তৃ-তনয়া পর্ব-১০+১১

0
502

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়া আরাফের বুকে মাথা রেখে শুয়ে বললো,
– একটা কথা বললে রাখবে?
– কি?
– রাগ করবে না তো?
– বলো।
– পড়াশোনা করে তো বেকারই বসে আছি। একটা চাকরি যোগাড় করে দাও। অন্তত শিক্ষাটা কাজে লাগাই।
– মাথা খারাপ! তুমি উপার্জনে নামবে!
– তো কি হয়েছে! মেয়েরা করে না চাকরি!
– অন্যদের সাথে তোমার তুলনা না। সারা সংসার সামলানোর ভার মাথায় তুলে নিয়েছো! সকালে ঘুম থেকে উঠে লেগে যাও আর শেষ হয় রাত এগারোটা বারোটা! চাকরি করার সময় তুমি কোথায় খুজে পাও!
– তখন কাজ একপাশে চাপিয়ে নেওয়া যাবে।
– সারাদিন কাজকর্মে লেগে থেকে এমনিতেই তোমার শরীর দুর্বল! তারউপর চাকরি করতে দেই আর তুমি পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে যাও! এতোটা পাগল আমি হই নি! মাস্টার্সে ভর্তি হতে বলেছিলাম, হওনি। আগামী বছর চাইলে ভর্তি হয়ে যেও। পড়াশোনা করতে নিষেধ করবো না।
– না, থাক। লাগবে না।
– মন খারাপ করছো কেন! মানুষের মস্তিষ্ক বলেও তো একটা কিছু আছে! কত চাপ সহ্য করতে পারে এইটুকু মস্তিষ্ক! অতিরিক্ত চাপে মানুষের স্ট্রোক হয়ে যায়! আমি তোমাকে হারাতে চাই না কোনো ভাবে। যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো। পারলে সংসারের কাজ থেকেও একটু চাপ কম নাও। নিজের শরীর মনেরও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। তোমার খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো চলে না সেটা আমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে।
– হয়েছে মাস্টার মশাই। অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেলছেন একসাথে! বেশি খেলে আবার বদ হজম হয়ে যাবে! একটু কম কম করেই গিলতে দিন।
আরাফ হেসে নাজিয়ার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বললো,
– আরোহীর আম্মু?
– হুম?
– গতকাল রাতে ফরহাদ স্যারের জমজ বাচ্চা হয়েছে।
– আলহামদুলিল্লাহ। সুস্থ আছে সবাই?
– হুম। আমরা নতুন মেহমানদের আনবো কবে?
নাজিয়া আরাফের বুকের লোম গুলোতে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
– এখন কি বেবি নেওয়া ঠিক হবে! এমনিতেই এক ঝড় গেলো পরিবারের উপর! আবার আয়াতের বিয়ের সমন্ধ আসছে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে তো এমনিতেই কতো টান পড়বে! তাছাড়া বাচ্চা নিলেও তো বাচ্চার জন্য সব দিক থেকে প্রিপেয়ার থাকতে হবে!
– হুম, তা তো হবেই। তবুও তো বাচ্চা আসতে মোটামুটি অনেক সময়ের ব্যাপার। হয়ে যাবে না সবটা প্রস্তুত?
– আমার মনে হয় একটু স্বচ্ছলতায় এগিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সবদিকই বিবেচনায় আনতে হবে। ভেবে দেখো তুমি। তোমার সিদ্ধান্তেই আমি মত পোষণ করবো।
– ওকে, পরেই প্ল্যান করবো। এবার একটু ঘুমাও। রাত অনেক হয়েছে।
.
