তৃ-তনয়া পর্ব-১+২

0
1523

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১
(নূর নাফিসা)
পর্ব- ১+২
.
.
“চলো, বিয়ে করবো!”
“এ!”
“এ না, হ্যাঁ! চলো, বিয়ে করবো!”
সাথে সাথেই নাহিদার হাত থেকে ঝালমুড়ির প্যাকেট ধুলোবালির উপর পড়ে গেলো! মুখে যেগুলো ছিলো তাও চিবাতে পারছে না! মুখ নাড়াচাড়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে! চোখ জোড়া ঘনঘন পলক ফেলছে আর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার হাত ধরে রাখা ছেলেটার দিকে! নাহিদা তার দুই বান্ধবীর সাথে ভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভেতর দাড়িয়ে কথা বলছিলো আর ঝালমুড়ি খাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই এক অজানা, অচেনা ছেলে এসে হাত ধরে সরাসরি দিলো বিয়ের প্রস্তাব! নাহিদার যেন দম আটকে গেছে! সাথে থাকা বাকি দুজনও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। ছেলেটা অন্যহাতে নাহিদার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
– এই মেয়ে! হা করে তাকিয়ে আছো কেন? গিলে ফেলবে নাকি আমাকে! সময় চলে যাচ্ছে আমার, তারাতাড়ি চলো।
নাহিদার আর কিছু বলার সু্যোগ নেই! ছেলেটা তার হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলো গেইট দিয়ে! বন্ধবীদ্বয় হা করে সেখানেই দাড়িয়ে আছে! কি হচ্ছে সবটাই তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে!
এদিকে ছেলেটা নাহিদাকে টানতে টানতে বিরতিহীন হেটে যাচ্ছে আর নাহিদা “উম্ ম-ম!” শব্দ করে যাচ্ছে! ছেলেটা হাটতে হাটতেই বললো,
– আরে! কিসের উম্ম -ম! উম্ ম-ম! করে যাচ্ছো! আগে তো মুখের খাবার গেলার চেষ্টা করো, পরে কথা বলার চেষ্টা করো!
নাহিদা এবার তারাতাড়ি তার মুখে থাকা ঝালমুড়ি চিবিয়ে গিলতে লাগলো। এতোক্ষণে ছেলেটা ভার্সিটির গেইটের বাইরে রাস্তায় রিকশার কাছে চলে এসেছে। এখনো নাহিদার হাত ধরেই রেখেছে সে। নাহিদাকে ইশারা করে বললো,
– রিকশায় উঠো।
নাহিদা এবার পরিষ্কার গলায় বললো,
– আমি রিকশায় উঠবো কেন! কে আপনি?
– যেতে যেতে সব বলবো। আগে উঠো।
– ন..না, আমি উঠবো না।
– এই মেয়ে! উঠো!
ছেলেটা ধমক দিয়ে নিজেই আগে উঠে বসলো। অত:পর নাহিদার হাত ধরে টানলো, যার ফলে নাহিদা উঠতে বাধ্য হলো। এখনো নাহিদার হাত ধরেই আছে আর রিকশাওয়ালাকে বললো,
– আংকেল, কাজী অফিসের সামনে যান।
রিকশাওয়ালা রিকশা চালানো শুরু করলো আর এদিকে কাজী অফিসের কথা শুনে নাহিদা চমকে উঠে বললো,
– কাজী অফিসে কেন!
– কোন দুনিয়ায় বসবাস করো তুমি! কাজী অফিসে কেন যায় সেটা জানো না! বিয়ে করতে , বিয়ে করতে! বুঝতে পেরেছো?
– কার বিয়ে?
– তোমার আর আমার বিয়ে।
– না, আমি বিয়ে করবো না! রিকশা থামান, না হলে আমি চিৎকার করে লোক জড়ো করবো!
– এই মেয়ে! একদম চুপ! আরেকটা শব্দ উচ্চারণ করলে একেবারে গলা কেটে ফেলবো!
