তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-১২+১৩

0
484

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১২

ফজরের নামাজের পর মনটা এমনিতেই স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যায়। সারাদিনের মধ্যে এই সময়টা সবচেয়ে বেশি প্রশান্তিময়। আজও তাজ ভাইয়ের ডাকে আমার ঘুম ভাঙল। উনি দরজার বাইরে থেকেই ডেকে গেছেন। আমি আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসলাম। অলি আর জেমির ঘুমন্ত মুখটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলাম। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কানের দুল আর একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কানের দুল দুটো হাতে নিলাম। গতকাল রাতে মেলায় যেই দুল দুটো আমার পছন্দ হয়েছিল এগুলো সেগুলোই। কিন্তু এগুলো তো আমি কিনিনি। এখানে এল কীভাবে? কাগজটা হাতে নিয়ে দ্রুত ভাঁজ খুলে ফেললাম। কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে দুই লাইনের চিরকুট চোখে পড়ল। তাতে লেখা,

“পছন্দের জিনিসগুলো কাছে পেয়েও হাতছাড়া করতে নেই। এসব জিনিস সবসময় নিজের কাছে রেখে দিতে হয়। বুঝতে শিখো বনলতা।”

লেখাটা পড়ে আমি আরও অবাক হলাম। হাতের লেখাটা খুব সুন্দর। আবার আমাকে বনলতা বলে সম্বোধন করেছে! চিরকুট যে লিখেছে তার মনটা খুব সুন্দর বলতে হবে। কিন্তু এটা কার কাজ? আফরা আপু? না, সে তো মেলায় সারাক্ষণ আমার সাথেই ছিল। তাহলে? তাজ ভাই? উনি কেন দিবেন? শয়তানটা তো আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না। তাহলে বাকি থাকে শ্রেয়ান ভাইয়া। হ্যাঁ, তার মানে এটা শ্রেয়ান ভাইয়ার কাজ। কিন্তু উনি নক না করে আমার রুমে ঢুকেছেন? তাও আবার রাতের বেলায়! এটাও তো বিশ্বাস হচ্ছে না। তাছাড়া আমাকে এটা দেয়ার হলে তো মেলাতেই দিতে পারত। এভাবে দেয়ার কী আছে? আশ্চর্য! দুল জোড়া পেয়ে বেশ খুশিই লাগছে। কিন্তু গিফটদাতাকে খুঁজে না পেলে শান্তি পাব না। এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে তাই কানের দুল আর কাগজটা আবার রেখে দিলাম। অজু করে এসে নামাজ আদায় করলাম। আজ আর বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না তাই আবার শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখটা লেগে এল। তারপর ছোটো কাকির ডাকে যখন চোখ খুললাম তখন সকাল নয়টা বাজে। ছোটো কাকির ভাষ্যমতে সে এর আগেও দুবার আমাকে ডেকে গেছেন। কিন্তু আমি নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়েছি। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরোনোর সময় কানের দুল দুটোর কথা মনে পড়ল। গিফটদাতাকে খুঁজে পাওয়ার একটা উপায় খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ভাবার পর পেয়েও গেলাম। আমার কানের দুল দুটো কান থেকে খুলে রেখে দিয়ে ওই দুল দুটো পড়লাম। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। খাবার টেবিলে দাদুমনি, আফরা আপু, শ্রেয়ান ভাইয়া, তাজ ভাই আর অলি বসে খাচ্ছে। বাবা আর কাকারা বোধ হয় আগেই খেয়েছে। আমাকে দেখে মেজো কাকি খেতে ডাকল। আমি গিয়ে দাদুমনির পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। শ্রেয়ান ভাইয়া মিষ্টি হেসে বললেন,“গুড মর্নিং ইলোমিলো।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,“গুড মর্নিং। বাট ইলোমিলো কী?”

উনি বললেন,“আমি ঠিক করেছি তোমাকে এই নামেই ডাকব। আপত্তি আছে?”

আমি হেসে ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,“নাহ্।”

আফরা আপু খেতে খেতে বলল,“তবে নামটা কিন্তু সুন্দর দিয়েছেন ভাইয়া।”

শ্রেয়ান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“মানুষ‌ যেমন নামও তেমন। তবে মানুষটার তুলনায় নামটা কিছুই না।”

আমি হাসলাম। আফরা আপু আর দাদুমনি ভ্রু বাঁকিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকাল। তাজ ভাইয়ের দিকে চোখ পড়তেই গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল। মনটাও অস্থির হয়ে উঠল। উনি দিব্যি বসে বসে একহাতে ফোন চাপছেন আরেক হাতে খাবার খাচ্ছেন। আশেপাশের কোনো কথাই যেন তার কানে ঢুকছে না। খেতে খেতে হঠাৎ আফরা আপু বলে উঠল,“ইলো, এই দুল না তুই রেখে এলি? তাহলে তোর কানে এল কীভাবে?”