লোকজনের দেনাপাওনা সব পরিশোধ করা হয়েছে সাথে দোকানটাও বেচে দিয়েছে আলফাজ সাহেব। কেননা এটা নিয়ে চলা যাবে না। ছেলেদেরকে তার জন্য অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে! আর কষ্ট দিতে পারবে না। ছেলেরা উপার্জন করে দুমুঠো খাবার মুখে তোলার জন্য দিলে খাবে আর না হয় না খেয়ে মরে যাবে। তবুও আর লোকসানের ঘানি টানতে পারবে না। তাই ঋণ পরিশোধ করা সত্ত্বেও বিক্রি করে দিলো। তবে দোকান বিক্রির টাকা সঞ্চিত রাখা হয়েছে। অন্যান্য কাজে লাগাতে পারবে। আপাতত কোনোমতেই চালিয়ে নিচ্ছে সংসার। গত দেড় মাসে যা অবস্থা হয়েছে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কে জানে কতদিন লাগবে! বিপদ কি আর আসতে দেখা যায়! আসে আচমকা ঝড়ের মতো বেগে আর যায় কচ্ছপের ন্যায় ধীর পায়ে! ক্লান্তির ছাপ ফেলে অর্ধেক লাশ বানিয়ে তারপর না অবসান ঘটে দুঃখের!
আজ দুপুরের পর ঘটক আয়াতের জন্য আরেক সমন্ধ নিয়ে এসেছে। কেননা আয়েশা বেগমের তাড়া মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের সদস্য কমানোর! একজন কমলে একজনের খরচই কমবে। এমনিতেই সংসার ডুবে আছে কাদার নিচে! কে জানে উদ্ধার পাবে কিনা! এটা আয়েশা বেগমের ভাবনা!
আজ নাজিয়া মেহমানদের সামনে যায়নি। খাবারদাবার সব গুছিয়ে দিয়েছে আর আয়েশা বেগম নিয়ে গেছেন মেহমানদের সামনে। ছেলেপক্ষ মোটামুটি পরিচিতই তাদের। কেননা আরাফের বাসা থেকে দূরে না বেশি ছেলেদের বাসা। লোকজন যখন ঘরে প্রবেশ করছিলো, নাজিয়া কিচেনে থেকেই দেখেছিলো তাদের। এখানে ছেলে এসেছে কিনা ভাবা মুশকিল! একজন বয়স্ক মহিলা ও একজন বয়স্ক পুরুষ। সাথে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ! ঘটকসহ তিনজন পুরুষের মুখেই পান খাওয়ার ছাপ দেখা গেছে!
মেহমান মেয়েকে দেখে কথাবার্তা বলে চলে গেলো। আরাফ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে নাজিয়াকে ডেকে এক গ্লাস শরবত চাইলো। ওদিকে আলফাজ সাহেব নিজের ঘর থেকে আরাফকে ডাকলে আরাফ নাজিয়াকে শরবত বাবার ঘরে নিয়ে যেতে বললো এবং সে বাবার কাছে চলে এলো। আলফাজ সাহেব দুপুরে আসা মেহমানদের কথা বলছে আরাফের কাছে। আয়েশা বেগমও পাশে বসে আছে। নাজিয়া লেবুর শরবত এনে আরাফের হাতে দিয়ে আলফাজ সাহেবকে বললো,
– বাবা, আপনার জন্য আনবো এক গ্লাস?
– না। তুমিও বসো কথা আছে।
নাজিয়া চেয়ার টেনে বসলো। আলফাজ সাহেব আরাফ ও নাজিয়ার উদ্দেশ্যে ছেলের পরিবার সমন্ধে বললেন। নাজিয়া জিজ্ঞেস করলো,
– বাবা, আজ কি ছেলে এসে দেখে গেছে আয়াতকে?
– হ্যাঁ। ছেলের পরিবার পরিচিতই। আয়াতকে পছন্দ হয়েছে। জমিজমা ভালোই আছে। তোমার আম্মা রাজি এখানে বিয়ে দিতে। তোমরা কি বলো?
হুট করেই দরজার সামনে থেকে আয়াত বলে উঠলো,
– আম্মা রাজি হলেই কি হবে! যাকে বিয়ে দিবা তার মতামত নিয়েছো! আমি নিজেই রাজি না। করবো না বিয়ে!
আয়েশা বেগম ধমকে বললো,
– তোর কিসের মতামত নিতাম! আমার বিয়ের সময় কি বাপ মা আমার মতামত নিয়া বিয়ে দিছে! নিজের পছন্দ হইছে দিয়া দিছে! বড়দের কথার মাঝে বেশি কথা বলবি না। চুপচাপ নিজের ঘরে যা, আর পড়াশোনা কর। আর একটা কথাও যাতে না শুনি!
আয়াত রেগে চলে গেলো সেখান থেকে! আরাফ বিয়েতে রাজি না। তবুও বাবামায়ের উপর সরাসরি বলতে পারছে না। সে বয়সের অযুহাত দিলে আয়েশা বেগম উল্টো বুঝিয়ে দিলো সংসারের টান। তাছাড়া আয়াতের মেধা তেমন ভালো না। রেজাল্ট ভালো হয় না, এই পড়াশোনা দিয়ে কি করবো! নাজিয়া আগেই চলে এসেছে সেখান থেকে। পরে আরাফ রুমে এলে নাজিয়া বললো,
– আয়াতের বিয়ে কি সেখানেই দিবে?
– হয়তো!
– মেহমান যখন এসেছিলো কিচেনে থেকে তখন দেখেছিলাম। ভালো মনে হয়নি! বুড়ো লোকের মতো পান খায়। তাছাড়া আয়াতের তুলনায় অনেক বয়স্ক মনে হয়েছে!
– হুম, চিনি আমি তাদের। আমারও ভালো লাগছে না। ছেলেটা আমার চেয়েও কয়েক বছরের বড়। পড়াশোনাও করেনি, বাবার ব্যবসা সামলায়! যাইহোক, দেখি বাবা মা কি করে।
পরদিন আরাফের বাবা মা ছেলেদের বাড়ি দেখে এলো। আয়েশা বেগমের খুব পছন্দ হয়েছে। বাড়িটা তাদের বাড়ি থেকে বড়। টাকা পয়সা আছে। তিনি ঘটককে বিয়ের কথা এগিয়ে নিতে বললেন। শুক্রবারে ঘটক এলো তাদের বাড়িতে। আরাফ বাড়িতেই আছে। আলফাজ সাহেবের ঘরে বৈঠকে বসলো তারা। নাজিয়া হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করেছে তাদের জন্য। ঘটক জানালো ছেলে পক্ষ দাবি করেছে আসবাবপত্র দিয়ে তাদের ঘর সাজিয়ে দিতে হবে আর নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। এতো বড়সড় দাবি শুনে আরাফের পাশাপাশি আলফাজ সাহেবও অমত পোষণ করলেন। আলফাজ সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে আয়েশা বেগম জানতে চাইলো দাবি একটু কমানো যায় কিনা। কমানো গেলে তারা বিয়ে দিয়ে দিবে। এদিকে আয়াত বাইরে থেকে তাদের কথাবার্তা শুনে ভেতরে এসে বললো,
– মা, এইসব বন্ধ করবা! আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো!
আয়েশা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললো,
– যাবি এখান থেকে! নয়তো জুতা দিয়া কপালে মারমু! বড়দের কথার মাঝে কথা বলতে না করছি না! বিয়ে তো ওই বাড়িতেই হইবো। যা!
আয়াত কান্নার সহিত ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে গেলো। নাজিয়া যৌতুকের কথা শুনে মৃদু স্বরে বললো,
– আম্মা, যৌতুক দিয়ে কিংবা নিয়ে বিয়ে ঠিক না! দুটাই পাপ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। তাছাড়া যে পরিবার এতো দাবি রাখে সে পরিবার সুখী হয় না। সবসময় তারা একের পর এক দাবি নিয়ে প্রস্তুত থাকেই। অবশেষে দাবি পূরণ না হলে বিচ্ছেদ হয়ে যায়!
– চুপ থাকো! বেশি বুঝইতে আইসো না! পড়াশোনা আমরাও করছি! তোমার বাপের তো সামর্থ্য নাই, ভাগ্য ভালো তোমার কিছুই লাগে নাই! কে জানে কোন পাগল হইয়া আমার ছেলে বিনা পয়সায় ঘরে তুলে আনছে! সবাইরে নিজের পরিবারের মতো ছ্যাচড়া পরিবার ভাইবো না। যৌতুক না, এইসব উপহার বুঝছো! বিয়েতে উপহার হইলেও দেওয়া লাগে যেটা তোমার পরিবার দেয় নাই! দিবেই কিভাবে, থাকলে তো!
