তৃ-তনয়া পর্ব-২১+২২+২৩

0
481

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২১
(নূর নাফিসা)
.
.
সারাদিন পিঠা আমেজ চলেছে নাফিসাদের বাসায়। মেহেদীর বাড়ির লোকজন এসেছে। আরাফের বাড়ির সবাইকেও দাওয়াত করেছেন নিয়াজ উদ্দিন। সম্মান রক্ষার্থে শুধু আলফাজ সাহেব এসেছেন বিকেলে। তাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আবার চলে গেছেন। সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর আচরণ মেহেদীর পরিবারের। যেন বহুদিনের পরিচয় একে অপরের সাথে। প্রাণান্তরের আত্মীয় তারা। শুধু মেহেদীটার মনেই ছটফট। খারাপ লাগছে না তাদের মেলবন্ধন দেখতে কিন্তু তাকে কেন আটকিয়ে রাখা হয়েছে! বন্ধুরা একের পর এক ধাওয়া দিয়ে যাচ্ছে তাকে! এই ট্রিপ টা নিয়ে অনেকদিন ঘোরাতে হয়েছে তাকে! এক একজন যা টাকাপয়সা জমিয়েছে, সব নিষ্পত্তি করতে বসেছে। পিঠার আমেজ উপভোগ করে সন্ধ্যার পরপরই তারা বেরিয়ে গেলো। নাহিদার মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেলো। কান্নাও করেছে আবার। একটুও ইচ্ছে করছিলো না সেখান থেকে চলে আসতে। কিন্তু কি আর করার! সমাজের নিয়মের বাইরে তো চলা যাবে না!
নাহিদা রুমে এসে দেখলো ফুলের ঝাড় এখনো ঝুলে আছে খাটের উপর। সে চেঞ্জ করে এসে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মেহেদী ঢুকেছে রুমে। আজকেও ময়লা জুতা নিয়ে রুমে এসে পড়েছে! নাহিদা বললো,
– ঝাড়টা একটু ছুটিয়ে দিতে পারবেন?
– পারবো না আমি কিছু! সব কিছুতে একটা ভেজাল বাধিয়ে রাখো তুমি! ওফ্ফ শীট!
– আমি কি করলাম!
– কিছুই করোনি। তবে এখন করবে। যাও, তোমার শ্বশুরকে বলে আসো তুমি হানিমুনে যাবে না। আমি একা বেড়াতে যাবো, তুমি আমার সাথে যাবে না।
নাহিদার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বাইরে থেকে মেহেরুনের কণ্ঠে জবাব এলো,
– নাহিদা, তোর সাথেই যাবে। তা না হলে তোরও যাওয়া হবে না। আর যদি অমান্য করে বেড়াতে গিয়েছিস তাহলে আর বাড়িতে জায়গা হবে না।
– ধ্যাৎ!
মেহেদী জুতা ছাড়িয়ে একদিকে ঢিল মেরে ফেলে দিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। মেহেরুন নাহিদার কাছে এসে তাকেও বসালো নিজেও বসলো খাটে। অত:পর বললো,
– বড্ড বেশি অগোছালো আমার ছেলেটা। আগে এমন ছিলো না। কলেজ পর্যন্ত বাধ্য ছেলে ছিলো। ভার্সিটিতে উঠার পর শাসন মুক্ত হয়ে উশৃংখল হয়ে গেছে! মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে প্রায় এক বছরের বেশি। কবে থেকে বলছে তার বাবা অফিসে জয়েন করতে, ব্যবসা সামলে নিতে। কোনো কথা কানেই নিচ্ছে না। আমরা আজ আছি কাল নেই। এরপর কে তাকে আগলে রাখবে! কবে যে বুঝদার হবে আল্লাহ জানে। তাই বিয়ে করিয়ে বউ বানিয়ে নিয়ে এলাম তোকে। সেদিন ভিডিও কলে দেখেই খুব পছন্দ হয়েছে আমার। আমি তোর শ্বশুরকে দিনের পর দিন জ্বালাতন করেছি তোর খোঁজ নিয়ে ঘরে তোলার জন্য। অত:পর জানতে পারলাম তুই নিয়াজ উদ্দিন ভাইয়ের মেয়ে। তোর মাঝে সাহস, সততা, ন্যায়পরায়ণতা দেখেছি আমি। আমার বিশ্বাস তুই পারবি এই ছেলেটাকে একটু বুঝদার বানাতে। তোর বাবাকেও সবটা জানিয়েই সমন্ধ পাঠিয়েছিলাম। তোর স্বামীর দায়িত্ব এখন তোর। করবি না চেষ্টা?
– আমি চেষ্টা করবো মা। কিন্তু উনি এতো রাগী কেন?
– আদরে আদরে বাদড় বানিয়ে ফেলেছি! সবসময় আদরের পাশাপাশি শাসনেই রাখতাম কিন্তু কলেজ লাইফের পর তোর শ্বশুরের কথায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর কত বেধে রাখা যায় এতো বড় ছেলেকে! লাইফটা নিয়ে কখনো ভাবেই না। এখন অবস্থা খারাপ দেখে অপ্রয়োজনীয় টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তার বাবা। তোদের জন্য কক্সবাজারে তিনদিনের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। অনেক দিন ধরে শুরু করেছে বেড়াতে যাবে। বিয়ের জন্য আটকে রেখেছে। এবার সুযোগ করে দিলো। বেড়ানো শেষ হলেই কাজের চাপ দিবে। সবকিছু গুছিয়ে রাখিস। সকালের ট্রেনে রওনা দিবি। সাবধানে যাবি, আর সবসময় ওর পাশাপাশি থাকবি। গিয়েছিস কখনো সেখানে?
– না।
– তাহলে তো আরও ভয়! মেহেদীর চেনা আছে পথ ঘাট। তার সাথে সাথেই থাকবি। আর যাই হোক, কারো দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লে সেটা ঠিকভাবে পালন করতে জানে সে। খেয়াল রাখিস নিজের। যদি সেখান থেকে অন্যকোথাও যায় তাহলে তো সময় আরও বেশি কাটাতে হবে। ব্যবস্থা বাসা থেকে করেই যা।
– উনি একা যেতে চাইছেন। আমার না যাওয়াটাই উত্তম।
– ওর একটা কথা! যা তুই, ঘুরে এলে ভালো লাগবে। আমি নিজেই তো বছরে কমপক্ষে একটা ট্রিপে যাই তোর বাবার সাথে। ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। নেক্সট টাইম না হয় আবার আমরা ফ্যামিলি ট্রিপে যাবো। ওকে?
– হুম।
– আচ্ছা, তুই কাপড়চোপড় গুছিয়ে নে। আমি খাবারগুলো নামিয়ে রাখি। তোর মা এতো কিছু দিয়ে দিয়েছে। কে খাবে এগুলো!
– আপু চলে গেছে?
– না, যেতে চেয়েছিলো। আমি নিষেধ করলাম। তোরা কাল চলে যাবি, তাই আরও দুদিন থাকতে বললাম।
মেহেরুন ইসলাম চলে গেলেন। নাহিদা ঝাড়ু খুজে এনে রুমটা আবার ঝাড়ু দিলো। মেহেদী জুতা পড়ে আসায় বালি দিয়ে ভরে গেছে! এদিকে মেহেদী বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে উঠে ফুলের ঝাড় টেনে ছিড়ে ফেললো। এবং রুমে থেকেই আয়াশকে ডাকলো। আয়াশ দোড়ে এসে ঝাড় টেনে নিয়ে গেলো। ঝাড়ু দেওয়া শেষ হতেই গুটি গুটি পায়ে হেটে আরিশা এলো। নাহিদা ময়লা একপাশে চাপিয়ে ঝাড়ু রেখে আরিশাকে কোলে নিয়ে রুমে এলো। মেহেদী আবার গোছগাছ করতে লেগেছে। বহুদিন পর সুযোগ এসেছে, হানিমুন বলুক আর যাই বলুক ট্রিপ মিস দিবে না সে! নাহিদা আরিশাকে কোলে নিয়ে তার সাথে দুষ্ট মিষ্টি কথা বলতে বলতে রুমের মধ্যেই পায়চারি করতে লাগলো। মেহেদী তাকে বললো,
– এই যাবে না তুমি? ব্যাগ গুছাও না কেন!
– আপনার কথাই তো রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম আমাকে যেতেই হবে। যতই হোক পিতামাতার আদেশ তো অমান্য করা যায় না!
– আসছে আমার পিতামাতার বান্দি! সব রেখে আমাকে জ্বালাতন!
মেহেদী বিড়বিড় করতে করতে লাগেজ বন্ধ করে দিলো। নাহিদা আরিশার হাতে খেলনা দিয়ে নামিয়ে দিলো। তারপর নিজের লাগেজ গুছাতে লাগলো। মেহেদী আরিশাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। পেটের উপর বসিয়ে আরিশার সাথে খেলতে লাগলো। মেহেদীর দুষ্টুমিতে আরিশা খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠছে। দেখতে ভালোই লাগছে নাহিদার কাছে। একটু পর আয়াশও জামাকাপড় ছাড়িয়ে একটা শর্ট প্যান্ট পড়ে দৌড়ে এসে লাফিয়ে উঠে পড়লো খাটে। মামা ভাগিনাদের মধ্যে দুষ্টুমি আর হৈ-হুল্লোড় চললো কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে ফোনে কথপোকথন। এক পর্যায়ে নাহিদারও গুছানো শেষ হয়ে গেলো।
সকালে তারা রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। জহিরুল ইসলাম নাহিদার হাতে একটা নতুন ফোন তুলে দিলো। তা দেখে মেহেদী বললো,
– আব্বু, আমার ফোনটাও দেখো একটু পুরনো পুরনো লাগছে। এটা চেঞ্জ করতে হবে।
– চারমাস হয়নি এখনই তোমার চেঞ্জ করা প্রয়োজন! প্রায় দেড় লক্ষ দামের দুইটা সেট তোমার কাছে। আগামী পাচ বছরে নষ্ট হয়ে গেলেও কোনো ফোন পাবে না।
– আব্বু, তুমি যে দিন দিন কিপটে হয়ে যাচ্ছো সেটা কি তোমার জানা আছে! একবছর হলে মানা যায়। পাঁচ বছর কিভাবে চলে!
– আমার ফোনের চার বছর চলে। কিছুই হয়নি। তোমাকেও চালাতে হবে। হ্যাঁ আর আমি খুব ভালো করেই জানি আমি কিপটে হয়ে গেছি, তা না হলে উপায় ছিলো নাকি তোমার মতো ছেলে ঘরে থাকতে!
– বেড়াতে যাচ্ছি, এখনো বকাঝকা করছো! যাও, যাবোই না!
– না যাও। ট্রেন মিস হলে হাড়ে হাড়ে উশুল তুলবো আমার টাকার। কষ্টের টাকা।
– আমার কাছে ক্যাশ দাও।
– ত্রিশ হাজার দিয়েছি। তাছাড়া ট্রেনের কেবিন ও তিনদিনের জন্য রিসোর্টে রুম বুক করে দিয়েছি। নাহিদাকে নিয়ে সাবধানে যাও। ওর যত্নাদির যেন কমতি না পড়ে।
– এই টাকাতে তো আমারই চলবে না, আবার তার যত্নাদি!
– ফ্যামিলি ট্যুর হয়ে যাবে এটাতে৷ দুজনের খরচ তো এমনিতেই চলে যাবে। অর্থাৎ চালিয়ে নিবে। চতুর্থ দিনের মাথায় যেন বাড়িতে দেখি তোমাকে।
– যাবো তোমার ইচ্ছায়, আসবো আমার ইচ্ছায়। আল্লাহ হাফেজ।
মেহেদী তার লাগেজ টেনে আগেই পা চালালো। জহিরুল ইসলাম ডেকে আবার নাহিদার লাগেজ ধরিয়ে দিলো। নাহিদা শাড়ি পড়েছে আজ। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেহেদীর সাথে সি এন জি তে উঠলো। জহিরুল ইসলাম তাকে গাড়ি নিয়ে স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসতে চাইছিলো কিন্তু মেহেদী বললো, এটুকু পথ শুধু শুধু গাড়ি নিয়ে যেতে হবে না। কিন্তু স্টেশনে আসার পর নাহিদা তার প্রকৃত কারণ দেখতে পেলো। মেহেদীর বন্ধুরাও উপস্থিত তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। আর এজন্যই মেহেদী নিষেধ করেছিলো বাবাকে গাড়ি নিয়ে আসতে!
তারা আর আলাদা টিকেট বুক করেনি। মেহেদীর কথায় এক কেবিনেই সবাই আছে। মেহেদী, নাহিদা, আর তার তিনজন বন্ধু। নাহিদা জানালার পাশেই একটা সিট দখল করে নিয়েছে। মেহেদীও নাহিদার বিপরীতে জানালার পাশে সিট দখল করেছিলো। কিন্তু তার বন্ধুরা এখানে বসেনি। কাপলকে একপাশে রেখে তারা তাদের ডান পাশের জানালার পাশে ফাকা সিটগুলোতে বসেছে। এবার মেহেদীও এপাশ ছেড়ে বন্ধুদের পাশে চলে গেলো। বন্ধুরা তাকে নাহিদার কাছে বসার জন্য বললো, কিন্তু সে তাদের ঠাট্টা বিরক্তিকর ভাবে নাশ করে আড্ডায় জমে উঠলো। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। তারা কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা করছে। আর এদিকে নাহিদা নাফিসার কাছে কল করে নাফিসা ও মায়ের সাথে কথা বললো কিছুক্ষণ। এতোক্ষণে ট্রেন ঢাকা ছেড়ে এসেছে। তীব্র গতিতে ট্রেন চলছে বিধায় প্রচন্ড বাতাস লাগছে। তবে খারাপ লাগছে না নাহিদার। হিজাব পড়নে থাকায় এতোক্ষণ গরম লাগছিলো, এখন ঠান্ডাটা বেশ ভালো লাগছে। একমনে তাকিয়ে উপভোগ করছে ছোট জানালা দিয়ে দৃশ্যমান বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশ। মনে হচ্ছে ট্রেন নয়, স্থীর প্রকৃতি আজ দৌড়ে চলেছে বিপরীত দিকে। বাতাসে গুনগুন হয়ে ভেসে আসছে প্রকৃতির সুর। তার সাথে তাল মিলিয়ে নৃত্য করছে পলক। পলকে পলকে দৃশ্যত হচ্ছে রংবেরঙের ভুবন, আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ও যানচলাচল রাস্তা। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে উপস্থিত না করলে কখনো বুঝাই যায় না রংবেরঙের মানুষগুলোর প্রকৃত অবস্থা! সামান্য একটা পথ অতিক্রম করতেই দৃষ্টিতে আটকে যায় হাজারো জীবনের ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২২
(নূর নাফিসা)
.
.
প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চোখে ঘুম নেমে এসেছে। আর ওদিকে মেহেদী আড্ডায় মেতে। বেশ কিছুক্ষণ পর রায়ান মেহেদীকে দেখালো, নাহিদা জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে! মেহেদী দ্রুত উঠে এসে তার মাথা তুলে সোজা করলো। নাড়া পেয়ে নাহিদার ঘুম ভেঙে গেছে। ছোট ছোট চোখে করে ঘুমঘুম চোখে তাকাতেই মেহেদী ধমকের সুরে বললো,
– এটা কেমন অভ্যাস! যানবাহনে ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে বাসা থেকে বিছানাপত্র নিয়ে আসতে পারলে না! জানালায় মাথা রেখে কিসের ঘুম! কোনো বাধা পেলে তো এখনই মাথা কাটা যেতো!
নাহিদা চোখমুখ কুচকে রেখেই তার বন্ধুদের দিকে তাকালো। তাকে তাকাতে দেখে তার বন্ধুরা আবার অন্যদিকে ফিরে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেহেদী তাকে ধমকে জানালার পার্টিশন লাগিয়ে দিচ্ছে। নাহিদা মনে মনে মেহেদীকে বকে যাচ্ছে! লোকটা কত বড় বজ্জাত! বন্ধুবান্ধবদের সামনে বউকে এভাবে বকাঝকা করে কেউ! নিজে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থেকে এখন দায়িত্ববোধ দেখাতে আসছে! মেহেদী জানালা লাগিয়ে দিয়ে বললো,
– এবার মনপ্রাণ ভরে ঘুমাও। প্রয়োজনে সিট ছেড়ে মেঝেতে গুমাও। কে জানে, কখন আবার সিট থেকে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে!
বলতে বলতে মেহেদী তার বন্ধুদের কাছে চলে গেলো। তার কথায় বন্ধুরা হেসে উঠলো আর নাহিদা কিছুটা লজ্জা পেলো। রাগও হচ্ছে কিন্তু দেখাতে পারছে না। মেহেদী তাদের সামনে থেকে একটা স্পিড ও একটা প্যাকেট এনে নাহিদার পাশে সিটে রেখে বললো,
– ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নাও।
মেহেদী আবার চলে গেলো। তারা বন্ধুরা এবার নিরব হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে আর ক্যান বক্সে ইংলিশ গান চলছে। সবার হাতেই একটা করে স্পিড। গন্ধে পুরো কেবিন ভরে আছে! নাহিদার বিরক্ত লাগছে। স্পিডের গন্ধও তার সহ্য হয় না। তার জন্য আবার স্পিড রেখে গেছে! কি মজা পায় এসব পানিতে! না জানি সাথে মাদক দ্রব্যও নিয়ে এসেছে! নাহিদা তাদের নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্যাকেট ফেলে ভরে ফেলেছে! যেন ময়লার ডাস্টবিন! এতো খাদক! এইটুকু সনয়ে এতো কিছু খেয়ে ফেলেছে! ট্রেনের ঝাড়ুদার এনে এগুলোকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া উচিত!
নাহিদা এক হাতে নাক চেপে রেখে তাকে দিয়ে যাওয়া প্যাকেটটা খুলে দেখলো কি কি খাবার রাখা আছে। প্রথমেই চোখে পড়লো আচারের প্যাকেট। গণে গণে দেখলো এক ডজন আচারের প্যাকেট! এতো আচার কিনেছে কেন! আচার নামিয়ে দেখলো কেক, বিস্কুট, জুস, চিপস, চকলেট! এগুলো কি এনেছে! এই প্যাকেটেই তো প্রায় পাচশো টাকার খাবার হবে! ত্রিশ হাজারে তার চলবে কি করে! সে তো অযথা টাকা নষ্ট করে! বাসা থেকে মা যে খাবার দিয়েছে সেই খেয়াল কি আছে তার! ওগুলো না খেলে নষ্ট হবে না!
নাহিদা ফোনটা নিয়ে দেখলো এগারোটার বেশি বাজে! সময়তো তাহলে অনেকই কেটেছে। ট্রেন ছেড়েছে সকাল আটটায়!
এতোক্ষণে তার পেটে ক্ষুধা অনুভব করলো। সময় দেখে ক্ষুধা লেগে গেছে! ভাবতেই নাহিদার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো! সে সিট ছেড়ে উঠে কেবিনের মাঝামাঝিতে এলো। মেহেদী ও বাকিরা তার দিকে তাকালো। নাহিদা তাদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে একহাতে শাড়ির আঁচল ধরে অন্যহাতে দুই লাগেজের মাঝামাঝিতে থাকা মেহেদীর ব্যাগটা উপর থেকে টানলো। কিন্তু এতো ভারি ব্যাগ এক হাতে নামানো দায়। মেহেদী বসা থেকেই বিরক্তিকর ভাবে বললো,
– এটাতে আবার কি?
তার এমন ভঙ্গিতে কথা শুনে নাহিদা কোনো জবাব দিলো না। এখন থেকে এটাই স্থির করে নিলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভালোভাবে কথা বলছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো জবাব সে দিবে না। মেহেদী তার জবাব না পেয়ে উঠে এসে বললো,
– সরে দাড়াও।
নাহিদা সরে দাড়ালে মেহেদী ব্যাগ নামিয়ে দিলো। নাহিদা ব্যাগ তুলে সিটে রাখলো। ব্যাগ খুলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে খাবারটা বের করলো ততক্ষণ পর্যন্ত মেহেদী তার দিকে তাকিয়ে ছিলো সে ব্যাগে কি করছে সেটা দেখার জন্য। যখন দেখলো খাবার বের করছে তখন দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নাহিদা জানালা খুলে তারপর খাবারের বাটি নিয়ে খেতে লাগলো। বিরিয়ানির গন্ধ পেয়ে মেহেদীর বন্ধু জিহাদ বললো,
– ভাবি, একা একাই খাবেন! আমরা খেয়েছি আপনার জন্যও রেখেছি। তাহলে আমাদের খাবারের ভাগ কোথায়!
– এতো কিছু খাওয়ার পরেও আপনাদের পেটে জায়গা আছে!
– আমার তো পেটের কোনাও ভরেনি!
– বিশ্ব খাদক দেখছি আপনারা!
নাহিদা ছোট বাটি টা তার কাছে রেখে বড় বাটিটা এগিয়ে দিতেই তাদের হুলস্থুল! কেননা চেয়েছে জিহাদ। এপাশে মেহেদী ও রায়ান থাকায় হাত বাড়িয়ে রায়ান নিয়ে নিলো বাটি। আর তাদের বাদ রেখে একের পর এক চামচ বিরিয়ানি ঢুকছে রায়ানের মুখে। এ নিয়ে বাকি দুজন রায়ানকে খাওয়ার মাঝেই মাইর লাগাতে শুরু করেছে! নাহিদা হতবাক তাদের কাণ্ডে! মেহেদী পাশে থাকায় বাটি কেড়ে নিয়ে মাঝামাঝিতে রাখলো এবং চারজনই খেতে লাগলো। রায়ানের হাতে চামচ আর বাকিরা খালি হাতে। হাতও ধুয়া নেই তাদের অথচ এভাবে খেতে লেগে গেছে! বন্ধুদের কর্মকাণ্ড দেখে আনন্দও লাগছে আবার ঘিনঘিনও লাগছে নাহিদার! যেন অনাহারে থাকা বাচ্চারা বিরিয়ানি খেয়ে যাচ্ছে। আর এক একজনের কি প্রশংসা, “আন্টির হাতের বিরিয়ানি, অসাধারণ! ভাবি আপনার হাতে বিরিয়ানি খাওয়াবেন কবে!”
নাহিদার খাওয়া আর চলছে না। তাদের দেখেই তার পেট অর্ধেক ভরে গেছে। যতটুকু বাকি আছে ততটুকু ক্ষুধা টানটান লাগছে! তার এইটুকু বাটি শেষ হয়নি অথচ তাদের এতো বড় বাটি শেষ করতে পাঁচ মিনিটও লাগেনি। মেহেদী ঢেকুর তুলে বললো,
– এটুকুই ছিলো। নাকি আরও দিয়েছে আম্মু?
নাহিদা তার বাটি দেখিয়ে বললো,
– আর এটা দিয়েছে।
– ধুর! তোমার জুটা খাবো নাকি!
নাহিদা মলিন মুখে বললো,
– আগে জানলে তো এটুকুও খেতাম না। রেখে দিতাম আপনার জন্য। তাছাড়া মা তো জানতো না, ভাইয়ারা সাথে আছে।
– লাগবে না। খাওয়া শেষ করো আর ঘুমাতে হলে জানালা লাগিয়ে ঘুমাও।
খালি বাটি নাহিদার দিকে দিয়ে তারা সবাই হেলান দিয়ে চোখ বুজে গান শুনছে। নাহিদা আর খেতে পারলো না। জুটা কথাটা শুনে কেন জানি একটু খারাপ লাগলো। আরাফকে নাজিয়ার হাতের খাবার খেয়ে নিতে দেখেছিলো। তার বাবাকে তার মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে দেখেছিলো। তার বাবা তাদের তিন বোনের হাতেও খাবার খেয়েছিলো। হঠাৎ আশিকের কথাও মনে পড়ে গেছে তার! আশিক তার খাওয়া লাচ্চিটা কিভাবে খেয়ে নিয়েছিলো! ওটা তো জুটাই ছিলো! এতো খারাপ কেন আশিক! অন্যের জুটা খেয়ে ফেলে! তার চোখে অশ্রু ভীড় জমিয়েছে। সে দ্রুত চোখ মুছে নিতে নিতে মনে মনে বললো, “না না! এসব কি ভাবছি আমি! আশিককে কেন ভাবছি! এখন তো আমার হাসব্যান্ড আছে। ও তো পরপুরুষ! এসব ভাবা ঠিক না। তাছাড়া খারাপ লাগার কি আছে! সে তো ভুল কিছু বলেনি! খাওয়া খাবার তো জুটা ই হয়।”
নাহিদা আরও কয়েক চামচ বিরিয়ানি পানির সাথে গিলে নিলো। খাবার গিলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার! সে বাকিটুকু পরে খাওয়ার জন্য রেখে দিলো। এবং সব গুছিয়ে রেখে আনমনে বাইরে তাকিয়ে রইলো। আর ঘুম নামেনি চোখে।
দুপুরের শেষ সময়ে তারা চিটাগং এসে পৌছালো। সেখান থেকে বাসে উঠে কক্সবাজারে রওনা দিলো। ব্যাগ লাগেজ কিছুই তাকে বহন করতে হয়নি। সব মেহেদী ও তার বন্ধুরাই টেনেছে। ট্রেন ভ্রমণ করতে ভালো লাগলেও বাসে ভ্রমণ করে মাথাটা ঝিম ধরে গেছে নাহিদার। আর বাকিরা অভ্যস্ত হওয়ায় শরীরে খুব এনার্জি নিয়ে এখনো আমেজে মেতে আছে। রিসোর্টে এসে বন্ধুদের জন্য একটা রুম বুক করতে হয়েছে। অত:পর তারা যার যার রুমে চলে এলো। ব্যাগ ট্যাগ কোনোমত রুমে রেখে তারা বেরিয়ে গেছে। আর নাহিদা রুমে একা। কোথায় গেছে, কেন গেছে কিছুই বলে যায়নি তাকে। তারাহুরো করে শুধু বেরিয়ে গেলো মেহেদী। নাহিদা দরজা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে গোসল করে নিলো বাথরুমে। কাপড়চোপড় নেড়ে দেওয়ার মতো বারান্দা ছাড়া আর কোনো জায়গা পেলো না। মাথাটা ব্যাথা করছে। সে বিরিয়ানিটুকু খেয়ে বাটি ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অস্থির লাগছে খুব! বাকি খাবারের প্যাকেট সামনেই রাখলো যদি মেহেদীর প্রয়োজন হয় এই ভেবে। কিন্তু মাথার যন্ত্রণায় ভালো লাগছে না! একটা টেবলেট খেয়ে নিলে ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা পাবে কোথায়! বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর চোখে ঘুম নেমে আসছিলো মাত্র। এমনি দরজায় ধুপধাপ শব্দ হতে লাগলো! মেহেদী চেচিয়ে বলছে,
– ওই, মহারানী! আমি কি বাইরেই থাকবো! রুম তো আপনার একার জন্য ভাড়া করেনি! আরে! মরে গেলো নাকি! হ্যালো…ভেতরে কেউ আছে!
নাহিদা বিরক্তি নিয়ে উঠে এলো। দরজা খুলে দেখলো ভেজা কাপড়চোপড়ে মেহেদী। সমুদ্রে গোসল করে দেহ একদম সাদা ভেটকি মাছের মতো হয়ে গেছে। মেহেদী রুমে ঠুকতে ঢুকতে বললো,
– এতোক্ষণ কি করছিলে রুমে একা একা! কখন থেকে ডাকছি! আমার এতো উচ্চ কণ্ঠস্বর পৌছায় না তোমার কানে!
নাহিদা তার কোনো প্রতুত্তর করলো না। এমনিতেই মাথাটা ঝিম ধরে আছে! তার উপর এমন চেচিয়ে কথাবার্তা! মেহেদী কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নাহিদা দরজা লাগিয়ে পাপোশ দিয়ে ভেজা জায়গা মুছে দিলো। মেহেদী মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলে নাহিদা বাথরুমে এসে তার কাপড়চোপড় ধুয়ে দিলো। মেহেদী টিশার্ট পড়ে ফোন হাত নিয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎই তার ফোন বেজে উঠলো আর সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো! ফোন রিসিভ করেই মুখে মিথ্যে হাসির একটা ঝিলিক ফুটিয়ে তুললো। যেটা বারান্দায় যাওয়ার সময় নাহিদার চোখে পড়ে গেছে। আর বুঝতেও বাকি নেই আম্মু কিংবা আব্বু কল করেছে।
মেহেদী হাসিমুখে বললো,
– জ্বি আব্বু, বলো।
– পৌছেছো ঠিকঠাক মতো?
– হ্যাঁ, এই যে দেখো বেডে বসে আছি।
– জানাতে বলেছিলাম, জানাও নি কেন?
– ফ্রেশ হওয়ার সময় তো দিবে। এখনই তো জানাতাম তোমাকে।
– হু, বাটপার ছেলে আমার। তোমাকে খুব চেনা আছে। নাহিদা কোথায়?
– লজ্জা করে না তোমার, নিজেকে বাটপারের বাবা হিসেবে পরিচয় দিতে!
– তুমি যেমন বাটপারি করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছো, আমিও তেমন পরিচয় দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন বলো, নাহিদা কোথায়? তুমি একা কেন রুমে? ওর খেয়াল রাখতে বলেছিলাম।
মেহেদী বিছানা ছেড়ে বারান্দায় চলে এলো। নাহিদা কাপড় নেড়ে দিচ্ছিলো আর মেহেদী তার পেছনে দাড়িয়ে সামনে ফোন ধরে বললো,
– এই যে দেখো তোমাদের নাহিদাকে। দেখেছো? খেয়াল না রাখলেই কি এখনো এখানে দাড়িয়ে আছে!
হুট করেই মেহেরুন ইসলাম স্ক্রিনের সামনে এসে বললো,
– নাহিদা, তোর চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?
– তেমন কিছুনা মা, জার্নি করার ফলে মাথাটা একটু ব্যাথা করছে।
– বিকেল হতেই মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে! খেয়েছিস কিছু?
– হ্যাঁ, মা। বিরিয়ানি খেয়েছি।
– মেহেদী, এটাই তুই খেয়াল রেখেছিস! খেয়াল রাখলে তার মাথা ব্যথা করছে!
মেহেদী অবাক ভঙ্গিতে পেছনে থেকেই নাহিদার কপালে গলায় স্পর্শ করে বললো,
– এ! তোমার মাথা ব্যথা করছে! জ্বর টর হয়েছে নাকি! আমাকে বলোনি কেন! আমি তো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম! আম্মু, আব্বুকে বলো নাহিদাকে হসপিটালে নিয়ে যাবো। হসপিটালের খরচ বিকাশ করতে।
তার কথা শুনে ওদিকে বড়বোন মেহতাজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৩
(নূর নাফিসা)
.
.
তার কথা শুনে ওদিকে বড়বোন মেহতাজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। আর মেহেরুন রেগে বললো,
– ফিরে আয় তুই বাড়িতে। তারপর আমি নিজে তোকে হসপিটালে ভর্তি করে আসবো।
মেহেদী রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– আম্মু, তোমরা কেন বিশ্বাস করো না! এই যে দেখো, কত খাবার কিনে দিয়েছি। এগুলো কিনতে কি খরচ করিনি।
– কিনলেই কি, খায়নি তো কিছু। তাহলে কিনেছিস কেন!
– না খেলে আমার কি! খরচ করেছি টাকা দিবে। আমার পকেট থেকে টাকা গিয়েছে তো।
– টাকা তোর একার খরচের জন্য দেওয়া হয়নি। দুজনের জন্যই দেওয়া হয়েছে। আর সে তোর বউ। দায়িত্ব সম্পূর্ণ তোর উপর। অবহেলা করিস না বাবা। নিজের জীবনটা নিয়ে একটু ভাবতে বস। নাহিদাটাও অনেক ভালো। দুজন ঠিকঠাক মতো ঘুরে আয়। স্বেচ্ছায় সবকিছু গুছিয়ে নে, দেখবি সারাজীবন সুখে কাটবে তোর।
– আম্মু, কি শুরু করেছো! সারাদিন জার্নি করে আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমাবো। বাই…
মেহেদী কল কেটে দিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো। নাহিদাকে রুমে দেখতে পেয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো,
– মাথা ব্যথা, ঠ্যাং ব্যথা, বলতে পারলে না হসপিটালে যাবে! আমিও পারবো না ডাক্তারের কাছে নিতে। অর্ধেক পকেট খালি করে দিয়েছো আমার!
– লাগবে না তো আমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া। একটু মাথা ব্যথা হলেই ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয় না।
– তোমার জন্য যে আমি কত টাকা খরচ করলাম সেটা! হসপিটালে না ই বা যেতে, আমার খরচটা উশুল করলে কি হতো!
– এমন কেন আপনি! এতো অপচয় করেন কেন। সাশ্রয়ী হতে পারেন না। টাকা তো আপনারই থাকছে। বাবা মা তো আপনার খারাপ চাইছে না। তাহলে শুনছেন না কেন তাদের কথা! এভাবে আর ক’দিন চলবে।
– এই মেয়ে, চুপ থাকো! বয়সে, বুদ্ধিতে সবদিক থেকেই আমি তোমার চেয়ে বড়। বেশি পটু কথা বলতে এসো না! আমার বাপের টাকা আমি নেই, তাতে তোমার কি! তোমার বাবার টাকা খরচ করছি! যত্তসব ফাউল এসে আমার সামনে পড়ে!
মেহেদী চাদর টেনে শুয়ে পড়লো। এমনিতেই মাথাটা ব্যাথা করছে তার উপর এর খ্যাচখ্যাচ আরও বিরক্তিকর! একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাই জানা নেই আবার আসছে বয়সে বুদ্ধিতে বড়গিরি দেখাতে! নাহিদাও খাটে উঠে বসলো শুয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু সমস্যা এখানেই! বিয়ে হওয়ার গত দু’দিনই বাড়িতে দুজন আলাদা কাথা ব্যবহার করতো। এখানে দুইটা পাবে কোথায়! তাও আবার যেভাবে পেচিয়ে নিয়ে শুয়ে থাকে মেহেদী!
নাহিদা চাদর ছাড়াই এক কোনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। গোসল করেছে বিধায় এমনিতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। আবার আস্তে আস্তে আবহাওয়ায়ও ঠান্ডা নেমে আসছে! চাদর ছাড়া ঘুম হবে না। তাই নাহিদা এক কোনা টেনে কোনমতে শরীরে জড়িয়েছে। মেহেদী এতোক্ষণ সোজা হয়ে শুয়ে ছিলো। এখন আবার বিপরীত দিকে কাত হয়ে যাওয়ায় চাদরের কোনাও রইলো না নাহিদার দেহে! নাহিদা বিরক্তি নিয়ে এদিকে ঘুরে চাদরের কোনা টেনে বললো,
– এসব কি শুরু করেছেন! আমি ঘুমাবো না!
মেহেদী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললো,
– ইচ্ছে হলে ঘুমাও, আর ইচ্ছে না হলে চলে যাও! আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করছো কেন!
– আমি আপনার ঘুমে ডিস্টার্ব করছি নাকি আপনি আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করছেন! চাদর নিজের দখলে রেখেছেন কেন! আমি কি নিব!
– সেটা আমি কি জানি! বাসা থেকে চাদর নিয়ে এলে না! এটা টানছো কেন!
– আপনি এটা টানছেন কেন! আপনি নিয়ে এলেন না!
– আমি কেন আনতে যাবো! আমি তো জানিই আমার জন্য একটা চাদর রাখাই আছে।
– ইশ! কি ভি আই পি লোক! ছাড়ুন, আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি ঘুমাবো।
মেহেদী চাদর ছাড়তে ছাড়তে বললো,
– সেটা আমাকে শোনাও কেন!তোমার শ্বশুরকে গিয়ে শোনাও!
– কাউকে শুনতে হবে না। আপাতত আপনার মুখটা বন্ধ থাকলেই আমার ওষুধ কাজ করবে।
– আমার মুখের মালিক আমি। সুতরাং যা ইচ্ছে তা করবো, তাতে তোমার কি! প্রয়োজনে তোমার কান বন্ধ করে রেখো।
নাহিদা আর কোনো জবাব দিলো না মেহেদীর দিকে আরেকটু চেপে বিপরীত দিকে মুখ করে এক চাদরের নিচে শুয়ে রইলো দুজন। লোকটার আচরণে কখনো কখনো খুব রাগ হয় আবার কখনো খুব হাসি পায়। আর মাঝে মাঝে মনে হয় একটা পাগল জুটেছে তার নসিবে আর নয়তো সে নিজেই পাগল! নাহ! নাফিসার ধারণা মতে সে পাগলী।
ভাবতে ভাবতে নাহিদা ঘুমিয়ে পড়লো ওদিকে মেহেদীও শান্ত।
নাহিদার আগে মেহেদীরই ঘুম ভেঙে গেছে। রুম অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে নাহিদার দিকে তাকিয়ে দেখলো যেভাবে শুয়েছিলো সেভাবেই আছে, তবে একটু কুকড়ে গেছে! কারণ তার উপর চাদর নেই। ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করার কারণে সবটুকু মেহেদীর কাছেই চলে এসেছে। মেহেদী উঠে বসে পুরো চাদর নাহিদার উপর ছড়িয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মাগরিবের আযানের শব্দে নাহিদার ঘুম ভেঙেছে। সে উঠে মাথায় ওড়না দিলো এবং চাদর মুড়িয়েই খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলো। এতোক্ষণে খেয়াল করলো সম্পূর্ণ চাদর তার কাছেই! সে কি ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করে মেহেদীর উপর থেকে চাদর নিয়ে নিয়েছে কি-না তা ভাবছে! মেহেদী হাতমুখ ধুয়ে এসে নাহিদাকে খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো,
– রাতে কি খাবে বলো? আর অযথা টাকা নষ্ট করবো না তোমার জন্য।
– কিছু খাবো না। ক্ষুধা লাগলে এসবই খেয়ে নিবো।
– বিস্কুট কেক খেয়ে রাত পাড় করবে!
– হুম।
– মাথা ব্যথা না কমলে স্পিডটা খেয়ে নাও। সেড়ে যাবে।
– আমি এসব খাই না।
মেহেদী আবারও সেই চেচানো কণ্ঠে বললো,
– তো সেটা আগে বলোনি কেন! চৌদ্দ ঘন্টা লাগে তোমার মুখ খুলতে! আগে বললে আমি কি এটাকে গরম হতে দিতাম!
চেচাতে শুনে নাহিদা আবারও বিরক্তিকর ভাবে তাকালো তার দিকে! মেহেদীর সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই! সে স্পীডটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– দরজা লাগিয়ে বসে থাকো। আর আমি ডাকার সাথে সাথে খুলে দিবে। আর যদি কোথাও চলে যেতে চাও তাহলে আব্বু আম্মুকে বলে আমাকে জানিয়ে বিদায় হয়ে যেও।
মেহেদী বেরিয়ে গেলো আর নাহিদার হৃদ নামক পাতলা স্বচ্ছ কাচটা বারবার মজবুত হতে গিয়েও দুর্বল হয়ে পড়ে! সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকে মন, না জানি কখন এই কাচটা ভেঙেই যায়! সে তো চায় কাচটা খুব মজবুত হোক, কিন্তু এই মানুষটা এমন কেন! তার কাছে কি কখনো স্ত্রীর মর্যাদা পাবে না! সে কেমন ধাচের কথা বলে গেলো এটা! বিয়ে শব্দটা কি তার কাছে এতোটাই তুচ্ছ! কিভাবে তার বিয়ে করা বউকে বলে গেলো তাকে জানিয়ে যেন বিদায় হয়ে যায়! কোথায় যাবে! চলে যাওয়ার জন্য কি বউ হয়ে তার ঘরে এসেছে! সে এতোটা বেখেয়ালি আচরণ কেন করে সবার সাথে! নিজের পিতামাতার সাথেও তার আচরণ ভালো ঠেকে না! কি আছে মনে, কি তার চাওয়া পাওয়া কে জানে!
মেহেদী সারা সন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে রাতে নিজে খাওয়াদাওয়ার পর নাহিদার জন্য এক প্যাকেট মোরগ পোলাও নিয়ে এলো। খাওয়ার কোনো ইচ্ছে না থাকায় নাহিদা সেটা খায়নি। এমনকি মেহেদী আসার পর নিজ থেকে কোনো কথাও বলেনি। এক টুকরো কেক খেয়ে পানি পান করে ঘুমিয়ে পড়লো। রাতে যদি আবার নড়াচড়ার ফলে চাদর সড়ে যায় সেই ভেবে মেহেদী নিজে থেকেই এবার অল্প দূরত্ব বজায় রেখে নাহিদার দিকে একটু চেপে শুয়েছে।
সকালটা শুরু হলো মেহেদীর মুখ দেখে। বুকে ভর করে চিত হয়ে শুয়ে আছে। মাথার চুল এলোমেলো, অর্ধেক মুখ দৃশ্যমান। বাকিটা বালিশে লুকিয়ে আছে। দেখতে তো খুব ভালো, আচরণটা এমন কদাচার কেন!
বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বাইরে ফুটে থাকা আলোতে দৃশ্যমান মেহেদীর ঘুমন্ত মুখে। অত:পর মেহেদীর নাড়াচাড়াতে তার ধ্যান ভাঙলো। এবং বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো মেহেদী এখনো ঘুমাচ্ছে। চোখ পড়লো মেহেদীর ফোনের দিকে স্ক্রিনে আলো জ্বলছে আবার নিভে যাচ্ছে। ফোন সাইলেন্ট করা। ধরবে ভেবেও ধরলো না। অত:পর নিজের ফোনটাই পার্স থেকে হাতে নিয়ে দেখলো গতকাল সন্ধ্যা হতে এ পর্যন্ত নাফিসা, মেহেরুন ও মেহতাজের ফোন থেকে মোট উনিশটা কল এসেছে। আরেকটা এলে তো মিল মতো বিশটা হয়ে যেতো! নাহিদা কল ব্যাক করে তার মা বাবা ও নাফিসার সাথে কথা বললো। অত:পর মেহতাজের সাথে কথা বলতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ে ভেসে এলো, “ওই মেহেদী, রোমান্স শেষ হলে এবার ওঠ! আমরা বের হচ্ছি।”
নাহিদা বারান্দায় থেকেই মেহেদীর দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখ খুলে তাকিয়েছে । এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি দিয়ে তারপর উঠে পড়লো। মেহেদী ফ্রেশ হতে হতে নাহিদা রাতে নিয়ে আসা খাবার ঝটপট খেয়ে নিলো। মেহেদী পড়নের টিশার্ট পাল্টে আরেকটা টিশার্ট পড়ে নিলো। নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– কোথায় যাবেন?
– দু চোখ যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই।
– আমিও যাবো।
– তো যাও। না করেছে কে!
– আমি আপনার সাথে যাবো।
– আমার সাথে যেতে পারবে না! ছোট বাচ্চা না তুমি! যে আমি তোমাকে নিয়ে নিয়ে ঘুরাফেরা করবো। আমার পিছু ছেড়ে দাও।
– আমি আপনার সাথে এসেছি, আপনার সাথেই যাবো, ঘুরাফেরা করবো। শুধু রুমে বসে থাকার জন্য আসিনি এখানে।
– যা ইচ্ছে করো, আমার সাথে যাবে না! না! না! এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছি সেটাই অনেক!
– ওকে, আমি গেলাম। আপনি রুম লক করে আসুন।
নাহিদা মাথায় ওড়না দিয়ে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেদীকে রুমে রেখেই বেরিয়ে গেলো। মেহেদী তার কাজকর্ম সেড়ে রুম লক করে বেরিয়ে এলো। সিড়ি দিয়ে নেমে আসতেই দেখলো নাহিদা নিচে দাড়িয়ে আছে। সে কিছু না বলে পা চালাতে লাগলো। তার সাথে তাল মিলিয়ে নাহিদাও হাটতে লাগলো। মেহেদী থেমে গিয়ে বললো,
– আমার সাথে কি?
– আপনার সাথে কোথায়! আমি তো আপনার পেছনে!
– আমার পেছনেই বা কি!
– বা রে! আমি আপনার বউ না! বউ তো স্বামীর পিছু পিছুই থাকবে!
– হেই চুপ! কিসের বউ টউ! বউ হলে বউয়ের মতো ঘরে চুপটি মেরে বসে থাকো। বাইরে এসেছো কেন! যাও! আর ক্ষুধা লাগলে এই না, দুইশো দিলাম। খেয়ে নিও।
– আপনি কেমন হাসব্যান্ড! বউয়ের সাথে কেউ এমন আচরণ করে! কোথায় বলবেন “চলো একসাথে ব্রেকফাস্ট করে ঘুরাঘুরি করি!” আর তা না করে আমাকে উল্টো পথে রেখে চলে যাচ্ছেন!
– এই মেয়ে! এতো কথা বলো কেন! তোমার মনে রঙ লাগলেও আমার মনে লাগেনি! আমার সাথে আসবে না ব্যাস! আমি আগেই নিষেধ করেছিলাম আসতে! আমাকে জ্বালানোর জন্য যত্তসব ফাউল চিন্তাভাবনা তোমার! আমার পিছু পিছু আরেক পা এগিয়ে এলে তোমার পা ভেঙে দিবো।
এমনি হিমেল দূর থেকেই বললো,
– মেহেদী, জেনিফা ইজ কামিং!