নাহিদা ভয় পেয়ে গেছে এভাবে ধমকে উঠায়! সে নিশ্চিত এটা কোনো সন্ত্রাস! না হলে এভাবে কেউ হুমকি দেয়! শুধু সন্ত্রাসী না, এটা ছদ্মবেশী সন্ত্রাস! এজন্যই তো বেশে ফিটফাট! যেন ভদ্রঘরের অভদ্র ছেলে! সে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো এই সন্ত্রাসের হাত থেকে বাচানোর জন্য! নাহিদাকে ভয় পেতে দেখে ছেলেটা মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে মিষ্টি সুরে বললো,
– ভয় পাচ্ছো কেন! এখন আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবো অত:পর হানিমুনে যাবো।
সাথে সাথেই নাহিদার মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! আর ঝালমুড়ি খেয়ে গলা তো আগেই শুকিয়ে গেছে! নাহিদা কান্নার ভঙ্গিতে বললো,
– আ..আমি বিয়ে করবো না।
– আচ্ছা।
– আ..আমি হানিমুনেও যাবো না।
– আচ্ছা।
– তাহলে কাজী অফিস যাচ্ছি কেন!
– এমনি যাচ্ছি কাজী অফিস। বিয়েও করবো না, হানিমুনও করবো না। শুধু এখন যা যা বলবো তা তা করবে। অতিরিক্ত একটা কথাও বলবে না!
নাহিদার খুব ভয় লাগছে! কেমন কথাবার্তা বলছে লোকটা! পাগল নাকি!
চার-পাঁচ মিনিট রিকশায় ভ্রমণ করে কাজী অফিসের সামনে নেমে পড়লো অচেনা ছেলেটা। হাত ধরে টেনে এবার নাহিদাকেও নামালো। এক হাতে ওয়ালেট বের করে ফাক করে নাহিদার সামনে ধরে বললো,
– বিশ টাকার নোটটা তুলে নাও।
– এ!
– এই মেয়ে! সমস্যা কি তোমার! একবার বললে শুনতে পাও না! বারবার বলতে হয় কেন এককথা!
নাহিদার চোখে পানি টলমল করছে! ছেলেটা বিরক্তি নিয়ে হাত ছেড়ে এবার নিজেই টাকা নিয়ে রিকশাওয়ালার কাছে দিলো। এমনি আরও তিনজন ছেলে হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো তাদের কাছে। একজন ছেলেটার পিঠ চাপড়ে বললো,
– মেহেদী, অবশেষে তাহলে ভাবিকে উঠিয়ে নিয়ে এসে পড়েছিস!
ছেলেটা জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, এনেছি। এবার দ্রুত কাজ শুরু কর।
একজন মেহেদী নামক ছেলেটার দিকে প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এই নে, ধর।
মেহেদী প্যাকেট থেকে লাল দোপাট্টা বের করে দ্রুত নাহিদার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বললো,
– চোখে পানি কেন! ঝালমুড়ির প্যাকেট পড়ে যাওয়ায় কাদছো নাকি? আচ্ছা ঝালমুড়ি আরও পাচ প্যাকেট কিনে দিবো। এবার চোখের পানি মুছো! আর এখন আমি অনেক কিছুই বলবো কিন্তু তুমি কিছুই বলবে না। একদম চুপচাপ শুধু দাড়িয়ে থাকবে। আর যদি আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করি তখন তার উত্তর দিবে শুধু। ব্যাগ দাও।
– এই! আমার ব্যাগ!
– খেয়ে ফেলবো না তোমার ব্যাগ! লেডিস্ ব্যাগ দিয়ে আমরা কি করবো।
মেহেদী ব্যাগটা তার এক বন্ধুর কাছে ধরিয়ে দিয়ে কাজী অফিসের ব্যানারের সামনে দাড়ালো নাহিদাকে সাথে নিয়ে। আর তাদের সামনে তার বন্ধুরা ক্যামেরা নিয়ে রেডি। মেহেদীর ফোন থেকে তার বাবার নম্বরে ভিডিও কল করতে রিসিভ হলো। মেহেদী হাসি মুখে বলতে লাগলো,
– আব্বু, এই যে দেখো নতুন বউ। অবশেষে আজ বিয়ে করেই ফেলেছি।
ওপাশ থেকে মধ্যবয়স্ক লোকটা বললেন,
– তাই নাকি! বিয়ে করে ফেলেছো!
