তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৩২+৩৩

0
553

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩২

আজ নিয়ে পরপর তিনদিন শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে আমি ভার্সিটি এসেছি। সেই প্রথম দিন তাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলার পর দ্বিতীয় দিন আর আমি ফোন রিসিভ করিনি। পাঁচবার ওনার ফোন ইগনোর করার পর থেকে এখন পর্যন্ত আর একবারও উনি ফোন করেননি। আজ আমার ক্লাস শেষ হলো সাড়ে বারোটায়। ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে এসেই আমি শ্রেয়ান ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। মিষ্টি হেসে আমি এগিয়ে যেতেই শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“আজ তো অনেক তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হলো। চলো বাইরে থেকে ফুসকা খাই, তারপর বাড়ি পৌঁছে দিব।”

আমি খুশি হয়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,“ওকে।”

শ্রেয়ান ভাইয়া আর আমি পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গেইটের দিকে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার গা ঘেঁষে একটা মেয়ে দ্রুতবেগে হেঁটে চলে গেল। ফলস্বরূপ তাল সামলাতে না পেরে আমার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। শ্রেয়ান ভাইয়া খপ করে আমার এক হাত ধরে সামলে নিলেন। পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া পেছন ফিরে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন,“পায়ে হাঁটে না যেন বিমান চালায়। স্টুপিড!”

কথাটা বলেই উনি আমাকে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,“চলো।”

ওনার হাতের মুঠোয় যে আমার হাত এখনও বন্দি, সেদিকে হয়তো ওনার খেয়াল নেই। গেইট পেরিয়ে এসে হাত ছাড়ার কথা বলতে যাব ঠিক তখনই আমার দৃষ্টি চলে গেল রাস্তার ডান পাশে। সঙ্গে সঙ্গে আমার পা থেমে গেল। আমার সাথে শ্রেয়ান ভাইয়াও থেমে গেলেন। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে উনিও সামনে তাকালেন। ওদিকে তাজ ভাইয়ের শক্ত দৃষ্টি তখন আমার আর শ্রেয়ান ভাইয়ার হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হেসে বললেন,“হেই মিস্টার তাজওয়ার। এত দ্রুত কীভাবে এলি বস? তোর না বিকেলে আসার কথা ছিল?”

তাজ ভাই আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,“কাজ শেষ, তাই চলে এলাম। তোরা কোথায় যাচ্ছিস?”

“ইলোমিলোর আজ তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়েছে, তাই ওকে নিয়ে ফুসকা খেয়ে তারপর বাড়ি দিয়ে আসব ভেবেছিলাম। তুই যখন এসে গেছিস। চল, ওর ফুসকা খাওয়া শেষ হলে নিয়ে যাস।”

“না, তুই-ই নিয়ে যা। আমি এখন বাড়ি ফিরব না।”

“কেন?”

“কাজ আছে একটু। বাই।”

বলেই তাজ ভাই দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলেন। চোখের পলকে উনি গাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। অথচ আমার দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। আমি থম মেরে এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। ওনার চাপা রাগটা বুঝতে আমার বাকি রইল না। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,“ইলোমিলো, চলো আমরা ফুসকা খেয়ে আসি।”

আমি হঠাৎ বলে উঠলাম,“খেতে ইচ্ছে করছে না ভাইয়া।”

শ্রেয়ান ভাইয়া দুচোখে দারুণ অবিশ্বাস নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বললেন,“কী? তোমার ফুসকা খেতে ইচ্ছে করছে না? কিছুক্ষণ আগেই তো বেশ খুশি হয়েছিলে।”

“হ্যাঁ, আসলে আমার মাথাটা ধরেছে। তাই অল্প থাকতে বাড়ি যেতে চাইছি।”

শ্রেয়ান ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে বললেন,“সেকি! তোমার মাথা ধরেছে তা আগে বলবে না? ডক্টরের কাছে যাবে?”

“এটুকুর জন্য ডক্টরের কাছে যেতে হবে না। বাড়ি গেলেই চলবে।”

“আচ্ছা চলো।” বলেই শ্রেয়ান ভাইয়া এগিয়ে গিয়ে নিজের বাইকে চড়ে বসলেন। আমিও এগিয়ে গিয়ে ওনার পেছনে উঠে বসতে বসতে বললাম,“বাইক এখানে রেখে আপনি ক্যাম্পাসে ছিলেন?”

“আরে কী হয়েছে জানো? আমি বাইক নিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম‌। হঠাৎ দেখলাম ক্যাম্পাসে দুটো ছেলের মধ্যে গন্ডগোল বেঁধেছে। ওদেরকে থামানোর জন্য বাইক রেখে গেছি।”

“ওহ্।”

“বসেছ ঠিকমতো?”

“হ্যাঁ।”

“কাঁধে হাত রাখার কথা কি বারবার বলে দিতে হবে?”

আমি এক হাত শ্রেয়ান ভাইয়ার কাঁধে রাখলেও তার আর আমার মাঝে কিছু পরিমাণ ফাঁকা রাখলাম। সারা রাস্তা শ্রেয়ান ভাইয়া ননস্টপ কথা বললেও আমি চুপ রইলাম। একজনের রাগের চিন্তা এসে জুটেছে যে আমার মাথায়। পুনরায় তার মুখ দর্শন না করা অব্দি আমার মাথায় গন্ডগোল বেঁধেই থাকবে। আমাকে বাড়ির গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেলেন। যদিও ওনার তাড়া আছে, তবু আজ আর আমি অত আগ্রহ নিয়ে বাড়ির ভেতরে যেতে বললামও না। কলিংবেল চাপতেই মিতা দরজা খুলল। আমি ভেতরে ঢুকতেই মিতা এক হাতে দরজাটা বন্ধ করে উলটো দিকে পা বাড়াল। ওর হাতে শরবতের গ্লাস দেখে আমি প্রশ্ন করলাম,“বাবা এসেছে না কি?”

মিতা দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,“না, ভাইয়া এসেছে।”

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,“কখন?”

“একটু আগে।”

“আচ্ছা উনি গ্রাম থেকে ফিরেছেন কখন?”

“বললাম তো একটু আগেই।”

“ওহ্।”

মিতা তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে চলে গেল। উনি যে গ্রাম থেকে ফিরে বাড়ি না এসে আগে ভার্সিটি গেছেন, তা বুঝতে বাকি রইল না আমার। কিন্তু উনি তো বলেছিলেন কী যেন কাজ আছে। আমাকেও তাই সাথে আনলেন না। ব্যাস, হয়ে গেল আমার কপালে আস্ত একটা বজ্রপাত পড়া। আজ আমার ভাগ্যে যে শনির আখড়া জুটবে, সে বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত। দ্রুত ছুট লাগালাম নিজের রুমের দিকে। রুমে ঢুকেই শাওয়ার নিতে চলে গেলাম। আমি ফিরেছি শুনে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো উনি রুমে হাজির হবেন। তারপর আমার রুমের মধ্যে সুনামি বয়ে যাবে। কিন্তু না, এসবের কিছুই হলো না। শাওয়ার নিয়ে বেরোনোর পর আরও আধঘণ্টা আমি রুমে বসে রইলাম। আর আমার অচেতন মন ওনার অপেক্ষা করছে। হঠাৎ আমার মস্তিষ্ক প্রশ্ন ছুঁড়ল, আমি কি ওনার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি? উনি মাফিয়া জেনেও কি ওনার প্রতি আমার অনুভূতি বাড়তে দেওয়া উচিত? কিন্তু পরে এর ফল কী হবে? অথচ এসব ভাবতে গিয়েও বরাবরের মতো আমার ফলাফলের খাতায় সেই শূন্যই এল। শেষমেষ অধৈর্য হয়ে আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ওনার রুমের দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গেলাম। সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। আজ মনে হচ্ছে গত দিনগুলোর থেকে একটু বেশিই ভয় লাগছে ওনাকে। উলটো দিক ঘুরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলাম। মারজিয়া খালা রান্না করছেন। মিতা-রিতা তাকে সাহায্য করছে। পাশেই দেখলাম আফরা আপু কাপে চা ঢালছে। আমাকে দেখে আপু বলল,“ইলো, চা-টা একটু কাকার রুমে দিয়ে আয় তো। আমি এখনও গোসল করতে যাব।”

আমি প্রশ্ন করলাম,“বাবা কখন ফিরল?”

“এইমাত্র।”

আফরা আপু আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও তার পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম। কয়েক পা এগোতেই সামনে তাজ ভাইকে দেখে থেমে গেলাম। ওনার কাঁধে একটা ব্যাগ দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তার চেয়ে বেশি অবাক হলাম ওনার ড্রেস আপ দেখে। আজ উনি পাঞ্জাবি পারেননি। কালো প্যান্ট, সাদা শার্টের ওপর কালো কোট আর টাই পরেছেন। দেখে মনে হচ্ছে উনি বাইরে যাচ্ছেন। সু আর সানগ্লাসও কালো। আমার মস্তিষ্ক প্রশ্ন তুলল, আমার কি ক্রাশ খাওয়া উচিত? কিন্তু আমি তো ওনার ওপর আর কখনও ক্রাশ খাব না ভেবেছি। আপাতত ক্রাশ খাওয়ার কথা ভুলে দৌড়ে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। উনি আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে হাতের ঘড়ি ঠিক করতে লাগলেন। আমি কোনো কিছু না ভেবেই প্রশ্ন করে বসলাম,“এই অসময়ে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

তাজ ভাই আমার কথায় কান না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন,“আফরা, মামু ফিরেছে?”

পেছন থেকে আপু উত্তর দিলো,“হ্যাঁ।”

আফরা আপু যে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তা আমি খেয়াল করিনি। আমি ভেবেছিলাম সে চলে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। তাজ ভাই আবার বললেন,“মামুকে বলিস আমি একটা জরুরী কাজে বাইরে গেছি।”

“এই দুপুরবেলা কী জরুরী কাজ? লাঞ্চ করবেন না?”

“সময় নেই। বাইরে থেকে করে নিব।”

“একটু সময় নিয়ে খেয়ে গেলে কী হয়?”

“বললাম তো সময় নেই।”

“আচ্ছা।”

আমি বলে উঠলাম,“বাইরে গিয়ে খেলে কি সময় লাগবে না? বাসা থেকে খেয়ে যান, সময় আরও কম লাগবে। ভরদুপুরে কী এমন জরুরী কাজ?”

তাজ ভাই এক পলক আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু কোনো কথা না বলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। ওনার গম্ভীর মুখটা দেখে আমি চুপ মেরে গেলাম। ওই দৃষ্টিতে ঠিক কী ছিল বুঝে উঠতে পারলাম না। অভিযোগ, অভিমান, না কি রাগ? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগেই তাজ ভাই আমার সামনে থেকে উধাও। গটগট করে হেঁটে চোখের পলকে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওনার চলে যাওয়া দেখলাম। পরক্ষণেই আফরা আপুর কথায় আমার ধ্যান ভাঙল। আফরা আপু ভাবুক কন্ঠে বলল,“বুঝি না, ওনার কী এত কাজ? দেশে ফিরে তো উনি ঘোরাঘুরি ছাড়া আর কোনো কাজে নামেননি। আর ওনাদের বিজনেসও সুইডেনে। তাহলে?”

আমি আফরা আপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে হাসলাম। ওনার সিক্রেট কাজের ব্যাপারে আমি ছাড়া কেউ জানে না ভেবে বেশ মজা পেলাম। কিন্তু নিজের মনোভাবটা ধামাচাপা দিয়ে ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম,“কী জানি!”

দুপুর গড়িয়ে বিকেল গেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাত। অথচ তাজ ভাইয়ের বাড়ি ফেরার নাম নেই। বাবাকে প্রশ্ন করার পর তার উত্তর ছিল, উনি ছোটো বাচ্চা নন। সময় হলে বাড়ি ফিরে আসবেন। অথচ রাত আড়াইটা বাজার পরও ওনার বাড়ি ফেরার সময় হলো না। রাত এগারোটা থেকে এই পর্যন্ত বোধ হয় হান্ড্রেড প্লাস ফোন করেছি। কিন্তু তাজ ভাই বা শ্রেয়ান ভাইয়া কেউই ফোন রিসিভ করছেন না। বাড়ির সবাই শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। অথচ আমি বারবার বিছানায় শুতে গিয়েও ফিরে আসছি। পড়ার টেবিলে বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিম ধরে গেছে। এদিকে চিন্তায় মাথাও ধরেছে প্রচুর। এখনকার পরিস্থিতিতে আমার কোনো দোষ নেই জেনেও বারবার নিজেকেই দায়ী করছি। আমার সাথে রাগ করেই হয়তো উনি বাড়ি ফিরছেন না। নাহ্, আর বসে থাকা সম্ভব না। দরজাটা ভেজিয়ে রেখে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু দুচোখে মোটেও ঘুম নেই। মনটা কেমন অস্থির লাগছে। বারবার এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানি না। তারপর ঘুম ভাঙল বাবার ডাকে। চোখ খুলতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। কাল বেশি রাত করে ঘুমানোর ফল এটা। পরক্ষণেই মাথায় এল তাজ ভাইয়ের কথা। উনি কি আর বাড়ি ফিরেননি? লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বিছানা ছাড়লাম। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে বাবার রুমের দিকে চলে গেলাম। কিন্তু রুমে গিয়ে বাবাকে পেলাম না। হয়তো মসজিদে চলে গেছে। নিরাশ হয়ে আমি রুমে ফিরে এলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে তাজ ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করলাম। গতরাতে তবু রিং হচ্ছিল, অথচ এখন ফোনটাই বন্ধ বলছে। শ্রেয়ান ভাইয়ার ফোনও বন্ধ। এবার টেনশনটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। থমথমে মুখে অজু করে নামাজ আদায় করলাম, কুরআন তেলাওয়াত করলাম। তারপর আবার ফোন করলাম। ফলাফল শূন্য! বাবা মসজিদ থেকে ফেরার পর আবার গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তাজ ভাইয়ের খবর জানে কি না। বাবা গতরাতের মতোই ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো, উনি হয়তো কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় আছেন। আমি ভার্সিটি যাওয়ার আগেই হয়তো এসে পড়বেন। বাবার এই হয়তো শুনে আমার রাগ উঠে গেল। তবু চুপচাপ রুমে ফিরে এলাম। তারপর আবার ওনার নাম্বারে ডায়াল আর মিষ্টি কন্ঠে এক মেয়ের বলা কথা। এবার আমার চোখে পানি এসে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর আর রুম থেকে বেরোলাম না। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বাবার ডাক পড়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো। মাথা নিচু করে কোনোরকমে একটা রুটি শেষ করেই খাওয়া সমাপ্ত করলাম। ব্রেকফাস্ট শেষ করে বাবাকে টিভির সামনে বসতে দেখে অবাক হলাম। এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম,“টিভির সামনে বসছো যে! অফিস যাবে না?”

বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“যাব, নিউজটা দেখে যাই। বস এখানে।”

আমি বাবার পাশে বসে পড়লাম। নিউজ শুরু হওয়ার পর আফরা আপুও আমাদের পাশের সোফায় এসে বসল। প্রত্যেকদিন নিয়ম করে নিউজ দেখাটা তার অভ্যাস। আমার এই অভ্যাস একদমই নেই। মাঝেমাঝে বাবা কিংবা আফরা আপুর সাথে বাধ্য হয়ে দেখতে হয়। আর আজ তো মনেরই ঠিক নেই। বাবা আর আফরা আপুর সম্পূর্ণ মনোযোগ নিউজে থাকলেও, আমার নেই। আমি চুপচাপ বসে কোলের দিকে তাকিয়ে নখ খুঁটছি। নিউজের কথাগুলো কানে আসছে, তা-ও এই মুহূর্তে বিরক্ত লাগছে। ভাবলাম রুমে চলে যাব। রুমে যাওয়ার কথা ভাবার মুহূর্তেই নিউজের একটা লাইন কানে এল।

“নিজের মা এবং মামির হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে, দীর্ঘ আট বছর আগের পুরোনো কেস সামনে আনলেন নবীন ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ার।”

লাইনটা কর্ণগুহরে পৌঁছনোমাত্র আমি প্রচন্ড চমকে টিভির দিকে তাকালাম। নিউজ প্রেজেন্টার মহিলা পুনরায় বলতে শুরু করল,“জানা গেছে গত আট বছর আগে এক রাতে তার মা এবং মামি শপিং করে বাড়ি ফেরার সময় তাদের গলা কেটে হত্যা করা হয়। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তখন এই মামলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। স্ত্রী হারানোর শোক কাটাতে না পেরে আহনাফ তাজওয়ারের বাবা তার দুই ছেলে সন্তান নিয়ে সুইডেন পাড়ি জমান। সেখানেই তিনি নিজস্ব বিজনেস শুরু করেন। সুইডেনে বসবাসের চার বছরের মাথায় তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর থেকে আহনাফ তাজওয়ার এবং তার বড়ো ভাই আরফান রাজ বাবার বিজনেসের দায়িত্ব নেন। কিন্তু আহনাফ তাজওয়ারের মাথায় ছিল অন্য পরিকল্পনা। নিজের অ্যাডুকেশন কমপ্লিট করে আহনাফ তাজওয়ার দীর্ঘ আট বছর পর নিজ দেশে ফিরে আসেন। ডিটেকটিভ হয়েও সবার কাছে পেশাগত পরিচয় গোপন রেখে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডিটেকটিভ শ্রেয়ান চৌধুরীকে নিয়ে নেমে পড়েন মিশনে। তবে তার এই মিশনটা মোটেও সহজ ছিল না। উপযুক্ত প্রমাণ যোগাতে তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছদ্মবেশে তারা ছুটে চলেছে এদিক থেকে ওদিক। অবশেষে তারা তাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে। আসল খুনীকে নিয়ে এসেছে সবার সম্মুখে। খুনীদের মধ্যে একজন স্বয়ং আহনাফ তাজওয়ারের একমাত্র ফুপা রশিদ খান এবং তার মেজো মামা আজাহার উদ্দিন। এছাড়াও তাদের সাথে আরও কয়েকজন সন্ত্রাসী জড়িত আছে। এ কাজে তার পাশে থেকে সম্পূর্ণভাবে সাহায্য করেছেন ডিটেকটিভ শ্রেয়ান চৌধুরী এবং তার বড়ো মামা ইকরাম আহমেদ।”

আমি হতভম্ব হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছি। আফরা আপু তার বাবার নামটা শোনামাত্র সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনই স্ক্রিনে ভেসে উঠল জনসমাগম। তারমধ্যে মেজো চাচা আর তাজ ভাইয়ের ফুপাকে হাতকড়া পরা অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠলাম। দুজনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সাথে আরও চারজন লোকের হাতেও হাতকড়া। সবাইকে ঘিরে আছে একদল পুলিশ। দুজন পুলিশ তাদের ঠেলে গাড়িতে উঠাচ্ছেন। এরপর দেখাল তাজ ভাইকে। তার পাশেই শ্রেয়ান ভাইয়া আর নাসের ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। সাংবাদিকরা তার সামনে ভিড় জমিয়েছে। তাজ ভাই বেশ সিরিয়াসভাবে বলছেন,“তদন্তের পর যে এমন কিছু বেরিয়ে আসবে তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আপন মানুষরাই আমার পায়ে কুঠার মেরেছে। তবে তারা তাদের মূল উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। তাদের নজর ছিল প্রোপার্টির ওপর। দুজনের পরিকল্পনা ছিল আমার মা আর মামিকে সরিয়ে দিয়ে বাবা আর মামাকে মানসিকভাবে দুর্বল করবে। আমার বাবা তো সবকিছু ছেড়ে আমাদের নিয়ে সুইডেন চলে গিয়েছিল। আমার ফুপা অবশ্য আমার বাবাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বাবার প্রোপার্টি আত্মসাত করতে পেরেছিল। কিন্তু আমার মামা পারেনি। কারণ আমার বড়ো মামা পরিবারের থেকে দূরে থাকলেও নিজের সবদিক ঠিক রেখেছিল। আমি আমার বন্ধু শ্রেয়ানের কাছে কৃতজ্ঞ। ও না থাকলে হয়তো আমি আমার মিশনে সাকসেসফুল হতে পারতাম না। আমার জন্য ও নিজেও নিজের পরিচয় গোপন রেখেছে।”

আফরা আপু এক ছুটে দোতলায় চলে গেল। আমি ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকালাম। বাবাও কাঁদছে। আমি ধরা গলায় বললাম,“এতকিছু হয়ে গেল আর তুমি আমাকে কিছু বললে না বাবা!”

বাবাও ধরা গলায় বলল,“তদন্তের স্বার্থে গোপন রাখতে হয়েছে আম্মা। এই সত্যি জানার পর আমি নিজেও প্রচন্ড শকড হয়েছিলাম।”

আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। পুনরায় বললাম,“তার মানে এই জন্যই তাজ ভাই গ্রামে গিয়েছিল?”

বাবা ওপর নিচে মাথা দোলালো। আমি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠে বললাম,“কাকা এমনটা কীভাবে করতে পারল বাবা? আম্মুকে নিজের হাতে মেরে ফেলল!”

বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,“লোভ মানুষকে অমানুষ করে দেয় রে আম্মা।”

এবার সবকিছু আমার কাছে খোলাসা হলো। সমস্ত ধোঁয়াশা কেটে গেল। এতদিন তাহলে আমি ভুল ছিলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া আসলে মাফিয়া নন, ডিটেকটিভ! এই ছিল ওনাদের আসল রহস্য!

চলবে………………..🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৩

অপেক্ষার প্রহর এত সুদীর্ঘ কেন? এক-একটা মিনিট যেন এক-একটা ঘন্টার সমান। পৃথিবীর কতশত কপোত-কপোতী প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করে। দিন-মাস-বছর পেরিয়ে যায়। তবু তারা ক্লান্ত হয় না। অথচ তারা জানে যে যার জন্য এত অপেক্ষা, সে যুগ পেরোলেও ফিরবে না। তবু কেন এত অপেক্ষা? ‘ভালোবাসা’ নামক এই ছোট্ট শব্দটার বুঝি এত শক্তি! এতই যদি শক্তিশালী হয়ে থাকে, তবে কেন মানুষ ভালোবাসার অভাবে ভোগে? কেন বালিশে মুখ গুঁজে বিনিদ্র রজনী জাগে? কেন শতশত প্রাণ আত্নদান করে? এতকিছুর পরও ভালোবাসা ভালোবাসাই। না এর শক্তি পালটাবে, না অর্থ।

