তৃ-তনয়া পর্ব-০৫

0
545

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
দুইবোন একসাথে ভার্সিটিতে এসেছে। নাহিদাকে রাতেই পঞ্চাশ টাকা দেনা পরিশোধ করতে হয়েছে। ভার্সিটি আসার পথেও সারা রাস্তা তা নিয়েই বকবক করতে করতে এসেছে দুই বোন। নাফিসা তার ফ্রেন্ডের সাথে একদিকে চলে গেলো আর নাহিদা তার ক্লাসের দিকে যেতে লাগলো। হঠাৎ এক মেয়ে এসে নাহিদাকে বললো,
– আপু একটা কথা ছিলো।
– জ্বি, বলো?
– এইটা একজন দিয়েছে তোমাকে। এই নাও ধরো…
– কি এটা!
মেয়েটি নাহিদার হাতে ছোট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে গেলো! নাহিদাকে কিছু বলার সু্যোগই দিলো না! নাহিদা মেয়েটার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো! তারপর চিরকুটটা ফেলে দিতে গিয়েও দিলো না। ভাবলো, কি আছে এতে দেখে নেওয়া যাক! নাহিদা তার ক্লাসের দিকে না গিয়ে ক্যানটিনের পাশে জনশূন্য জায়গায় দাড়িয়ে চিরকুটটা খুলে দেখলো,
” ভালোবাসা কি তাকে বলে, যদি জ্যোছনা উপভোগ করতে গিয়েও প্রিয় মানুষকে উপভোগ করা হয়!
ভালোবাসা কি তাকে বলে, যদি একলা পথে চলতে গিয়ে পাশে প্রিয় মানুষকে অনুভব করা যায়!
ভালোবাসা কি তাকে বলে, যদি বাতাসে প্রিয় মানুষের সুবাস পাওয়া যায়!
যদি উক্তিগুলো ভালোবাসার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে আমি তোমায় খুব ভালোবাসি নাহিদা। খুবের চেয়েও ভীষণ ভালোবাসি! ভাবনাও তোমায় নিয়ে ভাবি, স্বপ্নও তোমায় নিয়ে সাজাই! তুমি হাত বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করলে ইচ্ছেগুলোও তিলে তিলে তোমায় নিয়ে গড়বো!”
নাহিদা কাগজটা মুঠোয় মুচড়ে ফেললো। অত:পর ক্লাসে চলে গেলো। ফ্রেন্ডের সাথে ফার্স্ট বেঞ্চিতেই বসলো। একটু পরেই আশিক প্রবেশ করলো ক্লাস রুমে। নাহিদার সামনে দিয়েই যাচ্ছিলো, নাহিদা তাকাতেই বললো,
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ।
– লাস্ট ক্লাসে এসেছিলে?
– হুম।
– ছুটির পর একটু নোট গুলো দিও তো।
– আচ্ছা।
আশিক চলে গেলো অন্যপাশে। নাহিদা আজ সবগুলো ক্লাস করেছে, আশিকও করেছে সব গুলোই। ক্লাস শেষে বের হতে যাবে এমন সময় আশিক বললো,
– নোট গুলো দিবে না?
– ওহ্! হ্যাঁ।
– ক্যানটিনের দিকে যাওয়া যাবে?
নাহিদা কিছু একটা ভেবে ফ্রেন্ডদের চলে যেতে বললো আর সে আশিকের সাথে ক্যান্টিনে চলে এলো। আশিক বললো,
– বসো, আমি কফি অর্ডার করি।
– না, ভাইয়া। প্রয়োজন নেই।
– তাহলে লাচ্চি খাবে?
– কিছু না।
– আরে, বসো। আমি আসছি।
আশিক গিয়ে দুইটা লাচ্চি নিয়ে এলো। নাহিদা নোট বের করে দিলো। আশিক নোট করতে করতে বললো,
– নাহিদা, তোমাকে কিছু বলার ছিলো।
– জ্বি, বলুন?
– রাগ করবে না তো তুমি?
নাহিদা তার কথায় জবাব না দিয়ে পার্স থেকে মোড়ানো চিরকুট দুটি বের করে আশিকের সামনে টেবিলে রেখে বললো,
– এগুলো নিয়েই তো বলবেন, তাই না?
আশিক চিরকুট দেখে মাথা তুলে নাহিদার মুখের দিকে তাকালো। নাহিদা স্বাভাবিক ভাবে বললো,
– আপনি দিয়েছেন না এগুলো?
– হ্যাঁ।
– আজকের পর থেকে আর এসব দিবেন না।
– ভালোবাসি নাহিদা।
– প্লিজ ভাইয়া! আপনি দ্বিতীয়বার এমন কিছু উচ্চারণ করবেন না। আর আমাকে নিয়ে এতো ভাবনা ভাববেন না, চিরকুটও লিখবেন না। দেখুন আমি এসবে কখনো পা রাখিনি আর রাখবোও না। এটা একটা প্রতিজ্ঞাই ধরে নিতে পারেন। আপনি জানেন আমার সম্পর্কে, আমার পরিবার সম্পর্কে। আমি আমার পরিবারের অসন্তুষ্টিতে এমন কোনো কাজ করতে পারবো না কখনো! আমি ব্যক্তিগতভাবেও অপছন্দ করি এগুলো। একমাত্র শরীয়ত মতে সম্পর্ক গড়ে তোলাই আমার কাছে উত্তম। আমার বাবা-মা ও আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে।
– নাহিদা, আমি শরীয়তের বাইরে যেতে চাইছি না। তোমার ইচ্ছাতেই আমি উত্তম সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাবো। পরিবারে জানানোর আগে তোমার মতামতটা জানতে চাইছি।
– দুঃখিত! আমি আপনার প্রস্তাবে মতামত রাখতে পারছি না। সেই ছোট থেকে আজও বাবা-মায়ের পছন্দ ছাড়া এক জোড়া জুতাও কিনি না! সেখানে লাইফ পার্টনার কিভাবে পছন্দ করি! বাবা-মা দিয়েছে স্বাধীনতা, তাই বলে উশৃংখল ভাবে চলবো সেটা কিন্তু না। বাবা-মায়ের আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত আমরা তিন বোন। উনাদের পছন্দের বাইরে এক পা রাখারও সাধ্য রাখি না। তাছাড়া, আপনার সাথে আমার কোনোভাবেই যায় না! সমবয়সী কিংবা সহপাঠীর সাথে বন্ধুত্ব করা যায় কিন্তু জীবন কাটানো যায় না। একটা ছেলে ও একটা মেয়ের মধ্যে বন্ধন গড়ে তুলতে হলে তাদের বয়সেরও একটা লক্ষ্যনীয় ব্যাপার আছে।
– আমি তোমার চেয়ে প্রায় দু বছরের বড়!
– বয়সের পার্থক্য পাচ থেকে সাত বছর হওয়াটা স্বাভাবিক। তার বাইরে বেমানান! দয়া করে আমাকে এ নিয়ে আর বিব্রত করবেন না ভাইয়া। আমি এটাও চাই না, আপনি আপনার কিংবা আমার পরিবারকে জানান সেটা! আপনি সম্পর্কে আমার বোনের দেবর, অন্যদিকে সহপাঠী। আশা করি সম্পর্ক রাখতে হলে বন্ধুত্ব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবেন। আমার আপুও যেন কোনোভাবে এসব ব্যাপারে না জড়ায়। তাহলে ঝামেলার সৃষ্টি হবে।
– নাহিদা, কোনো ঝামেলা হবে না। ট্রাস্ট মি, আমি সুশৃঙ্খল ভাবে সবটা সামলে নিবো।
নাহিদা চেয়ার ছেড়ে উঠে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
– আরাফ ভাইয়া বয়সে আপনার চেয়ে কয়েক বছরের বড়, মেধার দিক থেকেও বড়। পরিবারের ভাইয়ার একটা ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি আপনার পরিবারকে সামলাতে পারেনা। সেখানে, আপনি ভিত্তিহীন হয়ে কিভাবে! এসব দুরাশা করে লাভ নেই। আমিও থাকছি না আপনাকে সাপোর্ট করার জন্য। ভুলে যান এসব দুঃস্বপ্ন! নোট করে রাখুন, কাল নিয়ে নিবো। আর এটা পড়ার জন্য, কোনো চিরকুটের নোট না।
কথাটা বলে নাহিদা বেরিয়ে গেলো ক্যান্টিন থেকে। আশিক হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে নাহিদার যাওয়ার পানে। টেবিলে রাখা আছে অর্ধেক খাওয়া দুটো লাচ্চি! আশিক নাহিদার লাচ্চিটা সামনে টেনে নিলো। মুখে নিতে গিয়েও থেমে গেলো। নলটা তুলে উল্টো করে তারপর মুখে দিলো। লাচ্চির কথা মনে হতেই নাহিদা লাচ্চি নিতে আবার ক্যান্টিনে চলে এলো। কিন্তু ভেতরে আর প্রবেশ করতে পারলো না দৃশ্যটা দেখে! আশিক তাকে দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– চিন্তা করো না। আমি তোমার মুখ লাগানো অংশে মুখ লাগাই নি। উল্টে নিয়েছি।
নাহিদা বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। খুব রাগ হচ্ছে আশিকের উপর! এমন কেন করছে ছেলেটা! এই মাত্র না তাকে বুঝিয়ে এলো! মস্তিষ্কে কি ধরেনি কথাগুলো! অযথা শুধু শুধু কার সাথে বকবক করে এলো! ছি! কিভাবে পারলো কারো অর্ধেক খাওয়া লাচ্চিটা খেয়ে নিতে!
তেজে একের পর এক কদম ফেলে হাটছে সে। হঠাৎ করেই যেন তার সামনে বিকট শব্দ করে এক হিংস্র দানব এসে দাড়ালো!
“ভাও!”
নাহিদা ভয় পেয়ে বুকে থু থু দিলো। অত:পর নাফিসার কাধে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
– ডাইনোসর! আরেকটু হলে তো আমি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেতাম!
নাফিসা হাসতে হাসতে বললো,
– এজন্যই তো একটুখানি কমতি রাখলাম! দিনের বেলাও এতো ভয় পাও! হিহিহি…
– স্টুপিড!
– জানি! তা এমন তারাহুরো করে কোথায় যাচ্ছিলে শুনি!
– তোর ক্লাসের দিকেই তো যাচ্ছিলাম!
– আমি তো বারান্দায় তোমার অগ্রগামী পথেই দাড়িয়ে ছিলাম! তা-ও চোখে পড়লো না! এমন ভাবে হাটছিলে যেন গার্মেন্টস কর্মী তুমি! গার্মেন্টসের কাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাই অনবরত হেটেই চলেছো, হেটেই চলেছো!
– গার্মেন্টস কর্মী আমি! দাড়া!
নাফিসা দৌড়ে মাঠে নেমে হাসতে লাগলো। নাহিদা ব্রু কুচকে বললো,
– পাবনার পাগল একটা! বাড়ি চল!
নাফিসা দু গজ দূরত্ব বজায় রেখেই গেইটের দিকে হাটতে হাটতে বললো,
– কোন বাড়ি? পাবনা?
– হ্যাঁ, সাবানা! তোমাকে পাবনার বাড়িতেই পাঠানোর ব্যবস্থা করছি!
– খবরদার! মায়ের প্রিয় নায়িকা সাবানা। নানিকে নিয়ে নো দুষ্টুমি!
– তোর কোন সম্পর্কে নানি হয়, সেটাই তো বুঝলাম না!
– মাকে একবার সাবানা খালা বলতে শুনছিলাম! সেই সূত্রে মায়ের খালা আমার নানি!
নাফিসার কথা শুনে নাহিদা নিচু শব্দতেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। হঠাৎ করেই আশিক দৌড়ে এসে তাদের সমানতালে হাটতে হাটতে বললো,
– আহ! চিরল দাতের হাসি আমি খুব ভালোবাসি। ভদ্র মেয়েদের হাসলে খুব সুন্দর লাগে। সবসময় এমন হাসিখুশি থাকবে, বুঝলে। হাসলে মন ভালো থাকে আর মন ভালো থাকলে শরীর সুস্থ থাকে।
আশিক দুজনকে শুনিয়ে বললেও কথাগুলো নাহিদার উদ্দেশ্যে বলেছে সেটা খুব ভালোই বুঝতে পেরেছে নাহিদা। এদিকে হুট করেই আশিককে দৌড়ে এসে তাদের সাথে হাটতে হাটতে কথা বলতে দেখে নাফিসা আশিকের দিকে তাকালো। নাফিসাকে তাকাতে দেখেই আশিক তার বলা কথার প্রেক্ষিতে বললো,
– এটা আমার কথা না তো, নাফিসার বলা কথা। তাই না নাফিসা!
– আমার বলা কথা আপনি বলছেন কেন!
– স্মরণে রাখার জন্য! যাতে সবসময় নিজে ভালো থাকতে পারি অন্যকে ভালো রাখতে পারি।
– গুড। আপনি আমাদের সাথে কোথায় যাচ্ছেন?
– কেন, তোমাদের বাসায় যেতে চাইলে নিবে না?
– যেতে পারেন কিন্তু নিতে পারবো না।
– মানে!
– মানে, প্রয়োজনে বা বেড়াতে গেলে আগে-পরে যেতে পারেন কিন্তু আমাদের সাথে যেতে পারবেন না।
– আচ্ছা, ভয় পেয়ো না। যাবো না।
– ভয়! আপনাকে! হুহ্!
আশিক হাসতে লাগলো নাফিসার কথায়। এদিকে আশিককে এমন ইঙ্গিতে কথা বলতে শুনে নাহিদার একটুও ভালো লাগছে না। তাই জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে নাহিদা বললো,
– ভাইয়া, তাহলে আমরা আসি। আল্লাহ হাফেজ।
– দেখা না হতেই আল্লাহ হাফেজ! এখনো তো গেইট পর্যন্তই গেলাম না! যাইহোক, অপ্রয়োজনে আসিনি। এই নাও, তোমার নোট।
– আপনার নোট করা শেষ?
– ছবি তুলে নিয়েছি। পরে করে নিব। সাবধানে যাও। আল্লাহ হাফেজ।

চলবে।