– হ্যাঁ। এই সালাম দাও, তোমার শ্বশুর আব্বু হয়।
নাহিদার সবকিছু এলোমেলো লাগছে! মেহেদীর ধাক্কায় তবুও সে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে লোকটা সালামের জবাব দিয়ে “মেহেরুন” নাম ধরে ডাকলো। এবং সাথে সাথেই এক মধ্যবয়সী মহিলা লোকটার পাশে এসে বললেন,
– কি?
– এই দেখো, তোমার ছেলে বিয়ে করে ভিডিও কল করেছে।
– কিইইই!
– আরে রেগে যাচ্ছো কেন! ঠান্ডা হও। ওই যে ছেলের বউ। আর তুমি চুপ থাকো, আমি আগে বউমার সাথে একটু কথা বলে নেই। মা, তোমার নাম কি?
নাহিদা ভ্যাবাচেকা খেয়ে একবার মেহেদীর দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ফোনের দিকে! ভাবছে এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো সে! মেহেদী বললো,
– আব্বু কিছু জিজ্ঞেস করছে তো! নাম বলো!
– জ্বি! নূর নাহিদা।
ভিডিও কলে থাকা লোকটা বললেন,
– ওহ! খুব সুন্দর নাম।
মেহেদী বলে উঠলো,
– হ্যাঁ, আব্বু। খুব সুন্দর নাম। এবার আমার একাউন্টে বিশ হাজার টাকা পাঠাও। বউ নিয়ে হানিমুনে যাবো।
– আজ বিয়ে আবার আজই হানিমুন! বিয়ে করেছো তো তুমি?
– হ্যাঁ, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না! এই যে, আমার পেছনেই কাজী অফিস। মাত্রই বিয়ে সেড়ে এলাম।
– হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আর সাথে এটাও দেখতে পাচ্ছি তুমি এখন মতিঝিলেই আছো। সুতরাং আগে বউ নিয়ে বাড়িতে এসো তারপর হানিমুন।
– না, আব্বু। আগে হানিমুন পরে বাড়ি। তারাতাড়ি টাকা পাঠাও।
– তাহলে বাসা থেকে নিয়ে যাও।
– আরে না! হাতে টাকা থাকলে তো ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই একাউন্টে ট্রান্সফার করে দাও।
– বাপের সাথে ফাজলামোর জায়গা পাও না! নিশ্চয়ই তোমার ছাগল বন্ধুরা আছে তোমার কাছে! আর কোথাও যাওয়ার জন্য এসব প্ল্যান করছো সবাই মিলে!
– কি বলছো আব্বু! আমার বন্ধুরা নেই তো এখানে। এই-যে দেখো।
ক্যামেরা ম্যান ক্যামেরাটা এদিক সেদিক একটু নাড়ালো। এবার মেহেদী বললো,
– দেখেছো! কেউ নেই! শুধু আমরা দুজনই এখানে।
– তাহলে তোমার মোবাইলটা ধরে রেখেছে কে? তোমার দুইহাতই তো উন্মুক্ত!
লোকটার কথা শুনে সাথে সাথেই ক্যামেরা ম্যানের হাত থেকে মেহেদীর মোবাইলটা মাটিতে পড়ে গেলো! মেহেদী রেগে গিয়ে তার বন্ধুকে একটা লাথি দিয়ে বললো,
– হায়! হায়! হারামজাদা, আমার ফোনটাই শেষ করে দিছে!
তারাতাড়ি ফোন নিয়ে দেখলো কল কাটেনি। বালিতে পড়ায় ফোনেরও কোনো ক্ষতি হয়নি। সে বালি ঝেরে ফোন পরিষ্কার করে হাসিমুখে বললো,
– কোথায় আব্বু! ফোন তো আমার হাতেই। এই যে দেখছো না!
নাহিদা এতোক্ষণে বুঝতে পেরেছে বাপের সাথে ভণ্ডামি করে টাকা নেওয়ার ধান্দা সব! বাবাকে মিথ্যে বলে ঠকানো সহ্য করতে না পেরে এবার জোর গলায় নাহিদা বলতে লাগলো,
– আংকেল, মিথ্যে কথা! আপনার ছেলে বিয়ে করেনি। আমিও আপনার ছেলের বউ না। আমাকে ভার্সিটি থেকে কিডন্যাপ করে এখানে এনেছে আর মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে যেন চুপচাপ আপনার ছেলের কথা শুনে যাই।
মেহেদী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নাহিদার মুখের দিকে! ওদিকে তার বন্ধুরাও এক একজন জ্বিভ কেটে দাঁড়িয়ে আছে! ওপাশ থেকে লোকটি বললো,
– আমি জানি, আর খুব ভালো করেই চিনি আমার অমানুষ ছেলেকে! তুমি কিছু মনে করো না। আমি ওর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করছি।
মেহেদী বলে উঠলো,
– আব্বু! উপযুক্ত শাস্তি মানে!
– আগে বাসায় এসো তারপর দেখাচ্ছি! নিজে গিয়ে থানায় ভর্তি করে আসবো তোমাকে! ফাজলামোর একটা সীমা থাকা দরকার! মানুষ হবে না তুমি! অবশেষে কিডন্যাপ করতে নেমে গেছো!
– আব্বু, এটাকে কিডন্যাপ বলে না! আমি শুধু ভার্সিটি থেকে এটুকু পথ সযত্নে রিকশায় করে এনেছি।
– এইতো কতো ভালো আমার ছেলে! সব সত্যি কথা বলে দেয়!
.
.
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
– এইতো কতো ভালো আমার ছেলে! সব সত্যি কথা বলে দেয়! ওকে সযত্নে আবার ভার্সিটি পৌছে দিয়ে ভদ্র ছেলের ন্যায় বাড়ি ফিরে এসো। না হলে চিরদিনের জন্য ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে তোমার জন্য।
মেহেদী কল কেটে দিলো। ফোন পকেটে রেখে তার তিন বন্ধুদের মধ্যে একজনকে ইচ্ছে মতো মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো,
– এইটা বোকা মেয়ে? হ্যাঁ, এইটা বোকা মেয়ে! বোকা হলে এতো কথা বললো কিভাবে! টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ঘুরবি! যা, জন্মের ঘুরা ঘুর! আমি আর আসছি না। ছেলেটা কোনো মতে মেহেদীর কাছ থেকে ছুটে অন্যজনের পেছনে লুকিয়ে বললো,
– দোস্ত আমি তো জানতাম বোকা মেয়েই! ভার্সিটিতে যখনই দেখতাম বই নিয়ে বসে থাকে, কথাবার্তা বলে না তেমন! কারো সাথে আড্ডা দেয় না। লোকে দেখলে বলবে বোবা মেয়ে! তাই আমিও ভাবছি তোর কাজ সে-ই করতে পারবে, সেজন্যই তোকে ওর সন্ধ্যান দিলাম। আজ আবার মুখে কথা ফুটলো কিভাবে!
– কথা কিভাবে ফুটলো সেটা আমি জানি! না? তোকে তো…!
মেহেদী রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ইট নিলো তার বন্ধুকে মারার জন্য। ছেলেটা হাসতে হাসতে দৌড়ে কিছুটা দূরে চলে গেলো। মেহেদী বাদে তার সব বন্ধুরাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাসছে। ইট নিতে দেখে এদিকে নাহিদা ভয় পেয়ে গেছে। মেহেদী ইট ঢিল মেরে ফেলে নাহিদাকে ধমকে বললো,
– এই মেয়ে! এখানে দাড়িয়ে আছো কেন! আমার বারোটা বাজিয়ে এখন তামাশা দেখো! যাও..!
– ফালতু লোক কোথাকার! বাবার সাথে প্রতারণা করে! এই, আমার ব্যাগ দিন!
নাহিদা বিড়বিড় করতে করতে তার ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো।
এদিকে কাজ সফল না হওয়ায় মেহেদী কাজী অফিসের দেয়ালে লাথি মেরে বললো,
– ধুর! এক টাকা তো আনতে পারলাম না, শুধু শুধু আমার দোপাট্টা কেনা আর রিকশা ভাড়া গেলো!
