তৃ-তনয়া পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
472

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৪
(নূর নাফিসা)
.
.
– মেহেদী, জেনিফা ইজ কামিং!
মেহেদী ও নাহিদা দুজনেই তাকালো তার দিকে। তারা তিনজন সহ একটা মেয়ে আসছে তাদের সাথে। পড়নে তার শর্ট কটি আর জিন্স। কালার করা চুল চোখের সানগ্লাস মাথায় রাখা, হাতে বাচ্চাদের মতো ছোট একটা পার্স! পায়ে পেন্সিল হিল।
মেহেদী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– ওয়াও! হোয়াট এ সারপ্রাইজ!
জেনিফা মেহেদীর সাথে হাগ করে বললো,
– হেই জান। এতো ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে কেন তোমাকে! এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছো রাইট?
– ইয়েপ!
– শুনেছি বিয়ে করেছো। বউ নিয়ে মাস্তিতে আছো! আমাকে ইনভাইট পর্যন্ত করলে না!
– ধুর! কিসের বিয়ে! আমি নিজেই তো ইনভাইটেশন পেলাম না! পুতুলের মতো শুধু সেজে মঞ্চে উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছি!
– ওহ-হো!
জেনিফা হেসে উঠলো। মেয়েটার বেশ ও মেহেদীর সাথে ঘেঁষে দাড়ানো মোটেও পছন্দ হচ্ছে না নাহিদার কাছে। জেনিফা নাহিদাকে দেখিয়ে বললো,
– এটা কে?
– ওহ্ এর জন্যই পুতুল সাজতে হয়েছিলো। চলো পরিচয় করিয়ে দেই। হেই সি, সে হচ্ছে জেনিফা। আমার গার্লফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ড তো বুঝো! এবার আমার পিছু ছেড়ে দাও। আমি আমার আশিকা কে পেয়ে গেছি, তুমি এবার তোমার আশিককে খুঁজে নাও। বাই বাই, চলো বেবি..!
জেনিফা মেহেদীর পেটে খোচা দিয়ে বললো,
– কতো দুষ্টু তুমি! চলো ব্রেকফাস্ট করবো।
মেহেদীসহ বাকিরা চলে গেলো। নাহিদার চোখ ছলছল করছে! এই বুঝি অশ্রু গড়িয়ে পড়বে! তার জীবনে এমন সব মুহূর্তগুলো এসে ধরা দিবে তা কখনো কল্পনাও করেনি! রায়ান এখানে দাড়িয়ে ছিলো। কিছু বলতে যাবে তারও সুযোগ হলো না! নাহিদা এক প্রকার দৌড়ে রিসোর্টে ঢুকে পড়লো। রায়ানের ডাক পড়তেই সে আবার তার বন্ধুদের কাছে চলে গেলো। নাহিদার খুব কান্না পাচ্ছে! সে দ্রুত পায়ে হেটে তাদের রুমের সামনে এসে পড়লো। কিন্তু রুম যে তালা লাগানো! সে দরজার সামনেই মেঝেতে বসে কান্না করতে লাগলো! তাদের উপর তলা থেকে লোকজন নামতে দেখে সে উঠে দাড়ালো এবং চোখ মুছতে মুছতে রিসিপশনের কাছে এসে তাদের রুমের এক্সট্রা চাবি নিয়ে গেলো। সে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে তারপর মনেপ্রাণে কাদতে লাগলো! যেন সমুদ্রে সৃষ্ট ঝড় শুধুমাত্র তাকেই ধ্বংস করে গেছে! এটা জানতো তার হাসব্যান্ড একটু বেখেয়ালি কিন্তু এটা তো জানতো না সে এতোটা নীচ! আজকালকার ছেলেমেয়েদের গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বাভাবিক হতে পারে তাই বলে এমন অজ্ঞাত রিলেশনে কিভাবে থাকে! বউয়ের সামনে বউকে নিচু করে গার্লফ্রেন্ডকে পাহাড় সমান মর্যাদা দান করে! বউকে নাক ছিটকে সে এমন একটা পুচকে মেয়েকে নিয়ে ব্রেকফাস্টে চলে যায়! তাও সবটা আবার পরিবারের কাছে লুকিয়ে! এতোটাই যখন পছন্দ ছিলো তাহলে বিয়ে করে ঘরে তুললো না কেন! তার বাবা মা নিশ্চয়ই না করতো না! এখানে এতো সুন্দর সারপ্রাইজ তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা আগে জানা থাকলে কখনোই আসতো না এখানে!
দু’হাতে হাটু ঝাপটে ধরে মেঝেতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে নাহিদা। চোখের জল গাল গড়িয়ে শুকিয়ে আছে। দৃষ্টি পলকহীন তাকিয়ে আছে মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ পানে! কানে ভেসে আসছে বাতাসের শো শো ধ্বনি আর সমুদ্রে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ! ঢেউ যেন সমুদ্রের নয়, এ যেন মনের ভেতরে সৃষ্ট উথাল-পাথাল ঢেউয়ের শব্দ!
সকাল পেরিয়ে দুপুর এসে হানা দিয়েছে। নাহিদা চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। মেনে নিতে হবে ভাগ্যকে। সে ও তো দেখার অপেক্ষায় আছে, ভাগ্যের পরিহাস শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে!