আমি চোখ তুলে তাকালাম। বুঝলাম আফরা আপু এটা দেয়নি। শ্রেয়ান ভাইয়াও বললেন,“তাই তো। কখন কিনলে আবার?”

তার মানে শ্রেয়ান ভাইয়াও দেয়নি। বাকি থাকে একজন। আমি অবাক হয়ে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। আফরা আপু আবার জিজ্ঞেস করল,“কিরে? বলছিস না যে?”

আমি কিছু বলার আগেই তাজ ভাই বলে উঠলেন,“না কিনলে কি উড়ে এসে কানে জুড়ে বসেছে? এটা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে? কিনবে না বলেও হয়তো কিনে ফেলেছে। পিচ্চি মানুষ, মনের ঠিক নেই।”

আমি আহাম্মক বনে গেলাম। আমি কখন কিনলাম! তবে ওনার বলা মিথ্যা কথাটাই প্রমাণ করে দিলো যে উনিই গিফটদাতা। চিরকুটে উনি আমাকে ‘বনলতা’ বলে সম্বোধন করেছেন, আবার ‘তুমি’ বলেছেন! এটাও কি সম্ভব? এসব স্বপ্ন না-কি সত্যি! আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে উনি ওই চিরকুটটা লিখেছেন। এভাবে গিফট দেয়ার মানে কী? আমার হঠাৎ কাশি উঠে গেল। শ্রেয়ান ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। আমি ওনার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে পানি খেলাম। দাদুমনি বললেন,“আস্তে খা বইন।”

কেউ আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করলাম। আজ আবার তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া কোথাও একটা চলে গেলেন। আমার সন্দেহ জাগল যে ওনারা বাইরে ঘুরতে যান না। নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য যান। ছোটো কাকা অলিকে স্কুলে দিতে গেলেন। আফরা আপুও নিজের রুমে চলে গেল। জেমিকে কোলে নিয়ে আমি দাদুমনির সাথে বসে গল্প করতে লাগলাম। দাদুমনির সাথে গল্প করার মজাই আলাদা। সে সবসময় তার জীবনের হাসিখুশি মুহূর্তগুলোর কথা বলে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি। দাদুমনির ছোটো বেলার গল্প শুনলে আমি খুব আনন্দ পাই। কত হাসিখুশি ছেলেবেলা ছিল তার! সেসব শুনলে আমার নিজের জন্য আফসোস হয়। তার সাথে গল্প করলে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনিতেই কেটে যায়। আজও তাই হলো। গল্প করতে করতে দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেল। আমি রুমে গিয়ে আগে জেমিকে গোসল করালাম। ওকে গোসল করাতে গেলে আমার ঘাম ছুটে যায়। পানি দেখলেই ওর লাফালাফি শুরু হয়ে যায়। জোর করে ধরে গোসল করাতে হয়। ওকে রুমে রেখে আমিও গোসল সারলাম। ততক্ষণে যোহরের আজানও দিয়ে দিয়েছে। আমি নামাজ পড়ে আবার রুম থেকে বের হলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া এখনও বাসায় ফেরেনি। বাবা আর মেজো কাকা বসে কথা বলছেন। আমি গিয়ে বাবার পাশে বসলাম। বাবা আমাকে বলল,“তাজরা তো এখনও ফিরল না। একটু ফোন করে দেখ তো। আমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ।”

বাবাকে তো আর বলতে পারব না যে আমি ফোন করব না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাজ ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করলাম। পর পর কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল। তারপর আবার ফোন করলাম। তাও কেটে গেল। আমি বাবাকে বললাম,“উনি তো ফোন ধরছে না।”

মেজো কাকা বললেন,“দুই বন্ধু হয়তো ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত। থাক, এসেই তো পড়বে।”

আমি ভাবছি ওনারা বাইরে গিয়ে এত সময় পর্যন্ত কী করে। বাবাকে গতরাতের বিষয়টা বলব? না থাক। নিজেই তো ভালোভাবে কিছু জানি না। নিজে নিশ্চিত না হয়ে কাউকে বলা ঠিক হবে না। শুধু শুধু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। ছোটো কাকি সবাইকে খেতে ডাকল। একে একে সবাই গিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি লম্বা একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠেও দেখলাম তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া এখনও আসেননি। এবার আমি একটু বেশিই অবাক হলাম। কী এমন কাজ যে সারাদিন বাড়ি ফিরতে পারেনি? আসরের আরও কিছু পর আফরা আপু আমাকে পাকড়াও করে তার রুমে নিয়ে গেল। আমাকে বলল তাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে। মূলত তাজ ভাইকে ইমপ্রেস করার জন্যই সে শাড়ি পরবে। আমি বললাম,“আপু, আমি তো আর সবসময় তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে পারব না। এক কাজ করো, তুমি আজ শাড়ি পরা শিখে নাও। তাহলে এরপর থেকে যখন ইচ্ছে নিজে নিজেই পরতে পারবে।”

