তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৩৪+৩৫

0
450

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৪

আবেগ আর ভালোবাসা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো বিষয়। প্রায় বেশিরভাগ মানুষই আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়। কিন্তু সত্যিকারের ভালবাসা আসে কজনের জীবনে? মনের কোণের অনুভূতিগুলো কেবল আবেগ না কি ভালোবাসা, তা জানার বা বোঝার চেষ্টা করে কজন? তবে চেষ্টা করাটা জরুরী, প্রচন্ড জরুরী। কেবলমাত্র আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, থেমেও থাকে না। তার গতিবিধি থাকে ঠেলাগাড়ির মতো। তুমি ঠেলবে তো চলবে, তা না হলে স্বস্থানে স্থির থাকবে। কারণ আবেগ কখনও স্থায়ী হয় না। একটা সময় আসবে, যখন এই আবেগ নামক জিনিসটার প্রতি তোমার প্রচন্ড অনিহা জন্মে যাবে। আর ঠিক তখনই তোমার জীবন ঠেলাগাড়ির রূপ ধারণ করবে। কেবল সুস্থ চিন্তাধারাই পারে এই ঠেলাগাড়ির ন্যায় জীবনে জিপিএস সেট করতে। জিপিএসের মাধ্যমে অন্তত তোমার জীবনের বর্তমান অবস্থান বুঝতে সক্ষম হবে। তোমার অনুভূতিগুলো আবেগ না ভালোবাসা, এটুকু জানাটা হয়তো সহজ হবে।

গতকাল রাতেও আমি নির্ঘুম ছিলাম। ভোরের কিছু আগে একটু ঘুমিয়েছিলাম। সারাটা রাত আমার মনের সদ্য জন্মানো অনুভূতি নিয়ে হিসাব কষেছি। এই হিসাবের চূড়ান্ত ফলাফল মিলানো অতটাও সহজ ছিল না। নেহালের প্রতি আমার মনে যা ছিল, সম্পূর্ণটাই ক্ষণিকের আবেগ। ও চলে যাওয়ার সাথে সাথে তা আমার জীবন থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। আজ আর সেই আবেগ বেঁচে নেই। তাই আমার নির্ঘুম রাতে হিসাবের চূড়ান্ত ফলাফলে যা পেলাম, সেখানে কেবল একটা শব্দই ছিল। ভালোবাসা। ওই বিপজ্জনক লোকটার জন্য আমার মনে ভালোবাসার ছোট্ট একটা বীজ বপন হয়েছে। এই বীজ সে নিজ দায়িত্বে বপন করেছে। না জানি কখন এই বীজ প্রকাণ্ড এক বৃক্ষের মতো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! তাকে আজ জবাব দিতে হবে, সে কেন আমার মনে এই ভয়ঙ্কর বীজ বপন করল।

সকাল নয়টা বেজে গেছে। অথচ এখনও তাজ ভাইয়ের রুম থেকে বেরোনোর নাম নেই। ফজরের নামাজ পড়ে এসে রুমে ঢুকেছে, তারপর আজ আর চায়ের জন্য আমাকে চেঁচিয়ে ডাকেওনি। নাহ্, আর অপেক্ষা করা যাবে না। ভার্সিটিতেও তো যেতে হবে। এক দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে আমি খুব যত্ন সহকারে চা করলাম। তারপর এক কাপ চা হাতে সোজা চলে গেলাম তাজ ভাইয়ের রুমের সামনে। গতকাল পর্যন্তও আমি ওনার রুমে নক না করেই প্রবেশ করেছি। অথচ সেই আমারই আজ দরজার সামনে এসে পা থমকে গেছে। বিরাট এক রহস্য উদঘাটন করার পর, ভেতরে ঢোকার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না। কেবল মনে হচ্ছে, ভেতরে ঢুকলেই আমার মনের বপনকৃত বীজটি অঙ্কুরিত হবে। মনের সাথে একদফা স্নায়ুযুদ্ধ করে শেষমেষ বুক ফুলিয়ে বড়ো একটা দম নিয়ে দরজার নব ঘুরালাম। আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। রুমের লাইট অফ, এমনকি জানালাও বন্ধ। জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় আমি রুমের চারদিকে চোখ বোলালাম। বিছানায় চোখ পড়তেই দেখলাম নবাব এখনও বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছেন। তিনদিনের ঘুম সব একসাথে উসুল করছেন বোধ হয়। তাহলে কি আজ আমার ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না? দৌড়ে গিয়ে চায়ের কাপটা বেড সাইড টেবিলে রেখে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ওনাকে ডাকতে লাগলাম। তিনবার ডাকতেই উনি নড়েচড়ে উঠলেন। কিন্তু আমার দিকে ফিরে না তাকিয়ে নিজের ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“কী? হাত বাড়াচ্ছেন কেন? উঠুন।”
জবাবে উনি বাড়িয়ে রাখা হাতটা মৃদু নাড়লেন। আমি বিরক্ত হয়ে বেড সাইড টেবিলে চায়ের কাপটা রেখে ঘুরে গিয়ে বিছানার ওপাশে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। দেখলাম উনি বালিশে মুখ গুঁজে আছেন। আমি কোমরে হাত দিয়ে কিছুটা জোরে বলে উঠলাম,
“ডিটেকটিভ সাহেব, আমার ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আপনার কি আজ সকাল হবে না?”
এবার তাজ ভাই হাত নামিয়ে মাথা কাত করে চোখ খুললেন। ওনার চেহারার অবস্থা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। চোখ-মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। মলিন মুখে চোখ পিটপিট করে উনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে ডাকলেন,
“ইলু?”
আমি হন্তদন্ত হয়ে ওনার পাশে বসে খানিক ঝুঁকে পড়ে বললাম,
“কী হয়েছে আপনার? মুখের এই অবস্থা কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
উনি চোখ-কপাল কুঁচকে অতিকষ্টে বললেন,
“মাথাব্যথা।”
হুট করে আমার মনে পড়ে গেল, রাজ ভাইয়া বলেছিল ওনার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। তাজ ভাই হঠাৎ আমার একহাত বেশ শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরলেন। আমি প্রশ্ন করলাম,
“পেইন কিলার নেই?”
উনি ডানে-বায়ে মাথা দোলালেন। আমি ওনার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললাম,
“একটু সহ্য করুন। আমি এক্ষুনি আসছি।”
তাজ ভাই হাত ছাড়তে চাইলেন না। জোরপূর্বক হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চললাম। আমাকে হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে মারজিয়া খালা বললেন,
“কী হইছে মা?”
আমি দ্রুত চুলায় চায়ের পানি বসাতে বসাতে বললাম,
“তাজ ভাইয়ের মাথা ব্যথা করছে।”
মিতা বলল,
“একটু আগে না চা করে নিলে?”
“তাতে হবে না”, ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম আমি।
আদা আর লেবু দিয়ে দ্রুত কড়া করে চা বানালাম। কাপে চা ঢালতে ঢালতে রিতাকে বললাম,
“আমার রুমে গিয়ে চেয়ারের ওপর দেখবি ছোটো একটা তোয়ালে রাখা। ওটা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”

