তুমিময় নেশা পর্ব-০৫

0
118

#তুমিময়_নেশা (৫)

চোখ মেলতেই অদ্ভুতভাবে শিহরিত হলো অদ্রি’র সমস্ত শরীর। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাত্র কিছু সময়েই! ট্রেনের হুইসেল বেজে গিয়েছে। অথার্ৎ ট্রেন চলছে। অদ্রি’র দু চোখে ঘুম। ক্লান্ত শরীর। কতদিন পর আবার শহরে যাচ্ছে। সেই যে বাবার সাথে এল তারপর আর যাওয়া হয় নি। সময় চলে গিয়েছে মাস খানিক। বাইরে রাত্রি নেমে এসেছে। সেই সাথে বাড়ছে ঠান্ডা হাওয়া। ইষৎ শীত অনুভব হলো অদ্রি’র। মনে হচ্ছে একটা শক্তপোক্ত ব্যথা গলা দিয়ে নেমে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরেই এমনটা হচ্ছিল। তবে সে পাত্তা দেয় নি। বোধহয় এবার জ্বর এসেই গেল। অদ্রি সিট থেকে নেমে স্যুটকেস থেকে মোটা একটি চাদর নামিয়ে নিল। তারপর পুরো শরীরে জাপটে দিয়ে চোখ বুঝল। তবু তার শীত কমল না। বেশ কিছু সময় যেতেই মনে হলো পুরো ট্রেন ভীষণ নীরব। একটা পাখির আওয়াজ ও নেই। তবে ঘুমের চোটে চাওয়ার মতন শক্তি টুকু পেল না। পুনরায় ওর ঘুম ভাঙল মাঝ রাতের দিকে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে জল। তবে ওর ঠিক বরাবর একজন ব্যক্তি ভীষণ মনোযোগে বই পড়ছে। একপাশটা দেখে অদ্রির মনে হলো লোকটা ওর পরিচিত। তাই কেমন কৌতূহল জাগল। তবে উঠে এসে জিজ্ঞাসা করার মতন পরিস্থিতি নেই। পাশে যদি ঝামেলা হয় সেই ভয়ে! তাই বার বার উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সব টুকু চেষ্টা দিয়ে আড়ালে আবডালে মানুষটার মুখশ্রী দর্শন করার প্রয়াস করল। তবে পারল না। লোকটার আপাদমস্তক বইয়ের আড়ালে। জ্বর হওয়া শরীর নিয়ে অদ্রি আর চেয়ে থাকতে পারছে না। কোনো মতে ব্যাগ থেকে ঔষধ বের করে খেয়ে নিল। তার কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল অদ্রি নিজেও জানে না। ওর ঘুমটি ভাঙল ভোরের দিকে এক পুরুষ কণ্ঠে। অদ্রি চাইল। দেখতে পেল মুখশ্রী।

“ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে গেছে।”

বাক্যটি শেষ হতেই ধড়মড়িয়ে ওঠল অদ্রি। ছেলেটা তখন নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। অদ্রি একটু জড়ো কণ্ঠে বলল,”আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি?”

অদ্রির প্রশ্নটা বড়ো অদ্ভুত। ছেলেটা হেসে বলল,”আমাকে দেখেছেন কী না সেটা তো আপনিই বলতে পারবেন। আমি কেমন করে বলব বলেন?”

বুদ্ধিমতী অদ্রি কেমন লজ্জা পেল। আজকাল তার মাথাটা গেছে। এই ব্যাপারটা ঘটছে শুভ নামক মানুষটা জীবনে আসার পর। তারপর বৃদ্ধি ঘটল রাগীবের সাথে দর্শনের পর। এর থেকেই ওর সমস্তটা কেমন গুলিয়ে আসে। মনের ভেতর একাধিক সংশয় তৈরি হয়। ও একটা শ্বাস নিয়ে বলল,”না, আসলে আমি খেয়াল করতে পারছি না।”

জবাবের বিপরীতে পুরুষটির তরফ থেকে কোনো জবাব মিলল না। অদ্রি তার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে যেই না পথ চলবে ওমনি ব্যক্তিটি ডেকে ওঠল।

“অদ্রিতা, আপনার পানির বোতল।”

ব্যক্তিটির মুখে নিজের নাম শুনে যারপরনাই বিস্মিত হলো অদ্রি। তারপর হয়তো কিয়ৎ সেকেন্ড অতিবাহিত হয়েছে। অদ্রি চুপ। ওর মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত।

“কি হলো?”

“একটু আগে কী বললেন?”

“কী বললাম?”

“আমার নাম ধরে ডাকলেন? আপনি অদ্রিতা বলে ডেকেছেন?”

ছেলেটা যেন পালাতে চাইল। ওর হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে চট করেই নেমে গের। অদ্রি পুরোপুরি দ্বিধায় পড়ল। ছেলেটাকে চেনা মনে হতে লাগল। ওর মস্তিষ্ক যখনই বিষয়টা ভাবতে যাবে তখনই ফোনটা বেজে উঠল। শুভ নামক প্যারা আবার কল করেছে!

“হ্যালো অদ্রি, আপনি কী পৌছে গেছেন?”

“শুভ, আপনি কেন বার বার কল করেন আমায়?”

