তখন অপরাজিতা -৫
৯
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল হাসিবের। মাথার কাছে রাখা সেলফোনে দেখল রাত দুটো বেজে পনের মিনিট। পাশেই রাণী আর পাপাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হাসিবের হঠাৎ করে অয়নির কথা মনে হলো! এতরাতে এ সময়ে কেন ওর কথা মনে হলো, হাসিব বুঝতে পারল না, তবে ঘুমন্ত রাণীর দিকে তাকিয়ে একটা অপরাধবোধ তৈরি হলো।ইদানীং প্রায়ই এমন হচ্ছে, সময় অসময় মাথায় অয়নি ঢুকে পড়ছে। তাহলে কী রাণীর প্রতি সে লয়্যাল নয়, এটা মনে হতে অপরাধবোধ বাড়ছে।
পরক্ষনেই মনে হচ্ছে, বাচ্চা একটা মেয়ে, ওরই ছাত্রী, ওকে নিয়ে কেন ভাবছে!হাসিব বুঝতে পারছে, এই ভাবনার উপর ওর কোনো হাত নেই। কয়েকদিন আগে মনে হয়েছিল, অয়নির আচরণ কিছুটা অন্যরকম, গত দুই সপ্তাহে সেটা মনে হয়নি। মেয়েটা মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছে।
এই সপ্তাহে ওর মা কক্সবাজারে গিয়েছে, অয়নিতা সাথে যায়নি, আশ্চর্য বিষয়! একটা সময়ে ট্যুরে যাবার জন্য মন অস্থির হয়ে যেত, টাকা পয়সা সমস্যা হয়ে দাঁড়াত!
হাসিব উঠে পানির বোতল থেকে পানি খেলো। অয়নিতার সাথে টুকটাক কথা হয়, ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে নিজের কলিগকে। অয়নিতাকে বলেছেন তার সাথে থাকতে, কিন্তু অয়নিতা বাবাকে খুব একটা পছন্দ করে না।
অয়নির যতটুকু মনে আছে, ও দেখেছে বাবা মায়ের সাথে অনেক রুড আচরণ করে।
হাসিব আবারও বিব্রত হলো, এত রাতে অয়নিতার কথা কেন ভাববে। কী সমস্যা হচ্ছে!
হাসিব বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। ওর বারান্দাটা সুন্দর, অবশ্য এর কৃতিত্ব রাণীর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক দেখা যায়।
এত রাতেও রাস্তার ব্যস্ততা কমেনি! বাস প্রাইভেটকার রিকশা সবই চলছে। জাদুর শহরে রাতে আলোর দীপাবলি উৎসব শুরু হয়! সমু্দ্রের ধরে গেলে একাকী ঢেউ দেখার অনুভূতি আর রাত জেগে ব্যস্ত সড়ক দেখার অনুভূতি অনেকটা একরকম হাসিবের কাছে।
অয়নি কী কখনো দেখেছে খেয়াল করে!
ইস, আবার অয়নির কথাই মাথায় চলে আসছে!
একটা অযৌক্তিক চিন্তায় যৌক্তিক অপরাধবোধ মনে ভর করছে! হাসিব টের পায়নি, রাণী এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
হাসিবের এই অস্থিরতা রাণী খেয়াল করেছে তবে ঠিক ধরতে পারেনি। কোচিং টিউশনি নিয়ে হাসিব এমনিতেই অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটায় সবসময়। খুব ভালো হতো যদি একটা জবে ঢুকতো, কিন্তু রাণী কখনো জোর করেনি। টাকা পয়সা ভালো উপার্জন হলেও আজকাল পাপাইয়ের জন্য চিন্তা হয়। পাপাই কী বলবে বড় হয়ে!
-ঘুমুবে না- রাণী নিস্তব্ধতা ভেঙে কথা বলল।
হাসিব বলল, যাও আসছি।
রাণী একটু সময় দাঁড়িয়ে চলে গেল। হাসিব সিগারেট শেষ করে আরো কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইলো একা। তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো তবে ঘুম এলো না।
ঘুম এলো শেষ রাতে, চোখ জড়িয়ে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখল, অয়নি সমুদ্রের পারে বেলাভূমিতে ছুটে যাচ্ছে, হাসিব ডাকছে…….. অয়নিতা…
কিন্তু অয়নি শুনতে পাচ্ছে না।
১০
খুব সকালে ঘুম ভাঙলো মণিকার। ঘুম ভেঙে আসপাশের সব অপরিচিত মনে হলো। তারপর মনে হলো, ও ঢাকায় নেই, কক্সবাজারে। এই রিসোর্ট এর নাম “ঝিনুক”।
মণিকা দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখনো কেউ ওঠেনি। চারটা রুম সবগুলোই ওরা বুক করেছে। দুটো রুমে ইউএন ডেলিগেটসরা ,বাকি দুটোতে অফিসের অফিসারেরা।
সামনে সো সো করছে বিস্তৃত জলরাশি। আকাশে মেঘ থাকায় একটা ভয়ংকর সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে। সৈকত থেকে কিছুটা দূরে হলেও বারান্দা থেকে সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যায়। বেশ খোলা বারান্দা। সামনে দাঁড়ানো ও বসার সুন্দর ব্যবস্থা করা। প্রকৃতির কাছাকাছি গেলে মানুষকে তীব্র একাকীত্ব গ্রাস করে। অনেক ভীড়েও নিঃসঙ্গ লাগে। অনির কথা মনে হচ্ছে, মেয়েটা এলো না।এর আগে যখনি এসেছে শহরে থাকা হয়েছে। শহরের বাইরে রিসোর্টে এবারই প্রথম।
সামনে থেকে মেরিন ড্রাইভের রাস্তাটা চলে গিয়েছে। তার কিছুটা দূরেই সমুদ্র। বিয়ের পর পরই একবার এসেছিল। তখন তার বা আশফাকের টাকার সমস্যা নেই৷ তবুও আশফাক হিসেব করছিল খুব, বিষয়টা চোখে লাগছিল, আনন্দটাই মাটি করে দিচ্ছিল। তবু অয়নির দিকে তাকিয়ে এগারো বছর এই মানুষের সাথে থেকেছে!
বৃষ্টি নামল হঠাৎ , সমুদ্রের গর্জন বৃষ্টির শব্দে পাল্টে গেল।
পাশে জামিল এসে দাড়িয়েছে মনিকা টের পায়নি।
জামিলই বলল, কখন উঠেছো?
মনিকা আর জামিল একই সাথে চাকরিতে ঢুকেছিল।
কলিগের বাইরেও ভাল বন্ধু জামিল।
মনিকা বলল, এই তো কিছুক্ষণ, তুমি?
জামিল বলল, মাত্রই এলাম, দেখি তুমি সামনে দাড়িয়ে আছো?কোন কারণে আপসেট? ঘুম হয়েছে রাতে?
-হ্যা, ঘুমিয়েছি, মনিকা ছোট্ট করে উত্তর দিলো।
-আচ্ছা তুমি তো বলেছিলে অনি আসবে, এলো না কেন সে?
-অনির সামনে প্রি-টেস্ট, তাই আসতে চাইল না!
-দেখেছ, দিন কিভাবে পাল্টেছে, আমরা কিন্তু বেড়ানোর নামে হইহই করে উঠতাম!
-মেয়েটা অনেক চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, আমার সাথে তেমন কথাই হয় না। আমি মনে হয় আমি দূরে সরে যাচ্ছি জামিল।আমি কী দায়িত্ব পালন করতে পারছি না বলো তো?
-তুমি অয়নির বিষয়ে ওভার সিরিয়াস মনি, তাই এমন মনে হচ্ছে। ওকে দায়িত্ব মনে করছ কেন, ও ই তো তোমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি!
কথাগুলো কানে বাজলো মনিকার, অনেক বছর আগে, জামিল বলেছিল, তুমি চলে এসো মনি, আমি তুমি আর অনি ভালো থাকব। কিন্তু তখনো মনিকা চাইত না সংসার ভাঙুক। তাই জামিলকে সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল।
আর চলে এলেও অনির জন্য দ্বিতীয় বার সংসার করার কথা ভাবেনি। এখন জামিলের সংসার আছে, রূপসা, রুপুকে নিয়ে, এই কথা মনে হতেই জামিলকে জিজ্ঞেস করল, রূপসাকে নিয়ে এলে পারতে?
জামিল একটু স্বর পাল্টে বলল, রূপসাকে বলেছিলাম, রুপুর স্কুলের জন্য আসতে রাজী হলো না।
মনিকা জিজ্ঞেস করল, তোমার ঝামেলা মিটেছে?
জামিল বলল, ঝামেলা মেটার নয়, ঝগড়া তো নয়, কোথাও যেন সুর কেটে গেছে, কথা বলতেও ভালো লাগে না।রূপসাও সংসার রূপুকে নিয়ে ব্যস্ত, আমি যে বিষয়ে গল্প করতে পছন্দ করি, ওর সেটা ভালো লাগে না, সন্ধ্যায় সিরিয়াল দেখবে, রুপুর স্কুলে একটা সার্কেল আছে, ভাবীদের সাথে সে সারাদিন শপিং আর গসিপ নিয়ে ভালো থাকে।
মনিকা হেসে বললো, তুমি এক তরফা বলছো জামিল। তুমি কখনো ওর মতো করে ভেবেছ?
জামিল বলল ওর যা চাই, আমি মেটাই, টাকা পয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, শুধু গল্পটাই করা হয় না!
মনিকা বলল, তুমি অনলাইনে একটা বড় সময় কাটাও জামিল, ভার্চুয়াল জীবন থেকে বাইরে এসে রূপসার হাত ধরো, একদিন ওর সাথে সংসারে থাকো, শপিংয়ে যাও, তারপর ওকে নিয়ে তোমার পছন্দের মুভি দেখতে বসো, জীবনটা সহজ মনে হবে!
জামিল কথা বলল না।
মনিকা বলল, আমি ঘরপোড়া গরু, সিদূরে মেঘ দেখেই ভয় লাগে।
জামিল বলল, চেষ্টা করে দেখব।
তারপর একটু থেমে বলল, তুমি এই প্রজেক্টটা শেষ হলে ছুটি নাও, কিছুদিন অয়নির সাথে সময় কাটাও, দেখবে ওর সমস্যাগুলো তুমি বুঝতে পারবে।
মনিকা বলল, আমিও সেটা ভাবছি।
তারপর হেসে বলল, মানুষ বড় অদ্ভুত জানো, অন্যের সমস্যার সমাধান সে জানে, শুধু জানেনা নিজের সমস্যা গুলো কিভাবে ঠিক হবে!
জামিলও হেসে ফেলল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
মনিকার মনে হলো, এই বৃষ্টিতে যদি জীবনের সমস্যা গুলোও ধুয়ে যেত। মনটা হতো পরিস্কার, ঝকঝকে, বৃষ্টিধোয়া গাছের সবুজ পাতার মতো।
চলবে
শানজানা আলম