আরাফ এবার তেজ নিয়ে জবাব দিলো,
– মা, তুমি এসব কি শুনিয়ে যাচ্ছো! তুমি কি জানো ওর পরিবারে আছে নাকি নেই! তোমার পরিবারের চেয়ে খুব ভালো সচ্ছলভাবে চলে তার পরিবার। আমি নিতে চাইলে তো উনারা আমাকে দিবে! যতই বলে চালান করে দাও উপহার, এগুলো যৌতুক আর যৌতুকই রয়ে যাবে। উপহার তো স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়, তাহলে তারা দাবি রাখবে কেন সেখানে! আর ভাবলে কিভাবে আমি একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে যৌতুক নিব! যদি আট দশটা মূর্খদের মতো যৌতুক চেয়ে বসি তাহলে কোথায় থাকবে মূর্খের সাথে শিক্ষিতদের পার্থক্য! কোথায় থাকবে সেই শিক্ষার মর্যাদা! এমনই যদি হতে হয় তবে লাভটা কি হলো এতো পড়াশোনা করে!
– আরাফ! মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা জানা নেই তোর! বড় হচ্ছিস আর বেয়াদবের কাতারে পড়ছিস!
– শিক্ষা তো এমনই দিচ্ছো না? বাবার মুখের উপর তুমি কথা বলে যাও সেটা বেয়াদবি হয় না আর আমরা উচিত কথা বললে বেয়াদবি হয়ে যায়! বরাবরই তুমি নাজিয়ার সাথে বাজে ব্যবহার করে যাও! কেন? সে কোনো প্রচেষ্টা কম করে এই সংসারের জন্য! একা একজন সবদিক সামলে নিচ্ছে তবুও তোমাদের মন রক্ষা করতে পারে না! কি চাও তুমি? যৌতুক এনে দিক বাবার বাড়ি থেকে, সেটা চাও? তাহলে তা কোনোদিন পূর্ণ হবে না। আমি হতে দিবো না।
মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে দেখে নাজিয়া তাকে থামাতে বললো,
– আরাফ, তুমি কি বলে যাচ্ছো এসব! মায়ের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ! চুপ থাকো।
– একটা কথাও বলবে না তুমি! ওনাদের মেয়েকে উনারা যেভাবে, যেখানে ইচ্ছে বিয়ে দিক। এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না। যাও, ঘরে যাও! যাও।
নাজিয়া ঘর ত্যাগ করতে লাগলো আর আরাফ তার বাবা মাকে বললো,
– এতোক্ষণ তো পরোক্ষভাবে অমত পোষণ করছিলাম। কিন্তু এখন প্রত্যক্ষ ভাবে বলছি, আমি এই সমন্ধে একটুও রাজি না। মেয়ে তো তোমাদের তাই তোমাদের যা ইচ্ছে করো। আমাকে আর ডেকো না এসবের মাঝে। আর ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা হলেও আমাকে ডাকতে পারবে না।
কথাটা বলে আরাফ বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে এবং চলে গেলো বাড়ির বাইরে।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়া তার ঘরের দিকে যাওয়ার সময় চোখ পড়লো আয়াতের ঘরের দিকে। কেননা আয়াত তার রুমের জানালা ধুপধাপ লাগিয়ে দিচ্ছে। নাজিয়া নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে আয়াতের ঘরের দিকেই এলো তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। দরজা মনে হচ্ছে চাপিয়ে রাখা, তাই আর নক করলো না। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে নাজিয়া হতবাক! আয়াত খাটের ওপর চেয়ারে দাড়িয়ে সিলিং ফ্যানে ওড়না বাধছে গলায় ফাস দেওয়ার জন্য! নাজিয়া দৌড়ে এসে তাকে টেনে চেয়ার থেকে নামিয়ে দিলো। ওড়না ফ্যানেই ঝুলছে!
– কি করছো তুমি! পাগল হয়ে গেছো!
– ভাবি! আমার কাজে বাধা দিও না। বেরিয়ে যাও এখান থেকে! বের হও।
– আয়াত কি শুরু করেছো এসব!
– তুমি বের হবে নাকি আমি বিষ যোগাড় করে খেয়ে মরবো!
