ডাক্তার মিস পর্ব-৮+৯

0
631

#ডাক্তার_মিস [পর্বঃ৮]
মায়ের ফোন পেয়েই হন্তদন্ত করে বাড়িতে ফিরল রায়হান। সদর দরজা পার হতে হতেই হাঁকডাক শুরু করল গাড়ি বের করার জন্য। হুড়ুমুড় করে বাবামায়ের ঘরে ঢুকে দেখল রুস্তম শেখ বিছানায় শোয়া। চোখদুটো বন্ধ। মাথার কাছে বসে পাখা বাতাস করছে শিউলি বেগম। রায়হান ব্যাস্তভাবে মাকে বলল,

“আম্মা, গাড়ি বের করতে বলোনি কেন এখনো?”

শিউলি বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বুশরা বলল,

“চাচা একদম ঠিক আছে। ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। কয়েকঘন্টা ঘুমাবে। আপনি প্লিজ চেঁচামেচি করবেন না এখানে।”

এতক্ষণে রায়হানের খেয়াল হল ডাক্তার মিসও আছে ওখান্র। পালস চেক করছে। নিজেকে শান্ত করল ও। কিছুক্ষণ বাদে বুশরা বলল,

“আমরা বরং বাইরে গিয়ে কথা বলি। চাচি মা থাকুক শুধু।”

বাধ্য ছেলের মত বুশরার পিছে পিছে বেরিয়ে গেল রায়হান।

“কয়েকটা ওষুধ লাগবে। হসপিটালে যেগুলো পাওয়া যাবে আনতে পাঠিয়েছি। কিন্তু কয়েকটা ওষুধ এখানে পাওয়া যাবে না বোধহয়। কাওকে দিয়ে একটু গঞ্জ থেকে আনাতে পারবেন? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব?”

“আপনি লিখে দিন আমি আনছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”

এপ্রোনের পকেটে দুহাত চালিয়ে বুশরার খেয়াল হল তাড়াহুড়ায় নোটপ্যাডটা আনেনি। বুঝতে পেরে রায়হান বলল,

আপনার ফোনটা দিন। এক মুহুর্ত পরে ফোনটা ফেরত দিয়ে বলল,

“মিসডকল দিয়ে রাখলাম আমার নম্বরে। হোয়াটসঅ্যাপ করে দিন প্লিজ। আমি চললাম।”

বাইকের ধোঁয়া উড়িয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল রায়হান। যার পেশা শুনলে শুরুতেই যেকেউ ধারনা করবে, মধ্যবয়সী, ভারিক্কি, পেটমোটা গোছের কেউ হবে হয়তবা। আইন পাশ করে কোন যুবকের মাথায় যে চেয়ারম্যান হওয়ার ভুত ঢুকতে পারে এটা রায়হানকে না দেখলে জানা হত না বুশরার। আজ কাল কার বাবা মায়েরা তো ছেলেমেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া কিছু হিসাবে কল্পনাই করতে পারেননা।

হসপিটাল থেকে ফোন আসায় শিউলি বেগমকে চিন্তা না করতে বলে বেরিয়ে গেল বুশরা। যাওয়ার পথে রায়হানকে ওষুধগুলোর নাম হোয়াটসঅ্যাপ করতে ভুলল না। তার আগে মৃদু হেসে নম্বরটা সেভ করে রাখল “Chairman Strange” নামে।

রোগীর চাপ কমলে ডাঃ ইকবালকে বলে বাড়িতে চলে আসলো ও। কিছুক্ষণবাদে রায়হানও ফিরল। বুশরার হাতে ওষুধগুলো বুঝিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

“আর কিছু লাগবে?”

“এই প্রশ্ন ফার্মেসীতে বসে করলে বুঝতাম। এখন বললে কি আবার যাবেন?”

“দরকার হলে যাবো, সমস্যা নেই তো।”

“আর কিছু লাগলে আমি ফোন করতাম।”

“হুম।”

এক মুহুর্ত নিস্তব্ধতার পর রায়হান বলল,

“ডঃ”

“বলুন?”

“ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“আব্বার আগেরবার যখন এটাক হয়েছিল গঞ্জে নিতে অনেকটা সময় লেগে গেছিল। ডাক্তাররা বলেছিল পরেরবার আব্বা এতটা সময় দিবে না ডাক্তারের কাছে নেওয়ার। আপনি না থাকলে কি যে হত।”

“এটাতো আমার দায়িত্ব। ধন্যবাদ দেবেন না প্লিজ।”

“শহরমুখী মানুষের ভীড়ে আপনি যে গ্রামটাকে বেঁছে নিয়েছেন, ধন্যবাদটা সেজন্য।”

মৃদু হেসে বুশরা জিজ্ঞাসা করল, “আপনার মত?”

উত্তর শোনার আশায় না থেকে দ্রুতপদে রুস্তম শেখের ঘরে চলে গেল বুশরা। ওষুধগুলো খাইয়ে দিয়ে বসল উনার পাশে।

“চাচা, ভাল লাগছে এখন?”

অস্ফুটস্বরে হ্যাঁসুচক উত্তর দিলেন তিনি। একফোটা জল গড়িয়ে পড়ল শিউলি বেগমেন গাল বেয়ে। বড় নিঃশব্দ সে কান্না। মুখের দিকে না তাকালে বুঝার উপায় নেই।

রায়হান আসতেই চেয়ার ছেড়ে যায়গা করে দিল বুশরা। কিন্তু রায়হান গিয়ে বসল বিছানার পাশে। হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

“আব্বা তোমার স্বপ্নের গ্রাম চোখের সামনে সত্যি হওয়া দেখবে না? সামনের সপ্তাহে বালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর। এত অসুস্থ হলে অনুষ্ঠানে যাবে কি করে?”

হেসে মাথা নাড়লেন। মনে মনে বললেন, “আমি জানি আমার ছেলে পারবে একদিন। সোনার বাংলায় সোনার গ্রাম হবে এই স্বাধীনপুর। তোর উপর ভরসা করেই তো নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারব।”

বুশরা বলল,

“চাচা ঘুম আসে না? আরেকটু ঘুমান। চাচি আমি আছি এখানে, আপনি তো দুপুরে খাননি মনেহয়। খেয়ে আসেন।”

“আমার ক্ষুধা নাই মা। তুমি যাও। আরাম কর একটু।”

“আম্মা আমার ক্ষুধা লাগছে। চলো।”

টোপটা কাজে দিল। ছেলের খাওয়ার কথা চিন্তা করে উঠলেন শিউলি বেগম। ঘরের লাইটটা বন্ধ করতেই কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল শ্রান্ত রুস্তম শেখ।

মাকে পাশে বসিয়ে জোর জবরদস্তি করে খাওয়ালো রায়হান। নিজেও কয়েক লোকমা খেয়ে নিল। জীবনযুদ্ধে নেমে রায়হান একটা জিনিস শিখেছে, পেটে ক্ষুধা নিয়ে কোন বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়না। নিজে সুস্থ থাকলেই অন্যদের ভাল রাখার দায়িত্ব নেওয়া যায়।

শিউলি বেগম খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরে গিয়ে দেখলেন মেয়েটা টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে বাড়ি-হসপিটাল-বাড়ি দৌড়াতে দৌড়াতে। তাই ডাকলেন না। আবার ভাবলেন এভাবে ঘুমালে তো ঘাড়ে ব্যাথা করবে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ধড়মড় করে উঠল বুশরা। এভাবে ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য লজ্জা পেল।

“ঘরে গিয়ে ঘুমাও মা। তোমার চাচা উঠলে আমি ডাক দিব।”

