তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-০৬

0
472

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০৬

ঘুমের মধ্যে মুখে পানির স্পর্শ পেয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললাম। পর পর কয়েকবার মুখে পানির ছিটা পড়ার পর পিটপিট করে চোখ খুললাম। সামনে তাজ ভাইকে দেখে বেশ অবাক হলাম। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, সাদা টুপিতে ওনাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে। সাদা পাঞ্জাবিতে খুব মানিয়েছে লোকটাকে। আমি ঘুমঘুম চোখে হা করে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। তাজ ভাই হাতের গ্লাসটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“ওঠ।”

ওনার কথাটা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছল না। উনি আমার হাত ধরে টেনে তুললেন। আমি বিছানায় বসে ভ্রু কুঁচকে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি আবার বললেন,“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? ভূতে ধরেছে? নাম বিছানা থেকে।”

আমি এবার কিছু একটা ভেবে ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ভোর পাঁচটা বাজে। আমি ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,“কী ভাইয়া থুক্কু ভাই? এই ভোরবেলা আমার ঘুম নষ্ট করলেন কেন? আমার ঘুম পাচ্ছে।”

কথাটা বলেই আবার ধপ করে শুয়ে পড়লাম। তাজ ভাই এবার আমাকে টেনে তুলে বিছানা থেকে নামিয়ে তার সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,“এখন আর কোনো ঘুম নয়। অজু করে ফজরের নামাজ পড়বি এখন।”

আমি এবার স্পষ্ট দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। দুদিন ধরে বাবা বাসায় নেই বলে ফজরের নামাজের সময় উঠতেও পারি না। কারণ বাবা প্রতিদিন আমাকে নামাজ পড়তে ডেকে তোলে। গতকাল রাতে ডায়েরি লেখার সময় আমি লিখেছিলাম ‘আজ যদি আমার জীবনে মা থাকত তাহলে প্রতিদিন সকালে বাবাকে এত কষ্ট করে আমার ঘুম ভাঙাতে হত না। কিন্তু আফসোস, বাবা ছাড়া আমার জীবনে দ্বিতীয় কেউ নেই।’ এখন মনে হচ্ছে বাবা ছাড়াও আমার জীবনে কেউ একজন আছে। সত্যিই কি আছে? কী জানি! আমাকে ভাবতে দেখে তাজ ভাই আমার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললেন,“ভাবাভাবি পরে করিস। নামাজ পড়ে নে। আমি মসজিদে যাচ্ছি।”

কথাটা বলে উনি আমার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। উনি দেশে ফেরার পর থেকে আমি কখনও ওনাকে মসজিদে যেতে দেখিনি। আজ সুবুদ্ধি হয়েছে দেখছি! আমি হামি তুলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নিলাম। তারপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করলাম। তারপর বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। সকালের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ফুরফুরে হাওয়া এসে গায়ে লাগতেই মনটা একদম হাওয়ার মতোই ফুরফুরে হয়ে গেল। আমি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পূর্ব দিকে আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে। সুয্যিমামার আগমনের পালা চলছে। পাশে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। তাজ ভাইয়ের স্নিগ্ধ মুখটা দেখতে পেলাম। একদম সকালের প্রকৃতির মতোই স্নিগ্ধ। মেয়েদের মতো সৌন্দর্য ছড়িয়ে থাকে লোকটার মুখে। উনি আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। ইচ্ছে হলেও ওনার থেকে দূরে সরে দাঁড়ালাম না। আমি ওনার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে দৃষ্টি রেখেও বেশ বুঝতে পারলাম উনি আমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কাটানোর পর উনিই আগে কথা বললেন,“চা কর গিয়ে।”

এই মুহূর্তে এমন একটা কথা আমি মোটেও আশা করিনি। সকাল সকাল কোনোদিন রান্নাঘরে ঢুকেছি বলে মনে পড়ে না আমার। তবু কোনো কথা না বাড়িয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রান্নাঘরে চললাম। চা-টা আমি বেশ ভালোই করতে পারি। মাঝে মাঝে বাবাকে চা করে দেই। চা করে ওনার জন্য এক কাপ আর আমার জন্য এক কাপ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলাম। আমার কাপটা টেবিলে রেখে দিয়ে ওনার কাপটা হাতে নিলাম। ভাবলাম উনি নিশ্চয়ই এতক্ষণে নিজের রুমে চলে গেছেন। তাই ওনার রুমে ঢুকে পড়লাম। রুমে ঢুকে দেখলাম মহাশয় রুমের মধ্যে ব্যায়াম করছেন। প্রত্যেকদিন সকালেই উনি এমন রুমের মধ্যে ব্যায়াম করেন। প্রথম যখন এসেছিলেন তখনই ব্যাপারটা দেখেছিলাম আমি। উনি আমাকে দেখে ব্যায়াম থামিয়ে তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। আমি ওনার দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে ধরলাম। উনি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নেয়ার সময় আমার বাঁ হাতের দিকে সরু চোখে তাকালেন। তারপর মুখটা গম্ভীর করে বললেন,“চুড়ি কোথায়?”

আমার এতক্ষণে মনে পড়ল উনি বলেছিলেন কখনও যেন হাত থেকে চুড়ি না খুলি। আমি নরম কন্ঠে বললাম,“গাতকাল রাতে ঘুমানোর সময় খুলে রেখেছিলাম।”

উনি ঠান্ডা গলায় বললেন,“যা গিয়ে নিয়ে আয়। দরকার নেই তোর ঐ চুড়ি নেয়ার।”

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,“কেন?”

উনি এবার রাগত স্বরে বললেন,“আমি কাউকে ওগুলো ফেলে রাখার জন্য দেইনি। আমার মায়ের জিনিস আমি দিয়েছিলাম এখন আমিই ফেরত চাইছি। যা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”

ওনার রাগ দেখে আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। চুপচাপ ওনার রুম থেকে বেরিয়ে আমার রুমে ঢুকলাম। টেবিলের ওপর থেকে চুড়ি জোড়া হাতে নিলাম। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আসলে চুড়ি জোড়া আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আগেরকার দিনের ডিজাইন হলেও একদম ইউনিক। এত সুন্দর নিখুঁত ডিজাইন এখন আর তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। ফুপির চয়েসের প্রশংসা করতে হয় বটে! চুড়ি জোড়া কিছুটা চিকন বলে আমার আরও পছন্দ হয়েছে। শয়তানটা দিয়েছে তো দিয়েছে এখন আবার ফেরত নেয়ার কী দরকার? দেয়ার সময় তো বলল মায়ের পুত্রবধূর জন্য যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। তো আমাকে যদি ফুপির পুত্রবধূ ভেবেই দিয়ে থাকে তাহলে একবার খুলে রেখেছি বলে ফেরত চাইছে কেন? আমার তো এগুলো ফেরত দিতে ইচ্ছে করছে না। আমি চুড়ি জোড়া নিয়ে ওনার রুমে গেলাম। উনি বিছানায় বসে আরামসে চা পান করছেন। আমাকে দেখে বললেন,“এনেছিস? দে আমার কাছে।”

আমি গাল ফুলিয়ে দু’পা এগিয়ে গিয়েও থেমে পড়লাম। অসহায় মুখে একবার চুড়ির দিকে আরেকবার ওনার দিকে তাকিয়েই হুট করে চুড়ি জোড়া হাতে ঢুকিয়ে ফেললাম। উনি কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। আমি করুণ কন্ঠে বললাম,“আর খুলব না। সত্যি বলছি।”

উনি আমার দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে তারপর স্বাভাবিকভাবেই বললেন,“মনে থাকে যেন।”

আমি খুশি হয়ে ওনার পাশ থেকে খালি কাপটা নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উনি পিছু ডাকলেন,“ইলু শোন।”

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পেছন ফিরে ওনার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি বললেন,“আজ থেকে আমার চা-টা তুই বানাবি।”

“কেন?”

“আমি বলেছি তাই।”

“চা তো খালা বানায়।”

“ওনারটা ভালো লাগে না আমার।”

“তো আমারটা ভালো লাগে না-কি?”

“অতটা না তবে চলে আরকি।”

আমার রাগ উঠে গেল। আমার হাতের চা ভালো না লাগলে তাহলে আমাকে প্রতিদিন তার চা বানানোর কথা বলছেন কেন? আস্ত শয়তান একটা। আসল কথা হচ্ছে উনি আমার প্রশংসা করতে চাইছেন না। আমি দ্রুত পায়ে ওনার রুম থেকে বেরিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলাম আমার চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ধুর! এই লোকটা আসার পর থেকে আমি শান্তিতে চাও খেতে পারি না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে চাটুকু ফেলে দিলাম। খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। তখনই সেখানে মহারাজ এসে হাজির। এসেই বললেন,“আজ থেকে তোর সকালের আর রাতের খাবার বানানোর কথা। শুরু করে দে।”

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,“গতকালই তো দেখলেন আমি এসব পারি না।”

উনি বেশ দৃঢ়তার সাথে বললেন,“চিন্তা নেই। আমি শিখিয়ে দিবো। তোর মতো অকর্মা মেয়েকে কাজ শেখানোর জন্য আমার মতো দায়িত্বশীল ছেলে আছে। চল শুরু কর তাড়াতাড়ি।”

এই ঝগড়াটের সাথে কথা বললে একটার পর একটা বকবক বাড়তেই থাকবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু নামালাম। উনি আমাকে ময়দা আর পানির পরিমাণ দেখিয়ে দিলেন। সেই অনুযায়ী নিয়ে আমি ময়দা মাখালাম। তারপর গোল গোল করে ময়দার কাই বানালাম। কিন্তু রুটি বেলতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে। রুটি কিছুতেই গোল হচ্ছে না। একেকটা একেক দেশের মানচিত্রের আকার হয়ে যাচ্ছে। আমি ঠোঁট উল্টে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উজবুকটা আমার রুটি বানানো দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে। আমি তাকাতেই উনি আমার মাথায় টোকা মেরে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“সাধে কি আর তোকে অকর্মা মেয়ে বলি? আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। মনোযোগ দিয়ে দেখ।”

কথাটা বলে উনি আমার হাত থেকে বেলুন নিয়ে আমাকে সরিয়ে একটা কাই নিয়ে বেলতে শুরু করলেন। কয়েক সেকেন্ডেই একদম গোলগাল সুন্দর একটা রুটি বানিয়ে ফেললেন। আমি শুধু হা করে তাকিয়ে দেখলাম। উনি এবার আমার হাতে বেলুনটা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে বেলুন ধরে রুটি বেলতে হয়। তারপর একটা কাই নিয়ে আমার হাত ধরিয়ে ধরিয়ে কীভাবে রুটি বেলতে হয় শেখাতে লাগলেন। উনি আমার দুহাতের ওপর হাত রেখে রুটি বেলছেন। এতটা কাছে দাঁড়ানোর কারণে ওনার প্রত্যেকটা গরম নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে পড়ছে। রুটি বেলা শিখব কী? ক্রমেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে ভেতরে। আমার মনে হলো যেন আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমি হঠাৎ বেলুন ছেড়ে দিয়ে ওনার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ালাম। উনি ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকালেন। আমি জোরে বারকয়েক শ্বাস নিয়ে মাথা নিচু করে মৃদু কন্ঠে বললাম,“আমি একাই পারব। আপনি যান এখান থেকে।”

ওনার দিকে আর মাথা তুলে তাকালাম না।আশা করলাম উনি এখনই চলে যাবেন এখান থেকে। কিন্তু মিনিট খানেক পর ঘটলো সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। উনি চলে যাবার বদলে আমার একদম সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি মাথা তুলে ওনাকে এত কাছে দাঁড়াতে দেখে দু’পা পিছিয়ে যেতেই ফ্রিজের সাথে ধাক্কা খেলাম। ফ্রিজ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম,“বললাম না পাড়ব? যান আপনি।”

উনি এবার আমার হাত দুটো আলতো করে ধরে নিজের দুহাতের মুঠোয় নিলেন। আমি ভয়ে ঢোক গিললাম। ওনার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আমার দুহাত ফ্রিজের সাথে আলতো করে চেপে ধরলেন। আমি এবার আরও ভয় পেয়ে গেলাম। আমার ভয়ও একধাপ বেড়ে গেল। মুহুর্তে উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় এসে আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,“কী করছেন আপনি? প্লিজ ছাড়ুন আমাকে।”

উনি শুনলেন না আমার কথা। ওনার গরম নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে পড়তেই আমি কেঁপে উঠলাম। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে অনুরোধের সুরে বললাম,“আমি আপনার থেকে এমন আচরণ আশা করিনি।”

খারাপ পরিস্থিতির ভয়ে শিউরে শিউরে উঠতেই উনি হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,“আহনাফ তাজওয়ার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ছেলে যদি কোনোদিন এই মাথামোটা পিচ্চিটার এতটা কাছে আসার সাহস দেখায় তবে এই সুন্দর পৃথিবীতে সেদিনই হবে তার শেষ দিন।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চোখ খুলে অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। এ আবার কেমন হুমকি! উনি আমার চোখে চোখ রেখে বাঁকা হেসে বললেন,“মাইন্ড ইট।”

কথাটা বলেই উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে ওনার চলে যাওয়া দেখলাম। নড়াচড়ার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। বারবার ওনার বলা কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। এই লোকটা এমন কেন? সারাক্ষণ ঝগড়া করে, অপমান করে। আবার মুহুর্তে এমন কান্ড ঘটায় যে অবাক না হয়ে উপায় নেই। একদম স্ট্যাচু বানিয়ে রেখে যায়। বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার হুঁশ ফিরল। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বেলুন হাতে তুলে নিলাম। নিজের মতো চেষ্টা করে কয়েকটা রুটি বানালাম। সম্পূর্ণ গোল না হলেও খুব বেশি খারাপ হয়নি। কাজটা যে এত তাড়াতাড়ি শিখতে পরব না তা বেশ বুঝতে পারলাম। চুলা জ্বালিয়ে রুটি ভাজার পর ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম নামিয়ে ভেজে নিলাম। তারপর রান্নাঘরটা পরিষ্কার করে খাবারটা নিয়ে টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখলাম। রুমে গিয়ে দেখলাম আটটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসি পেয়ে গেল। কপালে গালে ময়দার গুঁড়ো লেগে আছে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ভাবলাম ব্রেকফাস্ট করে তারপর রেডি হব। কিন্তু তাজ ভাইয়ের সামনে যেতে সংকোচ বোধ হচ্ছে এখন। কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থাকার পর তাজ ভাইয়ের ডাক পড়ল। আমি ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম উনি খাবার টেবিলে বসে আছেন। আমি জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি গম্ভীর মুখে বললেন,“এসিস্ট্যান্ট হয়ে এটাও জানিস না কখন বসকে খাবার দিতে হবে? বেয়াদব কোথাকার! পানিশমেন্ট পেতে ইচ্ছে করে?”

আবার শুরু হয়ে গেছে! লোকটাকে যে আল্লাহ্ কেমন বানিয়েছে তা একমাত্র আল্লাহই জানে। এই ভালো তো এই খারাপ। আমি এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। ওনার প্লেটে রুটি আর ডিম দিয়ে আমিও নিলাম। উনি রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে বললেন,“মামু থাকলে তার গুণবতী মেয়ের বানানো প্রথম রুটি খেতে পারত।”

বাবার কথা মনে পড়তেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনদিন ধরে গ্রামে গেছে অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছে তিন যুগ। বাবাকে ছেড়ে কখনও না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে। আমি চুপচাপ রুটি চিবোতে লাগলাম। খাওয়ার মাঝে তাজ ভাই বললেন,“কাল গ্রামে যাচ্ছি।”

