তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-০৯

0
464

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০৯

রাতের খাবারের পর আফরা আপুর সাথে গল্প করতে তার রুমে গিয়েছিলাম। অথচ তার মুখে শুধু একটা নামই শুনতে হয়েছে। তাজ, তাজ আর তাজ। আমি বিরক্ত হলেও আপুর সাথে তাল মিলিয়েছি। কারণ আমি চাইছি শয়তানটাকে আপু বেশি বেশি জ্বালাক। তাই আপুর সামনে তাজ ভাইয়ের মিথ্যা প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলাম। তখন তো আর জানতাম না এটাই আজ আমার কাল হবে। আফরা আপু আমাকে বলল আমি যেন তাজ ভাইয়ের কাছে গিয়ে এমনভাবেই তার প্রশংসা করি যাতে তাজ ভাই তার প্রতি ইমপ্রেসড হয়ে যায়। আমি যখন মেকি হেসে বললাম কাল করব তখন আপু ঠেলেঠুলে আমাকে তাজ ভাইয়ের রুমে পাঠিয়েছে। তাজ ভাইয়ের রুমের দরজা ভেজানো দেখে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকেই আমার চোখ দুটো রসগোল্লার আকার ধারণ করল। উনি দরজা না আটকে ড্রেস চেঞ্জ করছেন। আমি ঘুরে দৌড় লাগাতে যাব তখনই তাজ ভাই পিছু ডাকলেন,“এই দাঁড়া।”

আমি থেমে গেলাম কিন্তু লজ্জায় পেছন ফিরে তাকালাম না। এমন একটা সময়ই এলাম। ধুর! তাজ ভাই বললেন,“এদিকে তাকা।”

আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম। চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা হালকা ঘুরালাম। এক চোখ হালকা খুলে দেখলাম ওনার চেঞ্জ করা শেষ। তাই চোখ খুলে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ালাম। উনি কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। উনি চোখ বড়ো করে বললেন,“তুই তো ডেঞ্জারাস মেয়ে! হুটহাট একটা নিষ্পাপ, ভদ্র ছেলের রুমে ঢুকে পড়িস। তোর মতো কি আমাকেও লাজহীন মনে হয়?”

আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“আমি কি জানতাম না-কি আপনি চেঞ্জ করছিলেন? আর এটুকু কারণে আপনি আমাকে লাজহীন বলছেন কেন? তাহলে তো আপনি বড়ো লাজহীন। দরজা আটকাননি কেন আপনি?”

“আমার রুমের দরজা আমি আটকে রাখব না খোলা রাখব সেটা আমার ব্যাপার। দরজায় নক করতে শিখিসনি তুই?”

“সবসময় বাবার রুমে নক না করে ঢুকি তাই অন্যদের রুমে গেলে খেয়াল থাকে না।”

উনি আর কথা না বাড়িয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম এটাই সুযোগ। যে কাজে এসেছি সে কাজে লেগে পড়ি। দু’পা এগিয়ে গিয়ে গলা ঝেড়ে একটু নরম কন্ঠে বললাম,“আচ্ছা তাজ ভাই? আফরা আপু কেমন বলুন তো?”

উনি আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে বললেন,“আমি কি চব্বিশ ঘন্টা ওর সাথে থাকি যে ও কেমন তা জানব? তুই জানিস না ও কেমন?”

“আরে তা বলিনি। আপনার কাছে কেমন মনে হয় সেটা বলেছি। আমি তো ভালোভাবেই জানি আফরা আপু কেমন? আপুর মতো মেয়ে এ গ্রামে খুব কমই আছে। যেমনি সুন্দরী তেমনি মিষ্টি দেখতে। অথচ এত সুন্দরী হয়েও তার একটুও অহংকার নেই। আজ পর্যন্ত কত ছেলে আপুকে প্রপোজ করেছে অথচ আপু কাউকেই একসেপ্ট করেনি। আমি তো আপুকে দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি…………….।”

তাজ ভাই আমার কথার মাঝে ঘাড়ে হাত দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বললেন,“গাড়িতে কী বলেছিলাম ভুলে গেছিস? কথা ছিল বাসায় এসে আমার ঘাড় টিপে দিবি। অথচ রাত হয়ে গেছে তবুও তোর খবর নেই। তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়।”