রিতা ছুটে চলে গেল। আমি ফ্রিজ খুলে বাটিতে বেশ কিছুটা বরফ নিলাম। একটা ট্রেতে চায়ের কাপ আর বরফের বাটি রাখলাম। রিতা তোয়ালে নিয়ে আসতেই ট্রে আর তোয়ালে নিয়ে আবার ছুট লাগালাম তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে। রুমে ঢুকে বিছানার একপাশে ট্রেটা রেখে আমি এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে লাইট জ্বালাতেই তাজ ভাই জড়ানো কন্ঠে বললেন,
“লাইট অফ কর। তাকাতে পারি না।”
আমি লাইট অফ করে গিয়ে জানালা খুলে দিলাম। এবার রুমটা বেশ আলোকিত হলো। এগিয়ে গিয়ে তাজ ভাইয়ের বাঁ হাতটা ধরলাম। এই প্রথম যেচে আমি ওনার হাত ধরলাম, কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই। উনি চোখ বন্ধ করে মৃদু শব্দ তুলে থেমে থেমে গুঙিয়ে উঠছেন। বুকের কোথাও একটা ধারালো অস্ত্রের আঘাত অনুভব করলাম। আমি এমনিতেই খুব দুর্বল মনের মানুষ। প্রিয় মানুষের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ওনার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলাম,
“উঠে বসতে পারবেন?”
উনি মাথা দুলিয়ে না করলেন। আমি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওনার হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,
“বসতে হবে। আমি হেল্প করছি, উঠুন।”
তাজ ভাই এবার আর কিছু বললেন না। চোখ খুলে তাকালেন আমার দিকে। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে ওনার ঘাড়ের নিচে হাত গলিয়ে একহাতে ওনার ডান হাতের বাহু, আরেক হাতে বাঁ হাতটা শক্ত করে ধরলাম। এবার উনি আমার সাহায্যে উঠে বসলেন। ওনার পিঠের পেছনে বালিশ রাখায় উনি ঠেস দিয়ে বসতে পারলেন। আমি চায়ের কাপটা ওনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
“এটা খান, ভালো লাগবে।”
উনি আমার হাত থেকে কাপটা নিয়ে পেছনের বালিশে মাথা এলিয়ে দিলেন। আমি আবার বললাম,
“খান।”
এবার উনি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। আমি বাটির বরফগুলো তোয়ালেতে পেঁচিয়ে নিয়ে ওনার পাশে বসলাম। তোয়ালেটা ওনার ঘাড়ে ছোঁয়াতেই উনি মাথাটা কিছুটা সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন,
“ঠান্ডা।”
“বরফ তো ঠান্ডা হবেই”, বলেই আমি আবার তোয়ালেটা ওনার ঘাড়ে হালকা করে চেপে ধরলাম। এবার আর উনি আপত্তি করলেন না। আমি বরফসমেত তোয়ালে দিয়ে ওনার ঘাড়ে আর মাথায় আস্তে আস্তে চাপ দিলাম প্রায় বারো মিনিটের মতো। ততক্ষণে ওনার চা খাওয়াও হয়ে গেছে। বরফ গলে ওনার মাথার চুল আর টি-শার্টের পিঠের কাছের কিছু অংশ ভিজে গেছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ক্লোজেট থেকে ওনার একটা হালকা টি-শার্ট আর তোয়ালে আনলাম। কিছুটা দ্বিধা বোধ হলেও তা পাত্তা দিলাম না। তোয়ালে দিয়ে খুব যত্ন সহকারে ওনার ভেজা চুলগুলো মুছে দিলাম। তারপর টি-শার্টটা ওনার হাতে দিয়ে বললাম,
“চেঞ্জ করে নিন। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আমি এগুলো রেখে আসছি।”
জবাবে উনি মাথাটা মৃদু ঝাঁকালেন। ট্রেতে সবকিছু নিয়ে আমি আবার রান্নাঘরে গেলাম। মিতাকে বললাম,
“একটু সরিষার তেল গরম করে দাও তো।”
মিতা সঙ্গে সঙ্গে সরিষার তেল গরম করতে লেগে পড়ল। মারজিয়া খালা বললেন,
“এত বেশি ব্যথা! ডাক্তার ডাকতে হইব, মা?”
“না খালা। কমে যাবে।”
“আমি গিয়ে তেল মালিশ করে দিব?”
“না থাক।”
মিতা তেল গরম করে ছোটো একটা বাটিতে ঢেলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। আমি সেটা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। রুমে ঢুকে দেখলাম তাজ ভাই টি-শার্ট চেঞ্জ করে এক হাতে কপাল চেপে ধরে শুয়ে আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বিছানায় উঠে ওনার পাশে বসলাম। কপাল থেকে ওনার হাতটা সরিয়ে গরম তেল হাতে নিয়ে বিনা বাক্যে ওনার কপালে মাখতে লাগলাম। উনি চোখ বন্ধ করে চুপ মেরে শুয়ে রইলেন। আমিও চ
গরম তেল চুপচাপ ওনার কপালে ঘঁষে চলেছি। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল জানি না। অনেকটা সময় পর মনে হলো উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। হয়তো এখন একটু আরাম বোধ করছেন। খালি বাটিটা হাতে নিয়ে আমি বিছানা থেকে নামতে যেতেই তাজ ভাই খপ করে আমার এক হাত মুঠোয় নিয়ে নিলেন। আমার আর নামা হলো না। উনি চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে মৃদু কন্ঠে বললেন,
“নিজেকেই তো সামলাতে পারিস না পিচ্চি। একদিনে এত বড়ো হলি কীভাবে?”
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে মাথানত করে ফেললাম। এবার আমার অস্বস্তি আর লজ্জা বোধ আরও একধাপ বাড়াতে উনি বালিশ ছেড়ে আমার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি একপ্রকার কড়া গলায় বলে উঠলেন,
“আগামী এক ঘন্টা আমাকে কোনোরকম ডিস্টার্ব করলে সঙ্গে সঙ্গে শুট করে দিব।”
আমি কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এই অবস্থায় থেকেও ব্ল্যাকমেইল! এ কেবল ওনার দ্বারাই সম্ভব। এতক্ষণ অব্দি যে আমি এত খাটলাম, ওসব কিছুই না? নির্দ্বিধায় বলে দিলো শুট করে দিব। আগামী এক ঘন্টা আমাকে এভাবে স্ট্যাচু বানিয়ে বসিয়ে রাখবে না কি? হায় কপাল! এ কে এসে জুটল আমার ফাটা কপালে!