শরীরে কুলাচ্ছেনা দেখে সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেল ও। বিছানায় মাথা দিতেই রাজ্যের ঘুম ভর করল দুচোখে। স্বপ্নে এল এক রাজকুমার। রাগী, অদ্ভুত রাজকুমার। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল গহীন অরন্যে। সূর্যরশ্মিরাও পৌঁছাতে পারেনা সেই অরন্যে। হিংস্র জন্তুতে পরিপূর্ণ সে অরন্য। ছুটতে ছটতে ওরা পৌঁছালো অরন্যের শেষ প্রান্তে। গাছপালা কমতে কমতে অরন্য শেষ হল। কিন্থ একি, এ তো পাহাড়ের শেষ প্রান্ত। কোথায় যাবে ওরা। আচমকা ওকে কোলে তুলে নিল রাজকুমার। চোখ বড়বড় করে তাকালো ও রাজকুমারের দিকে। মুহুর্তে রাজকুমার ঝাঁপ দিল পাহাড়ের কিনারা থেকে। তরতর করে নীচে পড়তে পড়তে বুশরার মনে রাজকুমার তার বড্ড চেনা।

ঠিক তখনই ঘুম ভেংগে গেল বুশরার। ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর। এমন স্বপ্ন দেখার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেলনা ও। বিছানার পাশে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেল বুশরা। অস্ফুটভাবে উচ্চারণ করল, “অদ্ভুত”।

পরের পর্ব দ্রুত পেতে চাইলে লাইক, কমেন্ট শেয়ার করে জানান দিন যে গল্পটি কেমন হচ্ছে।

চলবে????????

#ডাক্তার_মিস ❤️❤️
পর্বঃ৯
——————–
দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। রায়হানের বাউন্ডুলে জীবন, বাড়িতে কাটে শুধু রাতটা, সারাদিন, মিটিং, মিছিল সমাবেশ করেই কেটে যায়। বুশরাও আছে বুশরার মত, হসপিটালে সারাদিন কেটে যায়। রাতও হয়ে যায় মাঝে মাঝে, রোগীর চাপ বেশি থাকলে। একটা ভ্যানওয়ালা চাচার নাম্বার নিয়ে রেখেছে, ফোন দিলেই চলে আসে। আর বাড়ি ফিরে রেস্ট নিয়ে কিছুটা সময় কাটায় শিউলি বেগমের সাথে। পরিবারহীন বুশরাকে এই বাড়ির সবাই নিজেদের একজন করে নিয়েছে। ছুটির দিনগুলোতে বুশরা বিভিন্ন রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে। আজকেও সেরকমই এক ছুটির দিন।

রুস্তম শেখ ভর সন্ধ্যাবেলা ইয়্যা বড় একটা রুইমাছ এনেছেন বড়দিঘীর পাড় থেকে। প্রায় ছয়কেজি ওজন হবে। অনেক কসরত করে সেটা কাটাকুটি করে রেডি করা হয়েছে। শিউলি বেগম রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বুশরা বসে বসে দেখছে কিভাবে কি করে। বড় হওয়ার পরে পরিবারের সংস্পর্শ না পাওয়ায় রান্নার ব্যাপারটা আয়ত্ত্ব করতে পারেনি কখনো ও। যা ও বা রান্না করত সেগুলো নিতান্তই পেট চালানোর মত। ডাল, ভাত, খিচুড়ি, ভর্তা এইসব আরকি। এখন অবশ্য সুযোগ পাওয়ার শিখে ফেলছে যতটা সম্ভব। শিউলি বেগমও মেয়ের মত আদর করে শিখাতে কার্পণ্য করেন না।

শিউলি বেগমের মাছ রান্না খুবই মজা। বুশরা চিন্তা করেছে, আর কিছু শিখতে পারুক না পারুক, এই মাছ রান্না শিখে ফেলবে। মনযোগ দিয়ে রান্না করা দেখছিল ও। আর টুকটাক গল্প করছিল। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরতেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেল বুশরার।

“এখনি আসছি।”

“হ্যাঁ।”

” ঘুমিয়ে পড়ে না যেন কোনভাবেই।”, বলেই ফোনটা কেটে দিল ও।

শিউলি বেগম জিজ্ঞাসা করলেন, ” হাসপাতাল যাওয়া লাগবে এত রাতে?”

“হ্যাঁ চাচি।”

এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে ঘরে চলে গেল বুশরা। মুহুর্তের মধ্যে রেডি হয়ে নেমেও আসলো। অস্থিরভাবে কানে ফোনটা ধরে রেখেছে। শিউলি বেগম দেখে বললেন,

“কোন সমস্যা?”

