তৃ-তনয়া পর্ব-০৩

0
845

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
একটু পরেই আরাফ বাড়িতে ফিরলো। নাহিদা, নাফিসা দুজনেই সালাম দিলো। আর নাহিদা ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে একটু আধটু কথা বললো। নাফিসা তেমন কথা বললো না।
আরাফ হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে এলে নাজিয়া আরাফ, নাহিদা আর নাফিসাকে একসাথে খাবার দিলো। তাদের কথায় সাথে নাজিয়াকেও বসতে হলো। খেতে খেতে নাফিসা বললো,
– ভাইয়া, আপুকে সাথে নিয়ে যাবো আজ। যেতে দিবেন না?
– নাজিয়া গেলে নিয়ে যাও।
– এটা আবার কেমন কথা! আপনি যেতে না দিলে কি আপু যেতে চাইবে!
– আমি নিষেধ করেছি নাকি! নাজিয়া যাবে কিনা সেটা সম্পূর্ণ নাজিয়ার ইচ্ছে! আমি তার ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। যদি আমাকে যাওয়ার জন্য বলতে তাহলে না, আমি নিজের ইচ্ছেটা পোষণ করতাম!
আরাফের প্রথম কথায় মন মালিন্য হয়ে ক্ষেপে গিয়েছিলো নাফিসা কিন্তু আরাফ পরবর্তীতে হাসিমুখে সবটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলে এবার নাফিসার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। তাই বললো,
– হ্যাঁ, আপনিও যাবেন। আগে তো আপুর যাওয়াটা নিশ্চিত করলাম, আপুকে এখানে রেখে তো আর আপনি যাবেন না! এবার বলুন, আপনি যাবেন কি-না?
আরাফ হেসে বললো,
– খাওয়া শেষ করো আগে।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই নাজিয়া প্লেট কিচেনে রেখে এলো। নাহিদা আরাফকে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাইয়া যাবেন না?
– হ্যাঁ, যাবো তো। আজকে তোমরা থাকো। পরে আমরা যাবো।
নাফিসা বললো,
– না, আমরা থাকবো না। আপনি যাবেন কিনা বলুন। আর না গেলেও আপুকে কিন্তু নিয়ে যাবো।
নাজিয়া ঘরে আসতেই আরাফ বললো,
– নাজিয়া, যাবে আমার শ্বশুর বাড়ি?
নাজিয়া হেসে বললো,
– তুমি গেলে যাবো।
– আমি যাবো না। তুমি থেকে আসো। বাবা-মাকে বলে দেই আমি।
– কেন, কাল তো স্কুল বন্ধই। গেলে কি হবে!
নাহিদা বললো,
– হ্যাঁ, ভাইয়া। আপনিও যাবেন। কাল স্কুল বন্ধ।
– আচ্ছা, দেখি।
– কখন দেখবেন! বিকেল হয়ে গেছে!
– হ্যাঁ, আমিও তো সেটাই বলছি। বিকেল হয়ে গেছে, আজ তোমরা থাকো।
– আমরা থেকেছি, এবার আপনি চলুন।
– বাবা আসুক বাসায়, বলে দেখি।
একটু পরেই আরাফের বাবা আলফাজ সাহেব বাসায় ফিরলেন। আরাফ তার বাবা মাকে বললো, তার বাবা বললো যেতে কিন্তু তার মা কোনো মত দিলো না।
সন্ধ্যার একটু আগে আরাফ তাদের সিএনজিতে তুলে দিলো। নাজিয়া চেয়েছিলো আরাফ যাবে সাথে কিন্তু আরাফ বললো কাল যাবে সে। নাজিয়া আয়াতকেও বলেছিলো কিন্তু তার শ্বাশুড়ি সরাসরি না করে দিয়েছে আয়াতকে দিবে না তাদের সাথে। এটাও বলে দিয়েছেন দু এক দিন কাটিয়ে যেন চলে আসে।