লাগেজ থেকে জামাকাপড় নিতে গেলো গোসল করবে বলে। থ্রিপিস হাতে নিয়েও সেটা রেখে দিলো। শাড়ি পড়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাটবে সে। সে-ও তো ঘুরাঘুরির জন্যই এসেছে, তাহলে অন্যের অবহেলা সহ্য করে বসে থাকবে কেন!
গোসল করে শাড়ি পড়ে বেরিয়ে এসে দেখলো মেহেদী ভেজা কাপড়ে হাতে ফোন নিয়ে দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। ওয়ালেটটা খাটে রাখা আছে। নাহিদা ভেজা কাপড় নিয়ে বারান্দায় যেতেই মেহেদী বললো,
– এতোক্ষণ লাগে বাথরুমে! সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছি ভেজা কাপড়ে!
নাহিদা তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। নিজের কাজ করতে লাগলো। মেহেদী ফোন রেখে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নাহিদা দেয়ালে আটকানো আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে সজ্জিত করতে লাগলো। ঘন কালো লম্বা চুলগুলো আঁচড়ে বাকা সিতি করে খোলা রাখলো। কাজল নিয়ে চোখে চিকন রেখা টানলো। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করলো। মেহেদী মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে তাকে সাজুগুজু করতে দেখে বললো,
– এতো সাজুগুজু করছো কার জন্য! আশিক খুজে পেয়ে গেছো নাকি! নিতে আসবে? রুম শিফট হবে?
নাহিদা তার দিকে ফিরে বললো,
– আপনাকে কোনো কিছু জানাতেই বাধ্য নই! তা জামাকাপড় রেখে আসছেন কার জন্য! নিজের কাজ নিজে করুন, জামাকাপড় বাথরুমে দেখলে জানালা দিয়ে সোজা নিচে চলে যাবে।
– হু! আমার খেয়ে, আমার পড়ে, আমার রুমে থেকে আমাকেই ধমকি দাও!
– আপনার রুম কিভাবে হলো! এটা রিসোর্টের মালিকের রুম!
– আমি ভাড়া করেছি তো এখন আমা..
– আপনি ভাড়া করেননি। আমার শ্বশুর মশাই ভাড়া করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।
– বাহ! আমি বাপের দাপট দেখাতে পারবো না আর তুমি শ্বশুরের দাপটে আছো!
– লজ্জা করে না এতো বড় ছেলে হয়ে এখনো বাপের দাপটে চলেন! নিজের দাপট কবে সৃষ্টি করবেন!
– এই মেয়ে! তুমি কিন্তু লিমিট ক্রস করে যাচ্ছো!
– আমি তো লিমিট স্পর্শই করতে পারলাম না, ক্রস করলাম কখন!
– কথা কম বলো।
– আমি তো বলতেই চাই না কিছু! শুরুটা তো আপনিই করলেন!
– তুমি!
– আপনার মাথা!
নাহিদা জুতা পড়ে ফোনটা হাতে নিলো। দুশো টাকা খাটে রাখা মেহেদীর ফোনের উপর ঢিল মেরে ফেলে বললো,
– এই নিন আপনার দুশো টাকা। আপনারই কাজে লাগবে সেটা।
নাহিদা সাথে সাথেই তার পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে মেহেদী বললো,
– এই, কোথায় যাচ্ছো তুমি!
– যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে যাচ্ছি!
নাহিদা আর এক সেকেন্ডও দাড়ালো না সেখানে। দরজাটা ঠাস করে চাপিয়ে বেরিয়ে এলো। প্রথমেই ঢুকেছে রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে। এখানে লাঞ্চ সেড়ে নিবে। তার নিজেরও কিছু টাকা ছিলো আবার মেহেদীর অগোচরে জহিরুল ইসলাম এখানে আসার সময় তার হাতে পাচ হাজার টাকা দিয়েছিলো নিজ খরচের জন্য। আর মেহেদীকে জানাতেও নিষেধ করেছিলো কেননা সে জানলে তার জন্য নিজ পকেট থেকে এক টাকাও খরচ করবে না। নাহিদা এখন সেই টাকা নিজের জন্য কাজে লাগাচ্ছে। সে অল্প খাবার অর্ডার করলো যতটুকু এখন তার প্রয়োজন। রেস্টুরেন্টের প্রথম টেবিলেই সে বসেছে। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে মেহেদীসহ তার বন্ধুরা রেস্টুরেন্টে এলো। নাহিদা একবার তাদের দিকে তাকিয়েও আবার নিজের খাওয়ার দিকে মনযোগ দিলো। হিমেল বললো,
– কিরে মেহেদী! তোকে ছাড়াই ভাবি রেস্টুরেন্টে! ভাবি, আপনি একা একাই খাচ্ছেন! আমাদের ডাকবেন তো একবার!
– কেন! আপনারা ঘুরাঘুরি করার সময় কি আমাকে ডেকে নেন! তাছাড়া আপনাদের জেনিফার লোপেজ চলে গেছে! তার কাছে যান।
– আর বলেন না, সকালে পকেট খালি করে ফেলেছে। শুধু খাওয়ার ধান্দা!
কথাটা বলে হিমেল এখানেই বসে পড়লো। চেয়ার গুলো খালি থাকায় মেহেদীও এখানেই বসে পড়লো। চারটি চেয়ার ছিলো, তাই রায়ান অন্য টেবিল থেকে একটা টেনে এখানেই বসিয়ে নিলো। মেহেদী ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার দিলো। নাহিদার সামনে রাখা জুসের গ্লাসটা ধরতে যাবে এমন সময় নাহিদা টেনে নিয়ে বললো,
– এটা আমার জুটা।
– গ্লাস তো ফুলফিলই দেখছি!