তার বন্ধুদের মধ্যে একজন বললো,
– দোস্ত, মেয়ে তো দোপাট্টা নিয়ে গেলো!
মেহেদী তাকে লাথি মেরে বললো,
– দোপাট্টা দিয়া কি করবি, তুই পইড়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি!
নাহিদা মনে মনে বকতে বকতে ভার্সিটির পথে হেটে যাচ্ছে। হঠাৎ তার পাশে একটা রিকশা এসে বললো,
– আফা, উঠেন। ভার্সিটি যাইবেন না?
– আমি আপনাকে বলেছি?
– না, ওই যে হেই ভাইয়েরা পাঠাইছে।
নাহিদা পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওই ছেলে গুলো দাড়িয়ে আছে। নাহিদাকে তাকাতে দেখে তাদের মধ্যে একজন ইশারা করলো রিকশায় উঠার জন্য। নাহিদা রিকশাওয়ালাকে বললো,
– ভাড়া কি দিয়েছে?
– হু, নীল শার্ট পড়া ভাইয়ে ভাড়া দিয়া পাঠাইছে।
নাহিদা আরেকবার তাকিয়ে দেখলো নীল শার্ট পড়া ছেলেটা মেহেদী। শুধু শুধু আর পায়ের জোর কমাতে যাবে কেন। তাই রিকশায় উঠে পড়লো। ওই ছেলেটাই তো তাকে নিয়ে এলো তাই তার ভাড়া করা রিকশায় উঠে পড়লো। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই খেয়াল হলো তার মাথায় পড়ানো দোপাট্টার দিকে! এখন আবার যাবে! তার বন্ধুদের মাঝে একজনকে দেখে মনে হয়েছে ভার্সিটিতে দেখেছে। এই ছেলে নিশ্চয়ই ভার্সিটিতে পড়ে। তাই দোপাট্টা খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। ভার্সিটিতে দেখা হলে ফেরত দিয়ে দিবে তার কাছে।
ভার্সিটির সামনে নামতেই দেখলো তেড়ে তার ছোট বোন নূর নাফিসা বের হচ্ছে। কাছে এসেই এক ঝাড়ি মারলো,
– আপু! কোথায় গেছো তুমি! সারা ক্যাম্পাস খুজে ফেলছি, তুমি নাই!
– আরে এক পাগলের পাল্লায় পাড়ছিলাম! এজন্য একটু বের হতে হলো।
– কিসের পাগল!
– কিছু না, বাদ দে। তোর ক্লাস শেষ?
– নাজিয়া আপুর বাসায় না যাবে। এজন্য এক ক্লাস বাদ দিয়ে চলে এলাম।
– আচ্ছা, চল।
যে রিকশা থেকে নেমেছে, সেই রিকশাকেই ডাকলো নাহিদা। তারপর দুই বোন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাড়িতে ফিরে ঘরে ঢুকতেই তাদের মা রুমানা বললো,
– কিরে, আজকে না তারাতাড়ি আসার কথা! নাজিয়ার বাড়িতে যাবি, তাহলে দেড়ি কেন?
নাফিসা জবাব দিলো,
– তোমার মেঝ মেয়ের জন্য দেড়ি হইছে! যত্তসব পাগল ছাগল নাকি তোমার মেয়ের সামনেই পড়ে!
– মানে!
নাহিদা বললো,
– মানে তোমার ছোট মেয়েও এক পাগল। আর ঘুরেফিরে সে এসে আমার সামনেই পড়ে।
রুমানা হাসতে লাগলো। আর দুই বোন ঘরে এসে দ্রুত তৈরি হয়ে গেলো। রুমানা বিড়িয়ানি প্যাক করে দিলো নাজিয়ার জন্য। তারা দুই বোন ঝটপট খেয়ে নিলো। এমনি তাদের বাবা নিয়াজউদ্দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো। আজ হাফ ডে তাই আগেই ফিরে এসেছে। ঘরে পা দিয়েই বললো,
– মেঝ মা ছোট মা এখনো যায়নি বড় মার কাছে! জন্মদিন তো পেরিয়ে গেলো!