আফরা আপু কাউকে কিছু না বলে নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে। সকালে যখন আমি তাজ ভাইয়ের রুমে ছিলাম, সেই ফাঁকেই চলে গেছে। বাসে উঠে পরে আমাকে মেসেজ করে বলে দিয়েছে যে সে গ্রামে চলে যাচ্ছে। আমি তাকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু সে ফোন রিসিভ করেনি। মেসেজেরও রিপ্লাই দেয়নি। তাজ ভাইয়ের সাথে কথাটুকুও বলল না, চলে গেল। আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। তাজ ভাই সারাদিন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। বিকেলের দিকে তাজ ভাই আমাকে ডেকে বললেন,
“রেডি হ, বাইরে যাব।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“কী? আপনি ইচ্ছে করে আমাকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইছেন? আমি কি ঠিক শুনছি?”
“ড্রামা না করে চুপচাপ গিয়ে রেডি হ।”
“কখনও তো কারণ ছাড়া বাইরে নিয়ে যান না। আজ কী হলো?” ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
উনি ওনার বিখ্যাত ধমক দিয়ে বললেন,
“তোর কি যাওয়ার ইচ্ছে আছে? না থাকলে বসে বসে ক্যাঁচাল কর। আমি যাই, তোর আজাইরা ক্যাঁচাল শোনার সময় নেই আমার।”
“এই না না, এক্ষুনি আসছি আমি”, বলেই রুমে ছুট লাগালাম। পেছন থেকে তাজ ভাই বললেন,
“আমি গাড়িতে আছি। দশ মিনিটের মধ্যে বের হবি।”

রুমে এসে তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে আবার ছুটলাম বাইরে। গাড়িতে উঠে বসতেই তাজ ভাই নিজের হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,
“দশ মিনিটের জায়গায় ষোলো মিনিট লাগিয়েছিস। তা-ও তো কোনো সাজগোজ দেখছি না। তো কী করছিলি এতক্ষণ?”
আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম,
“মেয়েদের এটুকু সময় লাগে তাজ ভাই। এটুকুতেই অধৈর্য হয়ে পড়েছেন? আপনার বউ যখন ঘন্টা লাগিয়ে মেকআপ ঘঁষবে, তখন কী করবেন?”
“বেশি কিছু না, ছাদ থেকে সোজা নিচে ফেলে দিয়ে সুইসাইড কেস বলে চালিয়ে দিব”, গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বললেন উনি।
আমি ভ্রুকুটি করে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“আপনাকে ডিটেকটিভ হওয়ার আইডিয়াটা কে দিয়েছিল বলুন তো? নিঃসন্দেহে এটা আপনার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আপনার এসব কথাবার্তার সাথে ডিটেকটিভিটি মানায় না। এজন্যই তো বলি আপনার জন্য মাফিয়াই পারফেক্ট।”
“ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খেতে না চাইলে চুপ থাক”, স্বাভাবিকভাবেই বললেন তাজ ভাই।
আমি ওনার এই শান্ত স্বরের হুমকিতে চুপ মেরে গেলাম। গাল ফুলিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করলাম,
“মাফিয়া ডিটেকটিভ কোথাকার!”

বেশ কিছুক্ষণ পরে তাজ ভাইয়ের ফোন বেজে উঠল। উনি ফোন রিসিভ করে কথা বলতেই বুঝলাম শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কৌতুহলবশত আমি প্রশ্ন করলাম,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
ভেবেছিলাম উনি এক রামধমক দিয়ে বসিয়ে রাখবেন। কিন্তু তা না করে স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
“শ্রেয়ানই বাইরে ডেকেছে। আমি ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় বেরোব। ও বলল তোকে নিয়ে বিকেলে বের হতে। ঘুরেফিরে এতদিনের ক্লান্তি দূর করতে চায়। এতদিন ও অনেক খেটেছে। তাই ভাবলাম কথাটা রাখি।”
আমি ছোটো একটা শব্দ করলাম,“ওহ্।”
যদিও শ্রেয়ান ভাইয়া ডেকেছে শুনে আমি বেশ খুশি হয়েছি। কারণ শ্রেয়ান ভাইয়ার অছিলায় জমিয়ে ফুসকা খেতে পারব। তবু নিজের খুশিটা মুখে প্রকাশ করলাম না। করলেই তো আবার মহারাজের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তাজ ভাই বলে উঠলেন,
“মনে মনে লুঙ্গি ড্যান্স দিয়ে লাভ নেই। আজ ফুসকা নট এলাউড।”
ব্যস, দিলো আমার ছোট্ট, কোমল মনটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। নির্দয় লোক! ইচ্ছে করে ওনার এই মাইন্ড রিড করার অলৌকিক ক্ষমতাকে গলা টিপে হত্যা করতে।

টানা বিশ মিনিট গাড়ি চালানোর পর একটা পার্কের সামনে এসে গাড়ি থামালেন তাজ ভাই। এখানেই না কি শ্রেয়ান ভাইয়া অপেক্ষা করছেন। ভেতরে ঢুকে দেখলাম সত্যিই তাই। শ্রেয়ান ভাইয়া একটা বেঞ্চে বসে আছেন। তার পাশে মাঝারি আকারের একটা প্যাকেট চোখে পড়ল। আমাদের দেখে শ্রেয়ান ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন,
“এতক্ষণে এলি? আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।”
তাজ ভাই পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললেন,
“এজন্যই মহিলাদের নিয়ে কোথাও যেতে নেই।”
পাশ থেকে আমি বলে উঠলাম,
“আপনি আমাকে অপমান করছেন?”
তাজ ভাই সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
“তোর মান আছে?”
আমি তেতে উঠে বললাম,
“আবার অপমান?”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,
“আচ্ছা থামো ইলোমিলো। রাগ কোরো না। ও দুষ্টুমি করেছে তোমার সাথে।”
“সবসময়ই এমন করে ভাইয়া।”
“কুল ডাউন।”
আমি চুপ মেরে গাল ফুলিয়ে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শয়তানটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আপন মনে ফোন ঘেঁটে চলেছে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে বললেন,
“বসো এখানে।”

আমি ধপ করে পাশের বেঞ্চে বসে পড়লাম। কারো দিকে না তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে চুপচাপ রইলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বেঞ্চের কোণ থেকে প্যাকেটটা নিলেন, সেদিকেও ফিরে তাকালাম না। হঠাৎ আমাকে ভূত দেখানোর মতো চমকে দিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়া আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। তাকিয়ে দেখলাম ওনার হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ আর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। আমার মতো তাজ ভাইও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে। আমি একবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখপানে তাকালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া মিষ্টি হাসি মুখে ঝুলিয়েই বলে উঠলেন,
“সেই প্রথমদিন যেদিন তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেদিনও আমি ভাবতাম রামিশাহীন জীবনে আর কাউকে জড়াব না। তারপর যখন তোমার সাথে দেখা হলো, তখনও এটাই ভাবতাম। কিন্তু কখন যে আমার শক্তপোক্ত ভাবনাগুলোর সুতা ছিঁড়ে গেছে, টেরই পাইনি। হঠাৎ করেই আমার ভাবনায় রামিশার পাশে আরেকটা মুখও জায়গা দখল করে নিল। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হৃদয়ে সে জায়গা দখল শুরু করল। আমি শত চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারিনি। এক জীবনে দ্বিতীয়বারও যে ভালোবাসা সম্ভব, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। এমন নয় যে আমি রামিশাকে মন থেকে মুছে দিয়েছি। সে আমার প্রথম ভালোবাসা। তাকে ভোলা সম্ভব না। তবে এটাও চরম সত্যি যে, রামিশার পর তুমিই সে, যাকে আমি হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে ভালোবেসেছি। হ্যাঁ ইলোমিলো, আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। কবে, কখন, কীভাবে জানি না। শুধু জানি তুমিই সে, যে আমার রামিশাবিহীন অন্ধকার জীবনে আলো ছড়াতে সক্ষম। হবে আমার রামিশা? তোমার ভালোবাসার সামান্য কিছু অংশ দিবে আমায়?”

আমি স্তব্ধ হয়ে পাথুরে মুর্তির ন্যায় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ করেই মস্তিষ্কটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে। কন্ঠনালি বাঁধ সেধেছে। সজাগ চোখ দুটো শুধু এটুকুই দেখল, তাজ নামক ভয়ঙ্কর লোকটা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সন্তর্পণে সামনে থেকে সরে গেছে।

চলবে……………….🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৫

“ইলোমিলো?”
শ্রেয়ান ভাইয়ার ডাকে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। ফিরে তাকিয়ে বললাম,
“জি।”
“কিছু বলছো না যে?”
আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত, কী বলা উচিত কিছুই মাথায় আসছে না। সব কেমন গোলমেলে লাগছে। এদিকে শ্রেয়ান ভাইয়া উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন উত্তরের আশায়। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। দুহাত একসাথে করে কচলাতে কচলাতে বিব্রত কন্ঠে বললাম,
“হুট করে এসব কী বলছেন ভাইয়া? আমি তো কখনও এমন কিছু ভাবিনি।”
“আমি জানি তুমি এমন কিছু ভাবনি। হুট করে প্রপোজ না করলে সারপ্রাইজ দিতাম কীভাবে? তুমি তো আমার সম্পর্কে সবটা জানো ইলোমিলো। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না। সত্যিই ভালোবাসি তোমায়।”
“আপনাকে নিয়ে আমি কখনও এমন কিছু ভাবিনি ভাইয়া।”
“তা-ও জানি। একবার গ্রহণ করেই দেখো না। তারপর তুমিও ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করতে পারবে। আমার ভালোবাসা যদি মিথ্যা না হয়।”

এখন? কী বলব আমি? শ্রেয়ান ভাইয়ার কথাবার্তা আর মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে সে কতটা সিরিয়াস। ভাঙা মনের মানুষ উনি। বুকের মধ্যে ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর কষ্ট ধামাচাপা দিয়ে হাসিমুখে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। সেই মানুষটা যখন আমাকে নিজের ভালোবাসার মানুষের জায়গায় বসিয়ে বুকের কষ্টগুলোকে নিংড়ে ফেলতে চাইছে, তখন তার মুখের ওপর আমি ‘না’ বলব কীভাবে? ভাঙা মনের মানুষটাকে আমি স্বেচ্ছায় আরও গুঁড়িয়ে দিব কীভাবে? এই যে সে ভীষণ আশাবাদী হয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ওই দৃষ্টিতে ভয়ানক বর্ষণ ডেকে আনব কীভাবে? এতসব ভাবনা মাথায় নিয়ে আমার মুখ দিয়ে ‘না’ শব্দটা কিছুতেই বের হতে চাইছিল না। আবার হ্যাঁ-ও বলতে পারছি না। শ্রেয়ান ভাইয়া আবার ডাকতেই আমি নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে জিব দিয়ে নিজের শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিলাম। বড়ো একটা দম নিয়ে সাহস জুগিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম,
“আমার একটু সময় প্রয়োজন ভাইয়া। আসলে আমি নার্ভাস হয়ে পড়ছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার মুখ থেকে এমন উত্তর আশা করেননি। তবু মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ঠিক আছে। তুমি যখন চাইছো তখন সময় নাও। কিন্তু প্লিজ, ফিরিয়ে দিয়ো না। উত্তরটা যেন পজিটিভ আসে।”
আমি মেকি হেসে বললাম,
“ভেবে দেখব।”
“এটা অন্তত নাও”, হাতের গোলাপগুলো আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন শ্রেয়ান ভাইয়া।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি ওনার হাত থেকে ফুলগুলো নিলাম। তারপর বললাম,
“এখন আসি।”
“আসি মানে? মাত্রই তো এলে। ফুসকা খাবে না তুমি? তাজ গেল কোথায়?”
“উনি বোধ হয় গিয়ে গাড়িতে বসেছেন। হয়তো আবার শরীর খারাপ করছে। আমি গিয়ে দেখছি। সময় পেলে বাড়ি আসবেন ভাইয়া।”
তাড়া দেখিয়ে কথাগুলো বলেই আমি দ্রুত পায়ে হাঁটা
দিলাম। পেছন থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বারকয়েক ডাকলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। না শোনার ভান করে যত দ্রুত পারলাম পার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম। গাড়ির কাছে গিয়ে বড়ো করে দম নিলাম। ভেতরে যে সাক্ষাৎ যমদূত বসে আছে, না জানি কপালে কী আছে। সাহস জুগিয়ে দরজা খুলে সিটে উঠে বসলাম। দেখলাম মহারাজ শক্তপোক্ত গম্ভীর মুখে দুহাতে স্টেয়ারিং চেপে ধরে বসে আছেন। রাগত কটমটে দৃষ্টি রাস্তায় আবদ্ধ। আমি গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। উনি বিনা বাক্যে গাড়ি স্টার্ট করলেন, তবু আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। আমি পুনরায় গলা ঝেড়ে বললাম,
“শ্রেয়ান ভাইয়াকে না বলে চলে এলেন কেন? এখানে এসে তাহলে লাভ কী হলো? যার জন্য এসেছেন তাকে না বলেই তো চলে যাচ্ছেন।”
তাজ ভাই নিরুত্তর। কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় তাকিয়ে থেকে আমি আবার বললাম,
“আমরা কি এখন সোজা বাড়ি চলে যাব?”
এবারও নিরাশ হলাম। তারপর নিজেও কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলাম। হঠাৎ মাথায় শয়তানি বুদ্ধি কড়া নাড়ল। হাতের গোলাপগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে আড়চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“গোলাপগুলো সুন্দর না? একদম তাজা। আমার খুব ভালো লেগেছে।”
সঙ্গে সঙ্গে জোরেশোরে গাড়ি ব্রেক কষার শব্দ হলো। আমি দাঁতে জিব কেটে সুনামির অপেক্ষা করলাম। তাজ ভাই ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে ফুলগুলো কেড়ে নিলেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
“আরে, ফুল নিচ্ছেন কেন?”
“বড্ড‌ বেশি সুন্দর।”
গম্ভীর শান্ত স্বরে কথাটা বলেই উনি ফুলগুলো জানালা দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমি আহাজারি করে বলে উঠলাম,
“এটা কী করলেন? এত সুন্দর ফুলগুলো রাস্তায় ফেলে দিলেন?”
“গাড়ি থেকে বের হ”, আমার দিকে না তাকিয়েই শক্ত মুখে বললেন তাজ ভাই।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“কেন? আমি বাড়ি যাব কীভাবে?”
“পেছনে গিয়ে বোস।”
“না”, ত্যাড়াভাবে বললাম আমি।
সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই ধমকে উঠলেন,
“এক ধাক্কায় রাস্তায় ফেলে দিব, ইডিয়ট। পেছনে যেতে বলেছি না?”
আমি অসহায় মুখে বললাম,
“এমন করছেন কেন? একা একা পেছনে বসে থাকতে ভালো লাগবে আমার?”
“তোকে যেতে বলেছি।”
“প্লিজ।”
“আর একটা কথা বললে একদম শুট করে দিব। চুপচাপ পেছনে যা।”
ধমকের সুরে কথাটা বলতে বলতে উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। উনি তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“শ্রেয়ান ভাইয়া এমন কিছু করবে আমি ভাবতেও পারিনি। ওনার কথাবার্তায় বুঝলাম যে উনি সিরিয়াস, আর আমি ফিরিয়ে দিলেও খুব কষ্ট পাবেন। আমি চাই না উনি আমার জন্য কষ্ট পান। তাই আমি সময় চেয়েছি। উনি আমাকে সময় দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আমি কোনোকালেই ওনাকে একসেপ্ট করার কথা ভাবতে পারব না। ওনাকে বুঝিয়ে বলব। সময় নিয়ে বুঝিয়ে বললে হয়তো উনি কিছুটা হলেও কম কষ্ট পাবেন। ওনার প্রতি আমার বিশেষ কোনো অনুভূতি নেই। সত্যি বলছি।”
তাজ ভাই গম্ভীর মুখে আমার কথা শুনলেন। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিলেন। এটা কি স্বস্তির নিঃশ্বাস না কি? উনি চোখ খুলে দ্বিতীয়বার আর আমার দিকে তাকালেন না। গুমোট মুখে গাড়ি স্টার্ট করলেন। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। মাঝে মাঝে আড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম। রাগত ভাবটা এখন আর নেই। তবে গম্ভীর ভাবটা বিদ্যমান। এদিকে ফুলগুলো হারিয়েও আমার খানিক মন খারাপ হলো। এত সুন্দর ফুলগুলোর ওপর রাগ ঢেলে কী লাভ হলো? শয়তান লোক!

আমাকে বাড়িতে রেখে তাজ ভাই আবার বাইরে বেরিয়েছেন। সেই যে বেরিয়েছেন, তারপর ফিরেছেন রাত দশটায়। অনেকদিন পর আজ তাজ ভাই, বাবা আর আমি একসাথে ডিনার করেছি। তবে আমি খেয়াল করেছি তাজ ভাই প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথা বলছেন না। যা-ই হোক, আজ আমার ঘুম প্রয়োজন। গতরাতেও ঘুমাতে পারিনি। আজ লম্বা একটা ঘুম দিয়ে মনটা রিফ্রেশ করব। করলামও তাই। খেয়েদেয়ে গিয়ে যে বিছানায় সটান শুয়ে ঘুম দিলাম। এক ঘুমে রাত কাবার। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম বাবার ডাকে। তাজ ভাই আসার পর বুঝি বাবা আজই প্রথম ডাকল। প্রতিদিন তো উনিই ডেকে দেন, আজ কী হলো? এটা নিয়ে বেশি ভাবলাম না। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামতে যেতেই শিয়রের কাছে চোখ পড়ল। ভাঁজ করা চিরকুট আর এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। এই চিঠির প্রাপককে আমার ভালো করেই চেনা আছে। এর আগেও এমন অনেক চিঠি পেয়েছি। কিন্তু আজ কেন জানি মনটা খুশিতে নেচে উঠল। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। তড়িঘড়ি করে কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলাম।

বনলতা,
যেদিন মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার সেদিন আমি বড্ড অসহায় বোধ করেছিলাম। দ্বিতীয়বার অসহায় বোধ করেছিলাম যেদিন বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর আজ তৃতীয়বারের মতো নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। প্রথম আর দ্বিতীয়বার হারানোর ব্যথায় নিজেকে অসহায় মনে হয়েছিল। আর আজ হারানোর ভয়ে। হারানোর ভয় যে কী ভয়ংকর পীড়া দেয়, তা তুমি বুঝবে না। কারণ তুমি কখনও এটা টের পাওনি। এই যে আমার বুকের বাঁ পাশে ফোটন কণার অস্তিত্ব অনুভব করছি। তীব্র হাহাকারে শ্বাসকষ্টে ভুগছি। বিনিদ্র রাতের ঘোর অন্ধকার হাতড়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। এসব যদি তুমি নিজের বেলায় টের পেতে, তাহলে হয়তো তুমি নিজেকে সামলাতে পারতে না। ভেবেছিলাম আজ রাতে খুব করে একটা শান্তির ঘুম দিব। অথচ তুমি আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছ। ইচ্ছে করছিল তোমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করতে, হারানোর ভয় এত বাড়াচ্ছ কেন? তোমাকে বলেছিলাম না, আমি তোমাকে হারানোর ভয় পাই? তবে কেন এত বাড়াবাড়ি রকমের ভয়ে তটস্থ করে দিচ্ছ আমায়? মাকে হারানোর পর আমাকে বাবা সামলেছে। বাবাকে হারানোর পর ভাইয়া সামলেছে। সেই ভাইকে সুদূর সুইডেন রেখে আমি তোমার কাছে আশ্রয় খুঁজেছি। তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমাকে কে সামলাবে? তোমার কাছে আছে এর উত্তর? বলবে আমাকে? আমার কাছে একটা উত্তর আছে। বলব? তোমাকে হারালে আমার শ্বাসটুকুও বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বাস করো, স্রেফ বন্ধ হয়ে যাবে। তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব, দিবে? এটাই তোমার কাছে আমার প্রথম এবং শেষ চাওয়া। জীবনে কোনোদিনও আর কিচ্ছু চাইব না। তোমার কাছে বাকি জীবনের জন্য একটু সুখের আশ্রয় দিবে? সুখ শব্দটার ওপর আমার বড্ড বেশি লোভ। তবে সেটা শুধু এবং শুধুই তোমার থেকে চাই। দিবে?