সাথে সাথেই নাজিয়া সজোরে আয়াতের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো! এবং বললো,
– এই মেয়ে, মৃত্যু সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে! কি করতে যাচ্ছিলে তুমি ভেবে দেখেছো একবার! দুনিয়ায় জীবন আর ক’দিন! পরকালে তো জাহান্নামের স্থান দখল করে নিতে! এদিকে পরিবারকে যন্ত্রণা দিয়ে সেদিকে তুমি জাহান্নামে জ্বলতে চিরজীবন! আত্মহত্যা মহাপাপ, সেটা জানো না তুমি! আরেকবার এ ধরনের কথা বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না!
আয়াতের দুচোখে ঝরছে অশ্রু! গালে হাত রেখে কয়েক সেকেন্ড নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে এবার হুহুঙ্কার তুলে কেদে ঝাপটে পড়লো নাজিয়ার গলা ধরে। নাজিয়া আয়াতের অবস্থা দেখে এইটুকু কথা বলেই হাপিয়ে গেছে! আয়াত নাজিয়ার গলা ঝাপটে ধরে কান্না করতে করতে বললো,
– কি করবো ভাবি! আমার একদম ভালো লাগছে না! বাবা-মা তো আমার কথা শুনছে না একটুও! আমি এখন বিয়ে করবো না! এইসব সমন্ধ আমার একটুও পছন্দ না।
– তাই বলে এমন কাজে অগ্রসর হবে তুমি! কেমন মেয়ে হলে তুমি, যদি একটু ধৈর্যই না ধরতে পারো! বললেই তো আর হয়ে যাচ্ছে না বিয়ে! তোমার ভাইয়াও রাজি না এই সমন্ধে। সবাইকে উপেক্ষা করে কি আর বিয়ে দিবে আম্মা!
– শুধু এই সমন্ধ কেন! কোনো সমন্ধেই আমি রাজি না। করবো না আমি বিয়ে! বউ হয়ে যেতে হলে সেই একজনের ঘরেই যাবো। বিয়ে করতে হলে তাকেই করবো। তার ঘরে যেতে না পারলে আর কারো ঘরে যাবো না। আমার উপর জোরজবরদস্তি করতে এলে সোজা দুনিয়া ত্যাগ করবো আমি।
– সেই একজন মানে! কে সেই একজন?
আয়াত নাজিয়ার গলা ছেড়ে দিয়ে চেয়ার ঠেলে খাট থেকে ফেলে দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। নাজিয়া তার পাশে বসে বললো,
– বলো, কার কথা বলছো?
আয়াত চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
– চিনবে না তুমি। ভালোবাসি আমি একজনকে। বিয়ে করতে হলে তাকেই করবো।
– বাবা-মা জানে?
– উহুম। মা একবার শুনেছিলো হয়তো কারো কাছে তখন আমাকে শাসিয়েছে!
– এমন কাজ কিভাবে করতে পারো আয়াত! বাবা-মা, আর ভাইদের কথা ভাববে না তুমি! এসব সম্পর্ক জড়ানো যে পাপ তুমি সেটা জানো!
– এতে পাপের কি হলো! একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে তাকে পছন্দ হতেই পারে। আমি কি অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়েছি তার সাথে! দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা এটুকুতেই কি পাপ হয়ে গেলো!
– হ্যাঁ, এটাও পাপ। সম্পর্ক কতদিনের?
– দু বছর।
– ঘুরতে বেড়াতে যাওনি তার সাথে?
– হ্যাঁ, গিয়েছি।
– লুকিয়ে লুকিয়ে অপরিচিত লোকের সাথে কথাবার্তা, ঘুরাফেরা সবই পাপ। এমনিতেই আমরা হাজার..
– হ্যাঁ, পাপ যেহেতু করেই ফেলেছি তাহলে সেটা শুধরে নিবো তার সাথেই বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে। তাছাড়া অন্য কোথাও পাঠালে সংসার একদিনও টিকবে না দেখে নিও! লাশ পেয়ে যাবে আমার!
