তখন অপরাজিতা পর্ব-০৬

0
52

-৬

১১
আজ রবিবার, অয়নির মা আজ রাতে ফিরবেন ঢাকায়। স্কুল ছুটির পর অয়নির খুব মন খারাপ লাগতে লাগলো।
আজ বাংলা ক্লাশটেস্ট এর রেজাল্ট দিয়েছে, অয়নি খুব সাধারণ ভুলের জন্য পাঁচ মার্ক মিস করেছে। সবাই ই ভালো করেছে। গতকাল বাবার সাথে দেখা করার কথা ছিল, কিন্তু অয়নি যায়নি।বাবাকে বলেছে না আসতে।
মা ও ঢাকায় নেই। এখন মনে হচ্ছে মায়ের সাথে গেলেই ভালো হতো।
গত সপ্তাহে হাসিব ভাইয়া তিন দিন এসেছেন। নিরিবিলি ম্যাথ গুলো করিয়ে চলে গিয়েছেন। হাসিব ভাইয়াকে খুব ভালো লাগছে। আগের চাইতে অনেকটা সহজ হয়েছেন।
মাঝে মাঝেই নিজের স্টুডেন্ট লাইফের গল্প করেন।
আচ্ছা আজ হাসিব ভাইয়াকে একটা ফোন করা যায় না!
যদি ফ্রি থাকেন, আসতে বলে দেখব? নিজের কাছেই প্রশ্ন করে অয়নি!
ইস, আজ এত অস্থির লাগছে, আপুমনি নুডুলস দিয়েছেন, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। অয়নি কিছুক্ষণ টিভি দেখল। টিভি দেখতেও ভালো লাগছে না। নায়েরা আজ আবার ওদের সাথে গিয়েছে। কিন্তু অয়নিকে বলেনি যেতে।
অয়নিকে বলেছে, তোর যেতে হবে না, ভালো লাগবে না তোর!
সব গুলো বিষয় নিয়ে মনটা খারাপ হয়ে আছে। গতকাল আপুমনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তোর মায়ের একটা বিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো, একা একা কতদিন থাকবে আর!
যদিও মজা করে বলেছেন, কিন্তু অয়নির খুব মন খারাপ হয়েছে। মা যদি বিয়ে করে তাহলে অয়নি কার কাছে থাকবে!

অয়নি দু বার ল্যান্ডফোনের কাছে গিয়ে ফিরে এলো।
ফোন করবে ভেবেও করল না। আচ্ছা যদি মোবাইল থেকে ফোন করে? এই নম্বরটা হাসিব ভাইয়া চেনে না। গত সপ্তাহে মামা এনে দিয়েছেন নতুন হ্যান্ডসেট। অয়নি ভালো করে ইউজও করেনি!
অয়নি ফোন হাতে নিলো, হাসিব ভাইয়ার ফোন নম্বরটাও সুন্দর, ট্রিপল টু ডাবল ফোর টু, অয়নির মুখস্থ।
অয়নি আনমনে ডায়াল করেই ফেলল। রিং বেজে গেল, রিসিভ করল না। আননোন নম্বর দেখে মনে হয়। পাঁচ মিনিট পরে ফোন এলো হাসিব ভাইয়ার নম্বর থেকে।
অয়নির বুক কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলল,
ওপাশ থেকে রাণী বলল, হ্যালো, কে বলছেন প্লিজ?
অয়নি বলল, এটা হাসিব ভাইয়ার নম্বর না, আমি ওনার ছাত্রী, অয়নিতা।
রানী বলল, ওহ, অয়নিতা, তোমার টিচার তো একটু বাসার বাইরে গিয়েছে, চার্জ ছিল না বলে ফোনটা রেখে গিয়েছে!
অয়নি বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে। পাপাই ছিল রানীর কোলে, রানী ফোন কানে নিয়ে ডাকল, বুয়া পাপাইকে নাও তো।
অয়নি স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে হোন ভাইয়ার?
রানী শব্দ করে হেসে বলল, তোমার টিচার এত রাশভারি যে আমার গল্প তোমার সাথে করে ওঠেনি মনে হয়, আমি ওর ওয়াইফ, রাণী।

অয়নির ভেতরটা কেঁপে উঠল, ও কী ঠিক শুনল! হাসিব ভাইয়ার ওয়াইফ, কিন্তু ভাইয়া তো কখনো বলেনি!

একবারো অয়নির মনে হলো না, ওয়াইফের কথা বলার মতো তেমন কোন কথাই হয়নি হাসিবের সাথে। টুকটাক যে কথা হয়েছে, সেগুলো খুবই সাধারণ। অয়নি ফোন রেখে দিলো ধপ করে। খুব কান্না পাচ্ছে। ভাইয়া এমনটা কেন করল।ওর অস্থির মনে একবারো মনে হলো না, হাসিব কিছুই করেনি!

অয়নির সব চিন্তা ছিল এক তরফা, একা একা অনেক কিছু ভেবে একটা ফ্যান্টাসীর জগতে চলে গিয়েছে!
অনেক কিছু স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে পায়ের নিচে মাটি নেই, হালকা হয়ে গিয়েছে!
আচ্ছা আমার ভাগ্যটাই এমন কেন, কোন কিছু আমার জন্য না, আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন, মায়ের কোন সময়ই নেই আমার জন্য। ফ্রেন্ডরা সব আলাদা থাকে আমার থেকে।হাসিব ভাইয়া এমনটা করতে পারল!
অনেক চিন্তা করে অয়নি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল!
ড্রয়ার খুলে ব্লেড নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল! তাড়াহুড়ো করে দরজাটা লাগল না!

হাতের আর্টারী কেটে , বেসিনের কল ছেড়ে দিলো। গলগল করে রক্তে বেসিনটা লাল হয়ে গেল! মিনিট বিশেক পরে নাজমা এসে ওয়াশরুম ধাক্কা দিয়ে দেখে অয়নি বসে আছে দেয়াল ঘেষে, কোন সেন্স নেই! নাজমা চিৎকার করে আপুমনিকে ডাকল।

১২
হাসিব বাসায় ফিরেছে প্রায় ঘন্টাখানেক আগে।পাপাইকে নিয়ে টিভি দেখেছে কিছুক্ষণ। মনটা একটু বিক্ষিপ্ত।
এমন বিশ্রি আর অস্বস্তিকর সমস্যায় আগে কখনো পড়েনি সে। মনটা অস্থির হয়ে আছে বলে একটু আগে স্থানীয় বড় ভাই সাজ্জাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে এসেছে।
সাজ্জাদ ভাই সোজাসাপ্টা মানুষ, মনে ভ্যাজাল নেই, হাসিবের কথা শুনে বলেছে, আমার মনে হয়, চাকরি করিস না বলে তোর একটা গিল্টি ফিলিং কাজ করে, যেকারণে কোচিং বা পড়ানো নিয়ে চাপ নিয়ে ফেলিস!
এজন্য মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তোর রেস্ট প্রয়োজন।
রাণীকে নিয়ে ঘুরে আয় কিছুদিনের জন্য, ভালো লাগবে।
বাকি যেটা বলছিস, এটা কোন সমস্যা না! ফু দিয়ে উড়িয়ে দে!
হাসিব উত্তরে হেসেছে। কথা বাড়ায়নি। কারণ সে জানে এ বিষয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কোথাও একটা মনের মধ্যে অদ্ভুত সূক্ষ অনুভুতি তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে একত্রিশ বছর বয়সে বিষয়টি প্রচন্ড অস্বস্তিকর। রাণী আর পাপাইকে পাশে রেখে তার মনে হচ্ছে অয়নির কথা। অয়নির বয়সে এটা স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক তার বয়সে। এই অনুভুতি রাণীর জন্য হয়নি কখনো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া আশিভাগ সম্পর্ক প্রয়োজনের খাতিরে জন্ম নেয়, হয়তো ভালো বন্ধুর প্রয়োজন, হয়তো সময়গুলো পার করার প্রয়োজন, হয়তো ভালো একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন! বেশিরভাগ সম্পর্কে প্রথম প্রেমের অনুভূতি থাকে না। অবশ্য রাণীকে হাসিবের ভালো লাগত। সেটা ভালোবাসা ছিল কিনা হাসিব জানে না৷ এখন রাণী মানে অভ্যস্ততা।

তবে রাণীর আগে সদ্য স্কুল পেরোনো হাসিবের জীবনে একটা অনুভূতি ছিল আনিকা। ভীষণ মিষ্টি দেখতে শ্যামলা মেয়েটা হাসিবের ফিজিক্স টিচারের মেয়ে ছিল, ওর চাইতে বছর দুয়েকের ছোট। স্কুল ড্রেস পরে দুপাশে বেনী করে আনিকা যখন স্কুলে যেত, হাসিবের একটা অনুভূতি তৈরি হতো, কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি! একটা সময়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আনিকার কলেজ শেষ করার আগেই বিয়ে হয়ে যায় প্রবাসী এক ছেলের সাথে। স্বামীর সাথে ও দেশের বাইরে চলে যায়।

হাসিব কী তবে অয়নির মাঝে সেই ছোট্ট আনিকাকে খুঁজছে! হাসিবের ভালো লাগছিল না! রাত নটার দিকে হঠাৎ অয়নির মায়ের ফোন এলো।

হাসিব রিসিভ করতেই মণিকা বললেন, হাসিব একটু ইবনে সিনা হাসাপাতালে আসতে পারবে?
হাসিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন আন্টি?
মণিকা বললেন, অয়নি হাতের আর্টারী কেটে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। ওকে নিয়ে এখানে আছি!
মণিকা আন্টির গলা কেমন ধরা শোনাল, অসহায় মায়ের আকুতিটা সামনে না থেকেও হাসিব বুঝতে পারছিল।

একটু থেমে আবার বললেন মনিকা, এখন বিপদ কেটে গিয়েছে, ওকে কেবিনে শিফট করে দিয়েছে।
হাসিব চমকে উঠে বলল, কখন আন্টি?
মণিকা বললেন, বিকেলে সম্ভবত, আমার রাতে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু আমি বিকেলের ফ্লাইটে চলে এসেছিলাম মন ভালো লাগছিল না বলে, এয়ারপোর্টে নেমে শুনি এই এক্সিডেন্ট! তুমি পারলে এসো, ওর সাথে কমিউনিকেট করা প্রয়োজন, তোমার সাথে তো ও টুকটাক কথা বলে!
হাসিব বললো, আমি আসছি আন্টি!
হাসিব উঠে শার্ট গায়ে দিতে লাগল, রাণী এসে দেখে হাসিব রেডি হচ্ছে।
-তুমি এখন আবার কোথায় যাচ্ছ হাসিব?
-একটু হসপিটালে যাবো, অয়নি অসুস্থ একটু, আন্টি ফোন করে জানালেন।
-ওহ, হো! তোমাকে তো বলা হয়নি, অয়নিতা তো তোমাকে ফোন করেছিল বিকেলে, আমার সাথে কথা হয়েছে!
হাসিব রেগে গিয়ে বলল, তুমি এখন বলছ এটা? ওর মা বাসায় ছিল না, হয়তো অসুস্থ বোধ করে আমাকে ফোন করেছিল!
রাণী ভীষণ অবাক হয়ে বলল, অসুস্থ হলে তোমাকে কেন ফোন করবে!

হাসিবও চমকে উঠল আবার, সে রাগ ধরে রাখতে পারছে না, এটা খারাপ দিক! যাই হয়ে যাক, কিছু বিষয় মনের বাইরে আসতে দেয়া ঠিক না!নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মেয়েটা ভীষণ একা।তার উপরে মা শহরে ছিল না। হয়তো মনে হয়েছিল আমাকে জানলে আমি হেল্প করতে পারব।

রাণী বুঝল বিষয়টা , বুঝতে পেরে বলল, হুম, কাজের চাপে মাথা থেকে একদম বের হয়ে গেছে, পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম, ঠিক আছে, ঘুরে এসো।

হাসিব বের হলো। রিকশা নিয়ে যেতে দেরী হবে, সিএনজিতে নিয়ে নিলো।মনে কত প্রশ্ন আসছে, কোনো ভাবে আমি দায়ী নইতো,আচ্ছা আজ রাণীর সাথে কথা বলেছে, কোনো ভাবে এটা ইম্প্যাক্ট ফেলেনি তো! রাণীকে ইচ্ছে করেই সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে, এটা বলেনি হাসিব।

এই বয়সটাই এমন মাত্রা ছাড়া আবেগের বয়স।
হাসিবের মনটা কেমন অস্থির লাগছিল বিকেল থেকে। আচ্ছা এটা কী টেলিপ্যাথিক কোন যোগাযোগ!
এসব ভাবতে ভাবতে হাসিব পৌছালো দশটার দিকে।
মনিকার পাশে গিয়ে দাঁড়াল,অয়নি তখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

চলবে

শানজানা আলম