আমি এবার মুখ তুলে তাকালাম। অনেকটা খুশিও হলাম। কারণ গ্রামে গেলেই বাবার সাথে দেখা হবে। তাছাড়া অনেক দিন ধরেই গ্রামে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যদিও এই বিরক্তিকর লোকটার সাথে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই তবু যেতে হবে। এছাড়া কিছুই করার নেই। তাজ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“কাল গিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আসব। আশা করি এর মধ্যেই মামুর সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। রাতেই সব গুছিয়ে প্যাকিং করে ফেলিস। সকাল সাড়ে নয়টায় রওনা দিবো।”

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,“আচ্ছা।”

টেবিলের ওপর রাখা তাজ ভাইয়ের ফোনটা স্বশব্দে বেজে উঠল। উনি বাঁ হাতে ফোন রিসিভ করে কানে ধরেই হেসে বললেন,“হ্যালো মি. শ্রেয়ান। কী খবর আপনার?”

শ্রেয়ান নামটা শুনেই আমি চকিত চাহনিতে তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া কী বললেন তা শোনা গেল না। তাজ ভাই হেসে বললেন,“আমি তো বেশ আছি। তো, আর কতদিন লাগবে ফিরতে?”

শ্রেয়ান ভাইয়া কিছু একটা বলার পর তাজ ভাই আফসোসের সুরে বললেন,“কাল সকালের মধ্যে ফিরতে পারলে আমার সাথে গ্রামে যেতে পারতি দোস্ত।”

আরও কিছুক্ষণ ওনারা কথা বললেন আর আমি শুধু তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তাজ ভাই ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“অমন হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? মুখে মাছি ঢুকবে। শ্রেয়ানের সাথে এখন দেখা হওয়ার চান্স নেই। তবে গ্রাম থেকে ফিরে দেখা হবে।”

উফ্! এই লোকটার সামনে শান্তিতে কিছু ভাবতেও পারি না আমি। মাইন্ড রিড করে ফেলে। আজব লোক তো! শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে আমার দেখা করতে ইচ্ছে করে তাও বুঝে গেল। ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি বললাম,“আচ্ছা আপনি তো আট বছর সুইডেন ছিলেন। আট বছরেও শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে আপনার ফ্রেন্ডশিপ আগের মতোই আছে?”

তাজ ভাই মৃদু হেসে বললেন,“ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব পনেরো বছরের। আমাদের মধ্যকার বন্ডিংটা এতটাই ভালো ছিল যে আট বছরে প্রায় প্রতিদিনই ওর সাথে আমার কথা হয়েছে।”

আমি প্রশ্ন করলাম,“আপনি দেশে আসার পর ওনার সাথে দেখা হয়েছে?”

“আমি যেদিন এসেছি সেদিন মামুর সাথে শ্রেয়ানও এয়ারপোর্ট গিয়েছিল। তার পরদিনই ও একটা কাজে চট্টগ্রাম চলে গেছে। তিন চারদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। তখন তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।”

আমি বেশ খুশি হলাম। তাজ ভাই পানি খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমে যেতে যেতে বললেন,“রেডি হ।”

আমি প্লেটগুলো নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করে রেখে দিলাম। তারপর রুমে গিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। জেমিকে খাবার দিয়ে আদর করে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হলাম। তাজ ভাইয়ের রুমে উঁকি দিয়ে ওনাকে পেলাম না। বোধ হয় গাড়িতে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। দরজা লক করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠে বসতেই তাজ ভাই গাড়ি স্টার্ট করলেন। তাজ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আমার চোখ আটকে গেল। নীল পাঞ্জাবিতে ওনাকে দারুণ মানিয়েছে। আজ সকালে প্রথম ওনাকে পাঞ্জাবিতে দেখেছিলাম। তাও তো নামাজ পড়বেন বলে পরেছিলেন। তো এখন পাঞ্জাবি পরলেন কী মনে করে?

চলবে..………………….🍁