– আয়াত জেদ নিয়ে সব কাজ হয় না। বাবামায়ের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
– এটা কেমন বাবা-মা! কিসের প্রাধান্য দিবো তাদের সিদ্ধান্তে! দেখেছো তুমি সেই লোকটাকে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছে। দেখে মনে হয় তিন চার বাচ্চার বাপ! এতোদিনে আসছে বিয়ে করতে! এই লোককে কিভাবে পছন্দ হলো বাবামায়ের!
নাজিয়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। আয়াতকে বুঝাতে গিয়ে সেও থেমে যাচ্ছে। কেননা এই সমন্ধটি নাজিয়ার কাছেও আয়াতের জন্য একেবারেই ঠিক লাগছে না। তাই বললো,
– তুমি যাকে পছন্দ করো সে কি তোমার সমবয়সী?
– না। আশিক ভাইয়ার চেয়েও বড়। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে এবার।
– তাহলে তো আমাদের বেচের।
– না, তোমার চেয়ে এক ক্লাস সিনিয়র। এক বছর গেপ ছিলো। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা চাকরি করে সার্ভিসিং সেন্টারে ম্যানেজার হিসেবে। পরিবার আমাদের পরিবারের অবস্থানের চেয়ে একটু উচুতেই আছে।
– এতোই যখন পছন্দ তাহলে পরিবারকে জানাও। এসব উল্টাপাল্টা কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে কিভাবে! কার শান্তি হচ্ছে এতে!
– দেখোনা মা কেমন করে! মানবে আমার কথা!
– এর চেয়ে বোকা লোক পৃথিবীতে আছে! মানবে কি মানবে না সেটা বলে দেখেছো তুমি! বাবামায়ের কাছে না বলতে পারলেও তো ভাইদের কাছে বলতে পারো! তারা কেউ জানলোই না তাহলে মানার কথা কোথা থেকে আসে!
– সাহস হচ্ছে না আমার।
– কি আজব! কথা বলতে সাহস হয় না অথচ আত্মহত্যা করতে সাহস চলে আসে! যত কষ্টই আসুক জীবনে, এরকম কাজে আর কখনো পদার্পণ করবে না।
আয়াত মাথা নিচু করে বসে আছে। নাজিয়া আরও কিছুক্ষণ বুঝালো তাকে। অত:পর চেয়ার তুলে নিজেই ওড়নার বাধন খুলে নিলো ফ্যান থেকে।
সন্ধ্যায় কাপড়চোপড় বাইরে থেকে ঘরে এনে গুছিয়ে রাখছিলো নাজিয়া। এমন সময় আরাফ ঘরে এলো। নাজিয়া বললো,
– কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।
– নিজের কথা হলে বলো। এ পরিবারের কাউকে নিয়ে কিছু বলবে না।
আরাফ স্কুলের খাতাগুলো নিচ্ছিলো। নাজিয়া তো আয়াতের কথাই বলতো কিন্তু সে যে নিষেধ করে দিলো! না, বলতেই হবে। তাকে জানাতে হবে।
– একবার তো শুনো।
– বললাম তো নিজের কথা হলে বলো।
– আমার কথা না। আয়াতকে নিয়ে।
– তাহলে চুপকরে থাকো। আর মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।
– আচ্ছা, শুনতে সমস্যা কি!
– নাজিয়া, তোমাকে বারবার কেন বলতে হচ্ছে! এ পরিবারের কাউকে নিয়ে কোনো কথা…
– আয়াত গলায় ফাস দিয়ে আত্মহত্যা করতে গেছে।
আরাফের কথা শেষ না হতেই নাজিয়া দ্রুত বলে ফেললো কথাটা। তা না হলে সে একটুও শুনবে না! এদিকে আরাফ হতবাক হয়ে গেছে তার কথা শুনে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
– মানে! আয়াত আত্মহত্যা করতে গেছে! কখন! কেন!
– তুমি যখন বাইরে বেরিয়ে গেয়েছিলে তখন তার রুমে গেয়ে দেখি সে সিলিং ফ্যানে ওড়না বাধছে!
– এখন কোথায়?
– রুমেই আছে।
– কেউ জানে?