সারা রাস্তা গল্প করতে করতে তিন বোন বাড়ি ফিরে এলো। বাবা-মা উভয়েই খুশি, আজ মেয়ের জন্মদিনে মেয়েকে কাছে পেয়ে। রুমানা বেগম নিয়াজ উদ্দিনকে চাল দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন গুড়ো করে আনার জন্য। কাল পিঠা বানাবে। রুমানা রান্না বসিয়েছে, এসময় মা আর তিন মেয়ে গল্পে মেতে উঠেছে। বিয়ের পর এই চারমাসে নাজিয়া তৃতীয়বার বাবার বাড়ি এলো। বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই তার শ্বাশুড়ি ফুসতে থাকে। কাজে ফাকি দেওয়ার জন্য নাকি চলে আসে বাবার বাড়ি। কিন্তু নাজিয়া সেসব নিয়ে চুপচাপই থাকে। বাবা মা আসার কথা বললে, না আসার জন্য নিজেই বাহানা দেয় এটা সেটার। কাউকে কিছু জানায় না শ্বশুর বাড়ির কথা। কিন্তু বাবা মায়ের মন কি সেটা অজানা! আরাফকে ভালো লেগেছে তার বাবার কাছে। আরাফের বাবার আচার-আচরণও ভালো লেগেছে তাই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। আরাফ স্কুলে যাওয়ার পথে নাজিয়াকে প্রায়ই দেখতো সে ভার্সিটি যাচ্ছে। ভদ্র ও চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে মনে হয়েছে তাই ভালো লেগেছে এবং বাবাকে বলেছে তার কথা। তার বাবাই নাজিয়ার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। বিয়ের পর দেখলো শ্বাশুড়ির ব্যবহার ভালো না, তবু্ও তারা নাজিয়ার শ্বশুর বাড়ির সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করে।
নিয়াজ উদ্দিন বাড়িতে ফিরে এলে আরাফের কাছে কল করলো। নাজিয়ার বাবা মা উভয়ই কথা বললো আরাফ ও তার বাবামায়ের সাথে। সবাইকেই কাল আসার জন্য দাওয়াত করলো। আয়েশা বেগম জানিয়ে দিলো আসবে না৷ আফজাল সাহেবও কাজে ব্যস্ত। তাই জানালো ছেলে মেয়েদের পাঠিয়ে দিবে।
বহুদিন পর তিন বোন একসাথে হয়েছে। খাওয়াদাওয়াসহ ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত বাবা মায়ের সাথে তো কথা বার্তা বললোই, ঘুমানোর সময়ও তাদের দুষ্টুমি ফাজলামো, গল্পসল্প আছেই।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই রুমানা ব্যস্ত হয়ে পড়লো পিঠা বানানোর আয়োজনে। সাথে মেয়েরাও হাত লাগিয়েছে। যদিও আরাফকে এখানে এসে নাস্তা করতে বলেছে, তারা তিন ভাইবোন দশটার দিকে নাজিয়াদের বাড়িতে এসেছে। সারাদিন পিঠা খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, বাড়ির আশপাশ ঘুরাঘুরি চললো। নাফিসা তাদের বাড়িতে গিয়ে তেমন কথাবার্তা না বললেও নিজেদের বাড়িতে মেহমানদের আপ্যায়ন ঠিকই করেছে। আয়াত অন্যদের মতো অতটা মজা করেনি, বেশিরভাগ সময় ফোন নিয়েই চুপচাপ বসে ছিলো। বাকিরা হৈ-হুল্লোড়েই কাটালো সময়টা। বিকেলের শেষ দিকে তারা চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। রুমে নাজিয়াকে একা পেয়ে আরাফ বললো,
– তুমি যাবে কবে?
– তুমি কি চাও? এখন চলে যাবো?
– আমি চাই তোমার যতদিন ইচ্ছে থাকো। তবে যেদিন যাবে আমাকে আগে জানিয়ে দিও, প্রয়োজনে নিতে আসবো।
– তুমি যেদিন বলবে সেদিনই চলে যাবো।
– তারপর আমাকে বলো যে, বেড়াতে এসেছো আর আমি থাকতে দেই নি!
– বলেছি কখনো সেটা?
– উহুম, বলো নি ঠিক। থাকো, তিন চার যতদিন ইচ্ছে।
আরাফ তিন চারদিন বললেই কি, ওদিকে শ্বাশুড়ি যে বলে দিয়েছে দু এক দিন! তাই নাজিয়া বললো,
– আজকে থাকো না তুমিও!
