তখন অপরাজিতা পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
95

তখন অপরাজিতা -৮

পরদিন হাসিব এলো সকাল নটার দিকেই। মণিকা জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী যাবো?
হাসিব বলল, না আন্টি। আমিই ওকে নিয়ে যাই।
অয়নির একটু অস্বস্তি লাগলেও কয়েকদিন পরে বাইরে বেড়িয়ে মনটা ভালো লাগলো।

হাসিব রিক্সা নিয়ে নিলো। তবে অন্য কেউ ছিল না তখনো সাথে। আকাশ মেঘলা ছিল, হয়তো বৃষ্টি নামবে। অয়নি কোন কথা বলছিল না, হাসিব একটা সময় নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল, অয়নিতা তুমি যে কাণ্ডটা করলে, কোনো কারণে কী আমি দায়ী?

অয়নিতা কোন কথা না বলে, মাথা নিচু করে রইল। হাসিব কিছুটা বুঝে নিলো, নীরবতাই মাঝে মাঝে সব চাইতে ভালো উত্তর দিতে পারে। পুরো পথে আর কথা হলো না।
অয়নির কয়েকবার মনে হলো, রিক্সা থেকে নেমে ছুটে পালিয়ে যাই, কিন্তু হাত পা যেন জোর হারিয়ে ফেলেছে।
ভ্যাপসা গরম ছিল, কিন্তু ঝিরিঝিরি বাতাস শুরু হলো।
রিক্সা থামলো দোয়েল চত্বরে এসে। মোড়ে কয়েকজন অপেক্ষা করছিল। অয়নি দেখলো, সবাই বেশ বড় বড়।
একটা মেয়েও ছিল।
হাসিব আলাপ করিয়ে দিলো, অয়নির সাথে সবাইকে।
হাসিব ওদের নিয়ে কার্জন হলটা ঘুরে দেখালো।
চারপাশটা কি সুন্দর!
একসময় বৃষ্টি নামল, অয়নির মনে হলো ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর বৃষ্টি হয়তো এখানে হয়।

ছেলেমেয়েগুলোর চোখে স্বপ্ন খেলছিল, হাসিব এটাই চেয়েছিলো এই স্বপ্নটাই ও দেখেছিল ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে। সেখান থেকে বুয়েট ক্যাম্পাস, কলা ভবন পুরো এলাকাটা ঘুরে প্রায় দুপুর হয়ে গেল!
অয়নি চুপচাপ ঘুরছিল আর দেখছিল, হাসিব ভাইয়া সবাইকে সব কিছু ঘুরে দেখাচ্ছেন। ওরা দুপুরে সবাই নীলক্ষেতে খেতে গেল
কি অদ্ভুত পরিবেশ! এখানেই সবাই খাচ্ছে, অয়নির একটু অস্বস্তি লাগলেও একটু পরে ও স্বাভাবিক হয়ে গেল।
নীলক্ষেত থেকে বের হয়ে ছাত্রছাত্রীরা চলে গেল।
হাসিব অয়নিকে নিয়ে ধানমন্ডির ভেতরে গেল, লেকের পাড়ে ফুটপাতে বড় বড় পাইপ রাখা আছে, কিছু পরিবার সেখানে থাকছে। হাসিব বলল, এদের দেখো, এর কত কষ্ট করে বাঁচে, তবুও বেঁচে আছে!
অয়নির তাকিয়ে দেখলো, কী কষ্টের জীবন! তারপর জিজ্ঞেস করল, যদি বৃষ্টি নামে তখন?
হাসিব বলল, হয়তো আশেপাশে থাকে, পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখে সবকিছু। হাসিব অয়নিকে নিয়ে বসল একপাশে।
তারপর বলল, অয়নিতা আমি তোমার থেকে প্রায় পনের বছরের বড়, তাই অনেক কিছু তুমি না বলতেই আমি বুঝি! কিন্তু তুমি যেটা বোঝো না, সেটা হলো, তোমার জীবনটা শুরু হয়েছে কেবল! এখনো পথ চলার অনেক অনেক বাকি।অনেক কিছু দেখার বাকি। প্রাইভেট টিউটরের প্রেমে পরাটা ভীষণ পুরোনো কনসেপ্ট! তোমাকে কী এটা মানায়, বলোতো?

অয়নি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল, এরপরে ভাইয়ার কাছে কিভাবে পড়বে, তাকাতেই পারবে না!

হাসিব বলল, এখন পড়াশোনা করার সময়, সুন্দর একটা জীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তাই সবকিছু ভুলে যাও, বোকা বোকা কিছু ভাবনার জন্য কত বড় ভুল করে ফেলছিলে, একবার ভেবেছ?
যখনি মন খারাপ হবে, একবার এদের কথা ভাবো, একবার ভাবো, যে জায়গাগুলো দেখে এসেছ, সেখানে পড়তে হবে, বিষয়টা কিন্তু সহজ না! লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে! তুমি তখনি স্বপ্নকে স্পর্শ করতে পারবে, যখন স্বপ্ন তোমার ইচ্ছেতে পরিণত হবে!
অয়নি মনে মনে বলল, কিছু স্বপ্ন হয়তো ইচ্ছে হলেও পূরণ হয় না!