– না।
আরাফ খাতা হাত থেকে রেখে দিতেই নাজিয়া বললো,
– শুনো আগে কথা। পরে যাও।
আরাফ দাড়িয়ে গেলো নাজিয়ার কথা শোনার জন্য। অত:পর নাজিয়া সব বলে দিলো৷ আরাফ স্থির হয়ে খাটের কোনে বসে আছে। কি করবে তার জানা নেই। জীবনের এই রূপ আর ভালো লাগছে না! সবদিকে একটা না একটা টানাপোড়েন লেগেই আছে! একটার অবসান ঘটতেই আরেকটা এসে হাজির!
ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে আশিক দরজার সামনে এসে ডেকে গেলো, “ভাইয়া, বাবা ডেকেছে তোমাকে।”
আরাফ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বাবার ঘরের দিকে গেলো।
নাজিয়ার ফোনটা বেজে উঠতেই টেবিলের কাছে গেলো নাজিয়া। দেখলো নাহিদা ভিডিও কল করেছে। নাজিয়া রিসিভ করতেই মানুষের পরিবর্তে দেখলো বুট চানাচুর দিয়ে মাখা মুড়ির বোল। তা দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো, এবং বললো,
– আমাকে লোভ দেখানোর জন্য এই আয়োজন!
সাথে সাথেই ওপাশে দুজনের খিলখিল হাসির শব্দ শুনা গেলো। নাহিদা বললো,
– আপু, সেদিন এক বোল পেয়াজু খেয়ে পরবর্তী দুই দিন নাফিসাকে সেলাইন খেয়ে থাকতে হয়েছে। আজ কি হবে ভাবতে পারছো! তারাতাড়ি এসো, এগুলো শেষ করে দিয়ে যাও এবং নাফিসাকে রক্ষা করে যাও!
নাহিদা খিলখিল করে হেসে উঠলো আর নাফিসা রেগে বোল টেনে নিয়ে বললো,
– স্টুপিড ছো’আপু! একটা মুড়িও পাবে না তুমি!
– যা, লাগবে না মুড়ি। তুই ই খা বেশি বেশি।
– কিউটিপাই ব’আপু, চলে আসো মুড়ি খাই।
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– আমি দেখছি তো, তুই খা।
– হুম, খাবোই তো। এই যে দেখো।
নাহিদা তাকে সরিয়ে বললো,
– হুহ্! সর, আমার ফোনের চার্জ শেষ হচ্ছে! আমি কথা বলি এবার! কেমন আছো আপু?
– আলহামদুলিল্লাহ, বাবা-মা আর আমার কিউটিপাই দুইটা ভালো আছে তো?
– হুম, আলহামদুলিল্লাহ। কবে আসবে আবার?
– তোর বিয়েতে।
– ধুর! আসোনা বেড়াতে। কবে থেকে দেখা হয় না! তোমাকে অনেক মিস করি প্রতিটি মুহূর্তে!
– মিসকে ডিশমিশ করে ফুরফুরে মনে কথা বল এবার। পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই।
– শেষ কবে?
– পরশু দিলেই শেষ। তারপর আবার ক্লাস!
– এতো তারাতাড়ি ক্লাস!
– হুম, লেট করে এক্সাম হলো তো। তাই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে পরীক্ষার পরপরই।
– ওহ, আচ্ছা। মা কোথায়?
– কিচেনে। ওইতো, বাবাও এসে গেছে।
নাজিয়া বাবা-মায়ের সাথেও কথা বললো কিছুক্ষণ। কল কেটে দেওয়ার পর কিছু মনে হতেই আলমারির কাছে এলো। খুঁজে খুঁজে আরাফের রাখা গহনা বের করলো। সেখান থেকে চেইনটা নিয়ে বাকিগুলো সযত্নে রেখে দিলো। অতপর আয়নার সামনে এসে চেইনটা গলায় পড়ে নিলো। ভালোবাসাটা গলায় ঝুলাতে পেরে অজান্তেই যেন ক্লান্তির নাশ ঘটলো। কিন্তু ভালোবাসাটা উপহারস্বরূপ যে দিয়েছে সেই মানুষটা কি ঠিক আছে! একের পর এক চিন্তা এসে মানুষটার মাথায় ভীড় জমা করে! এসব দুশ্চিন্তার কি অন্ত ঘটবে না কভু!

চলবে।