“চাচি, ভ্যানওয়ালা চাচাকে ফোনে পেলাম না।”

“কফিল ভাই ও তো গঞ্জে গেছে তোমার চাচার সাথে। একলা মেয়েমানুষ এই রাতবিরাতে কেম্নে যাইবা?”

“জীবন নিয়ে টানাটানি চাচী। যেতেই হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

এমন সময় বাড়িতে ঢুকল রায়হান। এমন সময় ছেলেকে দেখে খুশি হলেন শিউলি বেগম। ইতস্তত করে

“আব্বা, তুমি কি একটু বুশরা মা কে একটু হসপিটালে পৌঁছে দিতে পারবে?”

বুশরার চোখেমুখে অস্থিরতা দেখে আর প্রশ্ন করল না রায়হান।

“আসুন।”

এইমাত্রই বাইরে থেকে আসায় বাইক বাইরেই রাখা ছিল। বাইক স্টার্ট দিয়ে ইশারায় বুশরাকে পেছনে বসতে বলল রায়হান। বুশরার চোখেমুখে অস্বস্তি দেখে রায়হান বলল,

“হেটে যেতে যেতে আপনার রোগী বেঁচে থাকবে তো?”

বুশরা আর দেরি করল না। যতটা সম্ভব জড়োসড়ো হয়ে বসল বাইকের পেছনে। একহাতে পেছনের স্ট্যান্ডটা শক্ত করে ধরে রাখল।

“কাঁধে হাত দিলে আমি খেয়ে ফেলব না আপনাকে।”

বুশরার রাগ হল। কিন্তু কিছু বলল না। রায়হানও আর কিছু বলল না। রাতের পথঘাট, গর্তটর্ত খেয়াল করে সাবধানে বাইক চালালো। ছয় সাত মিনিটের মাথায় হাসপাতালের গেটে বাইক থামানো মাত্র নেমে দৌড় দিল বুশরা। লবিতে পৌঁছানোর পরে মনে পড়ল, ভদ্রলোককে একটা থ্যাংকসও দেওয়া হলনা। ফিরে যাওয়া মানে সময় নষ্ট, আর উনি হয়ত চলেও গেছেন। বেশি ভাবনাচিন্তা না করে ওটিতে চলে গেল বুশরা।

ওদিকে বুশরার গমনপথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রায়হান, “অদ্ভুত মেয়ে তো”। সারাদিনের দৌড়ঝাপে ক্লান্ত রায়হান আর দাড়ালো না ওখানে। বাড়ি গিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

প্রেমে ব্যার্থ হয়ে একপাতা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক ছেলে। আজকালকার বাচ্চাগুলো যে কি হয়েছে! ছেলেটার মা বাবার আহাজারিতে হসপিটালের করিডোর কেঁপে উঠছে এই নিষুতি রাতে। এক মুহুর্ত দেরি না করে ওয়াশ করতে শুরু করলো ওরা।

ক্ষুধার পেটে ঘুমানোয় মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেল রায়হানের। ফোনটা হাতে নিল কয়টা বাজে দেখার জন্য। ইনবক্সে একটা নতুন ম্যাসেজ। ওপেন করতে সামনে এল একটাই শব্দ, “ধন্যবাদ”।

মুহুর্তেই রায়হানের মনে হল, “ডাক্তার মিস কি ফিরল?”

রাত অনেক হয়েছে। ইতস্তত করে একটা ফোন করেই ফেলল ওই নাম্বারে। ওপাশ থেকে কোন রেসপন্স না পেয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। বুশরার ঘরের দিকে গিয়ে দেখল দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই।

অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হল বুশরা। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অনেক রাত হয়ে গেছে। রাতটা চেম্বারেই কাটিয়ে দেবে নাকি ভাবছিল। তখনই চোখ পড়ল করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী মানুষটার দিকে। দুহাত পেছনে দিয়ে দেয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। করিডোরের আবছা আলোয় কি মায়াময় দেখাচ্ছে তাকে।

“আপনি?”

চলবে??????