তুমিময় নেশা পর্ব-০৪

0
118

#তুমিময়_নেশা (৪)

রাগীবের ঘরের লাগোয়া বারান্দাটা একটু বেশিই সুন্দর। বিশাল আর খোলা হওয়াতে এর সৌন্দর্য অধিক চোখে পড়ে। দুদিন ধরেই বারান্দার দিকে নজর যাচ্ছে অদ্রির। মেয়েটা একটা সংকোচ থেকে সে পথে আর যায় নি। তবে এই ভোর বেলায় লোভটা যেন সামলে উঠতে পারে নি। ভীষণ সুন্দর একটা ঘ্রাণ নাকে এসে ধরা দিচ্ছে। অদ্রি ছুটে গিয়ে নিজের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকে রাগীবের বারান্দাটা দেখা যায়। নানান রঙের ফুল রাখা সেখানে। অদ্রির মন ছুটে যেতে চাচ্ছে। ও বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেল। করিডোর পেরিয়ে আসতেই পায়ের গতি নেমে গেল। রাগীব জিম করে এসেছে। উন্মুক্ত শরীরে বিন্দু বিন্দু জলবিন্দু। অদ্রির মনে হলো তার শরীর কাঁপছে। চোখ ঘোলাটে হয়ে আসছে। সরে যেতে চাইলেই রাগীব ডেকে ওঠল।

“দাঁড়াও।”

থেমে গেল অদ্রির পদযুগল। রাগীব এগিয়ে এসে ওর বরাবর দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল,”এত ভোরে এখানে কেন?”

প্রশ্নের উত্তরটি চট করেই দিতে পারছে না অদ্রি। রাগীব কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে আশেপাশে তাকাল।

“কী? আমাকে খুঁজতে এসেছিলে?”

এবার প্রতিবাদ করল অদ্রি। দ্রুত সুরে বলল,”না তো।”

“তবে?”

“এমনি এসেছি।”

“বুঝি কিন্তু।”

“কী বুঝেন?”

“যা বোঝাতে চাও।”

“আমি? কখন কী বোঝালাম। আশ্চর্য তো।”

রাগীব কেবল হাসল। অদ্রি চেয়ে রইল। এই পুরুষটি তার দেখা সবথেকে অদ্ভুত মানুষের মধ্যে পড়ে।

টানা পড়াশোনা চলছে অদ্রি’র। মেয়েটার পরীক্ষা রয়েছে। তাই দম নেওয়ার ফুসরত নেই। রোকেয়া এসে নাশতা দিয়ে গেলেন। অদ্রির ভালো লাগায় বুক ভরে এল। মায়া নিয়ে তাকাল ও। মেয়েটার সেই দৃষ্টি দেখে হাসলেন রোকেয়া। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”সমস্যা হচ্ছে মা?”

“কিছুটা ভয় হচ্ছে আন্টি। আমার জীবনের ব্যাপার মনে হচ্ছে।”

“ছি মা, এই পরীক্ষাকে জীবনের সাথে তুলনা কেন করছো?”

“আন্টি ভয় হচ্ছে।”

“ভয় পেও না। ইনশাআল্লাহ সব ভালো হবে।”

অদ্রির মন ভরে ওঠল। রোকেয়া চলে গেলে পুনরায় পড়তে লাগল। কিছু সময় পর মা কে কল করে কথা বলে নিল। ভয়ের চোটে মেয়েটি কান্নাই করে দিল। ওপাশ থেকে সান্ত্বনা দিয়ে লুবনা বললেন,”যা হবে ভালোই হবে। চিন্তা করিস না। কাল তোর বাবা আসবেন।”

“ঠিক আছে মা।”

কল রেখেও বেশ কিছু সময় কাঁদল অদ্রি। পরীক্ষায় যাওয়ার আগে রোকেয়া এসে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিলেন। অদ্রির চোখ ভিজে এসেছে। এই মানুষটার প্রতি অদ্ভুত শ্রদ্ধা পাচ্ছে সে।

ড্রাইভারের হাত ভে ঙে ছে। অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটনা টা ঘটল। এদিকে অদ্রির লেট হচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে রীতিমতো। রোকেয়া বিষয়টা বুঝতে পারছিলেন। ঐ মুহুর্তেই বের হচ্ছিল রাগীব।

“রাগীব, শুনে যাও।”

গান শুনতে শুনতে বের হচ্ছিল রাগীব। মায়ের ইশারা পেয়ে কাছে এল।

“জি আম্মু?”