“কারণটা আপনার জানা।”

“জানা নয়। আপনি বুঝতে পারছেন না বিষয়টা কত খারাপ হচ্ছে। আর আপনি কেন দেশে পড়ে আছেন? কেন ফ্লাইট মিস দিচ্ছেন বার বার।”

শুভ কথা বলল না। অদ্রির খারাপ লাগছে। সে কখনো চায় না তার জন্য কেউ কষ্ট পাক। ও নিজের দুঃখটুকু লুকিয়ে বলল,”শুভ, আপনাকে আমার কসম দিলাম। আর কখনো কল করবেন না আমায়। কখনো না।”

বাক্যটি শেষ করেই কল কেটে দিল অদ্রি। শুভ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ফোনের দিকে চেয়ে রইল কিয়ৎকাল। তারপর হুট করেই দু চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনা জল নেমে গেল। অস্পষ্ট সুরে আওড়াল,”অদ্রি, এত চেয়েও কেন আপনাকে ভুলতে পারছি না আমি? এ কেমন নেশা হলো আমার?”

শুভ প্রশ্ন করল তো ঠিকই। তবে উত্তর দেবার মতন কেউ কী আছে? উহু নেই। শুভ’র প্রশ্ন, অনুভূতি, কিংবা দুঃখ সবটাই ওর একান্ত। এই একান্ত দুঃখের বিপরীতে কোনো উত্তর থাকে না।

বাড়ির ভেতর প্রবেশের জন্য অদ্রি এক পা এগিয়েছে মাত্র। ওমনি একটি কণ্ঠ ভেসে এল।

“ভীতু মেয়ে, আসার সময় হলো তবে?”

কণ্ঠটি একদম হৃদয়ে এসে লাগল অদ্রির। ও পা নামিয়ে ফেলল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সম্মুখে উপস্থিত হলো রাগীব। তার চোখে মুখে হাসির মেলা। অদ্রি হা হয়ে তাকিয়ে। রাগীব নামের পুরুষটি যেন আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছে।

“অদ্রি মা, এসেছো।”

রোকেয়া দোতলা থেকে নামতে নামতে কথাটি বললেন। অদ্রি মৃদু হেসে এগিয়ে গেল। একে অপরের আলিঙ্গন হলো।

“আপনি ভালো আছেন আন্টি?”

“হ্যাঁ মা ভালো আছি। তুমি এত লেট করলে যে?”

“বাড়িতে যাওয়ার পর একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। চোখে মুখে পানি দিয়ে আসো। এতটা জার্নি করলে…..”

অদ্রি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। রাগীব তখনো চেয়ে আছে। অদ্রি ও চাইল তার দিকে। ওমনি দুজনের চোখাচোখি হলো। রাগীব অদ্ভুতভাবে হাসল। অদ্রি ও লজ্জায় মাথাটা নুয়ে ফেলল।

তখন গভীর রাত। অদ্রি ঘুমিয়ে ছিল। হুট করেই একটা স্বপ্নে তার ঘুম ভে ঙে গেল। দু চোখ বিভ্রান্ত, আতঙ্কগ্রস্ত।

“ভালোবাসাটা কী আমার একার রাগীব?”

কথাটি বলেই কান্নায় ভে ঙে পড়ল অদ্রি। সে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছে। যেই স্বপ্নের কোনো আগা মাথা নেই। কেমন যেন। সমস্ত রাত অদ্রির দু চোখে ঘুম নেই। সে ঘুমাতে পারল না হাজারো চেষ্টা করেও। শেষমেশ রুম থেকে বেরিয়ে এল। পুরো বাড়ি ঘুরঘুর করে যেই না ফিরতে যাবে ওমনি রাগীবের ঘরের দরজাটি খুলে গেল। রাতের পোশাক পরা রাগীবের চেহারাটা মলিন। মলিন তো অদ্রির মুখশ্রীও। তবে দুজনেই কী একই বিষয় ভাবছে?

মাত্র তিনদিন। তিনদিন হলো অদ্রি আর রাগীবের সম্পর্কের। অদ্রি এখনো ভাবতে পারে না সে কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। কী আশ্চর্য! এমনটা সে তো স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। ভবিষ্যতেই বা কী হবে? এমন নানান কথাই ভাবছিল অদ্রি। রাগীব ড্রাইভ করছে। মেয়েটির অন্যমনস্ক ভাব অনুভব করে গাড়ি থামাল।

“কী হয়েছে?”

“হুম?”

“কী ভাবছো?”

“ভাবছি, কেমন করে তিনটে দিন পেরিয়ে গেল। আমি কাউকে ভালোবেসে ফেললাম ই বা কেমন করে। সবটা এত দ্রুত আর অবিশ্বাস্য যে….”

রাগীব হেসে মেয়েটির হাত টেনে নিল। চুমু খেল হাতের উল্টো পিঠে।

“সম্পর্ক নিয়ে খুশি নও?”

“এমনটা নয় রাগীব। বাট আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।”

“প্রথম সম্পর্কে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক না।”

অদ্রি কেবল হাসল। কিছু বলল না। রাগীব পুনরায় গাড়ি চালাচ্ছে। মৃদুমন্দ হাওয়া অনুভব হতেই দু চোখ বন্ধ করে রইল অদ্রি। ওর দিকে তাকিয়ে রাগীবের মনের ভেতর শত প্রজাপতি উড়ে যেতে লাগল।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি