তৃ-তনয়া পর্ব-১২+১৩+১৪

0
483

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
আলফাজ সাহেব উক্ত বিয়ে ক্যান্সেল করে দিয়েছেন সেটাই আরাফকে বলার জন্য ডেকেছেন। সেই সুবাদে আরাফ আয়াতের বিষয়ে বাবাকে সব টা জানিয়ে দিলো। সমন্ধটি আলফাজ সাহেব ফিরিয়ে দেওয়ায় আয়েশা বেগম শুরুতে গোমড়া মুখু হয়ে ছিলেন। আর এখন আয়াতের কথা শুনে তো তেলে বেগুন জ্বেলে উঠলেন! আয়েশা বেগম রেগে বসা থেকে উঠে আয়াতের কাছে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যেতে লাগলে আরাফ বাধা দিয়ে বললো,
– মা, এখন উল্টাপাল্টা কিছু বলতে যেও না। বিপরীতে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটাতে পারে। তার বয়সটা এখন আবেগময়! সবাই নিজেকে আপ্লুত রাখতে পারে না। কাউকে কোনো কিছু না জানিয়েই যেহেতু আজ এতো বড় পদক্ষেপ নিতে পেরেছে, এখন এসব নিয়ে তুমি বকাঝকা করলে জেদের বসে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটাতে দ্বিতীয়বার ভাববে না আয়াত! বাবা তুমি ঠান্ডা মাথায় কথা বলো তার সাথে। হয়তো এতে কাজ হবে। আর কি করবে ভেবে দেখো। তবে দুশ্চিন্তা করো না। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ভাবো। আল্লাহ যা করে সব ভালোর জন্যই করে।
আরাফ এখন তার বাবাকে যা বুঝালো একটু আগে ঠিক এই কথাগুলোই নাজিয়া আরাফকে বলেছিলো। আর আরাফ সেটা ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই ভেবেছে এবং বাবামায়ের সামনে নির্দিধায় তুলে ধরেছে। আলফাজ সাহেব এসব বিষয় নিয়ে আয়াতকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিষেধ করে দিলেন আয়েশা বেগমকে। কেননা আরাফ ঠিক বলেছে, এইটুকুতেই তার মেয়ে গলায় ফাস দিতে গিয়েছে! সেখানে যদি রেগে গিয়ে বকাঝকা বা মারধর করে তাহলে ভয়ংকর কিছু ঠিকই ঘটিয়ে ফেলবে!
আলফাজ সাহেব আরাফকে নিয়ে নিজে আয়াতের ঘরে গেলেন। ছেলে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে আর আয়াত মাথা নিচু করে সব উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বললো ছেলে যদি এখন বিয়ে করতে চায় তাহলে যেন তার পরিবার নিয়ে আসে। আর যদি বিয়ে করতে না চায় তাহলে তারা অন্যত্র ব্যবস্থা করবে আর আয়াত সেখানে অবাধ্য হতে পারবে না। আয়াত নিশ্চিত করলো সে তুর্যকে জানাবে।
.
গতকাল নাহিদার পরীক্ষা শেষ হলো। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বিছানাপত্র গুছাতে গুছাতে দুইবোন পরিকল্পনা করছে আগামীকাল নাজিয়ার বাসায় যাবে কিন্তু জানাবে না তাকে। হঠাৎ করে গিয়ে সারপ্রাইজ দিবে বড় আপুকে। অনেকদিন হলো বোনের সাথে দেখা হয় না। সে তো আসতেই পারে না, তাই তারাই যাবে কাল, আর জমিয়ে আড্ডা দিবে তিনবোন। ঘুমানোর জন্য দুজনেই শুয়ে পড়লো। নাহিদা ফেসবুকে লগইনের জন্য মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো কোনো এক অজানা নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে,
” নিশিতে মিশে থাকো তুমি,
আর সেই নিশিপথে হেটে যাই আমি।
পথ ভুলে যাই তবু না ভুলি তোমায়।
শুধু তোমায় ভালোবেসে নিজেকে মাখাই সেই পথের ধূলিকণায়।
অযথা কেন করছো এমন হেলা!
তুমি এলেই না তবে সার্থক হবে আমার সর্বাঙ্গের ধুলিমাখা খেলা।”
নাহিদার আর ফেসবুকে লগইন করা হলো না! সে সাথে সাথেই মেসেজটা ডিলিট করে মোবাইল রেখে দিলো। মানুষটা এমন কেন! এতোকরে নিষেধ করার পরও এভাবে প্রেমে আহ্বান জানায়! চাইলেই কি সম্ভব! সে কি বুঝে না, ম্যাচুরিটি বলেও একটা বিষয় আছে! তাহলে এতোটা পাগলামো কেন করছে! আর সে কি জানেনি এখনো তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এমনকি এনগেজমেন্টও হয়ে গেছে! হয়তো জানে না! তাহলে তাকে জানাতে হবে। দিনের পর দিন তার এমন পাগলামো সহ্য করা যাবে না।
সকালে নাস্তার পর নাহিদা গোসলের জন্য কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে গেলো। এক মিনিট হতে না হতেই দরজায় দাপদুপ ঢোল বাজতে লাগলো। আর সাথে কণ্ঠধ্বনি,
– আপু! আপু! দরজা খুলো!
নাহিদা ভেতর থেকে জবাব দিলো,
– আরে! কি হয়েছে তোর!
– আরে বেরিয়ে এসো তারাতাড়ি!
– কেন?
– আমি যাবো।
– আমার পরে।
– আরে, গোসল না। আমার এখন যাওয়া জরুরি! মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট!
– আমি গোসলে আসলে তোর মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট এসে যায়!
– হু, তারাতাড়ি বের হও! আর পারছি না!
ওদিকে রুমানা বেগম ঘরের ভেতর থেকে নাফিসাকে এমন ঢাকঢোল পিটাতে দেখে ধমকাচ্ছেন। আর এদিকে নাহিদা বুঝে গেছে নাফিসা টয়লেটে যাবে। তাই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সে। নাফিসা তাকে ঠেলে সরিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়লো,
– ওফ্ফ! সরো সরো!
– ইশ! কোনো সময় গময় নেই! অসময়ে এসে শুধু বিরক্ত! যত্তসব! এজন্যই বাড়িতে আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রাখতে হয়!
নাফিসা বাথরুমে চলে গেলে নাহিদা গুনগুন করতে করতে উঠুনে হাটতে লাগলো। তিনচার মিনিটের মতো অতিক্রম হওয়ার পরও নাফিসা বের হচ্ছে না তাই নাহিদা বাইরে থেকে বললো,
– নাফিসা, ঘুম পেয়েছে? বালিশ এনে দিবো?
নাফিসা বাথরুমের দরজা খুলে মাথা বের করে বললো,
– কিউটিপাই আপ্পিটা, আমার জামাকাপড় গুলো এনে দিবা? খাটের এক কোনে রেখে এসেছি আমি।
নাহিদা তাকিয়ে দেখলো নাফিসার মাথা ভেজা! সে মিথ্যে বলে এতোক্ষণে গোসল সেড়েছে! মেজাজ তার এখন প্রচন্ড খারাপ হচ্ছে! কতবড় ভন্ড মেয়ে! ভন্ডামিতে এক নম্বর ওস্তাদ! নাহিদা রেগে বললো,
– নাফিসা….! তোর মাথা ফাটায় ফেলবো আমি! বের হ! বের হ বলছি!
নাফিসা দাত বের করে হেসে বললো,
– তুমি জানো না, আমার চুল শুকাতে সময় লাগে! তাহলে আগে ঢুকেছো কেন! এর শাস্তি এটা! যাও যাও, ভদ্র আপুর মতো আমার জামাকাপড় গুলো এনে দাও। ভেজা কাপড়চোপড়ে ঘরে প্রবেশ করলে তো মা বকা দিবে।
নাহিদা তেড়ে এদিকে আসতে আসতে বললো,
– তোর জামাকাপড় এনে দিবো আমি! জামাকাপড় কেন, চটের বস্তাও পাবি না তুই! বের হ…!
নাফিসা হাসতে হাসতে দ্রুত দরজা বন্ধ করে চেচিয়ে বললো,
– চটের বস্তা লাগবে না। জামাকাপড় নিয়ে এসো। নতুবা তোমার জামাকাপড়ই পড়ে নিবো!
– নাফিসা! মেরে ফেলবো একেবারে!
– হু হু হু হা হা হা! তারাতাড়ি যাও, গোসল আমার এখনো অর্ধেক বাকি!
নাহিদা জোরে দরজায় লাথি দিলো! তাদের হৈ-হুল্লোড় শুনে রুমানা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ধমকের সুরে বললো,
– এমন শুরু করেছিস কেন তোরা!
– দেখো না, তোমার ইতর ভন্ড ছোট মেয়ে আমাকে বাথরুম থেকে বের করে সে গোসল সেড়ে নিচ্ছে! এখন আবার বলছে তার জামাকাপড় নিয়ে আসার জন্য!
– তোর চেয়ে কত ছোট সে আবার তোকে বের করে কিভাবে!
– সেটাই তো আমার প্রশ্ন!
– চরম বোকা মেয়ের জন্ম হয়েছে আমার ঘরে! ক্ষনে গলাগলি, ক্ষনে ঝগড়া! এগুলো নিয়ে যে কোথায় যাই!
বিড়বিড় করতে করতে রুবিনা ঘরে চলে গেলো। আর নাহিদা কপাল চাপড়ে বললো,
– ওফ্ফ! এই নাফিসার জন্য, শুধুমাত্র এই নাফিসার জন্য আজ মায়ের কাছে বোকা মেয়ে হয়ে গেলি নাহিদা! নো নো নো! নাফিসা, তোর তো আমি খবর নিয়ে ছাড়বো!
– ওক্কে! খবরাখবর পরে নিও! আপাতত আমার জামাকাপড় নিয়ে এসো।
– পারবো ন আকার না!!!
রুবিনা বেগম নাফিসার জামাকাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দুজনকেই বকাঝকা করতে করতে নাফিসার হাতে জামাকাপড় দিয়ে গেলো। গোসল সেড়ে নাফিসা দাত কেলিয়ে বের হলে নাহিদা এক ঘা মারার জন্য হাত বাড়াতেই নাফিসা “মা…!” বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আর নাহিদা বাথরুমে ঢুকে পড়লো!
দুজনেই ঝটপট রেডি হয়ে গেলো আপুর বাসায় যাওয়ার জন্য। মায়ের কাছে বলে বেরিয়ে গেলো তারা। নাজিয়া মাছ কাটছিলো উঠুনের এক কোনে বসে। আশিক মাত্রই বাড়ির দিকে আসছিলো, তার আগেই দেখলো নাফিসা নাহিদা তাদের বাড়িতে প্রবেশ করছে। দ্রুত পা চালিয়ে পেছন থেকেই বললো,
– হেই, ডাবল এন! ওহ না! ট্রিপল এন, কেমন আছো?
নাহিদা নাফিসা দুজনেই পেছনে তাকালো এতোক্ষণে আশিক তাদের পাশাপাশি এসে হাটতে লাগলো তাও আবার নাহিদার পাশ দিয়েই। নাহিদা জবাব দিলো “আলহামদুলিল্লাহ” আর নাফিসা বরাবরের মতোই ত্যাড়াব্যাড়া (আঁকাবাকা)।
– ভালো না থাকলে এই পর্যন্ত আসতে পারতাম নাকি!
– হুম তা তো ঠিকই। তবে আগে জানলে তো আমি বাসা থেকে নিয়ে আসতাম। তাহলে আরও ভালো থাকতে পারতে!
– আল্লাহ, পা দিয়েছে এবং পায়ে যথেষ্ট শক্তি দিয়েছে। তাহলে আপনার কাধে ভর করে কেন আসতে যাবো!
আশিক মাথা চুলকানো ভঙ্গিতে বললো,
– নাহিদা, নাফিসাকে কি আন্টি মধুর বদলে মরিচ খায়িয়েছে?
নাফিসা চোখ রাঙালো আশিকের দিকে আর নাহিদা নিশব্দে হেসে উঠলো! নাহিদার হাসিতে তাল মিলিয়ে আশিকও নিশব্দে হেসে বললো,
– বিলিভ মি, নাফিসাকে ভার্সিটিতে যতবার দেখেছি শুধু ঝালমুড়ি আর ফুচকা খেতে দেখেছি। কখনো মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে দেখিনি। ইভেন, একদিন ডেইরি মিল্ক চকলেটও সেধেছিলাম। নিলো না! তখন থেকে আমি শতভাগ নিশ্চিত সে মিষ্টি মুখে তুলে না সবসময় ঝাল খায় আর সেজন্যই ঝাল ঝাল কথা বলে!
নাফিসা ভেঙচি কেটে বললো,
– ভালো জেনেছেন। হুহ!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
– বিলিভ মি, নাফিসাকে ভার্সিটিতে যতবার দেখেছি শুধু ঝালমুড়ি আর ফুচকা খেতে দেখেছি। কখনো মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে দেখিনি। ইভেন, একদিন ডেইরি মিল্ক চকলেটও সেধেছিলাম। নিলো না! তখন থেকে আমি শতভাগ নিশ্চিত সে মিষ্টি মুখে তুলে না সবসময় ঝাল খায় আর সেজন্যই ঝাল ঝাল কথা বলে!
নাফিসা ভেঙচি কেটে বললো,
– ভালো জেনেছেন। হুহ!
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে তাদের আগে পা চালিয়ে গেলো। নাজিয়া নাফিসাকে দেখে অবাক সাথে মুখে হাসির ঝিলিক। পেছনে আবার নাহিদাকেও দেখলো। আশিক বললো,
– ভাবি, তোমার বোনেরা পথ ভুলে গিয়েছিলো। আমি দেখে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এলাম।
নাফিসা বললো,
– একদম মিথ্যে কথা আপু।
নাজিয়া হেসে আশিককে উদ্দেশ্য করে বললো,
– হ্যাঁ জানিতো, পথ ভুলতে নিশ্চয়ই তুমি সহায়তা করেছো।
– ধুর! আমি আরও নিয়ে এলাম তুমি উল্টো আমাকে দোষারোপ করছো!
– না, তো! একটুও দোষারোপ করছি না।
নাফিসা বললো,
– এমন অসময়ে কিসের মাছ কাটতে বসেছো!
– অসময়কেই সময় বানিয়ে নিয়েছি। যা, ঘরে গিয়ে বস। আমার হয়ে গেছে আমি আসছি।
নাজিয়া মাছ ধুয়ে ফ্রিজে রেখে দিলো। অত:পর তার রুমে এসে বললো,
– কি রান্না করবো তোদের জন্য, বল?
নাফিসা বললো,
– কিছু রান্না করতে হবে না। তোমাকে কবে থেকে দেখি না! আজ তাই তোমাকে দেখতে এসেছি আর তোমার সাথে এত্তো এত্তো গল্প করে যাবো।
– খালি পেটে থাকলে তো আর গল্প করতে পারবো না! সবাই তো আর নাফিসা না! নাজিয়া আর নাহিদার পেট থেকে কথা বের হবে না।
– বুঝি না আমি তোমাদের! কখনো আমাকে তোমরা পেটুক উপাধি দিয়ে যাও, আবার কখনো নিখাদক!
– হিহিহি নিখাদক! আচ্ছা, সব কথা বাদ, এবার বল কি রান্না করবো? বিরিয়ানি?
নাহিদা নিষেধ করলো। অত:পর নুডলসের কথা বলতেই নাফিসা হ্যাঁ বলে দিলো। পাচশ টাকার নোটটা বের করে নাজিয়া আশিককে ডাকলো দোকান থেকে নুডলস এনে দেওয়ার জন্য। আশিক টাকা নিয়ে দোকানে চলে গেলো। অন্যসময় হলে নিতো না টাকা কিন্তু তার হাতই আজ ফাকা।
আশিক নুডলস এনে দিলে নাজিয়া রান্না বসিয়ে দিলো। দুইবোন পাশে দাড়িয়েই গল্প করছে। নাহিদা নাজিয়াকে পাঠিয়ে দিলো গোসল করার জন্য আর সে নুডলস দেখছে। নুডলস হয়ে গেলে নাহিদা নাফিসা আয়াতের সাথে বসে টুকটাক গল্প করছে। গোসল শেষ করে এসে নাজিয়া কাচের প্লেট ধুয়ে ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় অসাবধানতাবশত একটা প্লেট পড়ে তিন টুকরো হয়ে গেছে! তা দেখে আয়েশা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন,
– দেখছোস! দেখছোস, কি করলো! কি অলক্ষুণে বউ জুটলো আমার কপালে! কোনো একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারছে আজ পর্যন্ত! এইটা কি বিয়ে করে আনছে আমার ছেলে!
নাজিয়া ভাঙ্গা কাচ তুলতে গিয়েছিলো। আয়েশা বেগমের মুখে এমন কথা শুনে তার হাত কেটে গেছে! এদিকে কাচ ভাঙ্গা শব্দ আর আয়েশা বেগমের কর্কশ কণ্ঠ শুনে ছেলেমেয়ে সব বেরিয়ে এলো। আশিক বললো,
– মা, একটা প্লেট ভেঙেছে এর জন্য এসব কি উল্টাপাল্টা বকছো! তোমার হাত থেকে কিছু ভাঙে না!
– শুধু কি প্লেট ভাঙ্গছে! আমার সংসার ভাঙ্গার জন্য উঠেপড়ে লাগছে!
নাহিদা ও নাফিসা দ্রুত পায়ে নাজিয়ার কাছে এলো হাত থেকে রক্ত পড়ছে দেখে। নাহিদা নাজিয়ার হাত দেখতে লাগলো আর নাফিসা বাকি প্লেটগুলো নিয়ে নিলো হাত থেকে। আয়েশা বেগমের কথায় নাজিয়া বললো,
– আম্মা, এসব কি বলছেন!
– চুপ কর, মুখপোড়া! অলক্ষুণে একখান ঘরে বইসা আছে! শান্তি কেমনে জুটবো! আমার ছেলেটাকে বশ কইরা আমার বিপক্ষে নিয়া গেছে। আজ আমার সাথে চোখ রাঙায় আমার ছেলে! মেয়ের বিয়ে ঠিক করি, ওইটাও বারবার ভাইঙা দেয়! এই বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকে একটা না একটা বিপদ সংসারে লেগেই আছে এই অলক্ষীর জন্য!
আশিক তার মাকে থামতে বলছে কিন্তু শুনছে না তিনি! নাফিসা তার বোনকে নিয়ে এসব শুনতে না পেরে জবাব দিলো,
– কিসব আজেবাজে বকে যাচ্ছেন আন্টি! মুখ সামলে কথা বলুন!
পাল্টা জবাব পেয়ে আয়েশা বেগম ছ্যাত করে উঠলো,
– কিহ! মুখ সামলে কথা বলতাম! আমি মুখ সামলে কথা বলতাম! কি করবি তুই! হ্যাঁ! লজ্জা করে না অন্যের বাড়ি এমন কইরা পইড়া থাকতে! ক’দিন গেছি তোদের বাড়ি! পোড়া কপালী একটা ঘরে পইড়া থাইকা তো সংসার খাইতাছেই, সাথে মানুষের মাথাও খাইতাছে! বিয়ার ছয়মাস চলে, না পারলো আজ পর্যন্ত সংসারে একটু সুখ আনতে আর না পারলো একটা নাতিনাতনি এনে দিতে! কে জানে কোন বন্ধ্যা হইয়া রইছে!
কথাটা প্রচন্ড আঘাত হানলো নাজিয়ার বুকের বাঁ পাশে! নাফিসা রেগে তার হাতের প্লেট সাথে সাথেই আছড়ে ফেলে ভেঙে ফেললো।
– ঝাটা মারি এমন সংসারে! ভাগ্য ভালো নাজিয়ার মতো একটা বউ পেয়েছেন। আপনার মতো এমন শ্বাশুড়িকে তো দা দিয়ে জবাই করা উচিত! অনেক হইছে আর অনেক দেখছি! আপু, চলো। আর এক মুহুর্তেও এ বাড়িতে না! এইটা কোনো মানুষের বাড়ি হতে পারে না! জল্লাদের বসবাস এই বাড়িতে!
– নাফিসা! আর একটা কথাও বলবি না।
– হ্যাঁ, বলতে চাইছিও না! এমন লোকজনের সাথে কথা বলার কোনো রুচি আমার মাঝে নেই! চলো, বাড়িতে চলে যাবে। এবাড়ির পথেও কোনোদিন উঁকি দিবে না।
– নাফিসা হাত ছাড়। আর অফ যা তুই।
– আপু, চলো। এবাড়িতে একটুও ভালো নেই তুমি সেটা অনেক আগেই দেখেছি আমি। এবাড়ির কাউকে দেখতে পারি না আমি। কাউকে মানুষ বলে মনে হয় না। চলো।
– হাত ছাড়তে বলেছি।
– না, তুমি এখন যাবে আমার সাথে। এই বজ্জাত মহিলার ঘরে আর এক মুহুর্তও না!
নাজিয়া সাথে সাথেই নাফিসার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আয়েশা বেগম ছাড়া সবাই অবাক! নাফিসা গালে হাত রেখে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে নাজিয়ার দিকে! নাজিয়া কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললো,
– তোর সাহস কি করে হয় বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে! বাবা মায়ের কাছে এই শিক্ষাই পেয়েছিস! কখন থেকে চুপ করতে বলছি তোকে! আর আমি শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে যাবো কিনা সেটা তোর নির্ধারণ করতে হবে! তোর ইচ্ছাতে আমার কাজ করতে হবে! প্লেট গুলো এভাবে ভাঙলি কেন! কার সাথে কি ধরনের কথা বলতে হয় সেটা তোর জানা নেই! বেরিয়ে যা। এই মুহূর্তে চলে যা এখান থেকে।
– ভাবি, কি বলছো এসব!
– আশিক, এটা আমাদের বোনের ব্যাপার। তুমি কিছু না বললেই ভালো। আর নাফিসা, জেনে রাখ। এটাও আমার একটা পরিবার। আমি পরিবার ছেড়ে কি করে যাবো। বাবা বুঝেশুনে বিয়ে দেয়নি আমাকে! সেখানে তুই এসব বলার কে! আমি এখানে কিভাবে থাকবো না থাকবো তা সম্পূর্ণই আমার ইচ্ছের বিষয়। আর একটা কথাও যেন না শুনি এই পরিবার সম্পর্কে! চলে যা।
– থাকতে আসিনি! আত্মার টানে দেখা করতেই এসেছিলাম তোমার সাথে। চলে যাবো সে আর বলতে কি! আর কোনোদিন এবাড়ির সীমানায় নাফিসার লাশের ছায়াও দেখতে পাবে না। সত্য কি মিথ্যা, দেখে নিও তুমি।
নাফিসা দৌড়ে নাজিয়ার রুমে গেলো। নাহিদা বললো,
– বাবা কি দেখে এমন পরিবারে তোমাকে বিয়ে দিয়েছে তা আমার অজানা। শুধু এটাই চাই আপু, যাতে একটু সুখে থাকো তুমি। নাফিসাও বুঝে আর না বুঝে তোমার সুখটাই কামনা করছে।
কথাটা বলে সেও নাজিয়ার রুমের দিকে গেলো। নাফিসা পার্সটা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। নাহিদাও নাফিসার জন্য তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়েছে। আশিক তাদের ডাকছিলো কিন্তু তারা কোনো সাড়া দিলো না। আশিক নাজিয়াকেও থামানোর জন্য বলছে, কিন্তু নাজিয়াও কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। আয়েশা বেগম তিন বোনকে নিয়েই ফুসতে থাকলে আশিক বললো,
– হয়েছে তো এবার তোমার শান্তি! অযথা ঝাঝালো কথাবার্তা বলে ঝগড়া বাধিয়ে দিলে!
– চুপ থাক তুই! ভাইয়ের মতোই ভাবির টানে বশ হয়ে যাচ্ছিস! উচিত কথা বলেছি আমি। উচিত বললে সবারই গায়ে লাগে! সব চেনা আছে আমার!
আয়েশা বেগম হনহন করে ঘরে চলে গেলো। নাজিয়া ভাঙ্গা প্লেট গুলো তুলে নিচ্ছে হাতে। প্লেট নিয়ে দাড়াতেই আশিক টুকরো গুলো হাতে নিয়ে নিলো অন্যত্র ফেলে দিয়ে আসার জন্য এবং বললো,
– ভাবি, কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি তোমার! এভাবে গায়ে হাত না তুললেও পারতে। প্রিয়জনের কষ্ট তো কারোই সহ্য হয় না। নাফিসারও হয়নি। তোমার হাত কেটে গেছে অনেকটা। স্যাভলন লাগাও। আয়াত, স্যাভলন লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দে।
নাজিয়া তার রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– লাগবে না।
নাজিয়া রুমে এসে দরজা চাপিয়ে দিলো। আশিক হতাশ হয়ে ভাঙা টুকরোগুলো ফেলতে গেলো। আয়াতও নিজের ঘরে চলে গেলো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়া এসে ধপাস করে খাটের কোনে বসে পড়লো। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে তার! আজ প্রথম বোনটাকে এতো কষ্ট দিয়েছে। কলিজা দুইটা এসেছিলো তার সাথে দেখা করতে আর সে কি-না শ্বশুরবাড়ির পক্ষপাতী হতে গিয়ে কলিজার টুকরো দুইটাকে আঘাত করেছে। একজনের গায়ে হাতও তুলে ফেলেছে! এই হাতই তো শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে এখন!
নাজিয়া খাটের স্ট্যানে হাত দুতিন ঘা মারলো! অত:পর খুব কান্না করতে লাগলো। যে কান্নার শব্দ শুধু ঘরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ আর মনের ভেতর ভাংচুর!
কি করে পারলো তাকে এমন কথাবার্তা শুনাতে! যত প্রচেষ্টা ছিলো সংসারে সবটা আজ ব্যর্থতায় ব্যথিত হয়ে গেছে! উপাধি পেয়ে গেছে অলক্ষুণে, অপয়া, বন্ধ্যা! আজ কি বোনদের সামনে এমন কিছু না বললেই হতো না! কতো শখ করে নাফিসাটা বললো নুডলস খাবে। কত শখ করে বোনের সাথে আড্ডা দিতে দিতে নিজেরা রান্না করে নিলো। অথচ মুখে তুলতে পারলো না খাবার! এমনকি এক ফোটা পানিও না! এ কোন পরিস্থিতিতে ধাবিত হলো সে! কি পাপ করেছিলো জীবনে, যার ফলস্বরূপ এমন জীবন অতিক্রম করতে হচ্ছে তাকে! ধৈর্যের ও তো একটা সীমা থাকা দরকার!
স্টুডেন্টদের মডেল টেস্ট চলছে তাই কোচিং অফ থাকায় বিকেলেই আরাফ বাড়িতে চলে এসেছে। নাজিয়া কান্না করতে করতে কখন মেঝেতে বসে গেছে তার খেয়াল নেই। আরাফ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে নাজিয়া আনমনা হয়ে বসে আছে। বুকের ভেতরটা চাপ দিলো তার! এভাবে বসে আছে কেন! কি হয়েছে তার!
– নাজিয়া!
আরাফের ডাকে ধ্যান ভাঙলো নাজিয়ার। সে দু’হাতে চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। আরাফ দরজা চাপিয়ে দ্রুত পায়ে তার কাছে এলো। হাত বাড়িয়ে মুখখানা ধরে বললো,
– এই, কি হয়েছে তোমার?
নাজিয়া দু’হাতে আরাফের কলার মুঠোয় ধরে বললো,
– বেবি লাগবে আমার। বলো, এনে দিবে না বেবি?
– এমন করছো কেন? কি হয়েছে বলো আমাকে?
নাজিয়া আরাফকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে কাদতে লাগলো। আরাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কথা বলছো না কেন! বলো আমাকে! নাজিয়া, তুমি কাদছো কেন? কেউ কিছু বলছে? মা কিছু বলছে?
আরাফ কয়েকবার একই কথা জিজ্ঞেস করলো কিন্তু নাজিয়া কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু কাদছে। উত্তর না পেয়ে আরাফ এবার ধমকের সুরে বললো,
– কি শুরু করেছো এগুলো! সারাদিন বাইরে থেকে দিন শেষে বাড়িতে ফিরেও কি শান্তি পাবো না একটু! ঘরে পা দিতেই মনমালিন্য, কান্নাকাটি দেখতে কি খুব ভালো লাগছে আমার!
আরাফের ধমকে নাজিয়া তাকে ছেড়ে দিয়ে দাড়ালো। এবং দুহাতে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। খাবার এনে দিচ্ছি।
– আমি জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে তোমার? কাদছিলে কেন?
– কই, কিছু হয়নি তো। আমার আবার কি হবে!
কথাটা বলে নাজিয়া পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আলমারির কাছে। কথা চাপা রাখতে দেখে আরাফ রেগে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। যাওয়ার সময় দরজাটা ঠাস করে চাপিয়ে গেলো! নাজিয়া আলমারির কাছে থেকেই আবার ঠোঁট কামড়ে কাদতে লাগলো! আরাফ আয়াতের কাছে যাচ্ছিলো কেননা আয়াত বাড়িতে ছিলো। সে জানবে নিশ্চয়ই কি হয়েছে। কিন্তু আয়াতের দেখা পাওয়ার আগে আশিকের দেখা পেলো সে। আশিক বললো,
– ভাইয়া মাত্র এসেছো?
– হ্যাঁ।
– কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।
– পরে বলি। আয়াতের কাছে যাচ্ছি একটু।
– ভাবির কথা জিজ্ঞেস করতে? আমিও ভাবির কথাই বলতে চাইছিলাম।
আরাফ তার কাছেই ইস্যু পেয়ে গেছে তাই সে আর আয়াতের কাছে না গিয়ে আশিকের সাথেই চলে গেলো। আশিক সবটা বলে দিলো আরাফের কাছে। সাথে এটাও বললো, যে গার্মেন্টসে সে কাজ করেছিলো সেখানে তদারক হিসেবে তাকে আহ্বান জানানো হয়েছে। বেতনও মোটামুটি ভালোই। পরবর্তীতে কাজের ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হবে। তাই আরাফের কাছে পরামর্শ চাইলো করবে কি-না। এমনকি আশিক নিজের ইচ্ছেও প্রকাশ করলো কাজটা করার জন্য। তাই আরাফ আর নিষেধ করলো না। যদি তার পড়াশোনা প্রব্লেম না হয়, তাহলে করতে পারবে। কথা বলা শেষ হতেই আরাফ সেখান থেকে আবার নিজের রুমে চলে এলো। নাজিয়া আলমারি খুলেই খাটে বসে আছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলধারা! আরাফকে দেখে আবারও মুছে নিলো গাল। আরাফ দরজা লাগিয়ে এসে তাকে দাড় করালো এবং সবার আগে তার হাত চেক করলো। একটা আঙুলের অনেকটা কেটে গেছে। রক্ত পড়ে শুকিয়ে আছে আঙুলের ধারেই! আরাফ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। এবং বললো,
– এতো ভালো, ভালো না বুঝতে পেরেছো! প্রয়োজনে উপযুক্ত জবাব দিতে হয়! সবচেয়ে বড় ভুল তো আমার হয়েছে! আমি কেন বাবাকে দিয়ে তোমার ঘরে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম! তোমার মতো এতো ভালো মেয়ের যোগ্য না এই পরিবার! এখানে ঝগড়াটে মেয়েদের মধ্যে একজনকে প্রয়োজন ছিলো। সেটা আমার মায়ের কাছে ভালো লাগতো। আমাকে আর এমন দিন দেখতে হতো না!
– হ্যাঁ, সবাই মিলে এখন আমাকে বকো। কিছু বলবো না আমি। আমি তো অলক্ষুণে, অপয়া, বন্ধ্যা!
আরাফ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে এবং একটানে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
– আরেকবার এমন কিছু মুখে আনলে মেরে ফেলবো একেবারে! তোমাকে এতো কথা শুনিয়ে গেলো তুমি কিছু বলতে পারলে না!
– কি বলবো! নিজের আপনজনদের সাথে কি যুদ্ধ করা যায়!
– নাফিসাও তোমার আপনজন ছিলো। ওর গায়ে হাত তোলা একদমই ঠিক হয়নি তোমার! ও ঠিক কথাই বলেছে। এমন পরিবেশে কোন সুস্থ মানুষ বসবাস করতে পারে না।
নাজিয়া কান্না করতে করতে বললো,
– কি করবো বলো। ও একটু বেশিই বলে ফেলছিলো। এভাবে তো ঝামেলার সৃষ্টি হতো তাইনা! ও আমাকে চলে যাওয়ার জন্য বলছিলো। আমি কি করে যাবো, বলো! বাবা কি চলে যাওয়ার জন্য তোমার কাছে পাঠিয়েছে! এটাও তো আমার পরিবার। এমন অভিমান নিয়ে কি সংসার হয়!
– নাজিয়া, ও ছোট। সংসার নিয়ে তোমার মতো এতোটা জ্ঞান ওর মাঝে নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর যা ভালো মনে হয়েছে, সেটাই বলেছে। তোমাকে খুব ভালোবাসে তো। তাই সহ্য করতে পারেনি তোমার অপমান।
– আমি খুব খারাপ, আরাফ! খুব খারাপ আমি! আমার আচরণে কলিজা দুইটা খুব কষ্ট পেয়েছে আজ। আমি কখনো হাত তুলিনি তাদের উপর! আজ প্রথম এতোটা আঘাত করে ফেলেছি! কত শখ করে এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতে আর আমি নিজে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছি। এক ফোটা পানিও তাদের মুখে তুলে দিতে পারিনি। ওরা নিজেরাই নুডলস রান্না করলো সেটাও মুখে তুলতে পারেনি! আমি জানি নাফিসাটা অনেক কান্না করেছে বাসায় গিয়ে। এখনো হয়তো কান্না করছে! খুব ব্যাথা দিয়েছি আমি! থাপ্পড় দেওয়ার সাথে সাথেই গালটা লাল হয়ে গিয়েছিলো। কি করে পারলাম আমি!
নাজিয়ার কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেছে! আরাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– এই, কান্না থামাও। নাফিসা হয়তো এই ভেবে আরও কান্না করছে যে তার বোনটা এদিকে অনেক কষ্ট পেয়েছে তাকে মেরে! এভাবে কান্না না করে এবার একটু কথা বলো তার সাথে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
– কিছু ঠিক হবে না! অনেক অভিমানী নাফিসাটা। নাহিদার মতো এতোটা বুঝ মাথায় নেয় না সে! যখন যা ইচ্ছে তা-ই করে। জানো সে যাওয়ার সময় কি বলে গেছে! ” এ বাড়িতে নাফিসার লাশের ছায়াও পড়বে না কোনোদিন! দেখে নিও তুমি!” কিছু ঠিক হবে না আরাফ! ও অনেক কষ্ট পেয়েছে!
– না বলেই জেনে গেলে কিছুই ঠিক হবে কি-না! আগে তো কথা বলো, তারপর দেখো কি হয়। দেখি সোজা হও।
– বেবি লাগবে আমার।
– ওকে, পরে ভেবে দেখবো।
– পরে না। এখনই ভাববে।
আরাফ দু’হাতে তার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
– চেহারার কি অবস্থা করেছো সেটা দেখেছো একবার আয়নায়! দুপুরে তো খাওনি কিছু, সকালে খেয়েছিলে?