“কোথাও বের হচ্ছো? অদ্রির পরীক্ষা আছে। নিয়ে যাও।”

রাগীব যেন চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। রোকেয়া বললেন,”ড্রাইভারের হাত ভে ঙে ছে।”

“উফস! এই সময়েই এমনটা হতে হলো।”

“যাও, ওর লেট হচ্ছে।”

কথাটি বলেই অদ্রির দিকে চাইলেন রোকেয়া। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”যাও মা। রাগীব তোমায় পৌছে দিবে।”

তখন থেকে শুভ নামক মানুষটি কল করে চলেছে। অদ্রি বিরক্ত হচ্ছে। বার বার কল কেটে দিচ্ছে। তবে ওপাশের ব্যক্তিটি থেমে নেই। সে লাগাতার কল করে চলেছে। এবার অদ্রির রাগ হলো। তবে পাশে রাগীব থাকায় রাগটি প্রকাশ করতে পারল না। ও কল রিসিভ করে ফিসফিস করে বলল,”এত বার বার কেন কল করছেন শুভ?”

“আপনার পরীক্ষা আছে না?”

“আমি বিরক্ত হই শুভ। আপনি কেন বুঝেন না? আপনাকে আমার পছন্দ নয়।”

প্রথমবারের মতো শুভকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করল অদ্রি। শুভ কিন্তু কষ্ট পেল না। বিনিময়ে হেসে বলল,”তাতে কী?”

“আশ্চর্য মানুষ আপনি।”

“অদ্রি, আপনাকে আমার অনেক বেশি মনে পড়ে।”

অদ্রি থেমে রইল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। শুভ ওপাশ থেকে বলল,”ভালো করে পরীক্ষা দিবেন। আর মনে রাখবেন আপনি আমার।”

কলটি কেটে যেতেই রাগীব বলল,”বয়ফ্রেন্ড?”

অদ্রির শক্তপোক্ত জবাব। “না।”

রাগীব হাসল। সেই হাসিতে কেমন অপমান বোধ করল অদ্রি। দাঁত কামড়ে বসে রইল। কিছু সময় যেতেই রাগীব বলল,”তুমি বড়ো চালাক মেয়ে।”

“হঠাৎ এটা কেন বললেন?”

“একসাথে দুটো ছেলেকে ঘুরাচ্ছ।”

অদ্রির মাথায় যেন আকাশ ভে ঙে পড়ল। রাগীব হেসে চলেছে।

“ভয় পেও না। মজা করে বলেছি।”

“এটা কোনো মজার মধ্যে পড়ে না। আপনি এমনটা কেন বললেন?”

দুঃখে অদ্রির কান্না পেল। রাগীব গাড়ি থামিয়ে বলল,”এমনি বলেছি।”

“আপনি এমনি বলেন নি। অন্য কিছু মিন করছেন। আমাকে খারাপ ভাবে প্রেজেন্ট করলেন। অথচ বিষয়টা এমন নয়। এই যে ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি যে ছিলেন তার নাম শুভ। যে কী না আমার কেউ না। কেউ না মানে কেউ না। তাকে আমি পছন্দ করি না। একদম ই না।”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভে ঙে পড়ল অদ্রি। রাগীব বুঝল সে হয়তো কিছু ভুল করেছে। তবে দুঃখ প্রকাশের ফুসরত ও মিলে নি। তার আগেই গাড়ি থেকে নেমে গেছে অদ্রি। চোখের জল মুছে এগিয়ে চলেছে কেবল।

পরীক্ষা ভালো হয়েছে। অদ্রির মন কিছুটা ভালো। সে ফুরফুরে মেজাজে বের হতেই দেখল রাগীব দাঁড়িয়ে আছে। কেন যেন একটা অভিমান এসে চেপে ধরল ওকে। ও অন্য দিকে চলতে যাচ্ছিল। ওমন সময়ই মেয়েটির হাত স্পর্শ করল পুরুষটি।

“কোথায় যাও?”