আমার মুখটা শক্ত হয়ে গেল। আমাকে চুপ করানোর জন্যই যে উনি এই কথাটা উঠিয়েছেন তা ভালো করেই বুঝতে পারছি। আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি আবার বললেন,“কথা কানে যায় না। বেয়াদব এসিস্ট্যান্ট! তাড়াতাড়ি এদিকে আয়।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“বাড়ি এসেছি সেই দুপুরে আর এখন রাত। এখনও আপনার ঘাড় ব্যথা আছে না-কি? ইচ্ছে করে আমাকে খাটাতে চাইছেন?”

“বসের কথার ওপর কথা বলিস, সাহস তো কম না! পানিশমেন্ট না চাইলে চুপচাপ কাজ কর।”

আমি ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই উনি বলে উঠলেন,“ঐ চিঠি আর পিক কিন্তু আমার সাথেই আছে।”

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওনার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত পিষে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে গেলাম। উনি বাঁকা হেসে দু’পা খাটে উঠিয়ে ঘুরে বসলেন। আমি চোখমুখ শক্ত করে ওনার ঘাড় টিপে দিতে লাগলাম। রাগে একটু জোরে জোরেই চাপ দিচ্ছি। কিন্তু এতে মনে হলো শয়তানটা খুব আরাম পাচ্ছে। তাই এবার আস্তে আস্তে চাপতে লাগলাম। নিজের ওপরই এখন রাগ লাগছে। কী দরকার ছিল আফরা আপুর কাছে এত বাড়তি প্রশংসা করার? প্রশংসা না করলে এখন এই শয়তানটার সামনে আসতেও হত না আর এমন খাটতেও হত না। ইচ্ছে করে সাপের গর্তে পা রাখলে যা হয়। ইচ্ছে করছে মট করে ঘাড়টা মটকে দিতে। তাজ ভাই তখনই বলে উঠলেন,“মরে ভূত হয়ে গেলে তখন ঘাড় মটকাস। এখন এসব চিন্তা করে ফালতু সময় নষ্ট হবে শুধু শুধু।”

আমি থতমত খেয়ে সামনে তাকালাম।‌ খাটের ওপাশে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আমাকে আর তাজ ভাইকে দেখা যাচ্ছে। উনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। হামি তুলতেই তাজ ভাই বললেন,“যা যা, ঘুমিয়ে পড়। অকর্মা মেয়েদের কাজের সময়ই ঘুম পায়।”

উনি সরে গিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন। আমি বললাম,“এতক্ষণ যে কষ্ট করে ঘাড় টিপে দিলাম তাতে আপনার মন ভরেনি।”

উনি এক ভ্রু উঁচু করে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ঝুলিয়ে বললেন,“মন‌ ভরার মতো কী করলি?”

উনি কথাটা অন্যরকম সুরে বললেন। আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এলোমেলো দৃষ্টিতে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। বিছানার একপাশে অলি আর জেমি ঘুমে মগ্ন। দরজাটা ভেজিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে চোখে ঘুম নেমে এল। পরদিন সকালে তাজ ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। বিছানা ছেড়ে উঠে নামাজ আদায় করলাম।‌ তারপর ভাবলাম আম্মুর কবরের পাশে যাব একটু। রুম থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে যেতেই মেজো কাকার সামনে পড়লাম। কাকা প্রশ্ন করলেন,“কোথায় যাচ্ছিস মা?”