দুজনেই একত্রে জবাব দিলো,
– এখনই যাচ্ছি, বাবা।
জবাব একত্রে হয়ে যাওয়ায় দুইবোন খিলখিল করে হেসে উঠলো সাথে তাদের বাবা-মাও। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিয়াজ সাহেব নাহিদার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– সামধানে যাও, মা।
– আচ্ছা।
নাহিদার মাথায় হাত বুলাতে দেখে নাফিসাও বাবার সামনে এসে মাথা পেতে রাখলো। নিয়াজ সাহেব হেসে তার মাথায়ও হাত বুলিয়ে বললো,
– সাবধানে যাও টুনি মা।
– ধুর! আর কতো মা ডাকবা! একবার ছোট মা আবার টুনি মা! একদিকে তো যাও!
– না, আমি সবদিকেই যাবো।
– আচ্ছা, যাও। আমিও এখন আপুর বাড়ি যাই।
দুজনেই বেরিয়ে রিকশা নিলো নাজিয়ার বাড়ি যাওয়ার জন্য।
.
নিয়াজ উদ্দিন “এস আর গ্রুপ অফ কোম্পানির” একজন সাধারণ কর্মচারী। পাচ সদস্য বিশিষ্ট তার এই মধ্যবিত্ত পরিবার। তিনি, তার স্ত্রী- রুমানা ও তিন কন্যা (তৃ-তনয়া)- নূর নাজিয়া, নূর নাহিদা এবং নূর নাফিসা। বড় মেয়ে নাজিয়ার বিয়ে হয়েছে চার মাসের মতো হলো। অনার্স পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই তার বিয়ে হয়ে গেছে। আজ তার জন্মদিন দিন, সেই সূত্রে তারা দুইবোন নাজিয়ার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে।
মেঝ মেয়ে নূর নাহিদা, অনার্স তৃতীয় বর্ষে পরীক্ষা দিবে। আর ছোট মেয়ে নূর নাফিসা সবে মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছে। তিন বোনের পড়াশোনা একই ভার্সিটিতে।
.
পনেরো মিনিট রিকশা ভ্রমণ করে চলে এসেছে নাজিয়ার বাড়িতে। নাজিয়া রান্না করছিলো। তারা সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো। দুজনেই একসাথে বলে উঠলো,
“হ্যাপি বার্থডে আপ্পি!”
নাজিয়া চমকে উঠে পেছনে তাকালো আর দুজনকেই জড়িয়ে ধরে বললো,
– থ্যাংক ইউ সো মাচ মাচ মাচ! এভাবে কেউ সারপ্রাইজ দেয়! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছি!
নাফিসা বললো,
– সারপ্রাইজ দিলে তো দেওয়ার মতোই দিবো তাই না!
– ইশ! তাই বলে আমাকে ভয় দেখিয়ে!
– এতো ভয় পাও কেন তুমি! মুরগির কলিজা বাদ দিয়ে গরুর কলিজা খাও বেশি বেশি। ভয় আর পাবে না।
তিনজনই হাসতে লাগলো। নাহিদা বিরিয়ানির প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
– ভাইয়া বাসায় নেই?
– না, স্কুলে। ফিরে আসবে এখনই। আজকে হাফ ডে না। এগুলো কি?
– মা, বিরিয়ানি রান্না করে দিয়েছে।
– মা-বাবাকে সাথে নিয়ে এলি না!
নাফিসা বললো,
– সাথে আনতে হবে! আসার হলে একা একাই আসতে পারে।
– ঘরে যা, আমি আসছি।
.
নাজিয়ার হাসবেন্ড আরাফ হোসাইন। মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক। তার পরিবারেও পাচজন সদস্য এবং মধ্যবিত্ত পরিবার। তারা দুই ভাই ও এক বোন আর তাদের বাবা-মা। ভাইবোনের মাঝে সে-ই বড়। ছোট ভাই আশিক নাহিদার সাথে একই শ্রেনীতে একই ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত। আর ছোট বোন আয়াত এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
.
