো হলের সামনে আসলো। রায়হান। বেশ কয়েকবার ফোন করল কথাকে। বার বার চেষ্টা করেও ফোনে না পেয়ে টেনশনে কথার রূমমেটকে ফোন করল ও। কথা ঘুমাচ্ছে শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল।

কথার ঘুম ভাংলো গভীর রাতে। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জালিয়ে এক গ্লাস পানি খেল ও। গ্লাসটা টেবিলে রাখতে গিয়ে খেয়াল করলো একটা প্যাকেট রাখা ওখানে৷ চোখ কচলে প্যাকেটটা খুললো কথা। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো একটা লাল টুকুটুকে তাঁতের শাড়ি, কাঁচের চুড়ি, মেহেদীর টিউব আর এক টুকরো কাগজ।

গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, “সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাইলে সকাল দশটায় রেডি হয়ে হলের সামনে এসো। অপেক্ষা করব।”

চলবে??