– তো কি হয়েছে! আমার তো!
– আরেকটা নিয়ে নিলেই হয়!
নাহিদা তার জবাব না দিয়ে একটু জুস খেয়ে আবার প্লেটের বাকি খাবার খেতে লাগলো। তার ভাব দেখে মেহেদী একটু বিরক্ত হলো আর বাকিরা অবাক! নাহিদা সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজের খাবার শেষ করে বিল দিয়ে তাদের সামনে থেকে উঠে চলে গেলো।
বাইরে এসে সমুদ্রের পথে যেতে লাগলো। এমন সময় তার সামনে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে এসে দাড়ালো। মেয়েটার বয়স আট কিংবা নয় হবে আর ছেলেটা পাচ কিংবা ছয়। মেয়েটা নাহিদাকে বললো,
– মেডাম শামুক কিনবেন? সমুদ্রের সাদা চুনা শামুক।
নাহিদা মৃদু হেসে বললো,
– শামুক দিয়ে আমি কি কি করবো!
– কে, শামুক দিয়া তো কত কিছুই বানানো যায়। আপনেও বানাইবেন। নেন না। বিশ টাকার নেন। ভাইডার ক্ষিধা লাগছে। আমার তো টাকা নাই। আজকা এক টাকারও বেচতে পারি নাই।
– ও তোমার ভাই?
– হু।
– নাম কি তোমার?
– পরি। আর আমার ভাই পারভেজ।
– তোমার বাবা-মা কোথায়?
– মায়ের খবর জানি না তো! বাবা, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়া হারায় গেছে।
মুহূর্তে নাহিদার মুখটা মলিন হয়ে গেছে! সে মলিন মুখে বললো,
– থাকো কোথায়?
– বাড়ি আছে তো আমাগো।
– ওহ, তুমি আর তোমার ভাইই থাকো বাড়িতে?
– হু।
– রান্না করে কে?
– একটা দাদি আছে, চাইল ডাইল নিয়া দিলে রান্না কইরা দেয়।
– তুমি খেয়েছো কিছু?
মেয়েটি মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে “না” জবাব দিলো। নাহিদা বললো,
– আচ্ছা, আমি পঞ্চাশ টাকার নিবো শামুক। এখন চলো আমার সাথে।
– কই যামু?
– আমি খাবার কিনে দেই।
– আপনে কি ছেলেধরা!
নাহিদা মুচকি হেসে বললো,
– উহুম, আমি ওই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বলছি। খাবার কিনে দিবো তোমাদের। তোমরা খেয়ে আবার চলে যেও। চলো।
নাহিদার সাথে বাচ্চা দুটি রেস্টুরেন্টে এলো। মেহেদী ও তার বন্ধুরা খাচ্ছে। তারা তাকে দেখে আবার সাথের জনদের দিকে তাকালো। নাহিদা তাদের দিকে না তাকিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য একটা টেবিলের দিকে গেলো। যেটাতে কোনো মানুষ নেই। বাচ্চাদের সেখানে বসতে বলে সে খাবার অর্ডার করলো। মেহেদী ও বাকিরা খেতে খেতে নাহিদার দিকেই দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে। খাবার অর্ডার করে নাহিদা তাদের কাছেই বসে রইলো। এমনি নাফিসার কল এলো। সে ফোনে কথা বলতে লাগলো। ওয়েটার খাবার এনে দিলে নাহিদা কথা বলতে বলতেই বাচ্চাদের দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে খেতে বললো। বাচ্চারা খেতে লাগলো। মেহেদীর খাওয়া শেষ হলে উঠে এসে বললো,
– এতো টাকা পেলে কোথায়! নিজের খাওয়া আবার এদের এনে খাওয়াচ্ছো!
– আপনার কাছে আমি হিসাব চেয়েছি কিছুর! তাহলে আমার টাকার হিসেব নিয়ে আপনার এতো মাথাব্যথা কেন!
এমন পালটা জবাব শুনে মেহেদী ব্রু কুচকে তাকালো তার দিকে। নাহিদা বাচ্চাদের থেকে নেওয়া শামুক গুলো টেবিলে নেড়েচেড়ে খেলতে লাগলো। মেহেদীরা তাদের বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে গেলো। বাচ্চাদের খাবার শেষ হতেই নাহিদা বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। এমনি মেহেদী দৌড়ে এসে তার পেছনে এক হাত রেখে জড়িয়ে ধরে দাড়ালো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৫
(নূর নাফিসা)
.
.
বাচ্চাদের খাবার শেষ হতেই নাহিদা বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। এমনি মেহেদী দৌড়ে এসে তার পেছনে এক হাত রেখে জড়িয়ে ধরে দাড়ালো। নাহিদা প্রথমে একটু অবাকই হলো এবং একটু কেপেও উঠলো মেহেদীর স্পর্শে! অত:পর দেখলো মেহেদী ভিডিও কল রিসিভ করে বললো,
– আম্মু, এই যে দেখো। তোমরা তো আমার কথা বিশ্বাস করো না। দেখেছো?
– তুই তো বললি সে খাচ্ছে, আমি তো দেখছি সে বাইরে কোথাও দাড়িয়ে আছে!
– ওই যে, পেছনে রেস্টুরেন্ট দেখো না! এই মাত্র বের হয়ে এলাম! কি গো, বলো।
নাহিদা তার এতো বানোয়াট মিথ্যা ও অভিনয় দেখে তার মুখের দিকে তাকালো। মেহেরুন বললো,
– লাঞ্চ করেছিস নাহিদা?
– হ্যাঁ, মা।
– মেহেদী তোর খেয়াল রাখছে তো?
– হ্যাঁ, প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত রেখে যাচ্ছে। আমার সাথে আরও কারো এক্সট্রা খেয়াল রাখছে।
– কার কথা বলছিস?
– জিজ্ঞেস করুন উনাকে।
মেহেদী বুঝে গেছে নাহিদা জেনিফার কথা বলছে। তাই সে নাহিদাকে ছেড়ে দিয়ে হাটতে হাটতে বললো,
– আম্মু, হয়েছে এবার রাখো তো। এতোবার কল করে জাসুস করে আমাদের হানিমুনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছো!
– নাহিদা কি বলছে!
– আরে, শামুক কিনে দেই নি তাই রাগ করেছে। রাখো রাখো, রাগ ভাঙাই!
মেহেদী কল কেটে নাহিদার কাছে এসে বললো,
– এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি! আমি যার তার খেয়াল রাখবো তাতে তোমার কি!
– আমিও তো সেটাই বুঝতে পারছি না, আপনি এতো শত অভিনয় কেন করে যাচ্ছেন! ভয় পান, যদি জেনিফা লুপেজের কথা বাবা মা জেনে যায়!
– শাট আপ! এসব বিষয় নিয়ে আব্বু আম্মুকে কিছু জানাবে না। আমার বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি কম করো। টাকার প্রয়োজন হলে বলো।
– হুহ্! নিজেই টাকার জন্য শ্বাস গণে আমাকে আবার টাকার গরম দেখায়!
কথাটা বলে নাহিদা আগে পা চালালো। হাটতে হাটতে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাটতে লাগলো। ঢেউ এসে তার পা ও শাড়ি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাতাস চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে একদিকে। ঢেউ ও বাতাসের মিশ্রিত ধ্বনি শো শো শব্দে ভেসে আসছে কানে। খুব ভালো লাগছে পরিবেশটা। কেউ সমুদ্রে ঝাপঝাপি করছে, কেউ কেউ প্রিয় মানুষের হাত ধরে ধীর পায়ে হাটছে আবার কেউ বালিতে ফুটবল খেলছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে মেহেদীরা উপস্থিত। রায়ান ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে নাহিদার দিকে। নাহিদা হাটছেই। রায়ান কল কেটে বললো,
– ভাবি এক মিনিট।
– জ্বি?
– জেনিফার কথা বলতে আসছিলাম।
– আমাকে কি একটু নিজের মতো চলতে দিবেন না! খুব মজা পান আপনারা অন্যকে কষ্ট দিয়ে! আপনার বন্ধু বউয়ের সামনে অন্য মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো আর আপনি এসেছেন এখন তাদের গল্প শুনাতে। তারা কি করেছে না করেছে আমি এসব কিছু জানতে চাই না। দয়া করে মানুষের মনটাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনাদের কষ্ট না হতে পারে তবে আমার মতো সাধারণ লোকজনের হয়।
– আপনি ভুল ভাবছেন, আমি সেসব বলতে আসিনি। জেনিফা মেহেদীর গার্লফ্রেন্ড না।
– সে নিজে বললো গার্লফ্রেন্ড আর আপনি উল্টো সুপারিশ!
– সুপারিশ না। একসাথে চলাফেরা জেনিফার সাথে। তবে সে নিজেকে মেহেদীর গার্লফ্রেন্ডই ভাবে। ভালো না মেয়েটা, বাজে প্রকৃতির। আমরা একটু এড়িয়েই চলি। কিন্তু ওইযে একসাথে চলাফেরা, সেই সূত্রেই মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ। আমি বুঝতে পেরেছি তখন আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু যা ভেবেছেন তা নয়। সে একটু লোভী প্রকৃতির মেয়েও বটে। দুর্ভাগ্যবশত সকালে দেখা হয়ে গেছে, আর আমাদের পকেট খালি করে ছেড়েছে। ভাগ্যিস এতো টাকা নিয়ে বের হইনি। সে বরাবরই এমন। আগে জানলে পালিয়ে থাকতাম! তবে এটা ঠিক, মেহেদী পরিবার থেকে সবসময় একটু দূরেই থাকতে চায়। ও স্বভাবতই একটু অন্যমনস্ক এবং আমাদের থেকে আলাদা। আমরা তো অভাবের টানে কোনো না কোনো কাজে নিযুক্ত কিন্তু তার তো কোনো অভাব নেই, তাই এমন। কাজকে সে বোরিং মনে করে এবং সর্বদা এড়িয়ে চলে। বলেছিলাম তাকে কিন্তু কাজ হয়নি। তবে বন্ধুরা মিলে মাঝেমধ্যে নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে একটু পার্টি করি। এছাড়া আর অন্যান্য খারাপ কাজে আমরা কেউই লিপ্ত না। আমি যতদূর জানি, মেহেদীর জন্য আপনার মনে কোনো ই জায়গা নেই। শুধু আপনি না, অন্য কেউ বউ হয়ে এলেও হয়তো একই অবস্থা থাকতো। ও রাতেও আমাদের রুমে থাকতে চেয়েছিলো। এক বিছানায় একসাথে ধাক্কাধাক্কি হবে, আঙ্কেলের টাকা উশুল হবে না এমন নানান কথা বলে তাকে পাঠিয়েছি আপনাদের রুমে। আংকেলের কাছ থেকেও আমাদের কাছে একটা বার্তা এসেছে যাতে তাকে নিজের বুঝটা বুঝতে বাধ্য করি। কিন্তু সে যদি না বুঝতে চায় তাকে জোর করে কি বুঝানো যায়! আই হোপ, আমরা যেহেতু ঠেলে রুম পর্যন্ত পৌছে দিতে পেরেছি সেহেতু আপনি ঠেলে ঠেলে একটু হলেও ঘরে থেকে বাকিটা করতে পারবেন। আই মিন, চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
হঠাৎ রায়ানের ফোন বেজে উঠলো। রায়ান কল রিসিভ করে নাহিদা থেকে দু তিন একদম পিছিয়ে বলতে লাগলো,
– আচ্ছা, তুমি বুঝতে পারছো না কেন! আমি তো অস্বীকার করছি না বেড়াতে এসেছি। মেহেদী হানিমুনে এসেছে আর হঠাৎই ডেকে নিয়ে এসেছে আমাদের। রাগ করে না, পাখি! আমাদের বিয়ের পর আমরা আবার হানিমুনে আসবো। ওকে? ধ্যাৎ!
কথা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেছে তাই নাহিদা বুঝে নিলো ওপাশ থেকে হয়তো রাগ করে কেটে দিয়েছে। রায়ান ফোন পকেটে রাখতে রাখতে আবার নাহিদার কাছে আসতেই নাহিদা বললো,
– গার্লফ্রেন্ড?
রায়ান মুচকি হেসে বললো,
– গার্লফ্রেন্ড ছিলো এখন হবু বউ। হয়তো ক’দিন পর বউ হয়ে যাবে।
– ভালো। আপনার বন্ধুর মতো হয়ে আবার মেয়েটার কপাল পুড়েন না। মেয়েরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে পদার্পণ করে, সেটা কিছু অবুঝ ছেলেরা না বুঝতে পেরে স্বপ্নগুলো গড়ার আগেই ভেঙে দেয়। যাকে বলা যায় গোড়ায় গলদ!
– হুম, যুক্তি আছে আপনার কথায়। স্বীকার করি সেটা তবে কিছু মেয়ে আছে যারা স্বপ্ন বুনতেই জানে না। যাইহোক, আপনি ওকে চিনবেন মনে হয়। আপনাদের আত্মীয়ই হয়।
বলতে বলতে রায়ান পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে একটা ছবি এনে নাহিদার সামনে ধরে বললো,
– চিনেন না?
– আয়াত!
– হুম।
– ও তো আমার আপুর ননদ।
– হ্যাঁ, আপনার বিয়ের দিন জানলাম আপনার আত্মীয়।
– আয়াত কি জানে, আপনি এসব পার্টি করেন আর ড্রিংকস করেন?
রায়ান মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ফোন পকেটে রাখতে রাখতে দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে বললো,
– জেনেছিলো আর জানার পর থেকেই আমি ওসব থেকে দূরে। এখনো পার্টিতে জয়েন করি তবে নেশা জাতীয় কিছুতে হাত লাগাই না।
– আপনার বন্ধুরা গিলে আর আপনি বসে থাকেন!
রায়ান তাচ্ছিল্যের সাথে নিশব্দে হেসে বললো,
– নিজ মনের ইচ্ছাশক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি! আমি যদি স্বেচ্ছায় ওদিকে না যাই তাহলে অন্যদের দ্বারা আমাকে ওদিকে নেওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২%। আমার মতে যেটা, সেটা বললাম আরকি! আমি ৯৮% এ টিকে আছি সেদিনের পর থেকে। কেননা আয়াতকে নিয়ে আমার খুব ভয়! অল্পতেই অনেক ভেঙে পড়ে এবং ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে! তাই তার অপছন্দের দিকে যেতে আমাকে শতবার ভাবতে হয়!
– প্রকৃত প্রেমিক, তবে প্রেমটা বিয়ের পর হলেই ভালো হতো। যাইহোক, ড্রিংকসের কথা শুনে কি এমন ভয়ংকর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছে সেটা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– তখন কিছু করেনি, শুধু আমাকে ওয়ার্নিংএ রেখেছে। তার মা বিয়ে ঠিক করাতে নাকি গলায় ফাস দিতে গিয়েছিলো! ভাবি মানে আপনার বোনই বাচিয়েছে। কাউকে কিছু জানায়ওনি, হুটহাট এমন সিদ্ধান্ত!
– হোয়াট! আপনি পূর্ব থেকে জানতেন না তেমন কিছু! এমনও তো হতে পারতো যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে! ডিরেক্টলি সুইসাইড!
– বিশ্বাস করবেন! তখন থেকে ফুললি মেড মনে হয়েছে তাকে! ভেবেছি শেষ পর্যন্ত একটা পাগলকে ভালোবেসেছি যে কিনা নিজের জীবনকে ভালোবাসতে জানে না! সে নিজেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে আবার নিজেই আমাকে ঠান্ডা মাথায় এই গল্প শুনিয়েছে! আমি তখন রাগান্বিত হবো নাকি হাসবো নিজেই বুঝতে পারছিলাম না! তবে এরপর থেকে মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। এখন আমার কাছে আনতে পারলেই আমি টেনশন মুক্ত!
হঠাৎই মেহেদী দৌড়ে এসে বললো,
– ওই, তুই এখানে কি করছিস রে! এর সাথে কি! খেলবি না?
– না, তোরা খেল।
– শুনে যা একটু।
মেহেদী রায়ানের কাধে ধরে নাহিদা থেকে একটু দূরে গিয়ে ফোন ওয়ালেট দিয়ে বললো,
– এগুলো রাখ তোর কাছে। জেনিফা আবার আসছে! তুই এদিকেই থাক। ওদিকে যাওয়া তোর বারন।
কথা ফিসফিস করে বললেও নাহিদার কান পর্যন্ত এসেছে। মেহেদী আবার দৌড়ে চলে গেলো খেলায়। জেনিফাকে আসতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র তীরে। রায়ান নাহিদার কাছে একটু সুপারিশ চাইলো। আয়াতকে ভিডিও কল করে নাহিদাকে দেখালো এবং বিশ্বাস করালো যে মেহেদী হানিমুনে এসেছে আর তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে এসেছে। তবে মেহেদীর এখনকার আচরণে নাহিদার কাছে পরিষ্কার তার মনে জেনিফার জন্য কোনো ফিলিংস নেই, রায়ান যা বলেছে সব সত্য। রায়ান আর ওদিকে যায়নি, ফোনে কথা বলতে বলতে নাহিদার আশপাশেই হেটেছে। নাহিদাও নোনা জলে পা ভিজিয়ে একা একাই উপভোগ করেছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। সূর্যাস্ত দেখে তারপর রিসোর্টে এসেছে সে। সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসায় এবং মেহেদীর বেখেয়ালিপনা দেখে রায়ান স্বেচ্ছায় রিসোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে নাহিদাকে৷ মেহেদীরা তখনও সমুদ্রের তীরেই ছিলো।
রাতে আর নাহিদা ভারি খাবার কিছুই খায়নি। খাওয়ার ইচ্ছেও নেই। সেদিনের কিনে দেওয়া ফাস্টফুড খাবারগুলোই এখনো আছে। নাহিদা সেখান থেকে চিপসের প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেতে লাগলো। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পেছনে ফিরে দেখলো মেহেদী দরজা খুলে রুমে এসেছে, হাতে তার একটা গ্লাস। গ্লাসটা মেহেদী বেডসাইড টেবিলে রেখে বাথরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। বেরিয়ে এসে দেখলো নাহিদা পানির মতো ঢকঢক করে গিলে ফেললো গ্লাসের সবটুকু! মেহেদী দেখে একদম হা হয়ে গেছে! নাহিদা গ্লাস টেবিলে রেখে মুখ মুছতে লাগলো। মেহেদী তেড়ে এসে বললো,
– এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছো! তুমি এটা খেয়ে নিলে কেন! তুমি জানো এটা কি!
– কি আবার! পানি!
– তোমার মাথা! এটা ওয়াইন!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৬
(নূর নাফিসা)
.
.
– এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছো! তুমি এটা খেয়ে নিলে কেন! তুমি জানো এটা কি!
– কি আবার! পানি!
– তোমার মাথা! এটা ওয়াইন!
– ওয়াইন! ওয়াইন আবার কি!
– ড্রিংকস বুঝো!
– ধুর! পাগল হয়ে গেছেন আপনি! আমি বোতল থেকে ঢেলে পানি খেলাম আর আপনি বলছেন ড্রিংকস!
– এ! বোতল থেকে আবার ঢেলে নিয়েছো!
– কি আশ্চর্য! এই যে পানির বোতল!
– বোতল তো পানির। গ্লাসে যে কিছু ছিলো সেটা তোমার চোখে পড়েনি!
– হ্যাঁ, গ্লাসের অর্ধেক পানি রাখা ছিলো। আমি এক গ্লাস পানি পানের জন্য বোতল থেকে ঢেলে গ্লাস ভরে নিয়েছি।
– ওফ্ফ! শীট! আমি আমার জন্য এতো টাকা খরচ করে এটুকু নিয়ে এলাম, এদিকে এই মাথামোটা গিলে বসে আছে!
– কি খেয়ে এসেছেন আপনি বলুন তো! এমন আজেবাজে বকে যাচ্ছেন কেন আমাকে! আমি আপনার মতো না! আমার ঘুম পেয়েছে, ডন্ট ডিস্টার্ব মি!
কথাটা বলেই নাহিদা দাড়ালো এবং সাথে সাথেই ধপাস করে বসে পড়লো খাটে! ঘন ঘন পলক ফেলে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনি এভাবে ঘুরছেন কেন, বলুন তো! আমার সামনে থেকে যান! কাউকে ঘুরতে দেখলে আমার মাথা ঘুরে! যান বলছি!
নাহিদার কথায় মাতলামো নেমে এসেছে! মেহেদী বেশ বুঝতে পারছে একশন করে ফেলেছে তাকে! এখন নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে তার! এই মেয়ে না জেনে হঠাৎ গিলে ফেললো, এখন না জানি কি অবস্থা হয়! এর কি এসবের অভ্যাস আছে! তার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে নাহিদা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এই! আপনি এভাবে ঘুরবেন না একদম! আমাকে ধরুন, আপনার ঘুরাঘুরি বন্ধ হয়ে যাবে। কি হলো ধরুন। আমি উঠতে পারছি না কেন! ওয়াশরুমে যাবো কিভাবে এখন!
মেহেদীর এখন কান্না করতে ইচ্ছে করছে! তবুও সে হাত বাড়িয়ে নাহিদাকে টেনে দাড় করালো। নাহিদা দাড়িয়েছে ঠিকই তবে মেহেদীর উপর হেলে পড়েছে। অত:পর দু’হাতে কলার মুঠোয় ধরতেই মেহেদী বললো,
– আরে কি করছো! সোজা হয়ে দাড়াও!
– হেই! চুপ! একটা কথাও না! এত্তো বদমাশ, বদমেজাজি কেন আপনি!
– হোয়াট!
– আবার বলে হোয়াট! একদম চুপ! আমি কথা বলছি না! আমার কথার মাঝে কোনো কথা না! আপনি আমাকে এতো ইগনোর করেন কেন! এতো বকাঝকা করেন কেন! একা একা ঘুরেন কেন! হানিমুনে কেউ বউ রেখে একা ঘুরে! ওই ওই কি যেনো, ধুর লুপেজ টুথপেজ কি যেন! ওই মেয়ের সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক! ওর সাথে কিসের ঘুরাফেরা! আমি আছি না, আপনার বউ! হু?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ আছো। আমার কলার ছাড়ো। টিশার্ট ছিড়ে যাবে।
– চুপ! ছিড়ে যাক! ওয়ারড্রব ফুলফিল টিশার্টে! একটাই তো ছিড়বো, বউ না আমি!
– আরে কি শুরু করেছো! পাগল হয়ে গেছো! সোজা হও!
– চুউউপ! তুই পাগল, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল!
– কিহ! আবার তুই তোকারি শুরু করেছো!
– ওহ্! না, সরি সরি, আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল।
মুহুর্তেই গলার সুর আহ্লাদী হয়ে গেছে নাহিদার! সে আহ্লাদী কন্ঠে বলতে লাগলো,
– এমন কেন আপনি! বিয়ে হয়েছে আমাদের! আমি তো আপনার বউ! কিভাবে পারলেন আমার সামনে দিয়ে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে। আমি খেয়েছি কিনা সেই খবর নেই, আপনি এমন বাজে একটা মেয়েকে নিয়ে যান ব্রেকফাস্ট করার জন্য! কিভাবে পারলেন আমাকে ধমকে একা ফেলে ঘুরতে যেতে! আমার তো খুব কষ্ট লেগেছে! খুব কষ্ট হয় আমার একা থাকতে! আপনি আমাকে একা রেখে বেড়াতে যান কেন! বাবা একসাথে পাঠিয়েছে না! তবুও আপনি বউ ছেড়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুরেবেড়ান! ওই মেয়েটা কি ভালো! ও তো দেখতেই বাজে! কি ছোট একটা টপস্ পড়েছে! ছেলেদের মতো জিন্স পড়েছে! সে তো মেয়েদের কাতারেই পড়ে না! ছেলে না মেয়ে সেটা লোকেদের বুঝতে অসুবিধে হবে! তাহলে ও আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় কিভাবে! আমি কি ভালো না! হ্যাঁ? আমি তো এমন বাজে পোশাক পড়ি না, ছেলেদের সাথে এভাবে মিশি না। তাহলে আমি কি ভালো মেয়ে না?
কথা বলতে বলতে নাহিদার গাল গড়িয়ে জলধারা বইছে! দৃষ্টি তাদের একে অপরের দিকে। নাহিদার উত্তরে মেহেদী তার হাত ছাড়াতে ছাড়াতে নরম গলায় বললো,
– হ্যাঁ, তুমি অনেক ভালো।
কথাটা বলার সাথে সাথেই নাহিদা মেহেদীর গলা ঝাপটে ধরলো। কাশতে লাগলো, যেন কাশতে পারছে না ঠিকমতো! এদিকে মেহেদী ছাড়াতে চেষ্টা করলো। কিন্তু নাহিদা তার টিশার্ট আঁকড়ে ধরে রাখলো!
– নাহিদা, ছাড়ো। সোজা হও।
– উহু, আপনি এমন কেন! আমি তো খারাপ না। আমি ভালো। তাহলে আমাকে সরিয়ে দিচ্ছেন কেন! ওই মেয়েটা আপনাকে এভাবে ধরলে আপনি সরিয়ে দিতেন?
– হ্যাঁ, দিতাম। ছাড়ো।
– কই দেননি তো! সকালে ধরেছে না আপনাকে! আমি আপনার বউ, আমাকে সরিয়ে দিচ্ছেন কেন!
– তুমি না ওয়াশরুমে যাবে। যাও। রাত হয়েছে ঘুমাবো তো!
কথা বলে সারতে পারেনি মেহেদী! নাহিদা তার উপর বমি করে দিয়েছে! নাহিদা এবার তাকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো বমি করতে করতে! মেহেদীর এখন চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে! এমন সময় তার টিশার্টের এ কি হাল করলো মেয়েটা!
– হোয়াট রাবিশ! এসব কি করেছো!
নাহিদা তার কথায় কোনো রেসপন্স করলো না! সে কোনোমতে উঠে বাথরুমে দৌড় দিলো! বমি করে মুখে পানি ছিটিয়ে হেলতে দুলতে বেরিয়ে এলো। মেহেদী না পারছে সইতে আর না পারছে এই মাতাল মেয়েকে কিছু বলতে! সে তার জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো গোসলের জন্য! এই রাতের বেলা তাকে আবার গোসল করতে হলো! বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো নাহিদা মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে খাটের উপর মেহেদীর ফোন নিয়ে কিছু করছে! মেহেদী এসে ফোন নিয়ে নিলো হাত থেকে এবং দেখলো গেমস খেলছে সে! ফোন পকেটে নিয়ে সে দরজার দিকে যেতে লাগলো। নাহিদা দাঁড়িয়ে বললো,
– কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
– তোমার সাথে এখানে এই রুমে থাকবো আমি আরও!