“আপনাকে কেন বলব?”

“রাগ দেখাচ্ছ?”

“দেখাচ্ছি।”

“বাপ্রে! তোমার এত তেজ?”

তেজ কথাটি বলতেই অদ্রি ঘুরে তাকাল। রাগীব মিটিমিটি হাসছে।

“ছাড়েন, আপনি অনেক খারাপ।”

“জানি তো।”

“এভাবে হাত ধরে আছেন কেন?”

“ধরলে সমস্যা?”

“অবশ্যই সমস্যা। শুভ এসে আপনাকে ইচ্ছে মতন মা র বে।”

রাগীবের যেন হাসি পেল। সে অবশ্য হাসিটা লুকিয়ে রাখার প্রয়াস করল না। অদ্রি অন্য দিক ফিরতেই রাগীব শুধাল,”শুভ সাহেবের এত জোর?”

অদ্রি চুপ। রাগীব আর বিষয়টি ঘাটাল না। আলতো হাতে মেয়েটির চুল টেনে বলল,”সরি। আসো এবার।”

অদ্রি চুপ করে চলতে লাগল। পথে বেশ অনেক বার কথা বলার চেষ্টা করল রাগীব। তবে অদ্রি চুপ। আশ্চর্য আর অদ্ভুত লাগলেও কোনো এক অদৃশ্য টানেই পুরুষটির প্রতি গাঢ় অভিমান দেখাতে পারছে সে। অথচ বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে একদম ই স্বাভাবিক নয়।

পরেরদিন সকাল থেকে মন ভালো নেই অদ্রির। বাবা আসবেন নিতে। অথচ ওর মন যেতে চাইছে না। এই না যেতে চাওয়ার জন্য দায়ী রাগীব। ছেলেটার প্রতি অন্যরকম টান অনুভব হচ্ছে। কিন্তু এটাকে কী বলা যায় সেটা বুঝে আসছে না। এই নিয়েও ভীষণ ভাবে দ্বিধায় ভুগছে ও। কান্না পাচ্ছে। তবে সে উপায় নেই। সকাল থেকেই রোকেয়া ভীষণ যত্ন করে চলেছেন। একটু পর পর ই দেখতে আসছেন। রোকেয়া না থাকলে সত্যিই কেঁদে ফেলত ও। সবথেকে খারাপ লাগছে রাগীব নামের পুরুষটি চোখের দেখাও দিচ্ছে না। লোকটার অন্তরে একটু ও কী মায়া নেই? আবার একটা অভিমান জমল। অদ্রি দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে নিল। তখন বাজে এগারোটা। মুজাহিদ এসে পড়েছেন। অদ্রি ও তৈরি। কিন্তু রাগীব নেই। এবার সত্যিই কান্নায় চোখ ভিজে গেল ওর। ব্যাগ পত্র নিয়ে বলল,”আব্বু, তুমি এসো আমি সামনে আগাই।”

কথাটি শেষ করেই এগিয়ে গেল অদ্রি। কান্নায় তার চোখ ভেজা। লাল হয়ে আছে মুখটা। বের হতেই চোখ পড়ল রাগীবকে। ছেলেটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। তার পাশে আরেকটি বলিষ্ঠ পুরুষ। দুজন কথা বলছে। অদ্রির ইচ্ছে হলো ছুটে যেতে। তবে কোনো এক অদৃশ্য বল তার পদ যুগল টেনে ধরে রাখল। মুজাহিদ এলেন। শুরু হলো বিদায় পর্ব। অদ্রি গাড়িতে ওঠে বসেছে। রাগীব তখনো কাছে আসে নি। অদ্রির অভিমান আরো গভীর হলো। তবে পুরুষটিকে দেখার লোভ সামলাতে পারল না। তবে যখন চাইল তখন রাগীবকে দেখা গেল না। তার পরিবর্তে দেখা মিলল রাগীবের বন্ধু রাজবি’র।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি