#ডাক্তার_মিস [পর্বঃ৬]
হাসপাতাল থেকে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল বুশরার। হেটে যেতে বড়জোর দশ পনের মিনিট লাগবে। কিন্তু ওর মনে হল নতুন যায়গায় একা রাত করে চলাফেরা করা ঠিক হবে না। তার উপর গ্রাম এলাকা। খুব করে চাচ্ছিল যাতে একটা ভ্যান পায়। দুই মিনিট হাটতেই পেয়ে ও গেল।
“মামা যাবেন?”
“কই যাবেন?”
“পূর্ব পাড়া। চলেন আমি দেখায়ে দিচ্ছি।”
“উঠেন উঠেন।”
কিছুদুর যাওয়ার পর ভ্যানওয়ালা মামা জিজ্ঞাসা করল,
“কার বাড়ি যাবেন বলেন আপা। এই পাড়ার সক্কলরেই আমি চিনি।”
“রুস্তম শেখ চাচার বাড়ি।”
“ও আগে কইবেন তো, চেয়ারম্যানবাড়ি।”
রুকুর বাবা যে এলাকার চেয়ারম্যান সেটা জানতো না বুশরা। রুকু কখনো বলেনি। শুধু বলেছে ওর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিশোর বয়সে বড় ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে গেছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশের পতাকা তো সাথে নিয়ে এলেন ঠিকই, কিন্তু বড় ভাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন নি। লাশটাও দাফন করতে পারেন নি। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে দেশমাতা।
“আপ্নেরে তো এই গেরামে আগে দেহিনাই আফা। বেড়াইতে আইছেন?”
“না। আপনাদের যে হসপিটাল, ওখানকার নতুন ডাক্তার আমি। আপনাদের চেয়ারম্যানসাহেবের মেয়ের বান্ধবী আমি। উনার বাড়িতেই উঠেছি।”
“চেয়ারম্যান সাহেবের মাইয়া? কি কন আফা? উনি তো বিয়াই করেননি এখনো। করলেও আপ্নের সমান মাইয়া হইতো না।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বুশরা। আমতা আমতা করতেই, ভ্যানচালকই বলে উটল,
“ও…. বুঝছি, আপনি রুকু আপার বান্ধবী। ঠিক কইছি না? উনি তো চেয়ারমানসাবের বইন লাগে।”
“ওহ…”
কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না বুশরা।
ভ্যানচালক নিজের মনেই বলতে থাকলো,
“চেয়ারম্যানসাব এই কয়বছরে এলাকার পুরা চেহারাই বদলায়ে দিছে আপা। উনার মতন ভাল মানুষ হয়না। আগের চেয়ারম্যান ছিল বজ্জাত। সব ট্যাকা পকেটে ঢুকাইতো।
ভ্যান থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল ও।
বাড়ির সামনে বেশ বড়সড় জটলা দেখে থমকে দাড়ালো বুশরা। মধ্যমনি রায়হান। লোকটা যে বখাটে পাতি নেতা না, বরং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সেটা বুঝল অবশেষে। ঠিক তখনই ওর মনে পড়ে গেল, কেন রায়হানকে পরিচিত মনে হচ্ছিল, আর কেনই বা লোকটা ওকে বলেছিল যে সে রাস্তাঘাটে চোখ বন্ধ করে চলে। বাসস্ট্যান্ডে সারি সারি পোস্টার দেখেছিল এলাকায় এসেই, পোস্টারের এক নজর দেখা সেই হাস্যোজ্জল মুখটাই তো রায়হান।
আলোচনার মাঝখানে বুশরার দিকে একবার ফিরে তাকালো রায়হান। তৎক্ষনাত ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মত বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল বুশরা।
শিউলি বেগমের সাথে বেশ সখ্যতা হয়েছে বুশরার। মা মেয়ের রসায়ন কেমন হয় সেটা তো ও জানেনা, কিন্তু বহু বছর পর স্নেহের পরশ পেতেই বুশরার মনপ্রাণ আর্দ্র হয়ে উঠেছে। বান্ধবহীন গ্রাম্য জীবন তাই খুব বেশী পীড়াদায়ক হয়নি ওর।
হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরতেই বিছানার উপর পায়েশের বাটি দেখল বুশরা। এতগুলো পায়েস কোনও মতেই পেটে আঁটবে না ওর এটা শিউলি বেগমকে বুঝায় কে? এঁটো না করে বাটি থেকে আগেই কিছুটা পায়েশ উঠিয়ে রেখে আসার জন্য ছুটল ও। সিড়ি বেয়ে নামা শুরু করতেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। এখানে সন্ধ্যার পরে ইলেক্ট্রিসিটি থাকা অনেকটা পূর্নিমার চাঁদের মতই। ফোনটাও সাথে নিয়ে আসেনি যে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাবে ।গ্রামের মাটির বাড়ির সিড়িগুলো বেশ সরু আর দুপাশে দেয়াল থাকে। এক হাত্র দেয়াল ধরে ধরে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকল বুশরা। আরেক হাতে পায়েসের বাটি। কয়েক ধাপ দিতেই হাতের বাটিটা কিছুতে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল। ঠিক তখনই ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসলো। আলো ঝলমলে সিড়িতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান। মেরুন পাঞ্জাবিতে সাদা পায়েস ল্যাপ্টালেপ্টি অবস্থা।
“দেখে চলতে পারেন না?”
চলবে…
#ডাক্তার_মিস [পর্বঃ ৭]
ঠিক তখনই ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসলো। আলো ঝলমলে সিড়িতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান। মেরুন পাঞ্জাবিতে সাদা পায়েস ল্যাপ্টালেপ্টি অবস্থা।
“দেখে চলতে পারেন না?”
“অন্ধকারে আপনি দেখতে পান?”
“অন্ধকারে ভুতের মত দৌড়াদৌড়ি না করলেই পারেন।”
বুশরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল রায়হান। দোষ যারই হোক, নতুন পাঞ্জাবি মাখামাখি হওয়ার ভীষণ বিরক্ত রায়হান।
খালি বাটিটা হাতে নিয়ে শিউলি বেগমের সামনে অপরাধীর মত কাচুমাচু করছে বুশরা। শিউলি বেগম বারবার জিজ্ঞাসা করছেন কি হয়েছে। খানিক্ষন চুপ থেকে বুশরা বলল,
“আন্টি আসলে… আসলে হয়েছে কি, আমি তো অতগুলো পায়েস খেতে পারিনা…”
“বাটি তো খালি! মজা হইছিলো?”
“না… মানে হ্যাঁ মজা হইসিল মনেহয়। আমি আসলে কমানোর জন্য আসছিলাম।”
“তারপর?”
“সিড়িতে আসতেই কারেন্ট গেল চলে, আর পায়েসের বাটি রায়হান সাহেবের পাঞ্জাবিতে।”
“ও এই কথা! আচ্ছা সমস্যা নাই, পায়েশ আরো আছে। সব কি পাঞ্জাবিতেই গেছে নাকি সিড়িরও কপাল খুলছে?”
“সিড়ির ও।”
বুশরার মুখভংগি দেখে হাসতে হাসতে শিউলি বেগমের অবস্থা শেষ। তখনি রুকাইয়া ফোন দেয় মা কে। শিউলি বেগম ফোন ধরে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন দেখে ওপাশ থেকে রুকু বলে,
“কি হইছে মা? বাড়িতে কি জোকার আসছে?”
হাসি থামিয়ে রসিয়ে রসিয়ে মেয়েকে কাহিনি শোনালেন তিনি। রুকুও বেশ হাসলো। তারপর চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“আমরা তো হাসতেছি, তোমার পুত্র মনেহয় ক্ষেপে বোম হয়ে গেছে। তাকে পায়েশ খাওয়ায়ে ঠান্ডা করো আম্মা।”
মেয়ের সাথে কথা বলার ফাঁকে কাজের মেয়েটাকে পাঠালেন সিড়ি পরিস্কার করতে। বুশরাকে আদর করে আবার পায়েশ খেতে দিলেন। সামনে বসিয়ে খেতে বাধ্য করলেন সবটুকু। তারপর আরেকবাটি পায়েস ট্রেতে করে টেবিলে রেখে বললেন,
“বুশরা মামনি, রহিমাকে একটু বলো তো সিড়ি পরিস্কার করা হলে পায়েশটা নিয়ে একটু রায়হানের ঘরে দিয়ে আসতে।”
বুশরা ইতস্তত করে বলল, “আমি নিয়ে যাই?”
“আরে না না, তোমার কষ্ট করা লাগবে না।”
“না না আন্টি কষ্ট কিসের? আর আমি তো দোতলায়ই যাবো। তাছাড়া, সরি ও বলা হয়ে যাবে।”
একটু ভেবে শিউলি বেগম বললেন, “আচ্ছা ঠিকাছে। সাবধানে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ট্রে টা নিয়ে ধীরে সুস্থে দোতলায় গেল বুশরা। আধা ভেজানো দরজায় হাতের উলটো পিঠ দিয়ে আস্তে করে নক করল দুবার। ভেতর থেকে উত্তর এল,
“খোলা আছে।”
“আসব?”
অবাক সুরে রায়হান বলল,
“ডাক্তার মিস, আপনি?”
“পায়েশ পাঠিয়েছে আন্টি।”
“আপনাকে পাঠিয়েছে? টেবিলে রাখুন।”
“আসলে আমিই নিয়ে আসলাম, সরি বলতে।”
“কোনটার জন্য বলুন তো?”
বুশরার মনে হল পরোক্ষভাবে যেন রায়হান লোকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো যে সরি বলার অনেক কারন আছে।
এক মুহুর্ত থেমে উত্তর দিল, “সিড়ির ঘটনার জন্য।”
“ও আচ্ছা। সরি বলতে হবে না। অন্ধকারে আরো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। সাবধানে চলবেন।”
“জি আচ্ছা।”
বুশরা চলে যেতে উদ্যত হলে রায়হান বলল,
“ডাক্তার মিস, শুনুন…”
“বলুন”
“রাতবিরাতে গ্রামে একা চলাফেরা করবেন না এত। ইমারজেন্সি থাকলে কাওকে সাথে নিবেন। গ্রামের মানুষ ভালো, কিন্তু সবাই না।”
মাথা নেড়ে সায় দিল বুশরা। তারপর, দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে বলল,
“আমি তো আপনার ছোটবোনের বয়সী, আমাকে বুশরা ডাকতে পারেন।”
“আপনি আমার ছোটবোন নন। আসুন এখন।”
মনে মনে বলল, ডাক্তার মিসের নাম তাহলে “বুশরা।”
চলবে..