কথাটা বলে মেহেদী দরজা খুলতে লাগলো কিন্তু দরজা লক করা! নাহিদা চাবি দেখিয়ে হেসে উঠলো। মেহেদী চাবি নিতে গেলে সে লাফিয়ে খাটে উঠে পড়লো এবং হাসতে লাগলো। মেহেদীও খাটে উঠে তার হাত থেকে চাবি নেওয়ার চেষ্টা করলে নাহিদা সুযোগ বুঝে তাকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিলো। এবং চাবি খাটের স্টেনের পেছনে ঢিল মেরে ফেলে দিয়ে মেহেদীর উপরে শুয়ে পড়লো। মেহেদী তাকে সরানোর জন্য চেষ্টা করতেই নাহিদা তার গলা ঝাপটে ধরে ঘাড়ে জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলো!
“আহ!”
নাহিদা মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। মেহেদী বিরক্তি নিয়ে বললো,
– এই মেয়ে! পাগল হয়ে গেছো! কামড়াচ্ছ কেন!
– আপনি এই রুম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কেন!
– তাই বলে এতো জোরে কামড় দিবে!
– হুহ্! চেচান কেন! আপনিও তো আমাকে কামড় দিয়েছেন! আমি চেচিয়েছিলাম!
– শাট আপ! মাতাল হলে সবাই সত্য বলে আর তুমি মিথ্যে বলছো কেন! আমি তোমাকে কখন কামড় দিলাম!
– দেননি! ভুলে গেছেন! বাসর রাতে আমার পেটে কামড় দেননি! এখনো তো ব্যাথা পাই আমি!
নাহিদা তাকে ছেড়ে দিয়ে বসে পেটের শাড়ি সরিয়ে বললো,
– এই যে! দাগ এখনো আছে।
মেহেদীও ওঠে বসে পড়লো এবং দেখলো সত্যিই দাগ আছে পেটে। কিন্তু সে এসব করেছে বিশ্বাস হচ্ছে না তার! সে কিছু না বলে নামতে যাবে, এমন সময় নাহিদা তার পায়ের উপর বসে পড়লো! মেহেদীকে ধাক্কা দিলো শুয়ে পড়ার জন্য কিন্তু মেহেদী দু’হাতে ভর দিয়ে হেলে পড়ে বসেই আছে। নাহিদা চাদরটা তাদের উপর টেনে নিয়ে মেহেদীর গলা ঝাপটে ধরে বললো,
– রুম থেকে চলে যাবেন কেন আপনি! আমি আপনার বউ না! বিয়ের পর তো বউয়ের সাথে থাকতে হয়। আপনি যাবেন না। আমি একা থাকতে ভয় পাবো তো! সত্যি বলছি, আর কামড় দিবো না৷ আপনি যাবেন না!
মেহেদী ব্যর্থ হয়ে হাতের ভর ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো। বালিশটা টেনে মাথার নিচে দিয়ে বললো,
– যাচ্ছি না আমি। তোমার বালিশে যাও।
– উহুম।
– উহুম মানে! যাবো না তো আমি, নিজের বালিশে যাও!
নাহিদা মেহেদীর সাথে মিশে তার টিশার্ট আঁকড়ে ধরে একটু আরাম করেই শুয়ে বললো,
– উহুম। এখানেই থাকতে ভালো লাগে। আমি ঘুমাবো আর ডিস্টার্ব করবেন না আমাকে। গুড নাইট।
মেহেদী এবার সত্যি করেই কপাল চাপড়ালো! একে তো তার ওয়াইন খেয়ে ফেলেছে! তারউপর এতো ঝড় প্রবাহিত করে এখন টিশার্ট যেভাবে মুঠোয় ধরেছে তাকে ছাড়ানোরও কায়দা নেই! উল্টো ছাড়াতে গেলে তার টিশার্টের বারোটা বাজবে! তবে পা দিয়ে ঠেলে তার উপর থেকে পা সরিয়ে দিতে পেরেছে সে।
সকালে ঘুম ভাঙলে চোখ খুলে নিজেকে মেহেদীর হাত পায়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে দেখলো নাহিদা। তার মাথাও বালিশে, চোখ বরাবর মেহেদীর ঠোঁট। নাকের গরম নিশ্বাস এসে পড়ছে নাহিদার কপালে। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো নিশ্বাসের জন্য এদিকসেদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে। মেহেদীর হাত তার কোমড় জড়িয়ে রেখে পায়ের উপর এক পা তুলে রেখেছে। নড়াচড়ার কোনো সুযোগ নেই তার! সে মাথাটা হালকা উপরের দিকে তুলে দেখে নিলো মেহেদীর ঘুমন্ত মুখখানা! পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে! নাহিদার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো! তার হাত এখনো মেহেদীর গলা ঝাপটে আছে! বারান্দার দরজা সারারাত খোলাই ছিলো বিধায় বাতাসে রুম ঠান্ডা হয়ে আছে! আর মেহেদী চাদর মুড়িয়ে নাহিদার সাথে কোমল উষ্ণতার ছোয়ায় জড়িয়ে আছে।

চলবে।