আমি জবাব দিলাম,“কবরস্থানের কাছে যাব কাকা।”

“আচ্ছা যা।” কথাটা বলে কাকা ভেতরে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ির থেকে কিছু দূরেই আমার আম্মু আর ফুপির কবরস্থান। গ্রামে এলে আমি প্রায় প্রতিদিনই একবার গিয়ে কবরস্থান দেখে আসি। সকালের ফুরফুরে বাতাসে গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে বেশ লাগছে। শহরের মতো কোলাহল নেই বলেই গ্রামটা আমার এত প্রিয়। হাঁটতে হাঁটতে কবরস্থানের পাশে এসে দাঁড়ালাম। অনেকদিন পর মনে হচ্ছে আমি আমার আম্মুর খুব কাছে এসেছি। কিন্তু না পারছি তাকে দেখতে আর না ছুঁতে। কিছুক্ষণ কবরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর আমার বুকটা ভারী হয়ে গেল। চোখ দিয়ে আপনা-আপনি পানি গড়াতে লাগল। আমি পারলাম না নিজেকে সামলাতে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলাম। হেঁচকি তুলে নিজে নিজেই বললাম,“আমাকে একা কেন রেখে গেলে আম্মু? আমার ভালো লাগছে না আর এই একাকীত্ব। আব্বুকে আমি কষ্ট দিতে চাই না বলে সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু দিনশেষে তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ একা আম্মু। আটটা বছর ধরে একাকীত্ব আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও না আম্মু। তোমাকে ছাড়া আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি জানো? তোমার মেয়ে আজও নিজেকে সামলাতে শিখতে পারেনি। এসব কথা আমি আব্বুকে বুঝতে দেই না। এভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে না আমার। আমাকে বোঝার মতো কেউ নেই আম্মু, কেউ নেই। সবাই ভাবে আমি খুব ভালো আছি। কেউ আমার ভেতরটার খবর জানতে চায় না। তুমি ছাড়া আমাকে বুঝার আর কেউ নেই আম্মু। আমি ভালো নেই আম্মু, শুনতে পাচ্ছ তুমি? তোমার মেয়ে তোমাকে ছাড়া একটুও ভালো নেই।”

আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কবরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম। তখনই আমার মাথায় কেউ হাত রাখল। আমি মুখ থেকে হাত সরিয়ে সামনে তাকালাম। তাজ ভাই গম্ভীর মুখে আমার সামনে বসে আছে। দ্রুত চোখ মুছে ফেললাম। আমি চাই না কেউ আমার চোখের পানি দেখুক। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো সুরাহা হলো না। চোখ মোছার সাথে সাথে আবার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। উনি আমার দুই বাহু ধরে দাঁড় করালেন। আলতো করে চোখের পানি মুছে দিলেন। তারপর একহাতে আলতো করে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আদুরে স্পর্শ পেয়ে আমার কী হলো জানি না। হঠাৎ করেই ওনার পিঠের কাছের পাঞ্জাবি খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে আবার ফুঁপিয়ে উঠলাম। উনি আমাকে সরানোর চেষ্টাটুকুও করলেন না। বরং সযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এই প্রথম আমার মনে হলো কেউ একজন আছে আমার পাশে থাকার, আমাকে বোঝার। আমি তো সবসময় চাই আমাকে বোঝার মতো কেউ থাকুক। যাকে আঁকড়ে ধরে আমি সব কষ্ট ভুলে যেতে পারব। কেঁদেকেটে ওনার বুকের কাছের পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিয়েছি আমি। অনেকক্ষণ কাঁদার পর যখন হুঁশ ফিরল তখন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি তাড়াতাড়ি ওনার থেকে দূরে সরে দাঁড়ালাম। অতিরিক্ত ইমোশনাল হয়ে কী করে ফেলেছি ভেবে লজ্জায় আর মুখ তুলে ওনার দিকে তাকালামও না। উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে কবরস্থানের ভেতরে ঢুকলেন। আমি হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম উনি আম্মু আর ফুপির কবরের ওপর থেকে দু একটা পাতা সরাচ্ছেন। তখন থেকে একটা কথাও বলেননি উনি। আচ্ছা? উনিও কি আমার মতোই কষ্ট পাচ্ছেন ফুপির জন্য? হয়তো পাচ্ছেন কিন্তু ছেলে বলে কাঁদতে পারছেন না। উনি কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এসে আমার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। ওনাকে বাধা দিতে মন সায় দিলো না। বাড়ির গেট পর্যন্ত গিয়ে উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। একসঙ্গে বাড়িতে ঢুকতেই আফরা আপু দৌড়ে আমার কাছে এল। আমাকে সাইডে নিয়ে বলল,“এই ইলো, তাজ ভাইয়ার সাথে কোথায় গিয়েছিলি তুই?”