পরিশিষ্ট —

বেশ কয়েক বছর পরের কথা…
ডরমিটরির বারান্দায় অয়নি বসে আছে অনেকক্ষণ।
হাতে একটা কাঠের বাক্স। বাংলাদেশ থেকে চলে আসার সময় এই বাক্সটা হাসিব ভাইয়া দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এটা তোমার গ্রাজুয়েশন গিফট। যেদিন গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হবে, সেদিন এটা খুলবে।
অয়নি গত সাত বছর ধরে এটা আগলে বসে আছে।
ইউএনএইচসিআর-এর প্রজেক্টে অয়নির মা অয়নিকে নিয়ে ইউএস চলে আসে অয়নির স্কুল ফাইনালের পরপরই। পরের বছর আপুমণিকেও নিয়ে আসে।
অয়নি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে। ওর পারফরম্যান্স এত ভালো যে ওর সুপারভাইসর প্রফেসর ওকে নিজের রিসার্চ এসিট্যান্ট হিসেবে জয়েন করতে বলেছেন, পোস্ট ডকের এর পাশাপাশি। অনেকক্ষণ ধরে হাতে ছোট্ট একটা চাবি নিয়ে বসে আছে অয়নি।
ডোরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি।
-হাই, অনেকক্ষণ ধরে বসে আছো দেখছি।
-হ্যা, তোমার আজ কাজ নেই কোন? ল্যাবে যাবে না?
-যাবো, তোমার হাতের এই বাক্সটার প্রতি আগ্রহ বোধ করছি!
– এটা একটা জাদুর বাক্স, এর মধ্যে একটা গিফট আছে, সাত বছর আগে এটা আমি পেয়েছিলাম,
-কে দিয়েছে?
অয়নি বাংলায় বলল,
-একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
ডোরা বুঝল না, তাকিয়ে রইল। অয়নি বলল, এ হকার অফ ড্রিম!
ডোরা হাসল কিছু না বুঝেই।
অয়নি বলল, আমাদের দেশে কিছু মানুষ স্বপ্ন ছড়িয়ে বেড়ায়, আমি তাদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বলি! তারা সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা না করেও একজন মানুষ যে মনের অসুখে ভুগছে, তাকে সুস্থ করে দিতে পারে। এক ধরণের ম্যাজিশিয়ান বলতে পারো।
ডোরা চাইনিজ, ও বলল, বুঝেছি, আমাদের দেশে প্রাচীন চিকিৎসা আছে কিছু, এটা তেমনই হয়তো হবে! অয়নি হো হো করে হেসে বলল, এটা তুমি বুঝবে না ঠিক।
ডোরা বলল, আমি এখন যাচ্ছি, ফিরে এসে তোমার গিফট দেখব!
অয়নি মাথা নাড়লো।
ডোরা চলে যাওয়ার পরে অয়নি ছোট্ট চাবিটা দিয়ে বাক্সটা খুলল।
একটা চিঠি!
অয়নি কাঁপা হাতে চিঠিটা তুলল, এই চিঠিতে হাসিব ভাইয়ার স্পর্শ লেগে আছে, আজ কত বছর পর যেন খুব চেনা একটা গন্ধ ভেসে আসছে!

প্রিয় অপরাজিতা,
তুমি যদি সঠিক সময়ে এই চিঠি পড়ো তাহলে এখন তুমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছ। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার জন্য
অভিনন্দন। তোমাকে কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন মনে হলো, কিন্তু যে সময়ে কথাগুলো লিখছি, তখন তুমি এই কথাগুলো বুঝবে না। তাই একটা সময় বেঁধে দিয়েছি তোমাকে এটা পড়ার জন্য।
তুমি একটা মারাত্মক ভুল করেছিলে তোমার সেনসিটিভ একটা বয়সে, তোমার বয়সটাই ছিল ভুল করার। কিন্তু আমি অনেক আগেই সেই সময়টা পেরিয়ে এসেছি!
তাই দায়িত্ব ও নীতিবোধকে সরিয়ে বাইরের আমি কোন ভুল করতে পারিনি!
আমাদের অনুভূতি এক হলেও আমরা দুজন দুটো সময়ের বাসিন্দা। প্রকৃতি আমাদের যে সময়ে পাঠিয়েছে, সেটা হয়তো আমাদের জন্য ছিল না! তবে অনুভূতি গুলো মিথ্যে হয় না!
আমি বিশ্বাস করি ভালোবাসা মানেই একসাথে থাকা বা সংসার করা নয়। ভালোবাসার একটা শুদ্ধ মানে হলো, শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।
তুমি যেখানেই থেকে আজ এই চিঠিটা পড়ছ, আজ আমি হয়তো কিছুটা হালকা বোধ করছি, অন্তত তোমাকে জানাতে পেরেছি, কিছু অনুভুতির কথা।
অনেক ভালো থেকো।

হাসিব

আজ অয়নিও বিশ্বাস করে, ভালোবাসা মানেই একসাথে থাকা বা সংসার করা নয়, ভালোবাসা মানে ভুল করা নয়, ভালোবাসা মানে স্বপ্ন দেখতে শেখানো। অনেক বছর আগে যেটা হাসিব করেছিল।
বেঁচে থাকুক শুদ্ধ ভালোবাসার অনুভূতি গুলো। শুধু অয়নির চোখ থেকে একফোঁটা জল চিঠির উপরে এসে পড়ল।

(সমাপ্ত)

শানজানা আলম