নাহিদা আর নাফিসা নাজিয়ার ঘরের দিকে যেতে লাগলো। সামনে পড়লো নাজিয়ার দেবর আশিক। তাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো?
নাফিসা জবাব দিলো,
– চোখ নাই নাকি আপনার! ভালো না থাকলে এখানে আসতে পারতাম!
আশিক মুচকি হেসে বললো,
– ওহ্! তাই তো!
নাহিদা নাফিসার কাধে আস্তে একটা থাপ্পড় দিয়ে আশিককে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। যাও, ঘরে গিয়ে বসো।
শেষ কথাটা বলার আগেই নাফিসা নাহিদার হাত ধরে টেনে নাজিয়ার ঘরে চলে গেলো। ঘরে এসে নাহিদা নাফিসাকে বললো,
– এমনটা কেন করলি!
– মন চাইছে তাই করছি।
নাফিসা রিমোর্ট নিয়ে টিভি ছেড়ে বসলো। নাজিয়া এসে বললো,
– আম্মার সাথে দেখা করেছিস তোরা?
নাহিদা বললো,
– না, যাচ্ছি।
আর নাফিসা নিচু স্বরে বললো,
– এতো ঠেকা পড়ছে নাকি!
নাহিদা নাফিসার মাথায় আস্তে করে ঠুসি দিলো। নাফিসা ভেঙচি কেটে টিভিতে চ্যানেল পাল্টাতে লাগলো। নাজিয়া বললো,
– হিজাব খুলে বসে থাক। আমি ভুনা খিচুড়ি নিয়ে আসছি।
– না, আমরা খেয়ে এসেছি।
– এ সময় এলি, তাহলে খেয়ে এলি কেন! আমি তো তোদের জন্যই রান্না বসিয়েছি!
– সেটা কি আমরা জানি! এখন তো কিছুই করার নেই! আমরা আসার আগে পেট ভরে বিরিয়ানি খেয়ে এসেছি।
– এখন আমি পিটুনি দেই তোদের!
নাফিসা বললো,
– কি দিয়ে পিটুনি দিবে? সাপের পা থেকে হাড় খুলে এনে দেবো?
নাজিয়া হেসে বললো,
– হ্যাঁ, এনে দে।
– তাহলে বসে থাকো।
– ওকে, বসেই থাকছি। তোরাও বসে বসে পেটের খাবার হজম করে নে। আমি পরে দেই খাবার।
নাহিদা বললো,
– আন্টির সাথে দেখা করে আসি।
কথাটা বলে নাহিদা দরজার কাছে যেতেই দেখলো নাজিয়ার শ্বাশুড়ি আয়েশা বেগম আসছে এদিকে। নাহিদা সালাম দিয়ে কথা বললো। তিনিও মুখ গোমড়া করে সালামের জবাব দিলো। তার মুখে হাসি খুব কমই দেখা যায়। আয়েশা বেগম এসে দরজার সামনে দাড়িয়ে নাজিয়াকে বললো,
– তাদের জন্যই রান্না বসাইছো আবার রান্না ছাইড়া যে গল্প করতে লাগছো পুইড়া তো ছাই হয়!
– না আম্মা, আমি রান্না শেষ করেই আসলাম। বসেন এখানে, খাবার এনে দেই।
– নাহ! আমার ঘরে নিয়া যাও।
– আচ্ছা।
আয়েশা বেগম চলে গেলো। নাজিয়া তাদের বসিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আয়েশার খাবার দেওয়ার জন্য। নাফিসা টিভি থেকে চোখ সরিয়ে নাহিদাকে বললো,
– এসব মানুষ ভালো ব্যবহারের উপযুক্ত, তাই না? ওরা তো নিজেরাই ভালো ব্যবহার করতে জানে না!
– চুপ থাক! ওদের ব্যবহার যেমনই হোক, তোর ব্যবহার তুই ঠিক রাখ। নিজে ভালো তো জগৎ ভালো।
.
.
.
[গল্পের নাম বুঝতে অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছে।
তৃ মানে তিন আর তনয়া হচ্ছে কন্যা শব্দের সমার্থক শব্দ।
“তৃ-তনয়া” মানে তিন কন্যা।
আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন।]