আমি বললাম,“একসাথে যাইনি আপু। আমি একাই কবরস্থানের পাশে গিয়েছিলাম। তারপর উনিও গিয়েছিলেন। তাই একসাথে বাড়ি ফিরলাম।”

আফরা আপু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উৎসুক কন্ঠে বলল,“কাল রাতে আমার কথা বলেছিলি?”

রাতের কথা মনে পড়তেই আমার মুখটা শক্ত হয়ে গেল। শয়তানটা সুযোগ পেয়ে আমাকে খাটিয়েছে। আমি বললাম,“হ্যাঁ আপু, বলেছিলাম।”

“ওনার এক্সপ্রেশন কেমন ছিল?”

“বুঝে উঠতে পারিনি।”

আপু হতাশ গলায় বলল,“তো এখন কী করব বল তো?”

আমি একটু ভেবে বললাম,“একটা কাজ করলে ভালো হয়। ওনাকে সোজাসুজি বলে দাও তোমার মনের কথা।”

আপু মন খারাপ করে বলল,“কিন্তু আমার তো সাহস হয় না রে। তুই তো বলেছিলি আমার হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে আছিস। তাহলে তুই বল না।”

আমি চোখ বড়ো করে বললাম,“আমি?”

আপু অনুরোধের সুরে বলল,“প্লিজ ইলো না করিস না। তোকে আমি ট্রিট দিবো দেখিস। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

আমি অসহায় মুখে আপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমনভাবে অনুরোধ করছে যে ফেলতেও পারছি না আবার আমার নিজেরই ভয় লাগছে। তবু আপুর অনুরোধে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু তাজ ভাইকে এই কথা বলার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না। বারবার ওনার আশেপাশে গিয়ে আবার ফিরে আসছি। কেন জানি ভয় ভয় লাগছে। সারাদিনেও আমি ওনার সামনে কথাটা তুলতে পারলাম না। বিকেলে জানালার পাশে বসে বাইরের নির্মল প্রকৃতি দেখছিলাম তখনই আফরা আপু আবার এসে তাড়া দিলো। গতকাল রাতের মতোই আজ আবার ধাক্কাধাক্কি করে আমাকে রাক্ষসটার রুমে পাঠাল। গুটিগুটি পায়ে রুমে ঢুকে দেখলাম মহাশয় ল্যাপটপে কিছু একটা করছেন। মুখটা কেমন যেন গম্ভীর দেখাচ্ছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক নয় বুঝতে পেরে যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। তখনই ওনার কথা শুনে থেমে গেলাম। উনি বললেন,“পিচ্চিদের পেটে কথা বেশিক্ষণ রাখতে নেই। বদহজম হয়ে যাবে। যা বলার আছে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।”

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। তাই একটু সাহস জুগিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। উনি ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই বললেন,“আজ সারাদিন ধরে আশেপাশে ঘুরঘুর করছিস কেন? মতলব কী?”

আমি মুখ ফুলিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। কিন্তু এখন রাগ করা চলবে না। তাই নিজেকে দমিয়ে নিয়ে বললাম,“আপনার সাথে জরুরি কথা আছে।”

উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,“শুনছি, বলে ফেল।”

বড়ো একটা দম নিয়ে বলে ফেললাম,“আফরা আপু আপনাকে পছন্দ করে।”

ওনার ভেতর কোনো রিয়েকশন দেখা গেল না। এমনকি আমার দিকে তাকালেনও না। স্বাভাবিকভাবেই বললেন,“হয়ে গেছে তোর জরুরি কথা বলা?”

বুঝলাম উনি বিষয়টাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছেন না। আফরা আপুর মতো এত সুন্দরী একটা মেয়ে পছন্দ করে শুনলে অন্য ছেলেরা এতক্ষণে কত এক্সাইটেড হয়ে যেত। অথচ এনাকে দেখো, ভাব দেখাচ্ছে। নিজেকে কোন রাজ্যের রাজকুমার ভাবে আল্লাহ্ জানে। আমি আবার বললাম,“আপু কিন্তু আপনাকে সত্যিই অনেক পছন্দ করে। অনেক মানে অনেক বেশি।”

উনি পূর্বের ন্যায় বললেন,“হ্যাঁ, শুনেছি। এবার তুই যেতে পারিস।”

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,“আপনি কিছু বলবেন না এ বিষয়ে?”

এবার উনি ল্যাপটপ থেকে চোখ উঠিয়ে কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। তারপর উল্টা প্রশ্ন করলেন,“আমার কিছু বলা উচিত না-কি?”

আমি বললাম,“অবশ্যই।”

উনি কিছু একটা ভেবে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমার সামনে এক হাত পেতে বললেন,“চুড়ি জোড়া দে।”

আমি অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আবার বললেন,“কী হলো? দে।”

আমি প্রশ্ন করলাম,“কেন?”

“আফরাকে দেবো। তুই না বললি ও আমাকে পছন্দ করে আর আমার এ বিষয়ে কিছু বলা উচিত? তো মুখে না বলে কাজে দেখানোটাই বেশি ভালো হবে, তাই না? তাই ভাবলাম চুড়ি জোড়া ওকে পরিয়ে দেই। তাড়াতাড়ি খোল।”

ওনার কথা শুনে আমার মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। চুড়ি জোড়া আমার একটু বেশিই পছন্দের। এগুলো দিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উনি যদি আফরা আপুকে পছন্দ করেন তাহলে এগুলো তো আফরা আপুরই প্রাপ্য। আমাকে তো উনি এমনি এমনি দিয়েছিলেন। তাই মন খারাপ হলেও ফেরত তো দিতেই হবে। এসব ভেবে মুখটা অন্ধকার করে চুড়ি খুলতে লাগলাম। তখনই তাজ ভাই হঠাৎ আমার দুহাতের কব্জি চেপে ধরে আমার কিছুটা কাছে এগিয়ে এলেন। ওনার এহেন কাজে আমি হকচকিয়ে গেলাম। ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললাম। উনি শক্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি কাঠ কাঠ গলায় বললেন,“একবার যখন বলেছিলাম কখনও যেন এগুলো হাত থেকে খুলতে না দেখি, তখন খোলার চেষ্টাও করবি না। এমনকি আমি বললেও না।”

আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“আপনি নিজেই তো খুলতে বললেন।”

উনি এবার ধমকে উঠে বললেন,“বললাম না আমি বললেও কখনও খুলবি না।”

ওনার ধমকে আমি কেঁপে উঠলাম। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে বকেনি। আমি মুখটা ছোটো করে ভয়ে ভয়ে বললাম,“বকছেন কেন এভাবে?”

উনি এবার আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালেন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আমার দিকে না তাকিয়েই ঠান্ডা গলায় বললেন,“যেটা বলেছি সেটা যেন মনে থাকে। আর আফরাকে নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। পিচ্চি মানুষ, এত বড়োদের বিষয়ে আগ্রহ কেন? রুমে যা।”

আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ ওনার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজের রুমে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে বাঁ হাতের কব্জির দিকে তাকালাম। শয়তানটা এত জোরে চেপে ধরেছে যে চুড়ির ঘষায় কব্জির একপাশে ছিঁলে লাল হয়ে গেছে। ওনার ওপর প্রচন্ড রাগ উঠে গেল আমার। এমন ফালতু রাগের কোনো মানে হয়? আমি কী এমন করলাম যে এমন রাগ উঠে গেল। নিজেই তো বলল চুড়ি দিয়ে দিতে। আবার নিজেই বলছে উনি বললেও যেন না খুলি। আসলে উনি কী বলেন, কী করেন তা বোধ হয় উনি নিজেই বোঝেন না। অযথা আমার ওপর চটে গেলেন। ধুর! জলজ্যান্ত রাক্ষসটার জন্য আমার শান্তি মনে হয় আমার থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। কবে যে শয়তানটা দেশ ছেড়ে যাবে, আর কবে আমার শান্তি ফিরবে আল্লাহ্ জানে।

চলবে……………………🍁

(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)