আপু একটু ভেবে বলল,“এটা ঠিক বলেছিস। তাহলে তুই আমাকে শিখিয়ে দে, আমি নিজে নিজে পরার চেষ্টা করি। ওয়েট, আরেকটা শাড়ি আনছি।”

আপু তার আলমারি থেকে আরেকটা শাড়ি বের করে আমার হাতে দিলো। আপুর হাতের শাড়িটা পিংক কালার আর আমারটা হোয়াইট। আমি নিজে পরতে পরতে আপুকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম কীভাবে পরতে হয়। আপুও আমারটা দেখে দেখে পরতে লাগল। আমারটা তাড়াতাড়ি পরা হয়ে গেলেও আপুর অনেকক্ষণ লেগে গেল। আপু উৎফুল্ল হয়ে বলল,“ওয়াও! এখন থেকে নিজে নিজে পরার চেষ্টা করব। আমি তো শাড়ি পরিই না। দু একবার যা পরেছি তাও মা পরিয়ে দিয়েছিল। এখন থেকে মাঝে মাঝে পরতে পারব।”

আমি হেসে বললাম,“তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে আপু।”

আপু আমার গাল টেনে দিয়ে বলল,“তোকেও খুব কিউট লাগছে। সাদা শাড়িতে তোকে খুব মানায়।”

আমি হাসলাম। এই কথাটা আমি বাবার মুখেও অনেকবার শুনেছি। আফরা আপু বলল,“শাড়ি তো পরলাম। তাজ ভাইয়া তো এখনও বাড়িই ফিরল না। এখন কী করব?”

আমি বললাম,“চলো ছাদে যাই। গল্প করতে করতে সময় কেটে যাবে।”

“হ্যাঁ, এটা ভালো বলেছিস। চল।”

“একটু ওয়েট করো। আমি শাড়িটা চেঞ্জ করে নেই।”

আফরা আপু বাঁধা দিয়ে বলল,“এই না। পরে চেঞ্জ করিস। বললাম না তোকে খুব সুন্দর লাগছে?”

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,“গরম লাগছে তো।”

আফরা আপু আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,“ছাদে গেলে গরম লাগবে না।”

ছাদের সিঁড়ি অবধি পৌঁছনোর আগেই পড়লাম তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার সামনে। আফরা আপু তাজ ভাইকে দেখে লাজুক হেসে বলল,“আপনাদের এতক্ষণে ফেরার সময় হলো? বাড়ির সবাই কত টেনশন করছে জানেন? ফোনও তো ধরেননি।”

তাজ ভাই বললেন,“আমাদের এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়েছিল। একসাথে সময় কাটাতে গিয়ে বিকাল হয়ে গেছে। আমি বড়ো মামাকে পরে ফোন করে বলেছিলাম।”

আফরা আপু অবাক হয়ে বলল,“এখানে আপনাদের ফ্রেন্ড এল কোত্থেকে?”

আফরা আপুর প্রশ্নটা চাপা পড়ে গেল শ্রেয়ান ভাইয়ার কথায়। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বললেন,“মা শা আল্লাহ্ ইলোমিলো। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। সাদা শাড়িতে একদম পুতুল পুতুল লাগছে।”

আমি মৃদু হেসে বললাম,“ধন্যবাদ ভাইয়া।”

তাজ ভাই ভ্রু কুঁচকে বলল,“হঠাৎ শাড়ি পড়ার কী হলো তোদের? ঐ পিচ্চি, তোকে যে সকিনার মতো লাগছে তা কি জানিস?”

তাজ ভাইয়ের কথায় শ্রেয়ান ভাইয়া আর আফরা আপু হেসে উঠল। আমি শক্ত মুখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,“আপনাকে তাকাতে বলেছে কে? প্রশংসা করতে হিংসা লাগে?”

“যা সত্যি তাই তো বললাম। আজকাল সত্যি কথা বললেও দোষ?”

আমার রাগ উঠে গেল। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“এই তাজ, শুধু শুধু মেয়েটাকে খেপাচ্ছিস কেন? ইলোমিলো, ওর কথায় রাগ কোরো না তো। তোমাকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে।”

আফরা আপু গদগদ কন্ঠে তাজ ভাইকে প্রশ্ন করল,“ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে?”

তাজ ভাই একনজর আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,“ভালো।”

এরইমধ্যে ছোটো কাকি সেখানে এসে বলল,“তাজ, তোমরা গোসল সেরে এসো যাও। আমি চা করছি।”

তাজ ভাইয়া হেসে বললেন,“আচ্ছা মামি।”

কাকি রান্নাঘরের দিকে যেতে নিতেই আফরা আপু বলে উঠল,“কাকি, আমি চা বানাচ্ছি।”

কাকি অবাক দৃষ্টিতে আফরা আপুর দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। যে মেয়েকে জোর করেও রান্নাঘরে ঢুকানো যায় না, সে কি না আজ তাজ ভাইয়ের জন্য ইচ্ছে করে রান্নাঘরে যেতে চাইছে! আপুর মাথাটা একদম গেছে। আফরা আপু রান্নাঘরে চলে গেল। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়াও গোসল করতে চলে গেলেন। আমি আফরা আপুর সাথে রান্নাঘরে যেতে গিয়েও থেমে গেলাম। কিছু একটা ভেবে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে গেলাম। রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম শ্রেয়ান ভাইয়া ওয়াশরুমে ঢুকছেন আর তাজ ভাই বিছানায় সটান শুয়ে আছেন। বুঝলাম শ্রেয়ান ভাইয়া গোসল করে বের হলে উনি ঢুকবেন। শ্রেয়ান ভাইয়া ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকানোর সাথে সাথে আমি রুমে ঢুকলাম। ধীর পায়ে তাজ ভাইয়ের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু ওনাকে ডাকতে কেমন যেন লাগছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই তাজ ভাই বলে উঠলেন,“কিছু বলবি?”

আমি পেছন ফিরে তাকালাম। উনি তো এখনও চোখ বন্ধ করে আছেন। তাহলে বুঝলেন কী করে আমি এসেছি? আমি বললাম,“একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”

উনি চোখ না খুলেই বললেন,“শুনছি, বল।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,“দুল দুটো আপনি দিয়েছেন?”

উনি না জানার ভান করে বললেন,“কিসের দুল?”

আমি এবার কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম,“ঢং করছেন? গতকাল আমি যেই কানের দুল পছন্দ করেছিলাম সেগুলো তো আমি কিনিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের ওপর এই কানের দুল আর একটা চিঠি পেয়েছি আমি।”

উনি একটু নড়েচড়ে বললেন,“তো?”

ওনার খাপছাড়া কথায় মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম,“আমি নিশ্চিত, কাল রাতে আপনি এগুলো রেখে এসেছেন।”

এবার উনি চোখ খুলে তাকালেন। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“আমার অত ঠেকা পড়েনি যে আমি টাকা খরচ করে তোকে তোর পছন্দের দুল কিনে দিব। তা-ও আবার লুকিয়ে। আজাইরা বকবক করিস না কানের কাছে।”

“তাহলে কি এসব উড়ে উড়ে চলে এসেছে আমার রুমে?”

“তা দুলকেই জিজ্ঞেস কর।”

“আপনি মিথ্যা কথা কেন বলছেন? গিফট দেওয়ার হলে এমন লুকিয়ে দেওয়ার কী আছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“এই পিচ্চি, এত বেশি বুঝতে চাস কেন? গিফট যখন পেয়েছিস তা নিয়ে খুশি থাক।”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“নিব না আমি এসব। আপনার জিনিস আপনিই রাখুন।”

কথাটা বলেই আমি কান থেকে দুল খুলতে লাগলাম। উনি চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন,“খুলছিস কেন? বললাম না আমি দেইনি?”

আমি ততক্ষণে দুল দুটো খুলে ওনার এক হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,“আমি সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি।”

ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াতে নিতেই শাড়ির আঁচলে টান পড়ল। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রচন্ড রাগও উঠে গেল। তেজ নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই তাজ ভাইয়ের মুখটা দেখে মিইয়ে গেলাম। চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। মনে হচ্ছে পারলে এখনই আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। আমি হাত দুটো কচলাতে কচলাতে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওনার হাতের মুঠোয় আমার শাড়ির আঁচল ধরা। উনি ধীর পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যাই। কিন্তু শয়তানটা তো আঁচল ছাড়ছেই না। কানের লতিতে ওনার হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেল। উনি আমার দুই কানে আবার দুল দুটো পরিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ আমার চুলের খোঁপাটা খুলে ফেললেন। আমার চুলগুলো অবাধ্যের মতো মুখে-পিঠে ছড়িয়ে পড়ল। উনি আমার মুখের ওপর পড়া চুলগুলো ঠেলে পেছনে দিয়ে দিলেন। আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে কিছুটা সরে দাঁড়ালাম। উনি আমার শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে বললেন,“ফেরত নেওয়ার জন্য তাজওয়ার কাউকে কিছু দেয় না।”

ওনার কথাটা কানে গেলেও আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালাম না। এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আফরা আপু আমাকে দেখে বলল,“এই ইলো, আমি চা করেছি। এখন কি রুমে দিয়ে আসব?”