রাত এখন সাড়ে এগারোটা। মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পীডে ঘুরছে। আর আমি বিছানায় সটান শুয়ে সেদিকে তাকিয়ে দুনিয়ার যত ভাবনা ভাবছি। অথচ কোনো ভাবনাই স্থায়ী হচ্ছে না। এটা ভাবছি তো ওটা ভালো লাগছে না, ওটা ভাবছি তো এটা ভালো লাগছে না। একটা সম্পূর্ণ না করেই আরেকটার পেছনে লেগে পড়ছি। জেমির মিয়াও মিয়াও ডাকে পাশ ফিরে তাকালাম। টেবিলে চোখ পড়ল। ঢেকে রাখা খাবারের প্লেটটা দেখে উঠে বসলাম। এখনও কি উনি আসেননি? সকালের সেই নিউজ শোনার পরও অনেকবার ওনাকে ফোন করেছি। রিং হওয়ার পরও উনি বারবার কেটে দিয়েছেন। অথচ বাবার ফোন ঠিকই ধরেছেন। বাবা বলেছে উনি না কি তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলেছেন। অথচ এখনও ফেরেননি। এদিকে আফরা আপু আজ সারাটা দিন ধরে ঘরে আটকে আছে। হাজারবার ডাকলেও সে দরজা খোলেনি। মাঝে না কি সন্ধ্যায় একবার বেরিয়েছিল বেশি ক্ষুধা পেয়েছিল বলে। তখন আমি দেখিনি। মিতা-রিতা চলে যাওয়ার সময় দেখেছিল। তারপর‌ ওরা এসে আমাকে বলে গেছে। জানি না আপুর মনে এখন কী চলছে। হয়তো প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। পেটের মধ্যে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে। সেই সকালে একটা রুটি খেয়েছিলাম। তারপর দুপুরে খাইনি। রাতে বাবা জোরাজুরি করছিল বলে খাবার নিয়ে রুমে চলে এসেছি। কিন্তু খাইনি। একজন দূর থেকে যে আমার খাদ্য ভক্ষণের ইচ্ছেটাও কেড়ে নিয়েছে। শোয়া থেকে উঠে বসলাম। ভাবলাম একটু পানি খেলে ভালো হয়। বেড সাইড টেবিলে শূন্য জগ পড়ে আছে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে জগ হাতে বাইরে হাঁটা দিলাম। টেবিলের কাছে যাওয়ার আগে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে তাকালাম। আমার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। রুমে বাতি জ্বলছে, তার মানে উনি এসেছেন। হাতের জগটা টেবিলে রেখে এসে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে সোজা ওনার রুমে ঢুকে গেলাম। বিছানায় ল্যাপটপ, ফোন আর অগোছালো জামা-কাপড় নজরে পড়ল। এগুলো পরেই উনি গতকাল বেরিয়েছিলেন। কিন্তু রুম তো ফাঁকা, ওয়াশরুমের দরজাও ভেজানো। তাহলে উনি কোথায়? বেলকনিতে ছুট লাগালাম। সেখানেও নেই। রুম থেকে বেরিয়ে আমি রান্নাঘর আর ড্রয়িংরুমে খোঁজ করলাম। কোথাও নেই। কোমরে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলাম উনি কোথায় আছেন। ওপরে না কি? হয়তো আফরা আপুকে স্বান্তনা দিতে গেছেন। এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে চলে গেলাম। আফরা আপুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতলাম। নাহ্, ভেতরে ‘টু’ শব্দটুকুও নেই। যে আমি রাতে ভূতের ভয়ে ড্রয়িংরুমে যেতেও ভয় পাই, সেই আমি কি না আজ এই রাতে সারা বাড়ি ছুটে বেড়ালাম! পুনরায় নিরাশ হলাম। উনি কি তাহলে আবার কোথাও গেছেন? ধুর! বাইরে গেলে কি ফোন রেখে যেতেন? আর কোথায় খুঁজব? গার্ডেনে, না ছাদে? ওসব জায়গায় আমি যাব কীভাবে? গার্ডেনে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হ্যাঁ, ছাদের দরজা খোলা থাকলে বুঝব উনি ছাদে গেছেন। বন্ধ থাকলে যাননি। ছাদের সিঁড়ি ঘরের দিকে ছুটলাম। মুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটল। দরজা খোলা। এবার ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দরজায় দাঁড়ালাম। চাঁদের আবছা আলোয় চারদিকে চোখ বোলালাম। ওই তো উনি। ওদিক মুখ করে বসে আছেন। দৃষ্টি বোধ করি আকাশের দিকে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। ওনার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে মিনিট দুই সময় নিয়ে সাহস জোগালাম। তারপর দ্রুত গিয়ে হুট করে ওনার পাশে বসে পড়লাম। ভেবেছিলাম উনি চমকে উঠবেন। কিন্তু মহাশয় আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। যেভাবে বসে ছিলেন সেভাবেই বসে রইলেন। আশ্চর্য! আজকাল কি সামনে না থাকলেও উনি মাইন্ড রিড করতে জানেন? যেচে একটু গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। ইচ্ছে করল শয়তানটার অ্যাটিটিউডকে গলা টিপে হত্যা করতে। মিনিট দুই কেটে গেল। ভেবেছিলাম আমি চুপ থাকলে উনি হয়তো কথা বলবেন। ওই ভাবনা ভাবনাই রয়ে গেল। চাঁদের আবছা আলোয় ওনার মুখের অভিপ্রায় বুঝতে পারলাম না। শেষমেষ হতাশ আমি বড়ো করে দম নিয়ে মুখ খুললাম। ওনার মতোই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনোকিছু না ভেবেই হঠাৎ শান্ত স্বরে বলে উঠলাম,
“প্রেম-ভালোবাসার সংজ্ঞা জানেন তাজ ভাই? জানাটা খুব প্রয়োজন আমার। বলবেন?”

ভাবিনি এক কথায় উনি মুখ খুলবেন। আমার প্রশ্নের গোষ্ঠীর তুষ্টি উদ্ধার করে খুব সুন্দর করে বললেন,“তিক্ত কথার মানুষের মুখে এসব শুনতে ভালো লাগবে না। শ্রেয়ানকে জিজ্ঞেস করলে ও বেশ ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারবে।”

আমি গাল ফুলিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। উনি এসবের জের ধরেই বাড়ি ফিরেননি। এবার আমি সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলাম,“দুদিন পর বাড়ি ফিরলেন কেন? বোধ হয় হাজারবার কল করেছি। গতকাল না হয় ধরে নিলাম কাজের চাপে রিসিভ করেননি। আজ কেটে দিলেন কেন? বাবার ফোন তো ঠিকই ধরেছেন।”

তাজ ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন,“প্রয়োজন বোধ করিনি।”

ওনার এটুকু কথায় এক গুচ্ছ অভিমান এসে আমার মনে জমাট বাঁধতে চাইল। সেসব দূরে ঠেলে দিয়ে পুনরায় বললাম,“জানেন আমি কত চিন্তায় ছিলাম? না আপনি ফোন রিসিভ করেছিলেন, না শ্রেয়ান ভাইয়া।”

“এত স্পেশাল মানুষের ফোন ইগনোর করল!”

বুঝলাম, উনি শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা বলছেন।‌ কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। আমি মিনমিনে গলায় বললাম,“সরি।”

“কেন?” গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন উনি।

আমি মাথা নিচু করে বললাম,“আমি সত্যিই শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে ভার্সিটি যেতে চাইনি। বাবা যেতে বলেছিল বলে বাধ্য হয়েছি।”

সঙ্গে সঙ্গে আমার বাহুতে চাপ পড়ল। উনি আমার এক বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে চোখে চোখ রাখলেন। সে চোখে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। রাগে গজগজ করতে করতে ধমকে উঠলেন,“মুখে বলেছিলাম মেপে মেপে বিশ হাত দূরে থাকতে। আর চোখে দেখলাম হাত ধরাধরি করে হাঁটতে। বাইকে গা ঘেঁষে বসাটাও হয়ে গেছে। আহ্! অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ। খুব সুন্দর মোমেন্ট ছিল, তাই না? প্রেমের সূচনা বলে কথা!”

আমার চোখে পানি এসে গেল। হাতের ব্যথার থেকে বেশি ব্যথা অনুভব করলাম বুকের বাঁ পাশটায়। ওনার এমন কঠিন কথাগুলো এসে যেন বুকের মধ্যে তীরের মতো বিঁধল। অসহায় মুখে, ছলছল চোখে আমি বললাম,“এসব কী বলছেন আপনি? শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেই বাড়ি বয়ে এসে আমাকে ভার্সিটি নিয়ে যেতে চাইছিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বাবার কথায় মানতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাইকে গেলেও আমি ওনার গা ঘেঁষে বসিনি। যথেষ্ট দূরত্ব রেখেছিলাম। আর হাত ধরাধরি করে হাঁটিওনি। একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছিলাম। তখন শ্রেয়ান ভাইয়া আমার হাত ধরে সামলে নিয়েছিলেন। ওই মেয়েটার ওপর ভাইয়া রেগে গিয়েছিলেন। রাগের মাথায় দ্রুত গেইটের বাইরে আসতে গিয়ে হাত ছাড়তে ভুলে গেছেন। আমি হাত ছাড়ার কথা বলব তার আগেই দেখলাম গেইটের বাইরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যি বলছি, আপনার দিব্যি।”

কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেই তাজ ভাইয়ের হাত আলগা হয়ে এল। সেই সুযোগে আমি ওনার হাত থেকে আমার বাহু ছাড়িয়ে অপর হাতের তালুতে ঘঁষতে লাগলাম। তাজ ভাই দুহাতে মুখ ঢেকে জোরে শ্বাস নিলেন। আমি হাত ঘঁষতে-ঘঁষতে অসহায় মুখে বললাম,“নিচে চলুন না, ক্ষুধা পেয়েছে আমার।”

উনি মুখ ঢেকে রেখেই বিরক্তি নিয়ে বললেন,“তো গিলতে যা। আমি কি আটকে রেখেছি তোকে?”

“সারাদিন ধরে অভুক্ত আমি”, ঠোঁট উলটে বললাম আমি।

সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই দ্রুত মুখ থেকে হাত সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। অবাক কন্ঠে বলে উঠলেন,”কী বললি? সারাদিন ধরে অভুক্ত মানে?”

আমি ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,“সেই সকালে একটা রুটি খেয়েছিলাম।”

“হোয়াট!” চেঁচিয়ে উঠলেন তাজ ভাই।

আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে হাঁটা ধরলেন। দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলেন। ডায়নিং টেবিলের পাশে এসে চেয়ার টেনে বসিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বললেন,“এক পা-ও নড়বি না এখান থেকে।”

‘খাবার গরম করব না’ বলতে গিয়েও বললাম না। দেখি মহারাজ কী করেন। বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ বসে রইলাম। তাজ ভাই সোজা রান্নাঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন পাঁচ মিনিট পর। প্লেটে খাবার নিয়েই এসেছেন। আমার পাশের চেয়ার টেনে বসে ভাত মেখে মুখে তুলে দিতে দিতে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,“না খেয়ে ছিলি কেন?”

“এমনিতেই।”

“এমনিতেই?”

“ইচ্ছে করেনি।”

“সারাদিনেও তোর খেতে ইচ্ছে করেনি? তো কী ইচ্ছে করেছে?”

“সারাদিন তো আপনার চিন্তা করে করেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে”, বিরক্তি নিয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম আমি।

তাজ ভাই নিজের মুখে খাবার তুলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,“আমার জন্য তোকে আজাইরা চিন্তা করতে বলেছে কে? প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস না কি আমার?”

কথাটা বলেই তাজ ভাই ভ্রু নাচালেন। আমি কিছুটা মিইয়ে গেলাম। এই প্রশ্ন তো সারাদিন ধরে আমি নিজেই নিজেকে করে এসেছি। তবু নিজে একধাপ এগিয়ে থাকার জন্য মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলাম,“আপনার প্রেমে পড়ে যেচে পায়ে কুঠার মারব আমি? কথায় কথায় মাথায় গান চেপে ধরেন। বিপজ্জনক লোক!”

কথাটা বলেই আবার আগ্রহী দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,“ওহহো! আপনাকে তো এখন আর মাফিয়া বলতে পারব না। আপনি তো ডিটেকটিভ। তাতে কী? আপনার স্বভাব মাফিয়াদের মতোই থেকে যাবে। আপনি ডিটেকটিভ না, মাফিয়া হিসেবেই পারফেক্ট।”

তাজ ভাই ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললেন,“তো তোকে যদি মার্ডার করে সুইসাইড কেস বলে চালিয়ে দেই। তাহলে কেমন হবে?”

আমি চমকে উঠে ঢোক গিলে বললাম,“এই একদম ব্ল্যাকমেইল করবেন না। আপনার এই স্বভাবটা সবচেয়ে বেশি খারাপ। এসব বাদ দিয়ে আপনার এতদিনের রহস্যের কথা বলুন তো একটু।”

“কী বলব?”