– না, কালকে স্কুলে যেতে হবে না! আয়াতেরও কলেজ আছে।
– কাল সকালে যাও। আমিও চলে যাবো কাল সকালে গেলে।
– যাবে তুমি?
– হুম।
– ওকে।
রাতে সবাই থেকে গেলো এখানে। পড়াশোনা হয়নি আজ কারো। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুষ্টুমি আর গল্পগুজবে কেটেছে, বাকি রাত ঘুমিয়ে। টিন শেড বিল্ডিংয়ে তিনটি রুম নাফিসাদের। এক রুমে আরাফ আশিককে পাঠিয়ে আরেক রুমে তারা চারজন থেকেছে। সকালে রুমানা বেগম নাজিয়ার শ্বশুর শ্বাশুড়ির জন্য আবার পিঠা বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। নাজিয়া চলে যাওয়ায় সকলেরই মন খারাপ। কিন্তু কিছুই করার নেই। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, শ্বশুর বাড়িই এখন তার আসল ঠিকানা। বাবা-মা যেন নিজের অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছে! ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেয়েকে আটকে রাখার ক্ষমতা নেই! কেননা সামাজিক মানুষ হিসেবে সমাজের নিয়ম মেনে চলতে যে বাধ্য! “যেতে নাহি দিব হায়, তবুও যেতে দিতে হয়। তবুও চলে যায়!” তাই নিজের ইচ্ছেটাকে অন্তরে পুষে রেখে মন থেকে শুধু এই দোয়াই করে যায়, সন্তান ভালো থাকুক, সুখে থাকুক।
তারা চলে যাওয়ার পরপরই নাহিদা ও নাফিসা রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। একসাথে ভার্সিটিতে এসে দুজনেই ক্লাসে চলে গেলো। ক্লাসে শিক্ষক এলে নাহিদা বই বের করলো। হঠাৎ মনে হলো বই থেকে কিছু পড়লো! নিচে তাকিয়ে দেখলো ছোট একটা রঙিন কাগজ পড়ে আছে। নাহিদা কাগজটা হাতে নিয়ে ভাজ খুলে দেখলো,
” হলুদ ড্রেসে দারুণ লাগে তোমায়। প্রকৃতির সবুজ রূপের মাঝে যেন তুমি একটাই হলুদ ফুল। অনুরোধ তোমার কাছে, অন্য কারো সামনে উপস্থিত হইয়ো না হলুদ পরি হয়ে! কেননা, কোন এক সময় আমি বারবার দেখবো তোমায় হলদে রূপে!”
নাহিদা প্রথমে অবাক হলেও পরে ঠিকই বুঝতে পেরেছে এই চিরকুটটা আশিক রেখেছে তার বইয়ে! কেননা সে ভার্সিটিতে বোরকা পড়ে আসে। আর গতকাল বাসায় সে হলুদ ড্রেস পড়েছিলো। আর কাল হলুদ ড্রেসে যারা দেখেছে তাকে, তাদের মধ্যে আশিক ছাড়া আর কেউ সন্দেহের মাঝে একদমই পড়ে না। কেননা, আশিক তাকে একটু হলেও পছন্দ করে সেটা তার আচার-আচরণ দেখে অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে নাহিদা।
চিরকুটটা মুচড়ে ব্যাগে রেখে ক্লাসে চোখ বুলিয়ে আশিককে খুজলো। কিন্তু আশিক আসেনি আজ ক্লাসে। অত:পর সে ক্লাস করতে মনযোগ দিলো। একের পর এক ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে এলো। আজ তার বান্ধবী গুলোও আসেনি। দোপাট্টার কথা মনে হতেই এদিক সেদিক তাকিয়ে মেহেদী ও তার বন্ধুদের খুজতে লাগলো। কিন্তু কারো দেখা পাচ্ছে না। মাস্টার্সের ক্লাসের দিকে গেলে দেখলো ক্লাস ফাকা। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় দেখলো ছাদ থেকে সিড়ি বেয়ে কয়েকজন ছেলে নামছে। তাদের মধ্যে সেই ছেলেটাও আছে যাকে মেহেদীর সাথে দেখে সন্দেহ করেছিলো তাদের ভার্সিটিতে পড়ে। ছেলেগুলো নামতেই নাহিদা ওই ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– এই যে ভাইয়া, একটু কথা ছিলো।
– কি! আমি?