– হ্যাঁ।
– বসো এখানে।
আরাফ স্যাভলন, তুলা আর সুতি কাপড় নিয়ে নিজেই রক্ত মুছে ব্যান্ডেজ করে দিলো নাজিয়ার আঙুল। আরাফ হাতমুখ ধুয়ে এলো আর নাজিয়া নাহিদার কাছে কল করলো। কিন্তু বিজি দেখালো। নাজিয়া কল কাটতেই নাহিদার ফোন থেকে কল এলো। রিসিভ হতেই শুনতে পেলো তার মায়ের গলা।
– নাজিয়া? কি হয়েছে বলতো আমাকে? নাফিসা কান্না করছে আর নাহিদা বলছে তোর শ্বাশুড়ি নাকি যা তা বলেছে তোকে?
– না, মা। তেমন কিছু হয়নি। একটু রাগারাগি এই ই।
– কি নিয়ে রাগারাগি করলো এমন? পাঠাবো তোর বাবাকে?
– আহ, মা বাদ দাও তো। সংসারে কতকিছুই থাকে, আর একটু আধটু রাগারাগি হতেই পারে। নাফিসা কোথায়?
– ওই যে, তখন থেকে রুমে একা বন্দী হয়ে কান্না করছে। কত ডাকছি, দরজা খুলছে না। খেয়েছে তোর ওখানে কিছু?
– না। ওকে একটু ডাকো, আমার কথা বলো।
রুমানা বেগম নাফিসাকে ডাকলো, নাজিয়ার কথা বললো। নাফিসা শুধু একটা কথাই বললো, “বলে দাও, নাফিসা নাম ধরে যাতে আর কখনো না ডাকে। মরে গেছে নাফিসা!”
কথাটা তীরের মতো বিধলো নাজিয়ার মনে! সে তার মায়ের সাথেও কথা বলতে পারলো না আর। কল কেটে দিলো। নাজিয়াকে ফোনে কথা বলতে দেখে আরাফ নিজেই প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো। রুমে এসে নাজিয়াকে আবারও কাদতে দেখলো। আরাফ বললো,
– আবার কান্না শুরু করেছো! কি বলেছে নাফিসা?
– কথাই তো বললো না! রুমে একা বন্দী হয়ে আছে। সেখান থেকেই চেচিয়ে তার নাম ধরে ডাকতে নিষেধ করে দিলো। বলেছি না আমি! এখনো কান্না করছে!
– এতোটাই যখন চেনো তাকে তাহলে হাত তুললে কেন! তখন মনে ছিলো না! একটুও কান্না করবে না এখন। যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমার সাথে খেয়ে নিবে, তারপর তোমাদের বাড়িতে যাবো।
– খাবো না আমি। তুমি খেয়ে নাও।
– আমি তো খাবোই। তুমিও খাবে। নুডলসটা তো মজাই হয়েছে। নাহিদা নাফিসা মনে হয় আমার জন্যই রান্না করেছে। দ্রুত যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো।
নাজিয়া হাতমুখ ধুয়ে এলো। আরাফ জোর করে দু লোকমা মুখে দিতে পেরেছে। খাবার গিলতে খুব কষ্ট হচ্ছে নাজিয়ার! বোন দুটো এখনো খায়নি! সে ভেবে সেও পারছে না খেতে।
আরাফ খাওয়া শেষ করে নাজিয়াকে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মাকে বলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। বাবা বাড়িতে না থাকায় বাবার কাছে শুধু কল করে বলেছে। আলফাজ সাহেব না করে না কখনো। শেষ বিকেলে তারা নাজিয়াদের বাড়িতে চলে এলো। নিয়াজ উদ্দিন বাড়িতে ফিরে নাফিসাকে সেই রুম থেকে বের করতে পেরেছে। কেননা, বাবা এক ডাক দিতেই মেয়েরা হাজির হয়ে যায়। বেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু বেশি কথা বলেনি। অল্প খাবারও খেয়েছে বাবার কথায়। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তাই নাফিসা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলো বাইরে থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে যাওয়ার জন্য। উঠুনে পা রাখতেই দেখলো আরাফ আর নাজিয়া হাজির! সে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। নাজিয়া হিজাব খুলতে খুলতে এগিয়ে আসতেই নাফিসা বললো,
– মা, আমি শিথি আপুর কাছে যাচ্ছি।
কথাটা বলে নাফিসা সাথে সাথেই দৌড়ে উঠুন পাড় হয়ে চলে গেলো পাশের বাড়ির ফুপাতো বোন শিথির কাছে। নাজিয়া পেছন থেকে ডাকছিলো তাকে কিন্তু কোনো সাড়া দিলো না তার ডাকে। সে বেশ বুঝতে পেরেছে তাকে দেখেই ইগনোর করে চলে গেলো! আরাফও নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে আছে! যার জন্য এলো সে-ই পালিয়ে গেলো! কতো কষ্ট করে এ পর্যন্ত মানিয়ে নিয়ে এলো নাজিয়াকে। এখন আবার ইগনোর করে মনটা ভেঙে দিয়ে চলে গেলো!

চলবে।