“আপনাদের পরিচয় আমার কাছে লুকালেন কেন? বাবার কাছে তো লুকাননি। আমি কি ঢাক পিটিয়ে অ্যানাউন্স করে বেড়াতাম?”

“বলা তো যায় না, হয়তো এটাই করতি। তোদের মহিলা জাতির এটাই স্বভাব। সব কথা ঢাক পিটিয়ে অ্যানাউন্স করা। পেটে থাকলে তো বদহজম হয় তোদের।”

আমি বিরক্ত হলেও তা পাত্তা না দিয়ে আবার বললাম,“ঠিক আছে, পরিচয় লুকানোর কারণ বুঝলাম। তো, দুদিন পর পর আমার বালিশের পাশে আবেগঘন চিরকুট রেখে আসা, আমার পছন্দের জিনিস কিনে রেখে আসা, ওই বনলতা নাম, তুমি সম্বোধন, খাইয়ে দেওয়া, শ্রেয়ান ভাইয়ার থেকে দূরে থাকতে বলা, আমাকে নিয়ে এত চিন্তা, এত যত্ন, এসবের কারণ?”

তাজ ভাই এক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন,“কী শুনতে চাইছিস?”

“আপনার উত্তর।”

“আচ্ছা। ভাবলাম দুদিন পর তো এমনিতেই বিদায় করে দিব এ বাড়ি থেকে। এখন একটু যত্নআত্তি করি। পরে যেন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমাদের বদনাম করতে না পারিস।”

“ফালতু কথা না বলে সত্যি কথা বলতে পারেন না?”

“আমি তো ভেবেছিলাম আমি না বললেও শ্রেয়ান বলে দিবে। এত কাছের মানুষ হয়েও বলল না!”

আমি গোমড়া মুখে বললাম,“আপনি এখনও রেগে আছেন? একটু আগে তো আমি না খেয়ে আছি শুনেই রাগ ফুস করে উড়ে গিয়েছিল।”

“সবার ওপর রাগ দেখাই না আমি।”

আমি ভেংচি কেটে বললাম,“অথচ রাগের জন্যই দুদিন পার করে বাড়ি ফিরেছেন।”

“আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ফেলে রেখে আমি এসে বাড়ি বসে থাকতাম? বলদ কোথাকার! এসব বলদমার্কা কথা শিখিস কার থেকে?”

“এত কথা না বাড়িয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেই পারেন।”

“বেশি কৌতুহল ভালো না।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। গাল ফুলিয়ে চুপচাপ খাবার শেষ করলাম। খাবারের প্লেট ধুয়ে রেখে এসে দেখলাম তাজ ভাই ফোনে কথা বলছেন। কোনো কাজের ব্যাপারেই কথা বলছেন। আমি ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি ফোন রাখতেই বললাম,“ডিটেকটিভ সাহেব কি আজ ঘুমাবেন না? না কি সারারাত জেগে বসে বসে কাজ করবেন?”

তাজ ভাই ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন,“তিনটা রাত ঘুমাইনি। লম্বা একটা ঘুমের প্রয়োজন।”

আমি অবাক হয়ে বললাম,“তিনটা রাত ঘুমাননি মানে?”

“দেখলিই তো কী হয়ে গেল। গ্রামে গিয়ে দম ফেলার সময়টুকুও পাইনি।”

“কাকাকে কি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিবে?”

“মুক্তি চাইছিস?”

“আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে কাকা এমন জঘন্য কাজ করেছে”, ধরা গলায় বললাম আমি।

তাজ ভাই গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“শোন, আফরাকে বলবি কাল সকালে আমার সাথে কথা বলতে।”

আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম। তাজ ভাই হঠাৎ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,“কাল রাতে কখন ঘুমিয়েছিলি?”

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম, কিন্তু কোনো জবাব দিলাম না। উনি আবার বললেন,“শুকনো মুখ অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। সত্যি কথা বল।”

“তিনটার দিকে”, মিনমিনে গলায় কথাটা বলেই আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।

“অপেক্ষা করছিলি?”

আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকালাম। উনি বললেন,“আমার জন্য আর কখনও অপেক্ষা করবি না। আর কখনও না খেয়েও থাকবি না। এরপর থেকে আমার কাজের চাপ আরও বাড়বে।”

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে নখ খুঁটছিলাম। নিচু স্বরে প্রশ্ন করলাম,“আপনার রাগ কমেছে?”

উনি মৃদু হেসে আমার বাঁ হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিলেন। চুড়ি দুটো নাড়াচাড়া করতে করতে সেদিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,“চাইলেও সবার ওপর রাগ স্থায়ী করা যায় না। সাধ্য থাকে না।”

আমি স্থির দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“শুয়ে পড় গিয়ে”, বলেই উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে বললেন,“প্রেমের বহু সংজ্ঞা হয়, ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় না। এটা সম্পূর্ণই একটা অনুভুতি। অন্যরকম অনুভূতি। হঠাৎ উড়ে এসে হৃদয়ে জুড়ে বসে নিত্যদিনের জীবনটাই ওলট-পালট করে দেয়। আটকানোর চেষ্টাটুকুও করা যায় না।”

চলবে………………..🍁