– হ্যাঁ!
– আমি তোমার সাথে কথা বলবো! মরে গেলেও দ্বিতীয়বার এমন ভুল করবো না! জঘন্য মেয়ে তুমি! উপরে দেখতে ভোলাভালা, ভেতরে জিলেপির প্যাচ!
পাশের ছেলেগুলো এদিকে ওই ছেলেকে রায়ান নাম ধরে বলতে লাগলো, “কিরে রায়ান! কি ব্যাপার! কয়জন পটিয়ে রাখছিস! এতোজন নিয়ে চলস কিভাবে! আমাদের কপালে তো একজনও জোটে না!”
– ধুর! ফাজলামো করিস না তো! মেহেদীর একটা কেসে আমি ফেসে গেছিলাম, এটা মেহেদী ফ্যাক্ট!
কেউ একজন বললো,
– মেহেদী ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড নাকি?
– আরে নাহ! অপরিচিত। অন্য কেস! তোরা বুঝবি না।
এদিকে তারা কথা বলতে বলতে নাহিদাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে দেখে নাহিদা বললো,
– আশ্চর্য! আমি আপনাকে জরুরি কথা বলার জন্য ডাকলাম না!
রায়ান পেছনে ফিরে বললো,
– বোন, মাফ করো আমায়! আমাকে অযথা ঝামেলার মধ্যে ফেলো না! মেহেদী তার প্রয়োজনে বলছিলো তাই তোমার সন্ধান দিয়েছিলাম! যা ঘটার ঘটে গেছে, তা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করো না!
– মানুষ এতো অগ্রিম ভাবে কেন আমি সেটা ভেবে পাই না! আপনি কি জানেন আমি কেন আপনাকে ডেকেছি! না জেনে আপনি এভাবে ইগনোর করে চলে যাচ্ছেন কেন!
– আচ্ছা, কি বলবে বলো?
– আপনার সেই বন্ধুটা কি আজ ভার্সিটি আসেনি?
– মেহেদী?
– হ্যাঁ।
– মেহেদী আমার এক ক্লাস সিনিয়র! সে মাস্টার্স কমপ্লিট করে আরও একবছর আগেই চলে গেছে। আমি এ বছরের যাত্রী। দোয়া করো, এইবার টেস্টে যেন প্রিন্সিপাল না আটকায় আমাকে।
ছেলেটা বড্ড বেশি কথা বলছে যা নাহিদার মোটেও ভালো লাগছে না। তাই সে সরাসরি ব্যাগ থেকে দোপাট্টা বের করে রায়ানের সামনে ধরে বললো,
– এই যে নিন। এটা আমার কাছে রয়ে গিয়েছিল। আপনার বন্ধুর কাছে দিয়ে দিবেন।
– তুমি কি আমাকে দোপাট্টা পড়িয়ে রাস্তায় ঘুরেবেড়ানোর রাস্তা খুজে দিচ্ছো! এইটা নিয়ে গেলে আমাকে মেয়েদের মতো এটা পড়েই রাস্তায় ঘুরাফেরা করতে হবে। আমি আগেই ভেবে নিয়েছি তুমি ডেঞ্জারাস একটা মেয়ে! আমাকে আর দ্বিতীয়বার পেছন থেকে ডেকো না। আর এই দোপাট্টাও কোনোদিন মেহেদীকে ফিরিয়ে দিতে যেও না! তোমার জন্য এমনিতেই আমাদের প্ল্যান মাটি হয়ে গেছে!
রায়ান চলে গেলো তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে। সে কি বলে গেলো নাহিদার মাথায় কিছুই ঢুকলো না! কি থেকে কি বললো তার আগাগোড়াতো তার কিছুই জানা নেই! শুধু জানে এই পাগল গ্রুপের প্রলাপ বরাবরই তার মাথার উপর দিয়ে যায়!
রেগেমেগে দোপাট্টা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো নাহিদা। আবার পরবর্তী ক্লাসের জন্য চলে গেলো।

চলবে।