চিরকুট পড়া শেষ করতেই এতক্ষণের দলা পাকানো কান্নারা বাঁধ ভাঙল। দু ফোঁটা অশ্রু চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল চিরকুটের ওপর। বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করলাম। সামান্য একটা চিরকুটই তো। এতটা যন্ত্রণা মাখিয়ে কেন লিখতে হবে? আজকাল যে আমারও বুকে ব্যথা হয়, তা কি সে টের পায় না? চিরকুট হাতে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে থম মেরে বসে মিনিট পাঁচেক চোখের অশ্রু ঝরালাম। তারপর গোলাপগুলো হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। এ কেমন অনুভূতি! এমন অসহ্যকর অনুভূতি সহ্য করার ক্ষমতা তো আমার নেই। কাবার্ডের একপাশে গোলাপ আর চিরকুট রেখে দ্রুত গিয়ে অজু করে এলাম। তারপর নামাজ আদায় করে রুম থেকে বেরোলাম। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা তাজ ভাইয়ের রুমে চলে গেলাম। আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। বিছানা শূন্য। উনি কি এখনও মসজিদ থেকে ফেরেননি? কিন্তু এতক্ষণে তো ফেরার কথা। হঠাৎ বেলকনির দরজা খোলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আমার পা থমকাল। বেলকনির মেঝেতে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন তাজ ভাই। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মলিন মুখটা মায়ায় ভরা। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওনার মুখোমুখি বসলাম। মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ফেটে আবার আশ্রু বেরিয়ে এল। সবেমাত্র আমি ওনাকে ডাকার জন্য মুখ খুলেছি, তখনই উনি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মৃদু কন্ঠে বলে উঠলেন,
“অতি প্রিয় মানুষরা সবসময় ফাঁকি দিতে ভালোবাসে, তাই না?”
পরক্ষণেই আস্তে করে চোখ খুলে আমার চোখে নিজের ঘোলাটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
“যদি মা ফিরে আসত, তাহলে কেমন হত? আমার সব সুখ ফিরে পেতাম?”
ওনার কথা শুনে এবার আমি ঠোঁট ভেঙে ফুঁপিয়ে উঠলাম। তাজ ভাই শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কাঁদছিস কেন?”
সঙ্গে সঙ্গে আমি সব অস্বস্তি ভুলে ওনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পাঞ্জাবী আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে অনবরত কাঁদতে শুরু করলাম। তাজ ভাই আমাকে ধরলেন না, সরিয়েও দিলেন না। যেভাবে বসে ছিলেন চুপচাপ সেভাবেই বসে রইলেন। হয়তো উনি এমন কিছু আশা করেননি। কিছু সময় পর নিচু স্বরে বললেন,
“এখন সুইডেন আর বাংলাদেশের তফাত মাপা হবে না? না কি মেয়ে বলে পার পেয়ে যাবি?”
আমি ওনার কথায় কানও দিলাম না। উনি আবার বললেন,
“আমার চা কোথায়?”
আমি বুঝলাম উনি আমাকে থামানোর জন্য এসব বলছেন। তবু একচুলও নড়লাম না। কান্নার গতি কমলেও আমার চোখের পানি ফুরাচ্ছিল না। তাজ ভাই আবার চুপ মেরে বসে রইলেন। তারপর অনেকটা সময় কেটে গেল। উনি একটা বারের জন্য আমাকে আলিঙ্গনও করলেন না। অতঃপর নিরবতা ভেঙে আমাকে বুক থেকে উঠিয়ে সোজা করে বসিয়ে দিলেন। দুহাতে আলতো করে আমার মুখটা তুলে ধরে চোখের পানি মুছে কপালে ক্ষণিকের জন্য ঠোঁট ছোঁয়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার দুচোখ মুদে এল। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেল। তাজ ভাই ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
“আমি বেশি জ্বালাই বলে প্রতিশোধ নিচ্ছিস?”
আমি চোখ মেলে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে উনি পুনরায় বললেন,
“আমার না প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাতে দিবি একটু?”
ওনার অসহায় মুখে বাচ্চাদের মতো আবদার শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। গাল থেকে ওনার হাত দুটো নামিয়ে নিজের মুঠোবন্দী করে নাক টেনে বললাম,
“কাল সারারাত যে ঘুমাননি। আবার মাথা ব্যথা করেনি?”
তাজ ভাই আমার কথায় মৃদু হাসলেন। তাচ্ছিল্য মাখা হাসি। আমার একহাত নিয়ে ওনার বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে বললেন,
“এখানে প্রচন্ড ব্যথা করেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে। মরতে মরতে বেঁচে গেছি।”
আমার চোখ দুটো আবার টইটুম্বুর হয়ে উঠল। তা দেখেই তাজ ভাই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
“এই খবরদার, একদম ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে কাঁদবি না আমার সামনে। অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছি। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সামনে থেকে বিদায় হ।”
আমি কপাল খানিক কুঁচকে সামনে থেকে সরে ওনার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লাম। তাজ ভাই কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। আমি কিছু না বলে চুপচাপ ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি আমার চোখে চোখ রাখলেন। গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন,
“এত সুখ লাগছে কেন?”
আমার কেন জানি কিছুটা লজ্জা লাগল। ওড়নার কোণা টেনে ওনার মুখের ওপর ফেলে মুখ ঢেকে ফেললাম। উনি ওড়নাটা সরালেন না। কোমল কন্ঠে বললেন,
“ওড়নার ঘ্রাণ শুঁকিয়ে যন্ত্রণা কমানো হচ্ছে, না বাড়ানো হচ্ছে?”
আমি ওড়নায় ঢাকা ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলাম। উত্তর না দিয়ে চুপচুপ ওনার চুলের ফাঁকে আঙুল চালিয়ে বিলি কাটতে লাগলাম। এতক্ষণের ব্যথায় জখম হওয়া মনে হঠাৎ করেই সতেজতা অনুভব করলাম। এই বিপজ্জনক লোকটাকে আমি এতটা ভালোবেসে ফেললাম কখন? এমন তো কিছু হওয়ার কথা ছিল না। তবু কীভাবে হয়ে গেল? আশ্চর্য!

চলবে………………..🍁