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম,“তোমার ইচ্ছা।”

আপু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,“রুমেই দিয়ে আসি। তুই বস, আমি আসছি।”

আমি ঘাড় কাত করে সোফায় বসে পড়লাম। তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। তাজ ভাই গোসল করে বের হলেই আবার ওনার সামনে পড়তে হবে। কিন্তু এখন আর আমি ওনার সামনে পড়তে চাই না।

চলবে…………………….🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৩

আজ আমার অবস্থা হুমায়ূন আহমেদ স্যারের উপন্যাস ‘মৃন্ময়ীর মন ভালো নেই’ নামের মতো। শুধু নামটা পাল্টে দিলে হয় ‘ইলোরার মন ভালো নেই।’ সন্ধ্যা থেকেই হঠাৎ করে আম্মুর কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। ইতোমধ্যে চোখ দুটোও ভিজে উঠেছে। রুমে ভালো লাগছিল না তাই ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ে এসে বসে আছি। বাড়ির বাইরের ইলেকট্রনিক লাইটের আলোক ছটা পুকুরের দিকেও কিছুটা আলো ফেলছে। বেশ কিছুক্ষণ পুকুরের দিকে তাকিয়ে এক ধ্যানে বসে থাকার পর হঠাৎ মনে হলো আমার পাশ ঘেঁষে কেউ বসল। আমি কিছুটা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। তাজ ভাইকে শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার পুকুরের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করলাম।‌ শ্রেয়ান ভাইয়া সন্ধ্যার কিছু আগে কোথাও একটা বেরিয়েছেন। হয়তো সেজন্যই ওনারও রুমে একা একা ভালো লাগছিল না। মিনিট দুয়েক পর তাজ ভাই বললেন,“একা একা এখানে বসে আছিস, ভয় করছে না? না-কি কষ্ট ভয়কেও হার মানায়?”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। যেমন ছিলাম তেমনই বসে রইলাম। তাজ ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। উনি আমার ডান হাতের ওপর আলতো করে হাত রাখলেন। আমি কিছুটা চমকে একবার হাতের দিকে আরেকবার ওনার মুখের দিকে তাকালাম। ওনার মুখটাও কেমন যেন শুকনো লাগছে। আমার মনে হলো ওনারও হয়তো ফুপির কথা মনে পড়ছে। উনি আরেক হাত দিয়ে আমার চোখের কোণের চিকচিকে পানিটুকু মুছে দিলেন। অন্যরকম একটা সুখ অনুভব করলাম আমি। এভাবে কতশত বার কান্না করে চোখ ভিজিয়েছি। কিছু সময় পর সেই ভেজা চোখ আবার শুকিয়েও গেছে, কিন্তু জলটুকু মুছে দেয়ার মতো কেউ ছিল না। আজ মনে হলো চোখের পানি মুছে দেয়ার মতো কেউ একজন পেয়েছি আমি। এসব ভাবতে ভাবতে যে অপলক দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তা খেয়ালই ছিল না। ওনার কথায় আমার হুঁশ ফিরল। উনি বললেন,“যাবি এক জায়গায়?”

আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করালেন। তারপর সেভাবেই বাড়ির গেটের দিকে হাঁটা দিলেন। অন্য সময় হলে আমি জেদ ধরে বসতাম। আজ আর সেই ইচ্ছে হলো না। চুপচাপ ওনার সাথে পা মিলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর বাড়ির উল্টো দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। গ্রামে এলে এই রাস্তায় খুব একটা আসা হয় না আমার। ভরা জোৎস্না না হলেও চারদিকে চাঁদের আলোয় বেশ আলোকিত হয়ে আছে। রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য বড়ো বড়ো গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এসবের নাম আমার জানা নেই। রাস্তার দুপাশেই নিচু ছোটো ছোটো বিল দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে মাঝে আবার কয়েকটা বসত বাড়িও আছে। এমন নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ আমার মনে হলো এক প্রেমী যুগল হাত ধরাধরি করে অজানা গন্তব্যে পথ চলছে তো চলছেই। এ পথ শেষ হবার নয়। পরক্ষণেই এমন উদ্ভট কল্পনার কারণে মনে মনে হাসিও পেল। প্রায় পনেরো মিনিটের মতো নিশ্চুপ ভাবে হাঁটার পর একটা বড়ো বিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম।‌ বিলের দিকে তাকিয়ে আমার মনটা উচ্ছসিত হয়ে উঠল। সারা বিল জুড়ে সাদা শাপলার সমাহার। বিলের মাঝামাঝি একটা নৌকায় সমবয়সী দুজন মেয়ে আর একজন ছেলেকে চোখে পড়ল। আমারও ইচ্ছে জাগল নৌকায় চড়ার। বহু বছর ধরে নৌকায় চড়া হয় না। তখনই একজন হাড্ডিসার বৃদ্ধ লোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,“নৌকায় উঠবানি গো দাদা?”

আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শয়তানটা যে আমাকে নৌকায় উঠতে দিবে না তা আমি দুইশ পার্সেন্ট নিশ্চিত। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে তাজ ভাই হাসিমুখে বললেন,“হ্যাঁ দাদু। আপনার নৌকা কোথায়?”

লোকটাও হেসে বললেন,“ঐ তো ওইহানে। আহো আমার লগে।”

লোকটা বিলের তীরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। তাজ ভাইও আমার হাত ধরে সেদিকে নিয়ে গেলেন। আমি এখনও অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে ওনার আচরণে পরিবর্তন দেখে আমি কনফিউশনে পড়ে যাই। বিলের পাড়ে ছোটো-খাটো একটা নৌকা বাঁধা আছে। নৌকার মাঝ বরাবর একটা হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা। বৃদ্ধ লোকটা নৌকায় উঠে বসে আমাদেরকেও উঠতে বললেন। তাজ ভাই আমাকে ধরে সাবধানে নৌকায় উঠিয়ে দিলেন। তারপর উনিও উঠে পড়লেন। আমি নৌকার পাটাতনে পা ভাঁজ করে বসে পড়লাম। তাজ ভাইও আমার পাশ ঘেঁষে বসলেন। আমি ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বললাম,“সবসময় গা ঘেঁষে বসেন কেন? আশ্চর্য!”

আমার কথায় উনি কোনো রকম তোয়াক্কা করলেন না। মাঝি নৌকা বাওয়া শুরু করলেন। ফুরফুরে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। আমি নিচু হয়ে কয়েকটা শাপলা তুললাম। তারপর পানিতে হাত ডুবিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। একদম পরিষ্কার, স্বচ্ছ পানি। হঠাৎ কোমরে আলতো হাতের স্পর্শে আমি হকচকিয়ে গেলাম। পরক্ষণেই বুঝলাম এটা তাজ ভাইয়ের কাজ। আমি ঢোক গিলে নড়েচড়ে বসে ওনার দিকে তাকালাম। উনি তখন আমার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছেন। এতে আমি আরও অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। তবু নিচু স্বরে বললাম,“সমস্যা কী আপনার? গা ঘেঁষে বসেও মন ভরেনি? এখন আবার টাচ করছেন!”

উনি কপাল কুঁচকে বললেন,“নিজেকে এত ইম্পর্ট্যান্ট ভাবিস না। তোকে টাচ করার অত সাধ নেই আমার। এই বিলটা একটু গভীর। যেভাবে নিচু হয়ে পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে আছিস, পড়ে গেলে দায় কে নিবে? সাঁতার তো জানিসই না।”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আমি সামলে নিতে পারব নিজেকে। আপনার হেল্প লাগবে না।”

উনি আর আমার কথায় কান দিলেন না। আলতো হাতে কোমর ধরে আগলে রেখে চুপচাপ বসে রইলেন। ঘাড়ত্যাড়া লোক একটা! আমি আর ওনার সাথে অযথা বকবক না করে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নৌকাটা বিলের মাঝামাঝি এসে পড়েছে। বৃদ্ধ মাঝি হঠাৎ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,“তোমার সোয়ামি কিন্তু তোমারে নিয়া অনেক ভাবে গো বইন। কত যত্ন কইরা তোমারে আগলায়া রাখছে! কপাল কইরা একখান সোয়ামি পাইছো। মাইয়া মাইনষের এমন একখান সোয়ামি থাকলে আর কী চাই? হেরা তো এমন দায়িত্ববান একখান সোয়ামিই চায়। আল্লাহর কাছে সবসময় শুকরিয়া জানাইবা, বুঝছো?”

আমি গোলগাল চোখে মাঝির মুখের দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলাম। এসব কী বললেন তিনি! না জেনে এমন উদ্ভট কথাবার্তার কোনো মানে হয়? এই বিপজ্জনক লোকটাকে আমার হাসবেন্ড ভেবে বসলেন!তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শয়তানটা ঠোঁট টিপে হাসছে। আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল। উনি বৃদ্ধের ভুল ধরিয়ে দেয়ার বদলে উলটো মজা নিচ্ছেন। আমি কটমট চাহনিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,“মজা নিচ্ছেন? শয়তান লোক! ওনাকে বলুন আমরা ভাই-বোন।”

উনি মাঝির দিকে তাকিয়ে বললেন,“দাদু, আমরা এখনও বিয়ে করিনি।”

আমি হা হয়ে গেলাম। বলতে বললাম কী আর উনি বললেন কী! এমনভাবে বললেন যেন এখন বিয়ে করিনি কিন্তু পরে অবশ্যই করব। মাঝি বললেন,“তাইলে তাড়াতাড়ি কইরা ফালাও দাদা।”

তাজ ভাই বললেন,“আমার মতো এত ভদ্র একটা ছেলে এমন ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে বিয়ে করবে কী মনে করে দাদু?”

মাঝি ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বললেন,“পিরিতি সত্য ওইলে পরে এই গাড়ত্যাড়া মাইয়াই তোমারে জগতের সব সুখ দিবো।”

“এত নিশ্চয়তা কীভাবে দিচ্ছ?”

“কতা মিছা ওইলে পরে আমার বিচার কইরো দাদা। তয় একখান হাচা কতা কী জানো? মাইয়াডার লাইগা তোমার পিরিতি এক্কেরে খাঁটি। ও বইন, এমন পিরিতি হারাই ফালাইও না আবার।”

ইতোমধ্যে আমি অবাকের শীর্ষ স্থানে পৌঁছে গেছি। মুখ দিয়ে কথা বের করতেও ভুলে গেছি। কেবল হা করে মাঝি আর তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথা গিলেছি। তাজ ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে তৃপ্তির হাসি লেগে আছে। আমার মাথার মধ্যে শুধু তাদের এতক্ষণের কথোপকথনগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বললেন,“সব কথা নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবা মাথামোটাদের কর্ম নয়। রিল্যাক্স পিচ্চি।”

আমি এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। কিছুটা লজ্জাও পেলাম মাঝির কথাগুলো ভেবে। বৃদ্ধ লোকটা না বুঝেই কীসব বকে যাচ্ছে। ধুর! কিন্তু আমার খটকা লাগল তাজ ভাইয়ের ব্যাপারে। মাঝিটা এত কথা বলার পরও উনি একবারও বলেননি যে এসব ভুল ধারণা। উলটো নিজেও তাল মিলিয়েছেন। এসবের মানে কী? মাঝির কথাটা কি তাহলে সত্যি? উনি সত্যিই আমাকে…..। ধুর! এটা জীবনেও সম্ভব না। কিন্তু তবুও তো ব্যাপারটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। যাকগে, এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন এসব ভেবে এত সুন্দর একটা মুহূর্ত নষ্ট করার মানে হয় না। আমি আবার শাপলা দেখতে মনোযোগ দিলাম। অনেকটা সময় নৌকা ভ্রমণ করে‌ মাঝি যখন তীরে নৌকা ভিড়ালেন তখন তাজ ভাই আমার কোমর ছাড়লেন। আমি যেন এতক্ষণে স্বস্তি পেলাম। তবে একটা ব্যাপার ভেবে অবাক হলাম। উনি আমার কোমরে হাত রেখে আগলে রাখলেন অথচ আমার তেমন অস্বস্তি হয়নি। তারপর ভাবলাম উনি খারাপভাবে ছোঁননি, বরং আমাকে রক্ষার জন্যই আলতো করে ধরেছিলেন, সেজন্যই হয়তো অস্বস্তি হয়নি। তাজ ভাই আমাকে যেভাবে নৌকায় উঠিয়েছিলেন সেভাবেই সাবধানে নামিয়ে দিলেন। উনি মাঝির ভাড়া মিটিয়ে হাসিমুখে বললেন,“আসছি দাদু, ভালো থেকো।”

মাঝিও হেসে বললেন,“তোমরাও ভালো থাইকো দাদা। তাড়াতাড়ি বিয়া সাদি কইরা সুখী হও, দোআ করি।”

আমি আরেক দফা অবাক হলাম। অথচ তাজ ভাই মুচকি হেসে আমার হাত ধরে আবার হাঁটা ধরলেন। আমার মনে এই মুহূর্তে এক গাদা প্রশ্ন জমা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর এই শয়তানটার থেকে পাওয়া সম্ভব না। হঠাৎ দেখলাম কয়েকটা পিচ্চি ছেলে রাস্তার একপাশে ভীড় করে আছে। সবাই পারলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ভালোভাবে তাকাতেই দেখলাম আমার বয়সী একটা ছেলে বড়ো একটা বাক্স থেকে আইসক্রিম বের করে সবার হাতে দিচ্ছে। সবাই আইসক্রিম নিচ্ছে আর টাকা দিচ্ছে। আমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাজ ভাইয়ের হাতে টান পড়ায় উনিও দাঁড়িয়ে আমার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি রাস্তার পাশে ইশারা করে দেখিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বললাম,“আইসক্রিম খাব?”

উনি সরু চোখে আইসক্রিমের বাক্সটার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,“বাইরের খোলা আইসক্রিম খাওয়ার কোনো দরকার নেই। এসব অস্বাস্থ্যকর।”

আমি জানতাম উনি ঠিক এটাই বলবেন। তবু গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আইসক্রিম খাবই খাব। কিন্তু উনি কিছুতেই খেতে দিবেন না। শেষমেষ আমাকেই হার মানতে হলো। কারণ উনি আমাকে টানতে টানতে সেখান থেকে নিয়ে গেলেন। মনে মনে আমি ওনাকে এক গাদা বকা দিলাম। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে হঠাৎ আমি কিছু না ভেবেই বলে বসলাম,“আমাকে বনলতা নামে ডাকার কারণটা ঠিক বুঝলাম না।”

উনি আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন,“আগেই বলেছি সবকিছু বুঝা তোর মতো মাথামোটাদের কর্ম নয়।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“আপনি যেহেতু ডেকেছেন জেনেই তো ডেকেছেন। কারণটা বললেই তো হয়। বনলতা নামের একজনকেই চিনি। জীবনানন্দ দাশের কবিতার বনলতা। আমি কীভাবে বনলতা হলাম?”

উনি সেই ত্যাড়াভাবেই বললেন,“সবকিছু বুঝলে কি আর তোকে পিচ্চি বলতাম?”

উনি যে আমার কোনো প্রশ্নের সঠিক জবাব দিবেন না তা ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম। তাই নিজেও চুপ থাকলাম। ওনার এই ত্যাড়া-ত্যাড়া কথা শুনে মেজাজ খারাপ করার থেকে চুপ থাকা শ্রেয়। বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরে দাদুমনি আর ছোটো কাকির সামনে পড়লাম। তাজ ভাই দাদুমনির পাশে বসে বলতে লাগলেন আমরা কোথায় গিয়েছিলাম। আমি সেখানে না দাঁড়িয়ে রুমে চলে এলাম। রুমে ঢুকে বিছানায় বসতেই জেমি লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠল। ওকে আদর করে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। অজু করে নামাজ পড়ে জেমিকে নিয়ে রুম থেকে বেরোতে নিতেই আফরা আপু রুমে এল। আমি তাকে দেখে মিষ্টি হেসে বললাম,“কী করছিলে আপু?”

আপু আমার কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল,“কোথায় গিয়েছিলি?”

আমি সোজাসাপ্টা উত্তর দিলাম,“তাজ ভাইয়ের সাথে শাপলা বিলে গিয়েছিলাম।”

“একাই চলে গেলি!”

“উনিই হঠাৎ নিয়ে গেলেন। আমি জানতাম না ওখানে নিয়ে যাবেন।”

“বাহ্! একসাথে অনেকটা সময় কাটাতে পেরেছিস।”

আফরা আপুর কন্ঠটা কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগল আমার কাছে। তবু আমি হাসিমুখে বললাম,“আগে জানলে তোমাকে নিয়ে যেতাম আপু। সরি।”

আপু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,“বাদ দে। আমি একটা কথা বলার জন্য এসেছি।”

“হ্যাঁ বলো।”

“তুই তাজ ভাইয়ের থেকে………….।”

আপুর কথা শেষ না হতেই তাজ ভাই রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,“আমাকে নিয়ে কী কথা হচ্ছে?”

আফরা আপু মেকি হেসে বলল,“আমাকে ছাড়াই ঘুরে এলেন ভাইয়া?”

তাজ ভাই বললেন,“ওহহো! একদম খেয়াল ছিল না আফরা। আসলে শ্রেয়ান বাসায় ছিল না তো তাই তোমার কথাও মনে ছিল না। মন খারাপ কোরো না। পরেরবার কোথাও গেলে অবশ্যই তোমাকে নিয়ে যাব।”

উনি যে মিথ্যা কথা বললেন তা আমি বেশ বুঝতে পারলাম। আসলে উনি ইচ্ছে করেই আফরা আপুকে সাথে নেননি। আফরা আপু জোরপূর্বক হেসে মাথা দোলালো। আমি আফরা আপুর মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। তাজ ভাই জানালেন শ্রেয়ান ভাইয়া এইমাত্র বাসায় ফিরেছেন। কাকিরা আমাদের খাবার টেবিলে ডাকছে। আমি আর আফরা আপু তাজ ভাইয়ের পেছন পেছন রুম থেকে বেরিয়ে এসে খাবার টেবিলে বসলাম।

চলবে……………..🍁